অলৌকিক স্পর্শ
শহরের কোলাহল, দূষণ আর যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে রনিতা আর অর্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও বসবাস করবে। রনিতা, একজন লেখিকা, তার সৃষ্টিশীলতার জন্য শান্তি আর নির্জনতা খুঁজছিল। তার মন চাইছিল এমন এক পরিবেশ যেখানে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা তার লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে, যেখানে প্রতিটি সকাল হবে নতুন গল্পের বীজ। অর্ক, পেশায় একজন স্থপতি, তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চেয়েছিল প্রকৃতির সান্নিধ্যে, এমন এক স্থানে যেখানে সে তার শিল্পকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে। অনেক খুঁজে অর্ক এক পুরনো জমিদার বাড়ি আবিষ্কার করল। বাড়িটি শহরের উপকণ্ঠে, সবুজে ঘেরা এক নির্জন স্থানে অবস্থিত। তার বিশালতা, তার প্রাচীন স্থাপত্য, আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নীরবতা তাদের মুগ্ধ করল। বাড়িটির নাম ছিল ‘ছায়ানীড়’, যদিও তার নামের মধ্যে যে শান্তি লুকিয়ে ছিল, তা কেবল দিনের আলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেন এক গভীর রহস্যের আবরণ তাকে ঢেকে রেখেছিল।
বাড়িটি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল, প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তার কোনো রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। তার দেওয়ালগুলো শ্যাওলায় ঢাকা পড়েছিল, যেন এক সবুজ চাদরে মোড়া, যা তার প্রাচীনত্বকে আরও প্রকট করে তুলছিল। জানালাগুলো ভাঙা, কাঁচগুলো খসে পড়েছে, আর তার ভেতর থেকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আসত, যা শুনলে মনে হত বাড়িটি যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। বাগানটি পরিণত হয়েছিল এক জংলি অরণ্যে, যেখানে আগাছা আর বুনো লতা-গুল্মের রাজত্ব, যেন প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে সবকিছু গ্রাস করে নিতে চাইছে। কিন্তু অর্ক তার স্থপতিসুলভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বাড়িটির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। সে বাড়িটির জীর্ণ দশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য আর আভিজাত্যকে চিনতে পেরেছিল, তার মনে হচ্ছিল এই বাড়িটি যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যা, যাকে জাগিয়ে তোলার অপেক্ষায় আছে। সে রনিতাকে বোঝাল, “এই বাড়িটাকে আমরা নতুন করে সাজাবো, রনিতা। এর প্রতিটি ইঁটে ইতিহাস লুকিয়ে আছে, প্রতিটি কোণায় যেন এক পুরনো গল্প লুকিয়ে আছে। এটা আমাদের স্বপ্নের বাড়ি হবে, আমাদের আশ্রয় হবে, যেখানে তুমি নিশ্চিন্তে লিখতে পারবে, আর আমি আমার শিল্পকর্ম নিয়ে কাজ করতে পারব। আমরা এখানে আমাদের নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলব।”
রনিতা প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিল। বাড়িটির বিশালতা আর তার চারপাশের নির্জনতা তাকে কিছুটা ভয় পাইয়েছিল। বিশেষ করে, যখন তারা প্রথমবার বাড়িটি দেখতে গিয়েছিল, তখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই তার গা ছমছম করে উঠেছিল। একটি অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি তার শরীর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, যেন কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, অথচ সেখানে কেউ ছিল না। তার মনে হয়েছিল যেন অদৃশ্য কোনো সত্তা তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু অর্কের চোখে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল, এক অদম্য উৎসাহ আর ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা। তার ভালোবাসার কাছে তার ভয় ফিকে হয়ে গেল। তারা বাড়িটি কিনে নিল, এক বিশাল অঙ্কের বিনিময়ে, যা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ছিল। অর্ক তার সমস্ত দক্ষতা আর ভালোবাসা দিয়ে বাড়িটির সংস্কার কাজ শুরু করল। সে তার দল নিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে কাজ করল।
সংস্কার কাজ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। পুরনো দেওয়ালগুলো নতুন রঙে সেজে উঠল, তার গায়ে নতুন করে প্লাস্টার করা হল, যেন বাড়িটি আবার নতুন করে শ্বাস নিতে শুরু করেছে, তার পুরনো ক্ষতগুলো সেরে উঠছে। ভাঙা জানালাগুলো মেরামত করা হল, তাতে নতুন কাঁচ বসানো হল, আর তার উপর লাগানো হল পুরনো দিনের নকশার পর্দা, যা সূর্যালোককে নরম করে ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে দিত। জংলি আগাছায় ভরা বাগানটি পরিণত হল এক সুন্দর ফুলে ভরা উদ্যানে, যেখানে রনিতা নিজের হাতে নানা রঙের ফুলগাছ লাগাল, যেন সে প্রকৃতির সাথে এক নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছে। পুরনো দিনের আসবাবপত্রগুলো মেরামত করে নতুন করে সাজানো হল, যা বাড়িটিকে এক ঐতিহ্যবাহী অথচ আধুনিক রূপ দিল, যেন অতীতের সাথে বর্তমানের এক সুন্দর মেলবন্ধন ঘটল।
অবশেষে, সংস্কার কাজ শেষ হল। প্রায় এক বছর লেগেছিল এই কাজ শেষ করতে, প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি কোণা যেন তাদের ভালোবাসা আর পরিশ্রমের সাক্ষী ছিল। এক ঝলমলে সকালে রনিতা আর অর্ক তাদের নতুন বাড়িতে প্রবেশ করল। তাদের চোখে ছিল আনন্দ আর তৃপ্তি, যেন তারা এক নতুন জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম কয়েকদিন সব স্বাভাবিক ছিল। তারা তাদের নতুন জীবন উপভোগ করছিল। সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে তাদের ঘুম ভাঙত, যা শহরের কোলাহলে তারা কোনোদিন শোনেনি। বিকেলে বাগানে বসে তারা চা পান করত আর বই পড়ত, সূর্য যখন অস্ত যেত, তখন আকাশ রাঙা হয়ে উঠত। রাতে তারাদের নিচে বসে তারা গল্প করত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত, তাদের মনে হচ্ছিল যেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতি। সবকিছুই যেন এক স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। বাড়িটি যেন তাদের আলিঙ্গন করে নিয়েছিল, তার প্রতিটি কোণায় যেন এক নতুন জীবনের স্পন্দন, এক অব্যক্ত শান্তি।
কিন্তু ধীরে ধীরে তারা অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকল। প্রথমত, রনিতা অনুভব করল এক অব্যক্ত গন্ধ, যা যেন পুরনো দিনের আতরের গন্ধের মতো। গন্ধটা ক্ষণিকের জন্য আসত, আবার মিলিয়ে যেত, যেন এক অদৃশ্য সত্তা তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে অর্ককে বলত, “অর্ক, তুমি কি কিছু গন্ধ পাচ্ছ? কেমন একটা মিষ্টি, কিন্তু পুরনো দিনের গন্ধ, যা আমি আগে কখনো পাইনি।” অর্ক শুঁকে দেখত, কিন্তু কিছুই পেত না। সে বলত, “হয়তো পুরনো কাঠের গন্ধ, বা কোনো ফুলের গন্ধ, যা তুমি লক্ষ্য করছ না। তোমার মন হয়তো বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।” রনিতা প্রথমে অর্কের কথা বিশ্বাস করত, কিন্তু গন্ধটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল, আর তার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি হতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, এই গন্ধের পেছনে কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে।
তারপর শুরু হল ফিসফিস শব্দ। রাতে যখন তারা ঘুমাতে যেত, তখন তাদের কানে আসত মৃদু ফিসফিসানি। মনে হত যেন কেউ তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, বা তাদের নাম ধরে ডাকল। রনিতা প্রথম দিকে ভয় পেলেও, অর্ক এগুলিকে তাদের মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিত। “হয়তো বাতাসের শব্দ,” সে বলত, “বা পুরনো বাড়ির কাঠ নড়াচড়ার শব্দ। পুরনো বাড়িতে এমন শব্দ হয়ই, বিশেষ করে রাতে।” কিন্তু রনিতা জানত, এটা শুধু বাতাসের শব্দ নয়। এই ফিসফিসানির মধ্যে এক অদ্ভুত সুর ছিল, যা তাকে অস্থির করে তুলত, যেন কেউ তার সাথে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু তার ভাষা সে বুঝতে পারছে না।
এক রাতে, যখন বাইরে ঝড় বইছিল, আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, রনিতা বাথরুমে গিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে আয়নার দিকে তাকাল, আর দেখল আয়নার প্রতিফলনে একটি আবছা অবয়ব, যেন একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখটি অস্পষ্ট, কিন্তু তার চোখ দুটো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঘুরে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। তার গা ছমছম করে উঠল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল, যেন তার বুক ফেটে যাবে। সে দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল এবং অর্ককে জড়িয়ে ধরল। অর্ক তাকে সান্ত্বনা দিল, “ভয় পেও না, রনিতা। এখানে কেউ নেই। সব তোমার মনের ভুল। ঝড়ের কারণে তোমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে।” কিন্তু রনিতা জানত, এটা মনের ভুল নয়। সে কিছু একটা দেখেছিল, যা তার মনকে নাড়া দিয়েছিল।
রনিতার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সে অনুভব করছিল, এই বাড়িতে কিছু একটা আছে, যা সাধারণ নয়। সে দিনের বেলাতেও একা থাকতে ভয় পেত। সে অর্ককে বলল, “অর্ক, আমার মনে হচ্ছে এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। আমি একা থাকতে পারছি না। আমি ভয় পাচ্ছি, অর্ক। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখছে, কেউ আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে।”
অর্ক প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, রনিতার ভয় দেখে সে চিন্তিত হল। রনিতা সাধারণত সাহসী মেয়ে, তার এমন ভয় পাওয়া অর্ককে অবাক করল। সে রনিতাকে সান্ত্বনা দিল, “ঠিক আছে, আমি তোমার সাথে থাকব। আমরা একসাথেই থাকব। আমরা এই রহস্যের সমাধান করব। আমরা এই বাড়ির ইতিহাস খুঁজে বের করব।”
একদিন সকালে, রনিতা যখন পুরনো দিনের জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল, তখন তার চোখ পড়ল একটি পুরনো দিনের আলmarিতে। আলমারিটি ছিল বিশাল, আর তার কাঠের কাজ ছিল অসাধারণ, তাতে খোদাই করা ছিল পুরনো দিনের নকশা। আলমারিটি সংস্কারের সময় তারা সরিয়েছিল, কিন্তু তার ভেতরের জিনিসপত্র গোছানো হয়নি। রনিতা আলমারিটি খুলল, আর দেখল তার ভেতরে কিছু পুরনো কাপড়চোপড় আর কিছু কাগজপত্র। তার মধ্যে একটি হলুদ হয়ে যাওয়া ডায়েরি তার চোখে পড়ল। ডায়েরিটি ছিল চামড়ার বাঁধাই করা, আর তার পাতাগুলো ছিল জীর্ণ, যেন শত বছরের পুরনো। ডায়েরির উপর একটি ছোট, শুকনো গোলাপ ফুল রাখা ছিল, যা স্পর্শ করতেই ঝরে গেল, যেন সময়ের সাথে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল।
রনিতা ডায়েরিটি হাতে নিল। তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল, যেন সে এক পুরনো ইতিহাসের অংশ হতে চলেছে। সে ডায়েরিটি খুলল, আর দেখল তার ভেতরে পুরনো দিনের বাংলা হরফে কিছু লেখা আছে। লেখাগুলো ছিল এক নারীর হাতের লেখা, খুব সুন্দর আর পরিপাটি, যেন প্রতিটি অক্ষর যত্ন করে লেখা হয়েছে, প্রতিটি শব্দে যেন এক গভীর আবেগ লুকিয়ে আছে। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা ছিল, ‘আমার নাম মাধবী। এই ডায়েরি আমার জীবনের শেষ আশ্রয়, আমার নীরব সঙ্গী। আমার বেদনা, আমার কষ্ট, আমার ভালোবাসা – সবকিছুই এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে।’
রনিতা ডায়েরিটি পড়তে শুরু করল। যত সে পড়তে লাগল, তত তার গা ছমছম করে উঠল। ডায়েরিতে লেখা ছিল এক রহস্যময়ী নারীর কথা, যিনি এই বাড়িতেই বসবাস করতেন। তার নাম মাধবী। মাধবী তার ভালোবাসার প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। তার স্বামী, যিনি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলে মনে হত, তিনি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অন্য এক নারীর জন্য। মাধবী তার স্বামীকে এতটাই ভালোবাসতেন যে এই প্রতারণা তিনি মেনে নিতে পারেননি। ডায়েরিতে তার বেদনা, তার কষ্ট, তার অসহায়তা – সবকিছুই বিস্তারিতভাবে লেখা ছিল। তার প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠছিল এক গভীর যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত আর্তনাদ।
ডায়েরির প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠছিল মাধবীর যন্ত্রণা। সে লিখেছিল, “আমার জীবন শূন্য হয়ে গেছে। আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার প্রিয়তম আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর বাঁচতে চাই না। এই বাড়ি, যা একসময় আমার ভালোবাসার আশ্রয় ছিল, এখন আমার কারাগার, আমার নিঃসঙ্গতার সাক্ষী।” ডায়েরির শেষ কয়েকটি পাতায় লেখা ছিল তার আত্মহত্যার কথা। মাধবী এই বাড়িতেই আত্মহত্যা করেছিলেন, তার ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করে, তার শেষ আশা ছিল তার প্রিয়তম ফিরে আসবে। আর তার আত্মা নাকি এখনও সেই বাড়িতে বিচরণ করে, তার ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। তার শেষ ইচ্ছা ছিল, তার গল্প যেন কেউ জানে, তার বেদনা যেন কেউ অনুভব করে, তার আত্মাকে যেন কেউ মুক্তি দেয়।
রনিতা ডায়েরিটি শেষ করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার গা ছমছম করছিল। সে বুঝতে পারল, এই বাড়িতে যে অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটছে, তার কারণ মাধবীর অতৃপ্ত আত্মা। সে দ্রুত অর্ককে ডাকল এবং ডায়েরিটি তাকে দেখাল। অর্ক ডায়েরিটি পড়ে অবাক হল। তার চোখে অবিশ্বাস। “এটা কি সত্যি?” সে ফিসফিস করে বলল। “এটা তো সিনেমার গল্প! এমনটা কি সত্যিই সম্ভব?”
“আমার মনে হয় হ্যাঁ,” রনিতা বলল, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, “এই বাড়িতে মাধবীর আত্মা আছে। সে আমাদের কিছু বলতে চাইছে, তার গল্পটা শেষ করতে চাইছে। সে মুক্তি চাইছে।”
অর্ক প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিন্তু ডায়েরির লেখা আর রনিতার অভিজ্ঞতা তাকে চিন্তিত করল। সে বুঝতে পারল, এই বাড়িটি কেবল একটি পুরনো বাড়ি নয়, এটি এক রহস্যময় ইতিহাসের সাক্ষী, এক গভীর বেদনার আশ্রয়। রনিতা আর অর্ক কি পারবে সেই অতৃপ্ত আত্মার রহস্য উন্মোচন করতে এবং তাকে শান্তি দিতে? নাকি তারাও সেই রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়বে? এই প্রশ্ন তাদের মনে এক গভীর উদ্বেগ তৈরি করল, যা তাদের নতুন জীবনের শান্তিকে বিঘ্নিত করছিল।
ডায়েরিটি পড়ার পর রনিতা আর অর্কের মনে এক নতুন ভয় বাসা বাঁধল, যা ধীরে ধীরে কৌতূহলে রূপান্তরিত হল। বাড়িটির প্রতিটি কোণায় যেন মাধবীর উপস্থিতি অনুভব করছিল তারা। রাতের ফিসফিসানি, অব্যক্ত গন্ধ – সবকিছুই এখন স্পষ্ট মনে হচ্ছিল। অর্ক, যে প্রথমে এসবকে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেও এখন মাধবীর অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করল। তার মনে হল, মাধবী যেন তাদের কাছে কিছু বলতে চাইছে, তার অসমাপ্ত গল্পটা শেষ করতে চাইছে। তারা যেন এক অদৃশ্য সুতোয় মাধবীর সাথে বাঁধা পড়েছিল, তাদের ভাগ্য যেন মাধবীর ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল।
তারা দুজনেই মাধবীর গল্প নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। মাধবী তার ডায়েরিতে তার স্বামীর নাম উল্লেখ করেননি, কেবল তাকে ‘প্রিয়তম’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তার প্রতারণার কারণও স্পষ্ট ছিল না। শুধু ছিল তার গভীর বেদনা আর আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। রনিতা, একজন লেখিকা হিসেবে, এই গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে চাইল। সে মাধবীর বেদনাকে অনুভব করতে চাইল, তার কষ্টকে বুঝতে চাইল। তার মনে হচ্ছিল, মাধবীর গল্প তার নিজের লেখার জন্য এক নতুন বিষয়বস্তু হতে পারে, কিন্তু তার আগে তাকে মাধবীর আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে।
রনিতা বলল, “আমাদের মাধবীর আত্মাকে শান্তি দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে? আমরা তো তার স্বামীর নামও জানি না, বা কেন সে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেটাও জানি না। আমাদের আরও তথ্য দরকার।”
অর্ক চিন্তিত মুখে বলল, “আমি জানি না, রনিতা। আমি এসব অলৌকিক বিষয়ে বিশ্বাস করি না, কিন্তু এই ডায়েরি আর আমাদের অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবাচ্ছে। আমাদের এই বাড়ির ইতিহাস আরও গভীরভাবে জানতে হবে।”
তারা গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষের সাথে কথা বলল, যারা জমিদার বাড়ির পুরনো গল্প জানত। গ্রামের প্রবীণরা ‘ছায়ানীড়’ বাড়িটির পুরনো গল্প জানত। তারা বলল, বাড়িটি একসময় ‘রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। রায়চৌধুরী জমিদাররা ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার, তাদের প্রতাপ ছিল অসীম, তাদের কথা ছিল গ্রামের আইন। মাধবী ছিলেন জমিদার বাড়ির পুত্রবধূ। তার স্বামী ছিলেন জমিদার পুত্র, নাম তার রঞ্জন রায়চৌধুরী। রঞ্জন ছিলেন সুদর্শন আর শিক্ষিত যুবক, তার সাথে মাধবীর প্রেম ছিল গভীর। তাদের প্রেম ছিল গ্রামের সবার মুখে মুখে, সবাই তাদের ভালোবাসাকে ঈর্ষা করত। তাদের দেখে মনে হত, তারা যেন স্বর্গের জুটি।
কিন্তু রঞ্জনের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল, নাম তার ললিতা। ললিতা ছিল রঞ্জনের প্রতি দুর্বল, তার মনে রঞ্জনকে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, যা তাকে হিংস্র করে তুলেছিল। সে রঞ্জনকে পাওয়ার জন্য মাধবীকে নানাভাবে উত্যক্ত করত, তাকে অপমান করত, আর তাদের সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টা করত। গ্রামের মানুষ বলত, ললিতা ছিল একজন কালো জাদুর সাধিকা। সে তার অশুভ শক্তি দিয়ে মানুষকে বশ করত। সে রঞ্জনকে বশ করার জন্য কালো জাদু প্রয়োগ করেছিল। রঞ্জন ধীরে ধীরে মাধবীকে ভুলে যেতে লাগল, আর ললিতার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল। তার আচরণে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছিল, যেন সে নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, যেন তার মনকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। মাধবী এসব দেখেও কিছু করতে পারছিল না। সে রঞ্জনকে বোঝানোর চেষ্টা করত, তার ভালোবাসা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত, কিন্তু রঞ্জন তার কথা শুনত না। তার মনে হত, রঞ্জন যেন অন্য কেউ হয়ে গেছে, তার ভালোবাসার মানুষটি যেন হারিয়ে গেছে, এক অশুভ শক্তির প্রভাবে।
মাধবী তার ডায়েরিতে এসব কথা স্পষ্ট করে লেখেননি, হয়তো ভয়ে বা লজ্জায়। তিনি শুধু তার বেদনা আর অসহায়তার কথা লিখেছিলেন, তার অসহ্য যন্ত্রণার কথা। কিন্তু গ্রামের মানুষের গল্প শুনে রনিতা আর অর্ক বুঝতে পারল, মাধবীর আত্মহত্যার পেছনে ললিতার কালো জাদুর হাত ছিল। এই সত্য তাদের মনে এক নতুন ভয় আর কৌতূহল তৈরি করল। তারা বুঝতে পারল, মাধবীর আত্মাকে মুক্তি দিতে হলে তাদের ললিতার জাদুর উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
এক রাতে, যখন তারা ঘুমাচ্ছিল, তখন তাদের ঘরের দরজা খুলে গেল। মৃদু চাঁদের আলোয় তারা দেখল, মাধবীর ছায়া তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়াটি ছিল আবছা, কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল স্পষ্ট, তার চোখে ছিল গভীর বেদনা আর এক অদ্ভুত আকুতি, যেন সে তাদের কাছে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর নেই। রনিতা ভয়ে অর্ককে জড়িয়ে ধরল। অর্কও ভয় পেয়েছিল, তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। সে জানত, তাদের ভয় পেলে চলবে না।
মাধবীর ছায়া তাদের বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। তার হাতটি যেন তাদের দিকে বাড়িয়ে দিল, যেন কিছু বলতে চাইছে। রনিতা ফিসফিস করে বলল, “মাধবী, আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন? আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই। অনুগ্রহ করে আমাদের পথ দেখান।”
ছায়াটি মৃদুভাবে মাথা নাড়ল। তার হাতটি যেন একটি নির্দিষ্ট দিকে ইঙ্গিত করল – তাদের শোবার ঘরের দেওয়ালের দিকে। তারপর ছায়াটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেন বাতাসের সাথে মিশে গেল, তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল।
রনিতা আর অর্ক ভয়ে কাঁপছিল। কিন্তু মাধবীর আকুতি তাদের মনে এক নতুন দৃঢ়তা এনে দিল। তারা বুঝতে পারল, মাধবী তাদের কাছে সাহায্য চাইছে। সে তাদের কাছে একটি গোপন রহস্য উন্মোচন করতে চাইছে, যা তার আত্মাকে মুক্তি দিতে পারে।
পরদিন সকালে, তারা শোবার ঘরের দেওয়ালটি পরীক্ষা করতে লাগল। দেওয়ালটি ছিল পুরনো, আর তার রঙ ছিল ধূসর। তারা দেওয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করল, হাত দিয়ে ঠুকে দেখল, কিন্তু কিছুই খুঁজে পেল না। অর্ক বলল, “হয়তো দেওয়ালের পেছনে কিছু লুকানো আছে, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো কোনো গোপন কুঠুরি।”
তারা দেওয়ালের একটি অংশে হাত দিল, আর অনুভব করল একটি ফাঁপা শব্দ। অর্ক দ্রুত একটি হাতুড়ি নিয়ে এল এবং দেওয়ালের সেই অংশটি ভাঙতে শুরু করল। প্রতিটি আঘাতের সাথে সাথে পুরনো প্লাস্টার খসে পড়তে লাগল, আর তার নিচে বেরিয়ে এল পুরনো ইঁট। দেওয়াল ভাঙতেই তারা দেখল, তার পেছনে একটি ছোট গোপন কুঠুরি। কুঠুরিটি ছিল অন্ধকার আর ধূলোয় ভরা, যেন বহু বছর ধরে কেউ তার ভেতরে প্রবেশ করেনি। তার ভেতরে একটি ছোট কাঠের বাক্স ছিল, যা শ্যাওলা আর মাকড়সার জালে ঢাকা পড়েছিল, যেন সময়ের সাথে তার অস্তিত্ব মিশে গেছে।
রনিতা বাক্সটি হাতে নিল। বাক্সটি ছিল জীর্ণ, আর তার তালাটি ছিল মরিচা ধরা। অর্ক একটি লোহার রড দিয়ে তালাটি ভাঙল। বাক্সটি খুলতেই তারা দেখল তার ভেতরে কিছু পুরনো চিঠি আর একটি ছোট মূর্তি। মূর্তিটি ছিল একটি নারীর, তার মুখটি ছিল বিকৃত, আর তার চোখ দুটো ছিল হিংস্র, যেন তার মধ্যে এক অশুভ শক্তি লুকিয়ে আছে, যা দেখলে গা ছমছম করে ওঠে। রনিতা মূর্তিটি দেখে চমকে উঠল। “এটা ললিতার মূর্তি!” সে ফিসফিস করে বলল, তার গলায় ভয় আর অবিশ্বাস।
চিঠিগুলো ছিল রঞ্জনের লেখা। চিঠিগুলো পড়ে রনিতা আর অর্ক অবাক হল। চিঠিগুলোতে রঞ্জন মাধবীকে তার ভালোবাসার কথা লিখেছিল, আর ললিতার কালো জাদুর কথা উল্লেখ করেছিল। রঞ্জন লিখেছিল, ললিতা তাকে জোর করে বশ করে রেখেছিল, আর তাকে মাধবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সে মাধবীকে ভালোবাসত, কিন্তু ললিতার জাদুর কারণে সে কিছু করতে পারছিল না। তার মন আর শরীর যেন তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না, সে যেন এক অদৃশ্য শক্তির দাস ছিল। সে মাধবীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, আর লিখেছিল, সে ললিতার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। সে মাধবীকে অনুরোধ করেছিল, তাকে ক্ষমা করতে, আর তার জন্য অপেক্ষা করতে।
চিঠিগুলোর শেষ অংশে রঞ্জন লিখেছিল, সে ললিতার জাদু ভাঙার জন্য একজন তান্ত্রিকের কাছে গিয়েছিল। তান্ত্রিক তাকে একটি মন্ত্র আর একটি তাবিজ দিয়েছিল, যা ললিতার জাদু ভাঙতে সাহায্য করবে। কিন্তু রঞ্জন সেই জাদু ভাঙার আগেই মারা গিয়েছিল, হয়তো ললিতার জাদুর প্রভাবে, বা অন্য কোনো কারণে। রঞ্জনের মৃত্যু ছিল এক রহস্য, যা গ্রামের মানুষের কাছেও অজানা ছিল। তার মৃত্যু ছিল আকস্মিক, যা মাধবীর জীবনকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল।
রনিতা আর অর্ক বুঝতে পারল, মাধবী তাদের কাছে এই চিঠিগুলো আর মূর্তিটি খুঁজে বের করার জন্য সাহায্য চেয়েছিল। মাধবী চেয়েছিল, তার স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ হোক, আর ললিতার কালো জাদুর প্রভাব চিরতরে শেষ হোক। এই চিঠিগুলো ছিল মাধবীর বেদনার সাক্ষী, আর ললিতার জাদুর প্রমাণ। তারা জানত, তাদের হাতে এখন এক বিশাল দায়িত্ব।
চিঠিগুলো আর মূর্তিটি পাওয়ার পর রনিতা আর অর্কের মনে এক নতুন দায়িত্ববোধ জন্মাল, যা তাদের ভয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পারল, মাধবীর আত্মাকে শান্তি দিতে হলে তাদের ললিতার কালো জাদুর প্রভাব শেষ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? ললিতা কি এখনও বেঁচে আছে? নাকি তার জাদু এখনও এই বাড়িতে প্রভাব ফেলছে? এই প্রশ্নগুলো তাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
তারা গ্রামের প্রবীণদের কাছে আবার গেল, এবার আরও বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য। তারা ললিতার কথা জিজ্ঞেস করল। প্রবীণরা বলল, ললিতা অনেক বছর আগেই মারা গেছে, তার মৃত্যু হয়েছিল এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে। কেউ কেউ বলত, তার জাদু তার উপরই ফিরে এসেছিল, তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। কিন্তু তার কালো জাদুর প্রভাব নাকি এখনও এই অঞ্চলে রয়ে গেছে, বিশেষ করে ‘ছায়ানীড়’ বাড়িতে। তারা বলল, ললিতা ছিল একজন শক্তিশালী সাধিকা, আর তার জাদু ছিল খুব শক্তিশালী, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি মৃত্যুর পরেও তার অশুভ শক্তি সক্রিয় থাকতে পারে।
অর্ক বলল, “আমাদের একজন তান্ত্রিকের সাহায্য নিতে হবে। যে এই জাদু ভাঙতে পারবে। একজন সত্যিকারের জ্ঞানী তান্ত্রিক, যিনি এই ধরনের অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে পারেন।”
গ্রামের প্রবীণরা একজন তান্ত্রিকের কথা বলল, যিনি গ্রামের বাইরে এক নির্জন আশ্রমে বসবাস করতেন। তার নাম ছিল মহাতান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ। তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী এবং শক্তিশালী তান্ত্রিক, যিনি কালো জাদু ভাঙতে পারতেন এবং আত্মাদের মুক্তি দিতে পারতেন। তার খ্যাতি ছিল দূর-দূরান্ত পর্যন্ত, মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত এবং ভয় পেত। রনিতা আর অর্ক তান্ত্রিকের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের মনে এক নতুন আশা জন্মাল।
তারা রঞ্জনের চিঠিগুলো আর ললিতার মূর্তিটি নিয়ে তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষের আশ্রমে গেল। আশ্রমটি ছিল ঘন জঙ্গলের মধ্যে, এক নির্জন স্থানে, যেখানে সূর্যের আলোও ঠিকমতো পৌঁছাত না। আশ্রমের পরিবেশ ছিল গম্ভীর আর রহস্যময়। তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি চিঠিগুলো পড়লেন আর মূর্তিটি পরীক্ষা করলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠল, যেন তিনি অতীতের গভীরে প্রবেশ করতে পারছেন। তিনি বললেন, “ললিতার জাদু এখনও এই বাড়িতে সক্রিয় আছে। মাধবীর আত্মা এই জাদুর কারণে শান্তি পাচ্ছে না। রঞ্জন চেষ্টা করেছিল জাদু ভাঙতে, কিন্তু সে সফল হয়নি। তার মৃত্যুও এই জাদুরই ফল। ললিতা তাকে বাঁচতে দেয়নি।”
তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ বললেন, “এই জাদু ভাঙতে হলে একটি বিশেষ পূজা করতে হবে। এই পূজাটি পূর্ণিমার রাতে করতে হবে, যখন চাঁদের আলো সবচেয়ে শক্তিশালী থাকে, যখন অশুভ শক্তি সবচেয়ে দুর্বল থাকে। আর এই পূজায় ললিতার মূর্তিটি ব্যবহার করতে হবে। এই মূর্তিটিই জাদুর মূল উৎস, একে ধ্বংস করতে হবে।”
তিনি তাদের একটি মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন, যা পূজার সময় পাঠ করতে হবে। তিনি বললেন, “এই মন্ত্রটি খুব শক্তিশালী। এটি ললিতার জাদুর প্রভাব শেষ করবে এবং মাধবীর আত্মাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু তোমাদের মনে কোনো ভয় বা দ্বিধা থাকলে চলবে না। তোমাদের বিশ্বাসই তোমাদের শক্তি, তোমাদের ভালোবাসা তোমাদের রক্ষা করবে।”
পূজার দিন ঘনিয়ে এল। রনিতা আর অর্ক তান্ত্রিকের নির্দেশ অনুসারে সব প্রস্তুতি নিল। তারা বাড়িটিকে পরিষ্কার করল, প্রতিটি কোণা থেকে ধূলো আর মাকড়সার জাল সরাল। পূজার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করল – পবিত্র জল, ফুল, ধূপ, প্রদীপ, চন্দন, আর কিছু বিশেষ ভেষজ। পূর্ণিমার রাতে, তারা মাধবীর সেই পুরনো আলমারির কাছে পূজা শুরু করল। তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ তাদের সাথে ছিলেন। চাঁদের আলোয় ঘরটি আলোকিত হয়ে উঠল, এক অদ্ভুত পবিত্রতা যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, যা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করছিল। তারা ললিতার মূর্তিটি পূজার স্থানে রাখল, তার চারপাশে কিছু পবিত্র ফুল আর ধূপকাঠি রাখল, যা থেকে এক মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছিল।
তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর আর শক্তিশালী, যেন তার প্রতিটি শব্দে এক অলৌকিক শক্তি নিহিত ছিল, যা অশুভ শক্তিকে কাঁপিয়ে তুলছিল। রনিতা আর অর্ক তার সাথে মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। তারা অনুভব করছিল এক অদ্ভুত শক্তি তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরের তাপমাত্রা কমে গেল, আর বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত কম্পন অনুভব করছিল তারা। তাদের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা।
হঠাৎ, ললিতার মূর্তিটি কাঁপতে শুরু করল। তার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করে উঠল, আর তার মুখটি আরও বিকৃত হয়ে গেল, যেন তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অশুভ আত্মা জেগে উঠেছে। মূর্তিটি থেকে এক কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল, যা ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, যেন এক অশুভ শক্তি তাদের গ্রাস করতে চাইছে, তাদের ভয় দেখাতে চাইছে। রনিতা আর অর্ক ভয় পেয়েছিল, তাদের শরীর কাঁপছিল, কিন্তু তারা মন্ত্র পাঠ করা বন্ধ করল না। তারা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল, তাদের বিশ্বাসই তাদের শক্তি যোগাচ্ছিল, তাদের ভালোবাসা তাদের রক্ষা করছিল।
কালো ধোঁয়া ধীরে ধীরে ঘন হতে লাগল, আর তার মধ্যে থেকে ললিতার আবছা অবয়ব ফুটে উঠল। তার মুখটি ছিল বিকৃত, তার চোখ দুটো ছিল হিংস্র, যেন সে তাদের দিকে তাকিয়ে ঘৃণা আর ক্রোধ প্রকাশ করছিল। সে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল, তার হাসি ছিল ভয়ংকর, যা তাদের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিল। সে যেন তাদের ভয় দেখাতে চাইছিল, তাদের মনোবল ভাঙতে চাইছিল, তাদের পূজাকে ব্যর্থ করতে চাইছিল।
কিন্তু রনিতা আর অর্ক ভয় পেল না। তারা মন্ত্র পাঠ করা চালিয়ে গেল। তাদের কণ্ঠস্বর আরও দৃঢ় হল। তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষও তার মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন, তার চোখে এক অদ্ভুত শক্তি আর দৃঢ়তা। তিনি তার হাতে একটি ত্রিশূল নিয়েছিলেন, যা দিয়ে তিনি অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করছিলেন, তার চারপাশে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করছিলেন।
ধীরে ধীরে, ললিতার অবয়বটি ম্লান হতে লাগল। কালো ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে লাগল, যেন তা বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে, তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মূর্তিটি থেকে এক অদ্ভুত শব্দ বের হল, যেন কিছু ভেঙে গেল, যেন এক অশুভ শক্তি চিরতরে শেষ হল। তারপর মূর্তিটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তার অশুভ শক্তি চিরতরে শেষ হল, তার প্রভাব বিলীন হয়ে গেল।
ললিতার জাদুর প্রভাব শেষ হল। ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। বাতাসের কম্পন থেমে গেল, আর ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এল। যেন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িটি মুক্তি পেল, তার উপর থেকে শত বছরের অভিশাপ দূর হল।
মুহূর্তেই, মাধবীর ছায়া আবার আবির্ভূত হল। এবার তার মুখটি ছিল শান্ত, তার চোখে ছিল এক পরম তৃপ্তি আর আনন্দ। তার মুখে ফুটে উঠল এক অমলিন হাসি, যা রনিতা আর অর্কের হৃদয়ে শান্তি এনে দিল। সে রনিতা আর অর্কের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তার হাতটি যেন তাদের দিকে বাড়িয়ে দিল, যেন তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। তারপর ছায়াটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বাতাসের সাথে, চিরতরে। মাধবী অবশেষে মুক্তি পেল, তার আত্মা অনন্ত শান্তিতে মিশে গেল।
রনিতা আর অর্ক স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তাদের চোখে জল। তারা অনুভব করল, মাধবীর আত্মা অবশেষে শান্তি পেল। তারা ললিতার কালো জাদুর প্রভাব শেষ করতে পেরেছে, আর মাধবীর ভালোবাসাকে মুক্তি দিতে পেরেছে। তাদের মনে এক অদ্ভুত শান্তি আর তৃপ্তি, যা তারা আগে কখনো অনুভব করেনি।
তান্ত্রিক রুদ্রাক্ষ তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “তোমরা সফল হয়েছ,” তিনি বললেন, তার চোখে এক গভীর প্রশান্তি, “মাধবীর আত্মা এখন শান্তিতে আছে। তার ভালোবাসা মুক্তি পেয়েছে। তোমরা এক মহান কাজ করেছ, যা তোমাদের জীবনকে নতুন অর্থ দেবে।”
পরদিন সকালে, রনিতা আর অর্ক অনুভব করল, বাড়িটি এখন সত্যিই ‘ছায়ানীড়’। তার মধ্যে আর কোনো ভয় ছিল না, ছিল শুধু শান্তি আর এক নতুন জীবনের স্পন্দন। সূর্যের আলোয় বাড়িটি ঝলমল করছিল, যেন সে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে, যেন তার পুরনো ক্ষতগুলো সেরে উঠেছে। তারা জানত, এই বাড়িটি এখন তাদের স্বপ্নের বাড়ি। মাধবীর গল্প তাদের জীবনে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে তা সময়, মৃত্যু, আর জাদুর বাঁধনকেও অতিক্রম করতে পারে।
তারা মাধবীর ডায়েরি আর রঞ্জনের চিঠিগুলো যত্ন করে রাখল। এইগুলো এখন তাদের জন্য কেবল পুরনো কাগজপত্র নয়, এটি এক প্রেমের গল্প, এক রহস্যের সমাধান, আর এক অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার স্মারক। তারা জানত, মাধবী তাদের জীবনে এক অলৌকিক স্পর্শ রেখে গেছে, যা তাদের চিরকাল মনে করিয়ে দেবে ভালোবাসার অনন্ত শক্তির কথা। তারা তাদের নতুন বাড়িতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল, আর তাদের বাড়িটি পরিণত হল এক ভালোবাসার নীড়ে, যেখানে আর কোনো অতৃপ্ত আত্মা ছিল না, ছিল শুধু শান্তি আর আনন্দ। রনিতা তার লেখায় মাধবীর গল্পকে অমর করে রাখল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মনে ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিল, আর অর্ক তার স্থাপত্যের মাধ্যমে এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় মাধবীর শান্তির গল্পকে ফুটিয়ে তুলল। তাদের জীবন এখন এক নতুন অর্থে পরিপূর্ণ, এক অলৌকিক স্পর্শের সাক্ষী।
~সমাপ্ত~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion