Episode 15593 words1 views

অন্ধকারের ছায়া ও ভালোবাসার আলো

অধ্যায় ১: অচেনা সুরের হাতছানি কলকাতার ব্যস্ততম গড়িয়াহাট মোড়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যেতেই নিয়ন আর হ্যালোজেনের কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করে উঠল চারপাশ। ফুটপাতের ওপর বসা অস্থায়ী দোকানগুলোয় ক্রেতাদের ভিড়, হকারদের হাঁকডাক আর গাড়ির অবিরাম হর্ন – সব মিলিয়ে এক পরিচিত কোলাহল। এই কোলাহলের মাঝেই নিজের ছোট্ট কফি শপ ‘ক্যাফে নস্টালজিয়া’-এর কাঁচের জানালার ধারে বসে ছিল রিয়া। হাতে গরম কফির মগ, আর দৃষ্টি বাইরে, যেখানে জীবন তার নিজস্ব ছন্দে বয়ে চলেছে। রিয়া, ছাব্বিশ বছর বয়সী এক স্বাধীনচেতা তরুণী। তার বাদামী চোখ দুটোয় স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাসের মিশেল। ছোটবেলা থেকেই কফি আর বইয়ের প্রতি তার এক অদ্ভুত টান। সেই টান থেকেই এই ক্যাফে তৈরি করা। এখানে শুধু কফি নয়, পাওয়া যায় পুরনো দিনের গানের সুর আর তাকে ঘিরে জমে ওঠা আড্ডা। আজ মনটা একটু অন্যরকম। গত সপ্তাহে তার জীবনে এক নতুন মানুষের আগমন ঘটেছে – অর্ণব। পেশায় স্থপতি, কিন্তু মননে এক শিল্পী। প্রথম দেখাতেই রিয়ার মনে হয়েছিল, এ যেন বহুদিনের চেনা কেউ। অর্ণবের গভীর চোখ, শান্ত হাসি আর কফির প্রতি তারও একইরকম ভালোবাসা, রিয়ার মন কেড়েছিল। মাত্র কয়েকটা দিনের আলাপ, অথচ মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে চেনে। “রিয়া, তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,” মৃদু হাসির সঙ্গে অর্ণবের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রিয়া চমকে তাকাল। কখন যে অর্ণব এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, সে টেরই পায়নি। “অর্ণব! তুমি কখন এলে? আমি তো খেয়ালই করিনি।” অর্ণব হাসল। “তোমার চোখ তো তখন অন্য জগতে ছিল। কী ভাবছিলে এত?” রিয়া একটু লজ্জা পেল। “কিছু না… এমনিই।” “এমনিই? এত গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলে, আর বলছ এমনিই?” অর্ণব রিয়ার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াল। “ঠান্ডা হয়ে গেছে সত্যিই। আরেক কাপ দেব?” “না, থাক। তুমি বসো।” অর্ণব রিয়ার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসল। “আজ কাজ কেমন চলল?” “ভালোই। তবে আজ একটু অন্যরকম লাগছে.” “কেন?” রিয়া অর্ণবের দিকে তাকাল। “জানি না। কেমন যেন একটা অস্থিরতা। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।” অর্ণব রিয়ার হাতটা আলতো করে ধরল। “চিন্তা করো না। আমি তো আছি।” অর্ণবের স্পর্শে রিয়ার অস্থিরতা কিছুটা কমল। এই মানুষটা যেন এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে আসে তার জীবনে। তারা দু’জন গল্পে মেতে উঠল। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বপ্ন, ভালো লাগা-মন্দ লাগা – সব কিছুই ভাগ করে নিচ্ছিল তারা। ক্যাফের মৃদু আলোয় তাদের হাসিমুখগুলো যেন আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। রাত তখন প্রায় দশটা। ক্যাফে বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে। অর্ণব রিয়াকে তার গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে এল। রিয়ার ফ্ল্যাটটা গড়িয়াহাটের কাছেই, একটা নিরিবিলি গলির ভেতরে। গাড়ি থেকে নেমে রিয়া অর্ণবকে বিদায় জানাতেই, হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল গলির শেষ মাথায়। একটা আবছা ছায়া যেন দ্রুত মিলিয়ে গেল অন্ধকার গলিপথে। “ওটা কী ছিল?” রিয়া ফিসফিস করে বলল। অর্ণব চোখ কুঁচকে তাকাল। “কিছু না। হয়তো কোনো বিড়াল বা কুকুর হবে।” “না, অর্ণব। মনে হলো যেন একজন মানুষ। খুব দ্রুত চলে গেল।” রিয়ার মনে আবার সেই অস্থিরতা ফিরে এল। “তুমি হয়তো ভুল দেখেছ। চলো, ভেতরে যাও। সাবধানে থেকো।” অর্ণব রিয়াকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। রিয়া ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। কিন্তু সেই আবছা ছায়াটা তার মন থেকে সরছিল না। কে ছিল ওটা? আর কেনই বা এত দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল? পরের দিন সকালে, রিয়া ক্যাফেতে এসে দেখল, ক্যাফের পেছনের দরজাটা সামান্য খোলা। সে তো রাতে তালা দিয়েই গিয়েছিল! তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ভেতরে ঢুকে দেখল, সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। কোনো কিছু চুরি হয়নি, বা ভাঙচুরও করা হয়নি। কিন্তু একটা অদ্ভুত জিনিস তার চোখে পড়ল। ক্যাশের ড্রয়ারের ওপর একটা ছোট কাগজের টুকরো পড়ে আছে। তাতে লাল কালিতে লেখা – “সাবধানে থেকো। তুমি বিপদে আছো।” রিয়ার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কে এটা লিখল? কেন লিখল? আর এই বার্তাটা কীসের ইঙ্গিত? তার মনে পড়ল গতকাল রাতের সেই আবছা ছায়াটার কথা। তাহলে কি ওটা কোনো বিড়াল বা কুকুর ছিল না? সে দ্রুত অর্ণবকে ফোন করল। “অর্ণব, তুমি এক্ষুনি ক্যাফেতে আসতে পারবে? একটা সমস্যা হয়েছে।” অর্ণব মিনিট পনেরোর মধ্যেই চলে এল। রিয়ার বিবর্ণ মুখ আর হাতে ধরা চিরকুট দেখে সে চিন্তিত হয়ে পড়ল। রিয়া তাকে সব খুলে বলল। অর্ণব চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখল। “এটা তো সাধারণ কাগজ। কোনো হাতের ছাপও নেই মনে হচ্ছে। আর লেখাটাও খুব সাধারণ.” “কিন্তু এর মানে কী? কে আমাকে হুমকি দিচ্ছে?” রিয়ার চোখে ভয়। “শান্ত হও রিয়া। আমরা এর একটা কিনারা করব।” অর্ণব রিয়াকে জড়িয়ে ধরল। “পুলিশকে জানাবে?” রিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “জানি না। যদি এটা নিছকই কোনো দুষ্টুমি হয়? কিন্তু আমার মন বলছে, এটা সাধারণ কিছু নয়।” “ঠিক আছে। আপাতত আমরা নিজেরাই একটু খোঁজখবর নিই। যদি কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখি, তাহলে পুলিশকে জানাব।” সেদিন সারাদিন রিয়া আর অর্ণব ক্যাফেতে নজর রাখল। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। বিকেলে অর্ণব রিয়াকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে গেল। ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করল। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। রাতে, রিয়া যখন ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, তখন তার ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। রিয়া ইতস্তত করে ফোন ধরল। ওপাশ থেকে একটা ভারী, পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “তুমি ভুল মানুষের সাথে মিশছো, রিয়া। তোমার জীবন বিপদে পড়তে পারে।” রিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। “কে বলছেন? কী চান আপনি?” “আমি যা বলছি, তা মন দিয়ে শোনো। অর্ণবকে ছেড়ে দাও। ওর সাথে তোমার থাকা ঠিক হবে না.” “কিন্তু কেন? অর্ণব কী করেছে?” “সেটা জানার দরকার নেই তোমার। শুধু মনে রেখো, ওর ছায়া তোমার ওপর পড়লে, তোমার জীবনও অন্ধকারে ডুবে যাবে।” ফোনটা কেটে গেল। রিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। অর্ণবকে ছেড়ে দিতে হবে? কিন্তু কেন? অর্ণব কি কোনো বিপদে জড়িয়ে আছে, যার ছায়া তার ওপরও পড়ছে? নাকি কেউ তাদের সম্পর্ক ভাঙতে চাইছে? এই রহস্যময় ফোন কল তার মনে নতুন করে ভয়ের সঞ্চার করল। ভালোবাসার এই নতুন অধ্যায়ে হঠাৎ করেই যেন এক অচেনা, অন্ধকার ছায়া নেমে এসেছে। রিয়া কি পারবে এই রহস্যের জট খুলতে? অর্ণবের অতীত কি সত্যিই এত অন্ধকারাচ্ছন্ন?   অধ্যায় ২: সন্দেহের জাল ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। রিয়ার চোখে ঘুম নেই। রাতের সেই রহস্যময় ফোন কলটা তার মাথার ভেতর অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে। “অর্ণবকে ছেড়ে দাও… ওর ছায়া তোমার ওপর পড়লে, তোমার জীবনও অন্ধকারে ডুবে যাবে।” কথাগুলো যেন কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রিয়া বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো। তার ভালোবাসার শুরুতেই এমন এক অন্ধকার কেন নেমে এল? অর্ণব কি সত্যিই এমন কোনো বিপদে জড়িয়ে আছে যা তার জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে? সকাল হতেই রিয়া অর্ণবকে ফোন করল। তার কণ্ঠস্বর শুনেই অর্ণব বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। “রিয়া, কী হয়েছে? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?” রিয়া রাতের ঘটনাটা অর্ণবকে খুলে বলল। অর্ণব সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার নীরবতা রিয়ার মনে আরও বেশি ভয় ধরিয়ে দিল। “অর্ণব, তুমি কিছু বলছো না কেন? কে হতে পারে এই লোকটা? আর কেনই বা তোমাকে নিয়ে এমন কথা বলছে?” রিয়ার অস্থিরতা বাড়ছিল। অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “রিয়া, আমি জানি না কে এটা করছে। কিন্তু আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমার অতীতে কিছু জটিলতা ছিল, কিন্তু সেগুলো এখন অতীত। আমি কখনোই চাই না তার ছায়া তোমার ওপর পড়ুক।” “জটিলতা? কীসের জটিলতা, অর্ণব? তুমি আমাকে খুলে বলো। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, কিন্তু এই অন্ধকারে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।” রিয়ার কণ্ঠে অভিমান আর অসহায়তা। অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে রিয়া। আজ বিকেলে তুমি ক্যাফেতে এসো। আমরা বিস্তারিত কথা বলব। আমি তোমাকে সব খুলে বলব।” অর্ণবের কথা শুনে রিয়ার মনে কিছুটা স্বস্তি এল। অন্তত অর্ণব কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে না। কিন্তু একই সাথে একটা অজানা ভয়ও তার মনকে আঁকড়ে ধরল। অর্ণবের অতীত কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন? বিকেলবেলা। ক্যাফে নস্টালজিয়াতে আজ অন্যদিনের মতো ভিড় নেই। রিয়া আর অর্ণব একটা কোণার টেবিলে মুখোমুখি বসল। রিয়ার চোখে উদ্বেগ, অর্ণবের মুখে এক অদ্ভুত কাঠিন্য। “রিয়া,” অর্ণব শুরু করল, “আমি তোমাকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আমি যখন স্থপতি হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন একটা বড় প্রজেক্টে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেটা ছিল একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির প্রজেক্ট। সেই কোম্পানির মালিক ছিল একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার নাম সুরেশ রায়। তিনি একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং একই সাথে বিতর্কিত মানুষ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনেক অবৈধ কার্যকলাপের অভিযোগ ছিল।” রিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। “আমি জানতাম না যে সুরেশ রায়ের ব্যবসা কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমি শুধু আমার কাজটা মন দিয়ে করতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, এই প্রজেক্টের পেছনে অনেক অবৈধ লেনদেন এবং জালিয়াতি চলছে। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সুরেশ রায় আমাকে হুমকি দেন। তিনি আমার পরিবারকে নিয়েও হুমকি দিয়েছিলেন।” অর্ণবের চোখে এক পুরনো যন্ত্রণার ছাপ। “তারপর কী হলো?” রিয়া ফিসফিস করে জানতে চাইল। “আমি সেই প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু সুরেশ রায় আমাকে সহজে ছাড়তে চাননি। তিনি আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। আমি কোনোমতে সেই জাল থেকে বেরিয়ে আসি, কিন্তু তারপর থেকেই আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হয়। আমি আমার শহর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি, নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য।” “তার মানে এই লোকটা সুরেশ রায়?” রিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইল। “আমি নিশ্চিত নই। সুরেশ রায় অনেক বছর ধরে নিখোঁজ। অনেকে মনে করে সে মারা গেছে, আবার অনেকে ভাবে সে আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু যদি সে বেঁচে থাকে, তাহলে এই হুমকি তার কাছ থেকেই আসতে পারে।” অর্ণব বলল। রিয়া অর্ণবের হাত ধরল। “তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?” “আমি চেয়েছিলাম তোমাকে এই সব অন্ধকার থেকে দূরে রাখতে। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, রিয়া। আমি চাইনি আমার অতীতের ছায়া তোমার জীবনে পড়ুক।” অর্ণবের কণ্ঠে অনুশোচনা। “কিন্তু এখন তো সেই ছায়া পড়েছে, অর্ণব। এখন আমরা কী করব?” রিয়ার চোখে জল। “আমরা এর মোকাবিলা করব। আমি তোমাকে একা ছাড়ব না।” অর্ণব দৃঢ় কণ্ঠে বলল। তারা দু’জন যখন কথা বলছিল, তখন ক্যাফের বাইরে থেকে একজন লোক তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখটা একটা কালো স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। সে দ্রুত একটা ছবি তুলল এবং অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পরের দিন সকালে, রিয়া তার ক্যাফেতে এসে দেখল, ক্যাফের দেয়ালে একটা ছবি টাঙানো। সেটা রিয়া আর অর্ণবের গতকালের ক্যাফের ভেতরের ছবি। ছবির নিচে লাল কালিতে লেখা – “ভালোবাসা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। এবার এর ফল ভোগ করো।” রিয়া ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। এই লোকটা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। তাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোও তার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। এটা নিছকই কোনো হুমকি নয়, এটা যেন এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ঙ্কর খেলা। রিয়া বুঝতে পারল, এইবার তাদের পুলিশকে জানানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু পুলিশ কি তাদের বিশ্বাস করবে? আর এই রহস্যময় শত্রুকে কি তারা ধরতে পারবে? অর্ণবের অতীতের সেই অন্ধকার কি সত্যিই তাদের বর্তমানকে গ্রাস করতে চলেছে?   অধ্যায় ৩: পুলিশের দ্বারস্থ ক্যাফের দেওয়ালে টাঙানো সেই ছবিটা দেখে রিয়ার মাথা ঘুরছিল। অর্ণব তাকে ধরে ফেলল। “রিয়া, তুমি ঠিক আছো?” “ঠিক নেই, অর্ণব। একদম ঠিক নেই। এই লোকটা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখছে। এটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমাদের পুলিশে যেতেই হবে।” রিয়ার কণ্ঠে দৃঢ়তা। অর্ণব মাথা নাড়ল। “ঠিক আছে। চলো, দেরি না করে এখনই যাই।” তারা দু’জন নিকটস্থ থানায় পৌঁছাল। ডিউটি অফিসার তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। রিয়া একে একে সব ঘটনা খুলে বলল – ক্যাশের ড্রয়ারে পাওয়া চিরকুট, রাতের ফোন কল, অর্ণবের অতীতের কথা, এবং সবশেষে ক্যাফের দেওয়ালে টাঙানো ছবি। অর্ণব তার সুরেশ রায়ের সাথে তার অতীত সম্পর্কের কথা বিস্তারিতভাবে জানাল। অফিসার সব শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, “দেখুন, আপনাদের অভিযোগ আমরা শুনলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে তেমন কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। চিরকুটে হাতের ছাপ নেই, ফোন নম্বরটা অচেনা, আর ছবিটা কে টাঙিয়েছে তারও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। সুরেশ রায় নিখোঁজ, তার কোনো হদিস নেই।” রিয়া হতাশ হয়ে বলল, “কিন্তু স্যার, আমরা তো আতঙ্কে আছি। এই লোকটা আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনও নিরাপদ নয়।” “আমরা বিষয়টা নজরে রাখছি,” অফিসার বললেন। “আপনারা যদি কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখেন, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবেন। আমরা আপনাদের সুরক্ষার জন্য টহল বাড়াব। তবে এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।” তারা হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল। রিয়ার মন ভেঙে গেল। “তার মানে আমাদের নিজেদেরই নিজেদের রক্ষা করতে হবে, অর্ণব?” অর্ণব রিয়ার হাত শক্ত করে ধরল। “আমরা পারবো, রিয়া। আমরা একা নই। আমি তোমার পাশে আছি।” অর্ণবের কথাগুলো রিয়ার মনে কিছুটা সাহস জোগাল। তারা ক্যাফেতে ফিরে এল। অর্ণব ক্যাফের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিল। সে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর ব্যবস্থা করল এবং ক্যাফের পেছনের দরজায় অতিরিক্ত তালা লাগাল। সন্ধ্যা হয়ে এল। রিয়া আর অর্ণব ক্যাফে বন্ধ করে রিয়ার ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দিল। অর্ণব রিয়াকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে যাবে। গলির মুখে এসে তারা দেখল, একটা কালো রঙের গাড়ি তাদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা দেখে অর্ণবের চোখ কুঁচকে গেল। “এই গাড়িটা তো এখানে থাকার কথা নয়,” অর্ণব ফিসফিস করে বলল। তারা সাবধানে এগিয়ে গেল। গাড়ির ভেতরে কেউ নেই। অর্ণব গাড়ির নম্বর প্লেটটা দেখতে গেল। কিন্তু নম্বর প্লেটটা কাদায় ঢাকা। হঠাৎ, গাড়ির পেছনের সিট থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। তার হাতে একটা ছুরি ঝলসে উঠল। লোকটার মুখ একটা কালো মুখোশে ঢাকা। “অর্ণব!” রিয়া চিৎকার করে উঠল। অর্ণব এক মুহূর্ত দেরি না করে রিয়াকে পেছনে ঠেলে দিল এবং লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো ধস্তাধস্তি। লোকটা অর্ণবকে ছুরি মারার চেষ্টা করছিল, আর অর্ণব নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। রিয়া ভয়ে জমে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন তার চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে যাবে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অর্ণব লোকটার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিতে সক্ষম হলো। লোকটা বুঝতে পারল যে সে ধরা পড়ে যাবে। সে দ্রুত গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল এবং তীব্র গতিতে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। রিয়া ছুটে এসে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরল। “তুমি ঠিক আছো, অর্ণব? তোমার কোথাও লাগেনি তো?” অর্ণবের হাতে সামান্য ছড়ে গিয়েছিল। “আমি ঠিক আছি, রিয়া। চিন্তা করো না।” কিন্তু তাদের দু’জনেরই বুক ধড়ফড় করছিল। এই হামলাটা ছিল আগের সব হুমকির চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত এবং ভয়ঙ্কর। এটা প্রমাণ করে দিল যে তাদের শত্রু শুধু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হবে না, সে তাদের ক্ষতি করতেও প্রস্তুত। ফ্ল্যাটে ঢুকে রিয়া অর্ণবের হাতের ক্ষতটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিল। তাদের চোখাচোখি হলো। এই মুহূর্তে তাদের সম্পর্কটা যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। ভয়ের মধ্যেও তাদের ভালোবাসা যেন আরও দৃঢ় হয়েছে। “অর্ণব, আমি তোমাকে হারাতে চাই না,” রিয়া ফিসফিস করে বলল। অর্ণব রিয়ার কপালে আলতো করে চুমু খেল। “আমিও তোমাকে হারাতে চাই না, রিয়া। আমরা এই বিপদ একসঙ্গে মোকাবিলা করব।” কিন্তু তাদের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – কে এই লোকটা? কেন সে তাদের ওপর হামলা করল? সুরেশ রায় কি সত্যিই ফিরে এসেছে? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? পুলিশ তাদের সাহায্য করতে পারছে না, তাই তাদের নিজেদেরই এই রহস্যের জট খুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তাদের সামনে তখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, যেখানে ভালোবাসা আর বিপদ হাত ধরাধরি করে চলছে।   অধ্যায় ৪: এক নতুন সূত্র পরের দিন সকাল। রিয়া এবং অর্ণব দু’জনেই ক্যাফেতে। গত রাতের হামলার রেশ এখনো তাদের মনে টাটকা। ক্যাফের সিসিটিভি ফুটেজগুলো দেখতে বসেছে অর্ণব। আশা, যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়। রিয়া কফি বানাচ্ছে, কিন্তু তার মন অস্থির। “কিছু পেলে, অর্ণব?” রিয়া জানতে চাইল। অর্ণব মাথা নাড়ল। “না, রিয়া। লোকটা খুব চালাক। তার মুখ ঢাকা ছিল, আর গাড়ির নম্বর প্লেটও কাদায় ঢাকা। ক্যামেরায় কিছুই স্পষ্ট আসেনি।” রিয়া হতাশ হলো। “তাহলে আমরা কী করব? এভাবে আর কতদিন?” অর্ণব রিয়ার হাত ধরল। “আমরা হাল ছাড়ব না। সুরেশ রায়ের ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করতে হবে।” “কিন্তু কীভাবে? পুলিশ তো সাহায্য করছে না।” “আমার একজন পুরনো বন্ধু আছে। সে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তার নাম বিক্রম। সে হয়তো সাহায্য করতে পারবে।” অর্ণব বলল। রিয়ার চোখে আশার ঝলক। “তাহলে আর দেরি কেন? এখনি ফোন করো।” অর্ণব বিক্রমকে ফোন করল। বিক্রম সব শুনে তাদের সাথে দেখা করতে রাজি হলো। বিকেলে তারা এক নির্জন রেস্তোরাঁয় বিক্রমের সাথে দেখা করল। বিক্রম, চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের একজন লম্বা, সুঠাম দেহের মানুষ। তার চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর মুখে এক রহস্যময় হাসি। রিয়া আর অর্ণব তাকে সব ঘটনা খুলে বলল। বিক্রম মনোযোগ দিয়ে শুনল, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করল। বিশেষ করে সুরেশ রায়ের অতীত সম্পর্কে সে বেশ আগ্রহী ছিল। “সুরেশ রায়,” বিক্রম বলল, “সে ছিল একজন ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। তার অনেক শত্রু ছিল, এবং তার নিখোঁজ হওয়াটা অনেকের কাছেই রহস্যজনক ছিল। কিন্তু সে যদি সত্যিই ফিরে এসে থাকে, তাহলে এর পেছনে কোনো বড় উদ্দেশ্য আছে।” “আমাদের কী করা উচিত?” রিয়া জানতে চাইল। “প্রথমত, আপনাদের দু’জনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সুরেশ রায়ের অতীত এবং তার বর্তমান গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। আমি এই কাজটা শুরু করব। তবে এর জন্য কিছু সময় লাগবে।” বিক্রম বলল। “আমরা আপনাকে সবরকম সাহায্য করব,” অর্ণব বলল। বিক্রম তাদের আশ্বস্ত করে বিদায় নিল। রিয়া আর অর্ণব কিছুটা স্বস্তি পেল। অন্তত একজন তাদের কথা বিশ্বাস করছে এবং সাহায্য করতে প্রস্তুত। পরের কয়েকটা দিন রিয়া আর অর্ণবের জীবনে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন চলল। একদিকে তাদের ভালোবাসা গভীর হচ্ছিল, অন্যদিকে ভয়ের ছায়া তাদের পিছু ছাড়ছিল না। অর্ণব ক্যাফেতে রিয়ার সাথে বেশি সময় কাটাতে শুরু করল, যাতে সে একা না থাকে। তারা একসঙ্গে কাজ করত, হাসত, গল্প করত। এই কঠিন সময়ে তাদের একে অপরের প্রতি নির্ভরতা যেন আরও বেড়ে গেল। একদিন সকালে, অর্ণব ক্যাফেতে আসার সময় দেখল, তার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে একটা গোলাপ ফুল রাখা। ফুলটা দেখে তার মনটা ভরে গেল। সে ভাবল রিয়া রেখেছে। কিন্তু ফুলের সাথে একটা ছোট চিরকুট ছিল। তাতে লেখা – “আমার ভালোবাসা তোমার জন্য। কিন্তু তুমি কি জানো, তোমার ভালোবাসার মানুষটা কত বড় মিথ্যুক?” অর্ণবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রিয়া তাকে মিথ্যুক বলছে না। তাহলে কে এটা রাখল? আর কেনই বা রিয়াকে মিথ্যুক বলছে? তার মনে পড়ল সুরেশ রায়ের কথা। এই লোকটা কি রিয়াকে তার বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চাইছে? অর্ণব দ্রুত ক্যাফেতে ঢুকে রিয়াকে চিরকুটটা দেখাল। রিয়া চিরকুটটা দেখে অবাক হয়ে গেল। “আমি তো এটা রাখিনি, অর্ণব। আমি কেন তোমাকে মিথ্যুক বলব?” “আমি জানি রিয়া, তুমি এটা রাখোনি। এটা সেই লোকটার কাজ। সে আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে।” অর্ণব বলল। রিয়া অর্ণবের হাত ধরল। “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, অর্ণব। এই ধরনের নোংরা খেলা খেলে সে আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে পারবে না।” তাদের চোখে ভালোবাসার দৃঢ়তা। এই বিপদ তাদের সম্পর্ককে দুর্বল করার বদলে আরও শক্তিশালী করে তুলছিল। তারা বুঝতে পারছিল, তাদের শত্রুর উদ্দেশ্য শুধু ভয় দেখানো নয়, তাদের সম্পর্কটাকেও ধ্বংস করা। বিক্রমের কাছ থেকে ফোন এল। “আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি, অর্ণব। সুরেশ রায় নিখোঁজ হওয়ার আগে তার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। তার নাম ছিল শশাঙ্ক। শশাঙ্কও সুরেশ রায়ের সাথে একই সময়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে, এই শশাঙ্কই হয়তো আপনাদের ওপর নজর রাখছে।” “শশাঙ্ক?” অর্ণব অবাক হলো। “আমি এই নামটা আগে শুনিনি।” “সে সুরেশ রায়ের সবরকম অবৈধ কাজের সঙ্গী ছিল। তাকে খুঁজে বের করতে পারলে হয়তো সুরেশ রায়ের ব্যাপারেও কিছু জানা যাবে।” বিক্রম বলল। “কিন্তু তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?” রিয়া জানতে চাইল। “সে এখন কোথায় আছে, তা বলা মুশকিল। তবে আমার কাছে তার পুরনো কিছু ঠিকানা আছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি।” বিক্রম জানাল। ফোনটা রেখে রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল। শশাঙ্ক! এই নতুন নামটা তাদের মনে নতুন করে রহস্যের জাল বুনল। কে এই শশাঙ্ক? সে কি সুরেশ রায়ের হয়ে কাজ করছে, নাকি তার নিজের কোনো উদ্দেশ্য আছে? এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে গিয়ে তারা কি আরও বড় বিপদে পড়বে? তাদের ভালোবাসার শক্তি কি এই অন্ধকারকে জয় করতে পারবে?   অধ্যায় ৫: অতীতের ছায়া এবং নতুন মোড় বিক্রমের কাছ থেকে শশাঙ্কের নামটা শোনার পর রিয়া আর অর্ণবের মনে এক নতুন চিন্তার উদয় হলো। শশাঙ্ক, যে সুরেশ রায়ের ডান হাত ছিল, সে যদি সত্যিই ফিরে এসে থাকে, তাহলে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় কারণ আছে। অর্ণবের মনে পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় করতে শুরু করল। সুরেশ রায়ের সাথে তার প্রথম দেখা, প্রজেক্টের জটিলতা, আর সেই অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা। সেই রাতে, অর্ণব রিয়াকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে ফিরল। ক্যাফে বন্ধ করে তারা দু’জন মিলে রাতের খাবার তৈরি করল। তাদের মধ্যে এখন এক অদ্ভুত নীরবতা। ভয়ের মধ্যেও তাদের ভালোবাসা যেন এক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে আছে। “অর্ণব,” রিয়া মৃদুস্বরে বলল, “তোমার কি মনে হয়, শশাঙ্কই সবকিছুর পেছনে আছে?” অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “জানি না, রিয়া। তবে যদি সে সুরেশ রায়ের জন্য কাজ করে থাকে, তাহলে সে খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। সুরেশ রায় খুব কম মানুষকে বিশ্বাস করত, আর শশাঙ্ক ছিল তাদের মধ্যে একজন।” রিয়া অর্ণবের হাত ধরল। “আমি তোমার পাশে আছি, অর্ণব। আমরা একসঙ্গে এর মোকাবিলা করব।” অর্ণব রিয়ার দিকে তাকাল। তার চোখে ভালোবাসার গভীরতা। এই মেয়েটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই কঠিন সময়ে রিয়া তার পাশে না থাকলে হয়তো সে ভেঙে পড়ত। অর্ণব রিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিল। তাদের ঠোঁটে ঠোঁট মিশে গেল। এই মুহূর্তটা ছিল তাদের কাছে এক আশ্রয়, যেখানে বাইরের সব বিপদ সাময়িকভাবে মিলিয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে, বিক্রমের ফোন এল। “অর্ণব, আমি শশাঙ্কের পুরনো ঠিকানাগুলোর একটাতে খোঁজ নিয়েছিলাম। সেখানে একজন বৃদ্ধ দারোয়ান আছে, যে শশাঙ্ককে চিনত। সে আমাকে একটা অদ্ভুত তথ্য দিয়েছে।” “কী তথ্য?” অর্ণব উৎসুক হয়ে জানতে চাইল। “শশাঙ্ক নাকি সুরেশ রায়ের নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই খুব অস্থির ছিল। সে নাকি প্রায়ই বলত, সুরেশ রায় তাকে কোনো বড় বিপদে ফেলবে। আর নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে শশাঙ্ক নাকি তার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিল এবং তার পরিবারকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।” অর্ণব অবাক হলো। “তার মানে শশাঙ্ক সুরেশ রায়ের বিরুদ্ধে ছিল?” “মনে তো হচ্ছে তাই। সে হয়তো সুরেশ রায়ের কাছ থেকে পালিয়েছিল। কিন্তু এখন সে কেন ফিরে এল, আর কেনই বা আপনাদের ওপর নজর রাখছে, সেটাই রহস্য।” বিক্রম বলল। “তাহলে কি সুরেশ রায় বেঁচে আছে?” রিয়া জানতে চাইল। “সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যদি শশাঙ্ক সুরেশ রায়ের ভয়ে পালিয়ে থাকে, তাহলে এখন সে কেন এত সক্রিয়? এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।” বিক্রম বলল। “আমি শশাঙ্কের পুরনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ট্র্যাক করার চেষ্টা করছি। হয়তো সেখান থেকে কোনো সূত্র পাওয়া যাবে।” বিক্রমের কথা শুনে রিয়া আর অর্ণব দু’জনেই চিন্তিত হয়ে পড়ল। শশাঙ্ক যদি সুরেশ রায়ের শত্রু হয়, তাহলে তাদের ওপর হামলা করার কারণ কী? নাকি শশাঙ্কই সুরেশ রায়ের ছদ্মবেশে কাজ করছে? ক্যাফেতে সেদিন একজন নতুন কাস্টমার এল। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। তিনি কিছুক্ষণ ক্যাফেতে বসে কফি খেলেন, আর মাঝে মাঝে রিয়া আর অর্ণবের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন। রিয়া প্রথমে তেমন গুরুত্ব দিল না, কিন্তু লোকটার চাহনিটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। ভদ্রলোক কফি শেষ করে বিল মেটাতে এলেন। “আপনারা দু’জন খুব ভালো কফি বানান,” তিনি বললেন। “তবে এই ক্যাফেতে একটা জিনিস নেই।” রিয়া হাসল। “কী নেই, স্যার?” “নিরাপত্তা।” ভদ্রলোক একটা রহস্যময় হাসি হেসে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলেন। রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল। লোকটার কথাগুলো তাদের মনে নতুন করে ভয় ধরিয়ে দিল। এটা কি শুধুই একটা মন্তব্য, নাকি কোনো নতুন হুমকি? সেদিন রাতে, রিয়া যখন ক্যাফে বন্ধ করে অর্ণবের সাথে বাড়ি ফিরছিল, তখন তাদের ফ্ল্যাটের সামনে একটা রহস্যময় বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটা কালো কাপড়ে মোড়া। “এটা কী?” রিয়া ভয়ে ভয়ে বলল। অর্ণব সাবধানে বাক্সটা খুলল। ভেতরে একটা পুরনো ডায়েরি। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা – “শশাঙ্ক রায়।” রিয়া আর অর্ণব অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। এটা শশাঙ্কের ডায়েরি! কিন্তু কে এটা এখানে রাখল? আর কেনই বা রাখল? অর্ণব ডায়েরির পাতা ওল্টাতে শুরু করল। ডায়েরিটা পুরনো, অনেক পাতায় ধুলো জমে আছে। কিছু পাতা ছেঁড়া, কিছু লেখা অস্পষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু লেখা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। প্রথম কয়েকটি পাতায় শশাঙ্কের ব্যক্তিগত জীবনের কথা লেখা। তার পরিবার, তার স্বপ্ন। তারপর ধীরে ধীরে সুরেশ রায়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। সুরেশ রায়ের অবৈধ কার্যকলাপ, তার ক্ষমতা, আর শশাঙ্কের ভয়। একটা পাতায় শশাঙ্ক লিখেছে – “সুরেশ রায় আমাকে দিয়ে এমন কিছু কাজ করাচ্ছে, যা আমি করতে চাই না। আমি ওর জাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কিন্তু ও আমাকে ছাড়বে না। ও আমার পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে।” আরেকটা পাতায় লেখা – “আমি জানি সুরেশ রায় একটা বড় পরিকল্পনা করছে। সে একটা গোপন ফাইল তৈরি করছে, যেখানে তার সব অবৈধ লেনদেন এবং জালিয়াতির প্রমাণ আছে। সে এই ফাইলটা লুকিয়ে রেখেছে। যদি এই ফাইলটা পুলিশের হাতে পড়ে, তাহলে ওর সব শেষ হয়ে যাবে।” রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল। “গোপন ফাইল!” রিয়া ফিসফিস করে বলল। অর্ণব ডায়েরির আরও কয়েকটি পাতা ওল্টাল। শেষ কয়েকটি পাতায় শশাঙ্কের অস্থিরতা আরও স্পষ্ট। সে লিখেছে, সুরেশ রায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। সে পালিয়ে যেতে চাইছে। শেষ পাতায় একটা অদ্ভুত আঁকা। একটা মানচিত্রের মতো কিছু। তাতে কিছু চিহ্ন আর সংখ্যা লেখা। মানচিত্রের এক কোণে একটা ছোট করে লেখা – “গোপন আস্তানা।” রিয়া আর অর্ণব বুঝতে পারল, এই ডায়েরিটা কোনো সাধারণ ডায়েরি নয়। এটা শশাঙ্কের শেষ উইল। আর এই মানচিত্রটা হয়তো সেই গোপন ফাইলের হদিস দিতে পারে। কিন্তু এই ডায়েরিটা তাদের কাছে কে পৌঁছে দিল? আর কেন? শশাঙ্ক কি সত্যিই মারা গেছে, নাকি সে এখনো বেঁচে আছে এবং তাদের সাহায্য করতে চাইছে? এই ডায়েরিটা কি তাদের রহস্যের গভীরে নিয়ে যাবে, নাকি আরও বড় বিপদে ফেলবে? তাদের ভালোবাসা কি এই নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবে?   অধ্যায় ৬: মানচিত্রের রহস্য শশাঙ্কের ডায়েরি আর তার ভেতরের মানচিত্রটা রিয়া আর অর্ণবের হাতে আসার পর তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। ডায়েরির পাতায় পাতায় শশাঙ্কের ভয়, তার অসহায়তা আর সুরেশ রায়ের প্রতি তার ঘৃণা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই মানচিত্র। সকাল হতেই তারা বিক্রমকে ফোন করল। বিক্রম দ্রুত তাদের ফ্ল্যাটে চলে এল। শশাঙ্কের ডায়েরিটা দেখে সেও অবাক। “অবিশ্বাস্য! এই ডায়েরিটা কীভাবে আপনাদের কাছে এল?” “জানি না, বিক্রম। কাল রাতে ক্যাফে থেকে ফেরার পথে ফ্ল্যাটের সামনে একটা বাক্সে এটা পেলাম।” রিয়া বলল। বিক্রম ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। বিশেষ করে মানচিত্রটা। “এটা তো কোনো সাধারণ মানচিত্র নয়। এতে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আর সংখ্যা আছে। এর মানে বুঝতে হবে।” তারা তিনজন মিলে মানচিত্রটা নিয়ে বসলো। অর্ণব তার স্থপতিসুলভ জ্ঞান ব্যবহার করে মানচিত্রের রেখাগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগল। রিয়া তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে ছোট ছোট চিহ্নগুলো বোঝার চেষ্টা করল। বিক্রম তার গোয়েন্দা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিটি সম্ভাব্য অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর অর্ণব হঠাৎ বলে উঠল, “পেয়েছি! এই চিহ্নগুলো আসলে কলকাতার কিছু পুরনো স্থাপত্যের নকশা। আর এই সংখ্যাগুলো হয়তো সেই স্থাপত্যের বিশেষ কোনো অংশের নির্দেশক।” রিয়া অবাক হয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল। “তুমি নিশ্চিত?” “হ্যাঁ। এই রেখাগুলো আর এই কোণগুলো পরিচিত লাগছে। এটা হয়তো কোনো পুরনো বাড়ির নকশা, যা সুরেশ রায়ের কোনো প্রজেক্টের সাথে সম্পর্কিত ছিল।” অর্ণব বলল। বিক্রম মানচিত্রের সাথে কিছু পুরনো সরকারি নথি মিলিয়ে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তার মুখে হাসি ফুটল। “অর্ণব ঠিকই বলেছে। এই মানচিত্রটা কলকাতার একটা পুরনো জমিদার বাড়ির নকশা। বাড়িটা অনেক বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। সুরেশ রায় নাকি এই বাড়িটা কেনার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছু আইনি জটিলতার কারণে পারেনি।” “তাহলে কি গোপন ফাইলটা ওই বাড়িতে আছে?” রিয়া জানতে চাইল। “সম্ভবত। শশাঙ্ক ডায়েরিতে লিখেছিল যে সুরেশ রায় তার সব প্রমাণ একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে। এই পরিত্যক্ত বাড়িটা সেই গোপন আস্তানা হতে পারে।” বিক্রম বলল। “তাহলে আমরা কখন যাব?” অর্ণব জানতে চাইল। তার চোখে দৃঢ়তা। “সাবধানে থাকতে হবে। যদি শশাঙ্ক এই ডায়েরিটা আমাদের কাছে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে সে হয়তো চায় আমরা এই ফাইলটা খুঁজে বের করি। কিন্তু একই সাথে, যে বা যারা এই ডায়েরিটা এখানে রাখল, তারা হয়তো আমাদের ওপর নজর রাখছে।” বিক্রম সতর্ক করল। “আমরা আজ রাতেই যাব। দিনের আলোয় গেলে ঝুঁকি বেশি।” সেই দিনটা রিয়া আর অর্ণবের কাছে যেন অনন্তকাল মনে হলো। ক্যাফেতে কাজ করতে গিয়েও তাদের মন পড়ে ছিল সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির দিকে। তাদের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর ভয়। তারা জানে, তারা এক বড় বিপদের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু একই সাথে রহস্যের জট খোলার একটা সুযোগও তাদের সামনে। সন্ধ্যা নামল। রিয়া আর অর্ণব ক্যাফে বন্ধ করে বিক্রমের সাথে দেখা করল। বিক্রম তাদের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল – টর্চলাইট, গ্লাভস, আর কিছু আত্মরক্ষার সরঞ্জাম। “আমরা প্রথমে বাড়ির বাইরেটা পর্যবেক্ষণ করব। তারপর ভেতরে ঢুকব। কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।” বিক্রম নির্দেশ দিল। তারা তিনজন ট্যাক্সি করে সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির দিকে রওনা দিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে, এক নির্জন জায়গায় অবস্থিত ছিল সেই বাড়িটা। চারপাশে ঘন জঙ্গল, আর বাড়ির চারপাশে ভাঙা পাঁচিল। চাঁদের আবছা আলোয় বাড়িটা যেন এক ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে। গাড়ি থেকে নেমে তারা সাবধানে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। রিয়ার বুক ধড়ফড় করছিল। অর্ণব তার হাত শক্ত করে ধরেছিল। তারা বাড়ির পেছনের দিকে গেল। সেখানে একটা ভাঙা দরজা ছিল। বিক্রম সাবধানে দরজাটা খুলল। ভেতরে গাঢ় অন্ধকার আর ধুলোর গন্ধ। “সাবধানে,” বিক্রম ফিসফিস করে বলল। তারা টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতরে যেন এক অন্য জগত। পুরনো আসবাবপত্র, ভাঙা কাঁচ, আর দেওয়ালে শেওলা। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের মনে হচ্ছিল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের অনুসরণ করছে। তারা ডায়েরির মানচিত্র অনুযায়ী এগোতে লাগল। মানচিত্রে যে চিহ্নগুলো ছিল, সেগুলো বাড়ির ভেতরের কিছু বিশেষ জায়গার নির্দেশক। তারা একটা ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠল। দোতলার একটা ঘরে গিয়ে অর্ণব থমকে দাঁড়াল। “এই ঘরটা,” অর্ণব ফিসফিস করে বলল, “এই ঘরটার নকশা মানচিত্রে ছিল।” ঘরটা অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। মাঝখানে একটা ভাঙা টেবিল আর কিছু পুরনো কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা টর্চের আলোয় ঘরের প্রতিটি কোণা দেখতে লাগল। হঠাৎ, রিয়া একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল। টেবিলের নিচে একটা আলগা কাঠের তক্তা। সে সাবধানে তক্তাটা সরাল। ভেতরে একটা ছোট গোপন কুঠুরি। বিক্রম আর অর্ণব দ্রুত এগিয়ে এল। কুঠুরির ভেতরে একটা ছোট লোহার সিন্দুক। সিন্দুকটা তালা দেওয়া। “এইটা সেই ফাইল!” অর্ণব উত্তেজিত হয়ে বলল। বিক্রম তার সাথে আনা কিছু সরঞ্জাম দিয়ে তালাটা খোলার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর তালাটা খুলে গেল। তারা সিন্দুকটা খুলল। ভেতরে একটা কালো রঙের ফাইল। ফাইলটা খুলতেই তাদের চোখ কপালে উঠল। ফাইলটার ভেতরে সুরেশ রায়ের সব অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ, জালিয়াতির নথি, আর কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম। এই ফাইলটা যদি পুলিশের হাতে পড়ে, তাহলে অনেক বড় বড় মানুষের মুখোশ খুলে যাবে। কিন্তু ফাইলটার ভেতরে আরও একটা জিনিস ছিল। একটা ছোট পেনড্রাইভ। পেনড্রাইভটা দেখে অর্ণব অবাক হলো। “এটা কী?” বিক্রম পেনড্রাইভটা হাতে নিল। “এটা হয়তো আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু। হয়তো সুরেশ রায়ের শেষ চাল।” তারা ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা নিজেদের কাছে রাখল। তাদের কাজ শেষ। এবার এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যখন তারা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে একটা ভারী শব্দ শোনা গেল, যেন কেউ দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিয়েছে। তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ভয় আর উদ্বেগ। তারা ফাঁদে পড়েছে! কে তাদের ফাঁদে ফেলল? শশাঙ্ক কি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল? নাকি সুরেশ রায় সত্যিই বেঁচে আছে এবং তাদের জন্য এই ফাঁদ পেতে রেখেছে? এই অন্ধকার বাড়িতে তাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে? তাদের ভালোবাসার শক্তি কি এই বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে?   অধ্যায় ৭: মুখোশের আড়ালে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে রিয়া, অর্ণব আর বিক্রমের বুক কেঁপে উঠল। গাঢ় অন্ধকারে তারা একে অপরের দিকে তাকাল। টর্চের আলোয় তাদের মুখগুলো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। “কে আছে বাইরে?” অর্ণব চিৎকার করে বলল। কোনো উত্তর এল না। শুধু একটা শীতল হাসি যেন বাতাসের সাথে মিশে গেল। “আমাদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে,” বিক্রম শান্ত গলায় বলল। “কিন্তু কে?” হঠাৎ, ঘরের কোণা থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে এল। ছায়াটা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। টর্চের আলো ছায়াটার ওপর পড়তেই তারা দেখতে পেল, একজন লম্বা, সুঠাম দেহের লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার মুখে সেই কালো মুখোশ, যা তারা গলির মুখে দেখেছিল। তার হাতে একটা রিভলভার ঝলসে উঠল। “তোমরা অনেক দূর এসেছ,” লোকটা ভারী, বিকৃত কণ্ঠে বলল। “কিন্তু এর বেশি আর এগোতে পারবে না।” “কে তুমি?” অর্ণব দৃঢ় কণ্ঠে জানতে চাইল। “সুরেশ রায়?” লোকটা হাসল। সেই হাসিটা যেন হাড় হিম করে দিচ্ছিল। “সুরেশ রায়? সে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমি তার থেকে অনেক বেশি কিছু।” “শশাঙ্ক?” বিক্রম প্রশ্ন করল। লোকটা মুখোশটা সরিয়ে ফেলল। তার মুখটা দেখে রিয়া আর অর্ণব স্তম্ভিত হয়ে গেল। এ তো সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক, যিনি ক্যাফেতে এসে নিরাপত্তার অভাবের কথা বলেছিলেন! তার মুখে এক কুটিল হাসি। “তোমরা আমাকে চিনতে পারছো না?” লোকটা বলল। “আমি শশাঙ্ক রায়।” রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল। শশাঙ্ক! কিন্তু শশাঙ্ক তো সুরেশ রায়ের ভয়ে পালিয়েছিল! সে কেন তাদের ওপর হামলা করছে? “কিন্তু কেন শশাঙ্ক? তুমি তো সুরেশ রায়ের ভয়ে পালিয়েছিলে। তুমি কেন আমাদের ওপর নজর রাখছো? কেন আমাদের হুমকি দিচ্ছো?” অর্ণব জানতে চাইল। শশাঙ্ক হাসল। “পালিয়েছিলাম? হ্যাঁ, পালিয়েছিলাম। সুরেশ রায় আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি মরিনি। আমি বেঁচে আছি, আর আমি আমার প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।” “প্রতিশোধ? কার ওপর প্রতিশোধ?” রিয়া ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল। “সুরেশ রায়ের ওপর। আর যারা তার সাথে ছিল, তাদের সবার ওপর। অর্ণব, তুমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলে।” শশাঙ্কের চোখে ঘৃণা। অর্ণব অবাক হলো। “আমি তো সুরেশ রায়ের অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি তার জাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।” “হ্যাঁ, বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তুমি জানো না, সুরেশ রায় আমাকে কী কী করতে বাধ্য করেছিল। সে আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিল। আমি তার সব সম্পত্তি, তার সব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম। আর এই ফাইলটা,” শশাঙ্ক অর্ণবের হাতে থাকা ফাইলটার দিকে ইঙ্গিত করল, “এই ফাইলটা আমার সেই প্রতিশোধের অস্ত্র।” “তাহলে ডায়েরিটা তুমিই রেখেছিলে?” রিয়া জানতে চাইল। “হ্যাঁ। আমি চেয়েছিলাম তোমরা এই ফাইলটা খুঁজে বের করো। কারণ আমি জানতাম, তোমরা এই ফাইলটার গুরুত্ব বুঝবে। আর যখন তোমরা এটা খুঁজে বের করবে, তখন আমি তোমাদের শেষ করে দেব। আর এই ফাইলের সব তথ্য আমার হাতে চলে আসবে।” শশাঙ্কের চোখে এক উন্মাদনা। “কিন্তু কেন আমাদের শেষ করবে? আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।” রিয়া বলল। “তোমরা অর্ণবের সাথে আছো। আর অর্ণব সুরেশ রায়ের প্রজেক্টে কাজ করেছিল। তোমরা আমার প্রতিশোধের অংশ।” শশাঙ্ক রিভলভারটা তাদের দিকে তাক করল। “এখন ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা আমাকে দাও।” অর্ণব ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা শশাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দিল। শশাঙ্ক সেগুলো লুফে নিল। তার মুখে বিজয়ের হাসি। “তোমরা ভেবেছিলে তোমরা জিতে গেছো?” শশাঙ্ক বলল। “কিন্তু খেলাটা এখন শুরু হলো।” হঠাৎ, বিক্রম দ্রুত শশাঙ্কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শশাঙ্ক অপ্রস্তুত ছিল। বিক্রমের ধাক্কায় তার হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ল। শুরু হলো ধস্তাধস্তি। শশাঙ্ক শক্তিশালী ছিল, কিন্তু বিক্রম একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। অর্ণব দ্রুত রিভলভারটা তুলে নিল। রিয়া ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে দৃঢ়তা। শশাঙ্ক বিক্রমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল এবং অর্ণবের দিকে ছুটে এল। অর্ণব রিভলভারটা শশাঙ্কের দিকে তাক করল। “থামো শশাঙ্ক! কাছে এলে গুলি করব!” অর্ণব চিৎকার করে বলল। শশাঙ্ক হাসল। “তুমি আমাকে গুলি করবে না, অর্ণব। তুমি একজন নিরীহ মানুষ। তুমি খুনী নও।” শশাঙ্ক অর্ণবের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অর্ণবের হাত কাঁপছিল। সে সত্যিই গুলি করতে পারবে না। হঠাৎ, রিয়া একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো তুলে শশাঙ্কের দিকে ছুঁড়ে দিল। কাঁচটা শশাঙ্কের হাতে লাগল। শশাঙ্ক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। তার হাত থেকে ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা ছিটকে পড়ল। এই সুযোগে বিক্রম দ্রুত উঠে দাঁড়াল এবং শশাঙ্ককে জাপটে ধরল। অর্ণব ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা তুলে নিল। “এখনই পুলিশকে ফোন করো, অর্ণব!” বিক্রম বলল। অর্ণব দ্রুত পুলিশকে ফোন করল। শশাঙ্ক তখনো বিক্রমের সাথে ধস্তাধস্তি করছিল। তার চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। পুলিশ এসে শশাঙ্ককে গ্রেফতার করল। তার হাতে হাতকড়া পরানো হলো। অফিসার ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা হাতে নিলেন। “এই ফাইলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অনেক বড় বড় অপরাধীর মুখোশ খুলে যাবে।” রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে স্বস্তি আর ভালোবাসা। এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের সম্পর্ক যেন আরও দৃঢ় হয়েছে।   অধ্যায় ৮: নতুন সকাল কয়েকদিন পর। রিয়া আর অর্ণব ক্যাফে নস্টালজিয়াতে বসে আছে। ক্যাফেতে এখন আর কোনো ভয়ের ছায়া নেই। চারপাশে পরিচিত কোলাহল আর কফির সুবাস। শশাঙ্কের গ্রেফতারের খবরটা সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। তার দেওয়া ফাইল আর পেনড্রাইভের সূত্র ধরে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে। সুরেশ রায়ের অতীতও সবার সামনে এসেছে। বিক্রম ক্যাফেতে এল। তার মুখে এক প্রশান্ত হাসি। “তোমাদের ধন্যবাদ। তোমরা না থাকলে এই রহস্যের জট কোনোদিন খুলত না।” “আপনাকে ধন্যবাদ, বিক্রম। আপনি আমাদের পাশে না থাকলে আমরা হয়তো পারতাম না।” রিয়া বলল। “শশাঙ্কের কী হবে?” অর্ণব জানতে চাইল। “তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। সে দীর্ঘদিনের জন্য জেলে যাবে। তবে সে দাবি করছে, সুরেশ রায় এখনো বেঁচে আছে এবং সে তাকে খুঁজে বের করবে।” বিক্রম বলল। “সুরেশ রায় কি সত্যিই বেঁচে আছে?” রিয়া জানতে চাইল। “জানি না। তবে এই ফাইলটা আর পেনড্রাইভটা তার সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছে। আমরা তার খোঁজ চালাচ্ছি। সে যদি সত্যিই বেঁচে থাকে, তাহলে তাকেও ধরা পড়বে।” বিক্রম আশ্বস্ত করল। বিক্রম বিদায় নিল। রিয়া আর অর্ণব একে অপরের হাত ধরল। তাদের সামনে এখন এক নতুন সকাল। ভয়ের অন্ধকার কেটে গেছে। তাদের ভালোবাসা এখন আরও উজ্জ্বল। “অর্ণব,” রিয়া বলল, “আমাদের জীবনে অনেক বিপদ এসেছে। কিন্তু আমরা একসঙ্গে সব মোকাবিলা করেছি।” “হ্যাঁ, রিয়া। আর এই বিপদ আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে।” অর্ণব রিয়ার কপালে চুমু খেল। ক্যাফেতে তখন মৃদু গান বাজছিল। পুরনো দিনের এক ভালোবাসার গান। রিয়া আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল। তাদের চোখে স্বপ্ন আর এক নতুন ভবিষ্যতের হাতছানি। তারা জানে, জীবন হয়তো সবসময় মসৃণ হবে না, কিন্তু তারা একসঙ্গে সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারবে। তাদের ভালোবাসা, তাদের বিশ্বাসই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।                             ~  সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion