অরুণিমার অন্তর্ধান
কলকাতার অন্যতম বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং ‘দ্য রয়্যাল রেসিডেন্স’ শহরের বুকে এক আধুনিক স্থাপত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি শুধু একটি বাসস্থান ছিল না, ছিল আভিজাত্য আর সাফল্যের এক জীবন্ত ঘোষণা। কাঁচ আর ইস্পাতের তৈরি এই বিশাল অট্টালিকাটি যেন কলকাতার আকাশছোঁয়া স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, যেখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটই ছিল এক একটি ব্যক্তিগত দুর্গ। এর প্রতিটি তলায়, প্রতিটি ফ্ল্যাটে বাস করতেন শহরের বিত্তবান, প্রভাবশালী এবং খ্যাতিমান মানুষেরা – শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র তারকা, এবং অবশ্যই, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অরুণিমা সেন। এই উঁচু দালানের পনেরো তলায়, এক প্রশস্ত ফ্ল্যাটে তাঁর শিল্পকর্মের জগতে মগ্ন থাকতেন অরুণিমা। তাঁর ফ্ল্যাটটি ছিল রঙের এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি দেয়ালই যেন এক একটি গল্প বলত। দেয়ালজুড়ে বিমূর্ত চিত্রকর্মের ছটা, স্টুডিওর এক কোণে সারি সারি সাজানো রঙ-তুলি, আর মাঝখানে ইজেলের ওপর অপেক্ষারত নতুন ক্যানভাস। রঙের তীব্র গন্ধ আর টারপেনটাইনের মৃদু সুবাসে ফ্ল্যাটটি যেন এক অন্য জগতের প্রবেশদ্বার ছিল। অরুণিমা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। তাঁর তুলির টানে ক্যানভাসে ফুটে উঠত গভীর ভাবনা, যা দর্শককে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত, তাদের মননে এক নতুন বোধের জন্ম দিত। তাঁর আঁকা ছবিগুলো শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বেশ সমাদৃত ছিল। প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্কের নামকরা গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনীগুলো শিল্প সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিল, আর তাঁর প্রতিটি নতুন কাজই ছিল শিল্পপ্রেমীদের কাছে এক প্রতীক্ষিত ঘটনা। অরুণিমা ছিলেন এক স্বাধীনচেতা নারী, যিনি নিজের শর্তে বাঁচতে ভালোবাসতেন, কোনো রকম সামাজিক বাধার কাছে মাথা নত করতেন না। তাঁর জীবনে শিল্পের বাইরে আর কোনো কিছুর স্থান ছিল না, অন্তত বাইরে থেকে তাই মনে হতো। তাঁর জীবন ছিল রহস্যময়, তাঁর শিল্পকর্মের মতোই বিমূর্ত।
অথচ একদিন সকালে, এই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের শান্ত, সুশৃঙ্খল পরিবেশ হঠাৎ করেই এক মর্মান্তিক খবরে ভেঙে পড়ল। সকালের নরম আলো যখন সবেমাত্র শহরের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে, তখনই অরুণিমার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে পুলিশ যখন ভেতরে ঢুকল, তখন দেখা গেল তাঁর নিথর দেহ পড়ে আছে স্টুডিওর মেঝেতে। তাঁর শরীর ছিল নিথর, প্রাণহীন, যেন ক্যানভাসের ওপর আঁকা কোনো স্থির চিত্রের মতো। পাশেই ছিটকে পড়ে আছে একটি রঙ-তুলির বাক্স, যার রঙগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছে। আর ইজেলের ওপর অসম্পূর্ণ একটি ছবি – গাঢ় লাল রঙে আঁকা এক নারীর আবছা মুখ, যার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা, এক গভীর বেদনা। যেন মৃত্যুর পূর্বাভাস, যা শিল্পী নিজেই নিজের ক্যানভাসে এঁকে রেখেছিলেন।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়নি। ফ্ল্যাটে কোনো জোরপূর্বক প্রবেশের চিহ্ন ছিল না, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, যা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে হত্যাকারী পরিচিত ছিল অথবা কোনোভাবে ফ্ল্যাটে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। কিন্তু কিছু জিনিসপত্র এলোমেলো অবস্থায় পড়েছিল, যেমন একটি চেয়ার উল্টানো, কিছু বই মেঝেতে ছড়ানো, যা দেখে মনে হচ্ছিল একটি ধস্তাধস্তি হয়েছিল। অরুণিমার মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলো। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর ছড়িয়ে পড়ল, “বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অরুণিমা সেনের রহস্যজনক মৃত্যু!” এই খবর বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল শহরজুড়ে, শিল্পমহলে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। পুলিশের ডিটেক্টিভ দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ইনস্পেক্টর রঞ্জন মিত্র – একজন অভিজ্ঞ, কিন্তু কিছুটা গতানুগতিক চিন্তাভাবনার পুলিশ অফিসার – বেশ কয়েকদিন ধরে তদন্ত চালালো, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট সূত্র খুঁজে পেল না। অ্যাপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হলো, কিন্তু তাতে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়ল না। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, কিন্তু তাদের কথায়ও কোনো নতুন তথ্য উঠে এল না। সবকিছুই যেন গোলকধাঁধার মতো মনে হচ্ছিল, এক জটিল ধাঁধা যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফ্ল্যাটে অরুণিমার সহকারী দীপা ছাড়া আর কারোর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি, যা রহস্যকে আরও ঘনীভূত করছিল, কারণ এটি ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে অপরাধী অত্যন্ত সতর্ক ছিল।
একই বিল্ডিংয়ের সাত তলায় থাকতেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, অসীম দাস। একসময় তিনি কলকাতার এক স্বনামধন্য কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, যুক্তিবাদী মন এবং ইতিহাসের প্রতি গভীর জ্ঞান তাঁকে সহকর্মীদের কাছে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তাঁর ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন এক অনুপ্রেরণা, যিনি শুধু ইতিহাস পড়াতেন না, ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতেন। অবসর গ্রহণের পর তাঁর দিন কাটত বই পড়ে, খবরের কাগজ ঘেঁটে আর নিজের বারান্দায় বসে শহরের কোলাহল দেখে। তিনি ছিলেন একাকী মানুষ, কিন্তু তাঁর মন ছিল সজাগ, তাঁর মস্তিষ্ক ছিল সদা সক্রিয়। তিনি রহস্য উপন্যাস পড়তে ভালোবাসতেন, আর তাঁর ছাত্রদের কাছে তিনি প্রায়ই বলতেন, “ইতিহাস হলো এক বিশাল রহস্য, যার প্রতিটি অধ্যায়ে লুকিয়ে আছে নতুন নতুন সূত্র, যা ধৈর্য আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়।” অরুণিমার মৃত্যুর খবর শুনে তিনি নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলেন, তাঁর শান্ত জীবনে এই ঘটনা এক অপ্রত্যাশিত আলোড়ন তুলেছিল। অরুণিমা যদিও তাঁর সরাসরি ছাত্রী ছিলেন না, তবুও অসীমবাবু শিল্পীর প্রতিভার গভীর ভক্ত ছিলেন। তিনি অরুণিমার কয়েকটি প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর শিল্পকর্মের গভীরতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। অরুণিমার প্রতিটি ছবিতেই তিনি যেন এক নতুন ইতিহাস খুঁজে পেতেন।
যখন পুলিশের তদন্তে কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না, তখন অসীমবাবুর মনে খচখচানি শুরু হলো। তিনি খবরের কাগজে অরুণিমার মৃত্যুর খবর পড়ছিলেন, টেলিভিশনে সংবাদ দেখছিলেন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা তাঁকে হতাশ করছিল, তাঁর মনে হচ্ছিল তারা যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিস করছে। তাঁর মনে হলো, হয়তো পুলিশ এমন কিছু সাধারণ জিনিস উপেক্ষা করছে যা তাঁর মতো একজন সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়তে পারে, যিনি জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেন। তাঁর অতীতের অভিজ্ঞতাও ছিল। একবার তাঁর এক প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরির ঘটনায় পুলিশ যখন দিশেহারা, তখন অসীমবাবুই তাঁর ঐতিহাসিক জ্ঞান এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কিছু সূত্র দিয়েছিলেন, যা চোরকে ধরতে সাহায্য করেছিল। সেই থেকে ইনস্পেক্টর রঞ্জন মিত্রের সাথে তাঁর এক ধরনের শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, রঞ্জন মিত্র অসীমবাবুর বুদ্ধিমত্তার কদর করতেন।
অসীমবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজেই এই রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা করবেন। তাঁর মনে এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ববোধ কাজ করছিল। তিনি প্রথমে অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটির সাথে কথা বললেন। সিকিউরিটি ইনচার্জ, সুরেশ, অসীমবাবুকে চিনতেন এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। অসীমবাবু সুরেশের কাছে গত কয়েকদিনে অরুণিমার ফ্ল্যাটে কারা এসেছিলেন, তার একটি বিস্তারিত তালিকা চাইলেন, প্রতিটি নাম, সময় এবং উদ্দেশ্য সহ। সুরেশ একটু ইতস্তত করলেও অসীমবাবুর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না, কারণ তিনি জানতেন অসীমবাবু একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তালিকাটি হাতে নিয়ে অসীমবাবু দেখলেন, মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় কয়েকজন এসেছিলেন – একজন আর্ট ডিলার, মি. চৌধুরী; অরুণিমার সহকারী, দীপা; এবং একজন পুরোনো বন্ধু, ভাস্কর বিক্রম রায়। এই তিনটি নাম তাঁর মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগাল।
অসীমবাবু একে একে সবার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন, তাঁর শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণে তিনি প্রত্যেকের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করছিলেন। প্রথমেই তিনি গেলেন মি. চৌধুরীর কাছে। মি. চৌধুরী ছিলেন একজন সুপরিচিত আর্ট ডিলার, যিনি অরুণিমার অনেক ছবি বিক্রি করেছিলেন এবং তাঁর ব্যবসার অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন। তাঁর চেহারায় ছিল এক ধরনের চতুরতা, চোখে ছিল টাকার ঝিলিক, যা তাঁর পেশার সাথে মানানসই। অসীমবাবু মি. চৌধুরীর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলেন, তিনি বেশ বিচলিত, তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ।
“নমস্কার মি. চৌধুরী, আমি অসীম দাস, এই বিল্ডিংয়েরই বাসিন্দা। অরুণিমা দেবীর মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত।” অসীমবাবু শান্তভাবে, কিন্তু এক ধরনের দৃঢ়তা নিয়ে বললেন।
মি. চৌধুরী কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, কী যে হয়ে গেল! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। অরুণিমা ছিল আমার অন্যতম সেরা শিল্পী, আমার গ্যালারির প্রাণ। ওর মতো প্রতিভাধর শিল্পী আর আসবে না।” তাঁর কথায় শোকের পাশাপাশি এক ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির ইঙ্গিতও ছিল।
“আমি জানতে পারলাম, মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় আপনি অরুণিমা দেবীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?” অসীমবাবু সরাসরি প্রশ্ন করলেন, মি. চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে।
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। একটি নতুন প্রদর্শনীর বিষয়ে কথা বলতে। অরুণিমা সম্প্রতি কিছু নতুন কাজ করছিলেন, যা নিয়ে আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম। আমরা একটি বড় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু… আমাদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ হয়েছিল।” মি. চৌধুরী ইতস্তত করে বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে এক ধরনের অস্বস্তি স্পষ্ট ছিল।
“কী ধরনের মতবিরোধ?” অসীমবাবু আরও গভীরে প্রবেশ করলেন।
“আসলে, অরুণিমা তাঁর কাজের দাম নিয়ে খুব অনমনীয় ছিলেন। আমি একটি বড় ডিলের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যা তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিষ্ঠিত করত, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর শিল্প বিক্রি করার জন্য তিনি কোনো আপস করবেন না, তাঁর শিল্পের মূল্য শুধু টাকার অঙ্কে মাপা যায় না।” মি. চৌধুরী এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর কথায় এক ধরনের হতাশা স্পষ্ট ছিল, যেন একটি বিশাল সুযোগ তাঁর হাত ফসকে গেছে। অসীমবাবু লক্ষ্য করলেন, মি. চৌধুরীর চোখে হতাশার পাশাপাশি এক ধরনের লুকানো রাগও ছিল। একটি বড় ডিল হাতছাড়া হওয়ার রাগ, যা তার পেশাগত জীবনে একটি বড় ধাক্কা ছিল।
এরপর অসীমবাবু দেখা করলেন অরুণিমার সহকারী দীপার সাথে। দীপা ছিলেন একজন তরুণী, অরুণিমার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল, প্রায় ভক্তির পর্যায়ে। অরুণিমার মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁর চোখ দুটি ছিল ফোলা, কণ্ঠস্বর ছিল ক্ষীণ।
“দীপা, আমি অসীম দাস। অরুণিমা দেবীর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমি কিছু তথ্য জানতে চাইছিলাম, যদি আপনি সাহায্য করতে পারেন।” অসীমবাবু সহানুভূতিশীল গলায় বললেন।
দীপা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “আমি কী বলব জানি না স্যার। অরুণিমা ম্যাম আমার কাছে দেবীর মতো ছিলেন। তিনি শুধু আমার বস ছিলেন না, ছিলেন আমার গুরু, আমার পথপ্রদর্শক। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কেন এমনটা হলো।”
“মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় আপনি কখন অরুণিমা দেবীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েছিলেন?” অসীমবাবু প্রশ্ন করলেন।
“আমি সন্ধ্যা ৭টায় বেরিয়েছিলাম। মি. চৌধুরী তখনো ছিলেন। ম্যাম আমাকে কিছু ফাইল গুছিয়ে রাখতে বলেছিলেন। আমি কাজ শেষ করে চলে এসেছিলাম। ম্যাম বললেন, ‘দীপা, আজ আর কিছু করতে হবে না। তুমি বাড়ি যাও।'” দীপা স্মরণ করার চেষ্টা করলেন।
“অরুণিমা দেবী কি সেদিন কোনোভাবে বিচলিত ছিলেন? বা কোনো অস্বাভাবিক কিছু আপনার চোখে পড়েছিল?”
দীপা কিছুক্ষণ ভাবলেন, তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। “না স্যার, তেমন কিছু না। তবে ম্যাম গত কয়েকদিন ধরে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছিলেন। তিনি প্রায়ই ফোনে কথা বলতেন, আর তার পর একটু গম্ভীর হয়ে যেতেন। তাঁর চোখে এক ধরনের অস্থিরতা দেখতাম। কিন্তু তিনি আমাকে কিছু বলতেন না, আমি জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যেতেন।”
অসীমবাবু লক্ষ্য করলেন, দীপার কথায় তেমন কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেল না, কিন্তু তাঁর চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কোনো কিছু লুকাচ্ছেন, অথবা হয়তো তিনি নিজেও কিছু জানেন না, তবে তাঁর মনে এক গভীর ভয় কাজ করছে, যা তাকে অস্থির করে তুলছে।
সবশেষে অসীমবাবু গেলেন অরুণিমার পুরোনো বন্ধু, ভাস্কর বিক্রম রায়ের কাছে। বিক্রম ছিলেন অরুণিমার কলেজের বন্ধু, তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল দীর্ঘদিনের, গভীর। তাঁরা দুজনেই শিল্পকলার জগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যদিও বিক্রমের খ্যাতি অরুণিমার মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বিক্রমের ফ্ল্যাটে গিয়ে অসীমবাবু দেখলেন, বিক্রমের চেহারায় এক অদ্ভুত শূন্যতা। তাঁর চোখ দুটি লাল, যেন তিনি অনেক কেঁদেছেন, তাঁর পোশাক ছিল এলোমেলো, যা তাঁর স্বাভাবিক পরিপাটি স্বভাবের বিপরীত।
“বিক্রমবাবু, আমি অসীম দাস। অরুণিমা দেবীর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে দুঃখিত।” অসীমবাবু শান্তভাবে বললেন।
বিক্রম মাথা নিচু করে বললেন, “অরুণিমা… ও ছিল আমার আত্মার আত্মীয়। আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কী করে এমনটা হতে পারে? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।” তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা ভাঙা।
“আপনি মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় অরুণিমা দেবীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন, তাই না?” অসীমবাবু প্রশ্ন করলেন।
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। ওর সাথে একটু কথা বলতে। আমরা প্রায়ই দেখা করতাম, শিল্প নিয়ে আলোচনা করতাম, পুরনো দিনের কথা বলতাম।” বিক্রমের কথায় এক ধরনের স্মৃতিচারণ ছিল।
“আপনি কখন বেরিয়েছিলেন?”
“আমি মি. চৌধুরী চলে যাওয়ার পর গিয়েছিলাম। রাত ৯টা নাগাদ বেরিয়েছিলাম। অরুণিমা তখনো কাজ করছিল।”
“অরুণিমা দেবী কি সেদিন স্বাভাবিক ছিলেন? তাঁর আচরণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন?”
বিক্রম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা আর অস্থিরতা লক্ষ্য করলেন অসীমবাবু। তাঁর হাত দুটি কাঁপছিল। “সে একটু চিন্তিত ছিল। কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছিল। তার মুখে এক ধরনের চাপা ভয় ছিল। কিন্তু আমাকে কিছু বলতে চায়নি। আমি জোর করিনি, কারণ আমি জানতাম অরুণিমা যখন কিছু গোপন রাখতে চায়, তখন তাকে জোর করা বৃথা।”
অসীমবাবু বিক্রমের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তাঁর মনে হলো, বিক্রমের কথায় এক ধরনের অসঙ্গতি আছে। তাঁর অস্থিরতা স্বাভাবিক শোকের চেয়েও বেশি কিছু, যেন তিনি কোনো গভীর গোপন কথা লুকিয়ে রাখছেন, যা তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
অসীমবাবু অরুণিমার ফ্ল্যাটে পুলিশের সাথে পুনরায় প্রবেশ করার অনুমতি চাইলেন। ইনস্পেক্টর রঞ্জন মিত্র, অসীমবাবুর অনুরোধ রক্ষা করলেন, কারণ তিনি অসীমবাবুর বিচক্ষণতার ওপর ভরসা রাখতেন। অসীমবাবু ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন, প্রতিটি ছোট জিনিসের দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তিনি প্রথমদিনেই অরুণিমার ফ্ল্যাটের লিভিং রুমের একটি ছোট শেল্ফে একটি প্রাচীন মিশরীয় মূর্তি রাখা দেখেছিলেন। মূর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি ছিল, প্রায় এক ফুট উঁচু, আর তার গায়ে ছিল প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিকের নকশা। মূর্তিটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় হলেও, এর কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক বা আর্থিক মূল্য আছে বলে মনে হয়নি, অন্তত সাধারণ চোখে। কিন্তু যখন তিনি পুলিশকে নিয়ে পুনরায় ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলেন, তখন সেই মূর্তিটি সেখানে ছিল না। শেল্ফটি ছিল খালি, যেন মূর্তিটি কোনোদিন সেখানেই ছিল না। পুলিশ এই ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও অসীমবাবুর মনে খটকা লাগলো। মূর্তিটি যদি মূল্যবান না-ই হয়, তবে এটির অনুপস্থিতি কেন? যদি চোর আসত, তবে সে তো মূল্যবান জিনিসপত্র নিত, এই সাধারণ মূর্তিটি কেন? এটি যেন এক অদৃশ্য সূত্র, যা তাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছিল।
অসীমবাবু তাঁর নোটবুকে মূর্তিটির কথা লিখে রাখলেন, তার আকার, রঙ এবং আনুমানিক বর্ণনা। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই মূর্তিটির অনুপস্থিতিই হয়তো এই রহস্যের মূল চাবিকাঠি। তিনি মনে মনে ভাবলেন, “কোনো কিছু যদি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়, তবে তার পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ থাকে। আর এই কারণটিই অরুণিমার মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।” তাঁর গোয়েন্দা মন আরও সক্রিয় হয়ে উঠল।
তিনি আবার বিক্রমের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবার অসীমবাবু বিক্রমের ফ্ল্যাটে গিয়ে সরাসরি মূর্তিটির কথা তুললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা, যা বিক্রমকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল।
“বিক্রমবাবু, অরুণিমা দেবীর ফ্ল্যাটে একটি প্রাচীন মিশরীয় মূর্তি ছিল। আপনি কি সেটি দেখেছেন? আমি যখন প্রথমবার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম, তখন সেটি শেল্ফে ছিল, কিন্তু এখন নেই।”
মূর্তিটির কথা শুনেই বিক্রমের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাঁর চোখ দুটি ভয়ে বড় বড় হয়ে উঠল, যেন তিনি এক ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন। অসীমবাবু বুঝতে পারলেন, এই মূর্তির সাথে কোনো রহস্য জড়িয়ে আছে, যা বিক্রমকে ভীত করছে, এবং এই ভয় স্বাভাবিক নয়।
“কোন মূর্তি? আমি তো কিছু দেখিনি,” বিক্রম ইতস্তত করে বললেন, তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, স্বর ছিল জড়ানো। তিনি বারবার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
“মিথ্যা বলবেন না বিক্রমবাবু। আমি জানি আপনি দেখেছেন। আমি প্রথম দিনেই সেটি দেখেছি। আর এখন সেটি নেই। এর অনুপস্থিতিই আমাকে ভাবাচ্ছে।” অসীমবাবু শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন, “অরুণিমা দেবীর মৃত্যুর সাথে এই মূর্তির কোনো সম্পর্ক আছে, তাই না? আপনি কিছু লুকাচ্ছেন।”
বিক্রম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। তিনি সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন, মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর শরীর কাঁপছিল। “আমি… আমি কী করব বুঝতে পারছি না স্যার। আমি অরুণিমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি।”
অসীমবাবু তাঁর পাশে বসলেন, তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। “আমাকে বলুন বিক্রমবাবু। আপনি যদি আমাকে সব সত্যি বলেন, তবে আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। সত্য প্রকাশ পেলে আপনার বোঝা হালকা হবে।”
অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর বিক্রম স্বীকার করলেন। তাঁর কথা শুনে অসীমবাবু হতবাক হয়ে গেলেন। মূর্তিটি অরুণিমার কাছে ছিল কারণ তিনি একটি আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্ত্বিক পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে এটি চুরি করেছিলেন। আসলে এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল, যা সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী থেকে চুরি গিয়েছিল। এই পাচারকারী চক্রের প্রধান ছিল একজন কুখ্যাত ব্যক্তি, যার নাম ছিল রফিক। রফিক অত্যন্ত ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিল, যার হাত অনেক নোংরা কাজে জড়িত ছিল।
বিক্রম বললেন, “অরুণিমা গত কয়েক মাস ধরে এই পাচারকারী চক্রের ওপর নজর রাখছিল। সে তাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জোগাড় করেছিল, তাদের গতিবিধি অনুসরণ করছিল। সে চেয়েছিল তাদের মুখোশ খুলে দিতে, তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড জনসম্মুখে আনতে। এই মূর্তিটি ছিল তাদের সর্বশেষ চুরি করা নিদর্শন, যা তারা একটি আন্তর্জাতিক নিলামে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছিল, যার মূল্য ছিল কোটি কোটি টাকা। অরুণিমা সেই নিলামের ছদ্মবেশে গিয়েছিল এবং কোনোভাবে মূর্তিটি চুরি করে এনেছিল, যাতে সে প্রমাণ হিসেবে এটি ব্যবহার করতে পারে।”
“কেন? কেন সে এমন ঝুঁকি নিয়েছিল? নিজের জীবন বিপন্ন করে?” অসীমবাবু প্রশ্ন করলেন, অরুণিমার সাহসিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
“অরুণিমা ন্যায়বিচার চাইত। সে বিশ্বাস করত, শিল্পকর্মের স্থান জাদুঘরে, পাচারকারীদের হাতে নয়। সে চেয়েছিল রফিককে ফাঁসাতে, তাকে আইনের আওতায় আনতে। সে ভেবেছিল, মূর্তিটি তার কাছে থাকলে সে রফিককে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারবে, আর তার এই অবৈধ সাম্রাজ্য ভেঙে দিতে পারবে।” বিক্রমের চোখে জল এসে গেল। “আমি ওকে বারবার বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, এটা খুব বিপজ্জনক, রফিক অত্যন্ত হিংস্র। কিন্তু অরুণিমা শুনল না। সে বলেছিল, ‘আমি ভয় পাই না। আমি যা ঠিক মনে করি, সেটাই করব।'”
বিক্রম আরও জানালেন, তিনি নিজেও এই পাচারকারী চক্রের একটি অংশের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি রফিকের জন্য কিছু ভাস্কর্য তৈরি করতেন, যা পাচারকারীরা আসল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করত, যাতে তাদের অবৈধ কাজ ধরা না পড়ে। অরুণিমা এই বিষয়ে জানত, এবং সে বিক্রমকে হুমকি দিয়েছিল যে, যদি সে তাকে সাহায্য না করে, তবে সে তার নামও ফাঁস করে দেবে। তাই বিক্রম অরুণিমাকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু সে রফিকের ভয়ে ভীত ছিল, তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিল।
মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায়, মি. চৌধুরী চলে যাওয়ার পর বিক্রম অরুণিমার ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। অরুণিমা তখন রফিকের কাছ থেকে একটি হুমকি ফোন পেয়েছিলেন। রফিক জানতে পেরেছিল যে মূর্তিটি অরুণিমার কাছে আছে এবং সে সেটি ফেরত নিতে আসছে। অরুণিমা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সে বিক্রমকে বলেছিল, “বিক্রম, রফিক আসছে। আমি জানি না কী হবে। সে আমাকে মেরে ফেলতেও পারে।”
বিক্রম অরুণিমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল, তাকে লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু অরুণিমা রাজি হয়নি। সে বলেছিল, “আমি পালাব না। আমি এই লড়াই শেষ করব। আমি রফিকের কাছে মাথা নত করব না।”
বিক্রম ভয় পেয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, কারণ সে রফিকের মুখোমুখি হতে চায়নি। সে জানত, রফিক কতটা বিপজ্জনক, আর তার হাতে কত মানুষের রক্ত লেগে আছে। সে নিজের জীবন বাঁচাতে চেয়েছিল।
বিক্রমের কথা শেষ হতে না হতেই অসীমবাবু বুঝতে পারলেন, অরুণিমার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং একটি ভয়ঙ্কর অপরাধের পরিণতি ছিল। তিনি রঞ্জন মিত্রকে ফোন করলেন এবং বিক্রমের পুরো স্বীকারোক্তি জানালেন। রঞ্জন মিত্র প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাঁর কাছে পুরো ঘটনাটি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল, কিন্তু অসীমবাবুর যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা এবং বিক্রমের ভয়াবহ স্বীকারোক্তি তাঁকে ভাবতে বাধ্য করল।
পুলিশ দ্রুত অ্যাকশনে নামল। বিক্রমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রফিকের আস্তানায় অভিযান চালানো হলো। রফিককে গ্রেফতার করা হলো, এবং তার কাছ থেকে অরুণিমার ফ্ল্যাট থেকে চুরি যাওয়া প্রাচীন মিশরীয় মূর্তিটিও উদ্ধার করা হলো। রফিক প্রথমে অস্বীকার করলেও, বিক্রমের স্বীকারোক্তি এবং মূর্তির উপস্থিতি তাকে বিপদে ফেলে দিল। জেরার মুখে রফিক স্বীকার করল, সে অরুণিমার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল মূর্তিটি ফেরত নিতে। অরুণিমা তাকে বাধা দিয়েছিল, এবং ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অরুণিমা মেঝেতে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল। রফিক ভয় পেয়ে মূর্তিটি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, অরুণিমাকে সাহায্য করার কোনো চেষ্টাই করেনি, বরং তার মৃত্যু নিশ্চিত করে গিয়েছিল।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। “বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অরুণিমা সেনের হত্যাকারী গ্রেফতার!” “আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের মুখোশ উন্মোচন!” অসীম দাস রাতারাতি একজন নায়কে পরিণত হলেন, তাঁর নাম শহরের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। ‘দ্য রয়্যাল রেসিডেন্স’ আবার শান্ত হলো, কিন্তু তার ভেতরে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ঘটনাটি সবার মনে এক গভীর ছাপ ফেলে গেল, যা সহজে মুছে যাওয়ার নয়।
অসীমবাবু তাঁর ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে শহরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল এক কাপ চা, আর মনে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি। অরুণিমার স্মৃতি তাঁর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল – একজন শিল্পী, যিনি শুধু ক্যানভাসেই নয়, জীবনের ক্যানভাসেও রঙ ছড়াতে চেয়েছিলেন, আর ন্যায়বিচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অসীমবাবু জানতেন, প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টের পেছনেই হয়তো লুকিয়ে থাকে এমন কতশত গল্প, কতশত রহস্য – যা শুধু সঠিক চোখের অপেক্ষায় থাকে উন্মোচিত হওয়ার জন্য। এই ঘটনা তাঁকে মনে করিয়ে দিল, জীবনের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে অজানা অধ্যায়, আর সত্যের আলোয় সেগুলো উন্মোচন করাই হলো মানুষের দায়িত্ব। তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তিনি জানতেন, তাঁর কাজ শেষ হয়নি। এই শহরে, এই পৃথিবীতে, আরও অনেক রহস্য অপেক্ষা করছে উন্মোচনের জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion