Episode 18699 words0 views

অশরীরী ছায়া: এক ভৌতিক উপাখ্যান

 প্রথম অধ্যায়: পুরনো বাড়ির ডাক আর্ণব রায়, পেশায় একজন স্থপতি, শহরের কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর এই ভালোবাসাই তাঁকে টেনে এনেছিল এক এমন জায়গায়, যেখানে শান্তি ছিল এক অলীক স্বপ্ন, আর নিরবতা ছিল হাজারো চাপা চিৎকারের প্রতিধ্বনি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এই পুরনো বাড়িটা, যার নাম ছিল ‘রায় মঞ্জিল’, তাঁর ঠাকুরদার ঠাকুরদার হাতে তৈরি। বহুকাল ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, বাংলার এক নিভৃত পল্লীর গভীরে। আর্ণবের বাবা বহুবার এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আর্ণব রাজি হননি। তাঁর মনে হত, এই ইঁটের পরতে পরতে যেন লুকিয়ে আছে তাঁর পূর্বপুরুষদের গল্প, তাঁদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। তাছাড়া, তাঁর স্থপতি সত্তা এই জরাজীর্ণ স্থাপত্যের মধ্যে এক সুপ্ত সৌন্দর্য খুঁজে পেত। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই বাড়িকে নতুন করে সাজিয়ে তুলবেন, একে আবার প্রাণবন্ত করে তুলবেন। শীতের এক সকালে, আর্ণব তাঁর পুরনো জিপ নিয়ে রওনা দিলেন রায় মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে। তাঁর সাথে ছিল শুধু তাঁর ল্যাপটপ, কিছু নকশার খাতা আর অদম্য জেদ। পথ যত এগোচ্ছিল, ততই জনবসতি পাতলা হয়ে আসছিল। পিচঢালা রাস্তা শেষ হয়ে শুরু হয়েছিল লাল মাটির মেঠো পথ। দু’পাশে সারি সারি তালগাছ আর সুপারি বাগান, মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল ছোট ছোট গ্রাম, মাটির বাড়ি আর ধুলোমাখা শিশুরা। বেলা গড়িয়ে যখন তিনি রায় মঞ্জিলের ফটকের সামনে পৌঁছালেন, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বিশাল লোহার ফটকটা মরচে ধরে লাল হয়ে আছে, তার ওপর লতিয়ে উঠেছে অজস্র বুনো লতা। ফটকের পাশেই একটা পুরনো ভাঙা সাইনবোর্ড, তাতে আবছা অক্ষরে লেখা ‘রায় মঞ্জিল’। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আর্ণব। এই বাড়িকে আবার তার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে দিতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা চাপা গোঙানির মতো শব্দ হল। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে কব্জাগুলো জং ধরেছে। ভেতরে ঢুকেই আর্ণব থমকে গেলেন। বিশাল উঠোনটা আগাছায় ভরে আছে, মাঝখানে একটা শুকনো পুকুর, তার পাড়ে একটা ভাঙা শানবাঁধানো ঘাট। আর তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রায় মঞ্জিল – এক বিশাল, ধূসর রঙের বাড়ি, যার জানালার কাঁচগুলো ভাঙা, দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, আর ছাদের কার্নিশে বাসা বেঁধেছে অসংখ্য বাদুড়। বাড়িটা যেন এক প্রাচীন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু তার গভীরে লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য। আর্ণব গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মূল দরজাটা কাঠের, তাতে নকশা করা। দরজার কড়াটা ধরে টানতেই একটা কর্কশ আওয়াজ হল, যেন বহুদিনের ঘুম ভাঙলো কোনো প্রাচীন প্রাণীর। দরজাটা খুলতেই একটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর্ণবের নাকে এসে লাগলো। ভেতরে অন্ধকার, দিনের আলোও যেন এই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। তিনি মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রথমেই বিশাল হলঘর। চারপাশে ধুলোর আস্তরণ, মাকড়সার জাল, আর পুরনো আসবাবপত্রের আবছা ছায়া। হলঘরের মাঝখানে একটা বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, তার কাঁচগুলো ভাঙা, তাতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। আর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই বাড়ি পরিষ্কার করতে অনেক লোক লাগবে। তিনি সাবধানে পা ফেলে এগোতে লাগলেন। হলঘরের ডানদিকে একটা বড় সিঁড়ি, তার রেলিংগুলো ভাঙা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই একটা চাপা খসখস শব্দ হল। আর্ণব থমকে দাঁড়ালেন। শব্দটা যেন খুব কাছ থেকে আসছে। তিনি ফ্ল্যাশলাইট ঘুরিয়ে দেখলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। হয়তো কোনো ইঁদুর বা বাদুড় হবে, নিজেকে বোঝালেন তিনি। দোতলায় উঠে তিনি একটা ঘর বেছে নিলেন, যেটা তুলনামূলকভাবে কম ভাঙাচোরা। ঘরটা বেশ বড়, তাতে একটা পুরনো খাট আর একটা আলমারি ছিল। তিনি তাঁর ব্যাগটা খাটের এক কোণে রেখে জানালাটা খোলার চেষ্টা করলেন। জানালাটা জং ধরে আটকে ছিল। অনেক কষ্টে সেটা খুলতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস আর ভেজা মাটির গন্ধ ঘরে ঢুকলো। বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার আবছা আলোয় রায় মঞ্জিলকে আরও রহস্যময় দেখাচ্ছে। আর্ণব ভাবলেন, আজ রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে কাল সকালে লোকজনের খোঁজ করবেন। তিনি গাড়িতে রাখা কিছু শুকনো খাবার বের করে খেলেন। তারপর নিজের স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম তাঁর চোখে আসছিল না। বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে যেন চাপা আওয়াজ ভেসে আসছিল – পুরনো কাঠের মড়মড় শব্দ, বাতাসের শিস, আর মাঝে মাঝে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। তাঁর মনে হল, এই বাড়িটা যেন শ্বাস নিচ্ছে, আর সেই শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দই তাঁকে ঘিরে রেখেছে। রাত গভীর হচ্ছিল। আর্ণব পাশ ফিরলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, কেউ যেন তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলল। তিনি চমকে উঠলেন। উঠে বসে চারদিকে তাকালেন। ঘরের ভেতরে জমাট অন্ধকার, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আবছা আলো এসে পড়েছে। কিছুই দেখতে পেলেন না। “কে?” আর্ণব ফিসফিস করে বললেন। কোনো উত্তর নেই। শুধু বাতাসের শব্দ আর তাঁর নিজের হৃৎপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন। তিনি নিজেকে বোঝালেন, এটা তাঁর মনের ভুল, ক্লান্তির কারণে এমনটা হচ্ছে। কিন্তু একটা অস্বস্তি তাঁর মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তিনি আবার শুয়ে পড়লেন, চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করলেন ঘুমিয়ে পড়ার। কিন্তু এবার একটা ঠান্ডা অনুভূতি তাঁর পায়ের পাতা থেকে শিরশির করে উঠে আসতে লাগল। যেন বরফ শীতল কোনো কিছু তাঁর পায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর্ণব চোখ খুললেন। অন্ধকার ঘরে তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলেন, সেই ঠান্ডা অনুভূতিটা ধীরে ধীরে তাঁর শরীর বেয়ে উপরে উঠে আসছে। তাঁর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল, হৃৎপিণ্ড দ্রুত তালে ধুকপুক করছিল। তিনি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলেন। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে পায়ের দিকে তাকালেন। কিছুই নেই। শুধু তাঁর স্লিপিং ব্যাগটা পড়ে আছে। কিন্তু সেই ঠান্ডা অনুভূতিটা তখনও তাঁর শরীরে লেপ্টে আছে, যেন অদৃশ্য কোনো সত্তা তাঁকে ছুঁয়ে আছে। আর্ণব ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তিনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু এই অনুভূতিটা এত বাস্তব যে তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না। তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে তাঁর মনে হল, কেউ যেন তাঁর পিছু পিছু আসছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি যেন শুনতে পাচ্ছিলেন, তাঁর পেছনে আরও একটা অদৃশ্য পায়ের শব্দ। হলঘরে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। চাঁদের আলোয় হলঘরের মাঝখানে থাকা ঝাড়লণ্ঠনটার দিকে তাঁর চোখ পড়ল। এতক্ষণ সেটা স্থির ছিল, কিন্তু এখন সেটা ধীরে ধীরে দুলছে। যেন কেউ সেটাকে আলতো করে ঠেলে দিয়েছে। আর সেই দুলুনির সাথে সাথে একটা চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কোনো ক্রন্দন। আর্ণবের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তিনি একা নন এই বাড়িতে। তাঁর সাথে আরও কেউ আছে, যেটাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার উপস্থিতি তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন। তাঁর যুক্তি, তাঁর বিশ্বাস – সব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল এই বাড়ির অশরীরী উপস্থিতির সামনে। তিনি দ্রুত ফটকের দিকে ছুটলেন। গাড়িটা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে পৌঁছালেন। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই তিনি দ্রুত ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট হল না। তিনি আবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারও ব্যর্থ। ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে! আর্ণব হতাশ হয়ে স্টিয়ারিং-এ মাথা রাখলেন। তিনি এই বাড়ির ফাঁদে আটকা পড়েছেন। আর সেই মুহূর্তে, তাঁর গাড়ির পেছনের কাঁচের ওপর একটা ঠান্ডা, অদৃশ্য হাত যেন আলতো করে স্পর্শ করল। তিনি আয়নায় তাকালেন। আবছা চাঁদের আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একটা অস্পষ্ট, ছায়াময় আকৃতি তাঁর গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ দুটো যেন অন্ধকারের গভীরে জ্বলছে। ছায়াটা ধীরে ধীরে গাড়ির আরও কাছে এগিয়ে এল। আর্ণব শ্বাসরুদ্ধ করে তাকিয়ে রইলেন। ছায়াটা যেন গাড়ির কাঁচের মধ্য দিয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়াল। সেই অদৃশ্য হাতের শীতল স্পর্শ আর্ণবের কাঁধে অনুভব করলেন তিনি। তাঁর শরীর হিম হয়ে গেল। তাঁর মনে হল, যেন তার হৃৎপিণ্ডটা বুকের খাঁচার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ, ছায়াটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটি আবছা নারীমূর্তি, তার চুলগুলো এলোমেলো, চোখগুলো কোটরাগত। তার মুখটা বিকৃত, যেন তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে। আর্ণব সেই মুখ দেখে চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। ভয়ে তাঁর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। নারীমূর্তিটা গাড়ির কাঁচের ওপর তার হাত রাখল। আর্ণব স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তার হাতের আঙুলগুলো যেন কাঁচের ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে, আর যেখানেই তার আঙুল স্পর্শ করছে, সেখানেই কাঁচের ওপর একটা ঠান্ডা বাষ্পের মতো দাগ পড়ছে। নারীমূর্তিটা তার মুখটা গাড়ির কাঁচের আরও কাছে নিয়ে এল। আর্ণব এবার তার ফিসফিসানি স্পষ্ট শুনতে পেলেন। “পালাতে পারবে না… কেউ পারে না… এই বাড়ি কাউকে ছাড়েনি…” শব্দগুলো যেন সরাসরি তাঁর মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল, প্রতিটি শব্দে তীব্র যন্ত্রণা আর হতাশা মিশে ছিল। আর্ণবের মনে হল, তাঁর মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন, আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। তাঁর শরীর কাঁপছিল থরথর করে। যখন তিনি আবার চোখ খুললেন, তখন নারীমূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। গাড়ির কাঁচের ওপর শুধু সেই বাষ্পের দাগগুলো রয়ে গেছে, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আর্ণব দ্রুত হাতে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মনে হল, এই বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকা নিরাপদ নয়। তিনি ছুটতে শুরু করলেন, ফটকের দিকে। কিন্তু ফটকের সামনে গিয়ে তিনি থমকে গেলেন। বিশাল লোহার ফটকটা, যেটা তিনি নিজেই খুলে ভেতরে ঢুকেছিলেন, সেটা এখন বন্ধ! আর তার ওপর লতিয়ে থাকা বুনো লতাগুলো যেন আরও ঘন হয়ে ফটককে পেঁচিয়ে ধরেছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বন্ধ করে রেখেছে। আর্ণব ফটকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সেটা খোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেটা নড়ল না এক চুলও। তিনি প্রাণপণে ধাক্কা দিতে লাগলেন, কিন্তু ফটকটা যেন পাথরের মতো অনড়। তাঁর হাত-পা ব্যথা করতে লাগল, কিন্তু তিনি থামলেন না। তার মনে হচ্ছিল, যদি তিনি এই ফটক খুলতে না পারেন, তাহলে তিনি এই বাড়ির ফাঁদে চিরকালের জন্য আটকা পড়ে যাবেন। হঠাৎ, ফটকের ওপাশ থেকে একটা চাপা হাসির শব্দ ভেসে এল। সেই হাসিটা যেন বাতাসের সাথে মিশে তার কানের কাছে বাজছিল, আর সেই হাসিতে ছিল এক অদ্ভুত শীতলতা, যা আর্ণবের রক্ত হিম করে দিল। তিনি দ্রুত পেছনে ফিরলেন। বাড়ির বারান্দায়, আবছা চাঁদের আলোয়, তিনি আবার সেই নারীমূর্তিটাকে দেখতে পেলেন। এবার সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ দুটো যেন অন্ধকারের গভীরে জ্বলছে। তার মুখে একটা বিকৃত হাসি, যা আর্ণবের মনে ভয়ের এক শীতল স্রোত বইয়ে দিল। নারীমূর্তিটা ধীরে ধীরে তার হাত তুলল, আর তার আঙুল দিয়ে বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল। আর্ণবের মনে হল, সে যেন তাকে বাড়ির ভেতরে ফিরে যেতে বলছে। তার এই নীরব ইঙ্গিত আর্ণবের মনে এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করল। তিনি বুঝতে পারলেন, এই বাড়ি থেকে পালানো সহজ হবে না। আর্ণব ফটকের দিকে আবার ফিরলেন, কিন্তু এবার তার চোখে এক নতুন দৃঢ়তা। তিনি জানেন, তাকে এই ফটক খুলতেই হবে। তার জীবন এখন এই ফটকের ওপর নির্ভর করছে। তিনি আবার ফটক ঠেলতে শুরু করলেন, এবার আরও জোরে, আরও মরিয়া হয়ে। তার মনে হচ্ছিল, তার পেছনে সেই অশরীরী ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে, আর তার ঠান্ডা শ্বাস যেন তার ঘাড়ের কাছে অনুভব করতে পারছেন তিনি। ফটকটা নড়ছে না, কিন্তু আর্ণব হাল ছাড়লেন না। তার মনে হল, যদি সে এখানেই থেমে যায়, তাহলে সে চিরকালের জন্য এই বাড়ির ফাঁদে আটকা পড়ে যাবে। তার মনে এক তীব্র বাঁচার আকাঙ্ক্ষা জন্মালো। সে জানে, তাকে বাঁচতে হবে, এই অশরীরী ফাঁদ থেকে তাকে বের হতেই হবে। হঠাৎ, তার মনে হল, ফটকের একটি কব্জা যেন একটু আলগা হয়েছে। সে সেই কব্জার ওপর তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল। একটা কর্কশ শব্দ হল, আর ফটকটা একটু নড়ে উঠল। আর্ণবের মনে এক নতুন আশা জন্মালো। সে আবার ধাক্কা মারল, এবার আরও জোরে। আর সেই মুহূর্তে, বাড়ির ভেতর থেকে একটা বিকট শব্দ ভেসে এল। যেন কোনো ভারী জিনিস ভেঙে পড়ল। আর্ণব চমকে উঠলেন। তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন, বাড়ির দোতলার একটি জানালার কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়ছে। আর সেই ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে, তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, সেই নারীমূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ দুটো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, আর তার মুখে সেই বিকৃত হাসিটা আরও চওড়া হয়েছে। আর্ণব বুঝতে পারলেন, এই বাড়ি তাকে সহজে ছাড়বে না। সে যেন তাকে নিজের ভেতরে টেনে নিতে চাইছে, তাকে তার অংশ করে নিতে চাইছে। কিন্তু আর্ণব হাল ছাড়ার পাত্র নন। সে জানে, তাকে লড়তে হবে, এই অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে তাকে জিততেই হবে। সে আবার ফটকের দিকে ফিরল। তার মনে হল, তার পেছনে সেই নারীমূর্তিটা যেন আরও কাছে চলে এসেছে, তার ঠান্ডা শ্বাস যেন তার ঘাড়ের কাছে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন তিনি। সে জানে, তার হাতে বেশি সময় নেই। তাকে দ্রুত এই ফটক খুলতে হবে, নইলে সে চিরকালের জন্য এই বাড়ির ফাঁদে আটকা পড়ে যাবে। আর্ণব তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ফটকে শেষ ধাক্কা মারল। একটা বিকট শব্দ হল, আর ফটকের একটি কব্জা ভেঙে গেল। ফটকটা একটু খুলে গেল। আর্ণব সেই খোলা ফাঁক দিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি থামলেন না, ছুটতে লাগলেন যত দ্রুত সম্ভব। তার মনে হল, তার পেছনে সেই অশরীরী ছায়াটা যেন তার পিছু পিছু আসছে, তার ঠান্ডা শ্বাস যেন তার ঘাড়ের কাছে অনুভব করতে পারছেন তিনি। তিনি ছুটতে ছুটতে গ্রামের দিকে এগোতে লাগলেন। তার মনে হল, গ্রামের আলো দেখলে হয়তো সে শান্তি পাবে। কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – এই বাড়িটা কেন তাকে ছাড়ছে না? এই বাড়ির রহস্য কী? আর সেই নারীমূর্তিটা কে? আর্ণব জানে, এই প্রশ্নের উত্তর তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এই রাতটা ছিল শুধু শুরু। রায় মঞ্জিলের অশরীরী ছায়া তাকে এত সহজে ছাড়বে না। দ্বিতীয় অধ্যায়: গ্রামের অন্ধকারে এক নতুন আতঙ্ক আর্ণব ছুটছিল। তার ফুসফুস ফেটে যাওয়ার উপক্রম, পায়ের পেশিগুলো তীব্র ব্যথায় টনটন করছে, কিন্তু সে থামল না। তার মনে হচ্ছিল, যদি সে এক মুহূর্তের জন্য থামে, তাহলে সেই অশরীরী ছায়া তাকে গ্রাস করে ফেলবে। রাতের অন্ধকার, গ্রামের মেঠো পথের দু’পাশের গাছপালাগুলো যেন প্রেতাত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ছায়াগুলো আরও দীর্ঘ, আরও ভীতিকর দেখাচ্ছে। অনেকক্ষণ ছোটার পর, দূরে আবছা আলোর রেখা দেখতে পেল আর্ণব। গ্রামের আলো! তার মনে এক নতুন আশা জন্মালো। সে আরও জোরে ছুটতে লাগল। অবশেষে, সে গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁছাল। একটা ছোট চায়ের দোকান, তার সামনে একটা টিমটিমে লণ্ঠন জ্বলছে। দোকানের বেঞ্চিতে কয়েকজন গ্রামবাসী বসে গল্প করছিল। আর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চেহারা দেখে গ্রামবাসীরা চমকে উঠল। তার জামাকাপড় ধুলোয় মাখা, চুল এলোমেলো, চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত। “কী হয়েছে বাবু? এমন করে ছুটছেন কেন?” একজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী প্রশ্ন করল। আর্ণব কোনোমতে শ্বাস নিয়ে বলল, “রায় মঞ্জিল… ও বাড়িটা… ওটা ভূতুড়ে!” গ্রামবাসীরা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে অবিশ্বাস আর ভয় মেশানো এক অদ্ভুত দৃষ্টি। একজন যুবক বলল, “রায় মঞ্জিল? ও তো অনেকদিন ধরে পরিত্যক্ত। কেউ ওদিকে যায় না।” “আমি গিয়েছিলাম… বাড়িটা… বাড়িটা আমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল… একটা ছায়া… একটা নারীমূর্তি…” আর্ণব কথাগুলো বলতে গিয়ে কাঁপছিল। বৃদ্ধ গ্রামবাসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা জানি বাবু। ও বাড়িটা অভিশপ্ত। বহু বছর ধরে কেউ ওদিকে যায় না। যারা গেছে, তারা আর ফিরে আসেনি, নয়তো পাগল হয়ে ফিরেছে।” আর্ণব অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকাল। “আপনারা জানেন? তাহলে আমাকে আগে বলেননি কেন?” “কে জানত আপনি ওদিকে যাবেন? আর আমরা তো ভেবেছিলাম, ওসব পুরনো দিনের কথা। এখন আর কেউ ভূতে বিশ্বাস করে না।” যুবকটি বলল। আর্ণব তাদের কথা শুনে আরও হতাশ হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল, এই গ্রামবাসীরা তাকে সাহায্য করতে পারবে না। তারা নিজেরাই ভয়ে কুঁকড়ে আছে। বৃদ্ধ বলল, “আজ রাতটা আমাদের এখানেই থাকুন বাবু। কাল সকালে আমরা আপনাকে শহরে ফেরার ব্যবস্থা করে দেব।” আর্ণব রাজি হল। তার শরীর আর চলছিল না। সে দোকানের এক কোণে বসে পড়ল। গ্রামবাসীরা তাকে এক গ্লাস জল দিল। জল খেয়ে আর্ণব একটু ধাতস্থ হল। “ওই বাড়িটা কেন অভিশপ্ত? কী হয়েছিল ওখানে?” আর্ণব প্রশ্ন করল। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “বহু বছর আগে, ওই বাড়িতে রায় পরিবারের শেষ বংশধররা থাকত। জমিদার রায়বাহাদুর আর তাঁর স্ত্রী। তাদের একটি মেয়ে ছিল, নাম ছিল অপর্ণা। খুব শান্ত, সুন্দরী মেয়ে ছিল। কিন্তু তার কপালে সুখ ছিল না.” বৃদ্ধের কথা শুনে আর্ণবের কৌতূহল বেড়ে গেল। “কী হয়েছিল অপর্ণার সাথে?” “অপর্ণার বিয়ে ঠিক হয়েছিল পাশের গ্রামের এক জমিদারের ছেলের সাথে। কিন্তু বিয়ের দিনই অপর্ণা নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। তার বাবা-মা অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হল না। কিছুদিন পর, রায়বাহাদুর আর তাঁর স্ত্রীও রহস্যজনকভাবে মারা যান। তারপর থেকেই বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। আর গ্রামের লোকজনের মুখে মুখে রটে গেল, অপর্ণার আত্মা নাকি ওই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। সে নাকি তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়।” আর্ণব বৃদ্ধের কথা শুনে শিউরে উঠল। তার মনে পড়ল, গাড়ির কাঁচের ওপর দেখা সেই নারীমূর্তিটার কথা। তার মুখটা বিকৃত ছিল, যেন তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে। তাহলে কি সেটাই অপর্ণার আত্মা? “কিন্তু কেন? কেন সে প্রতিশোধ নিতে চায়?” আর্ণব প্রশ্ন করল। বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “সেটা কেউ জানে না বাবু। অনেকে বলে, তাকে নাকি খুন করা হয়েছিল। আবার অনেকে বলে, সে নাকি আত্মহত্যা করেছিল। আসল সত্যটা কেউ জানে না।” আর্ণব গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মনে হল, এই বাড়ির রহস্যের গভীরে কিছু একটা লুকিয়ে আছে, যা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। সে একজন যুক্তিবাদী মানুষ, কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে জানে, এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। রাত বাড়ছিল। গ্রামবাসীরা একে একে তাদের বাড়িতে চলে গেল। শুধু বৃদ্ধ আর যুবকটি দোকানে রইল। আর্ণব দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার চোখে ঘুম ছিল না। তার কানে বাজছিল সেই নারীমূর্তিটার ফিসফিসানি – “পালাতে পারবে না… কেউ পারে না… এই বাড়ি কাউকে ছাড়েনি…” হঠাৎ, সে শুনতে পেল, দোকানের বাইরে একটা চাপা গোঙানির শব্দ। আর্ণব চমকে উঠল। সে দ্রুত উঠে বসল। বৃদ্ধ আর যুবকটিও শব্দটা শুনতে পেয়েছিল। তাদের চোখেও ভয়। “কীসের শব্দ এটা?” যুবকটি ফিসফিস করে বলল। বৃদ্ধ লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে দোকানের বাইরে উঁকি দিল। বাইরে জমাট অন্ধকার, শুধু চাঁদের আবছা আলোয় গাছপালাগুলো দেখা যাচ্ছে। কোনো কিছু দেখতে পেল না। “হয়তো কোনো শেয়াল হবে,” বৃদ্ধ বলল, কিন্তু তার গলাতেও ভয়ের রেশ। কিন্তু আর্ণব জানত, এটা শেয়ালের শব্দ নয়। এই শব্দটা তার চেনা। এই শব্দটা সে রায় মঞ্জিলে শুনেছিল। এটা সেই চাপা গোঙানির শব্দ, যা তাকে আতঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছিল। শব্দটা আবার শোনা গেল, এবার আরও স্পষ্ট। যেন কেউ তীব্র যন্ত্রণায় কাঁদছে। শব্দটা যেন দোকানের আরও কাছে চলে আসছে। আর্ণব অনুভব করতে পারছিল, তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত তালে ধুকপুক করছে। বৃদ্ধ আর যুবকটি ভয়ে জড়সড় হয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারা দরজা বন্ধ করে দিল। আর্ণব জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। আর তখনই সে দেখতে পেল। দোকানের বাইরে, আবছা চাঁদের আলোয়, সেই অস্পষ্ট ছায়াময় আকৃতিটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই নারীমূর্তিটা! তার চোখ দুটো যেন অন্ধকারের গভীরে জ্বলছে, আর তার মুখটা বিকৃত, তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে। আর্ণব ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে ভেবেছিল, গ্রাম পর্যন্ত আসতে পারলে সে নিরাপদ। কিন্তু সে ভুল ছিল। রায় মঞ্জিলের অশরীরী ছায়া তাকে অনুসরণ করে এখানেও চলে এসেছে। নারীমূর্তিটা ধীরে ধীরে দোকানের দিকে এগিয়ে এল। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। আর্ণব অনুভব করতে পারছিল, দোকানের ভেতরেও ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে, তার লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে উঠছে। নারীমূর্তিটা দোকানের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতটা ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে এল। আর্ণব, বৃদ্ধ আর যুবকটি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারা শুনতে পেল, দরজার কড়াটা যেন আলতো করে নড়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর, কোনো শব্দ না পেয়ে আর্ণব ধীরে ধীরে চোখ খুলল। নারীমূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। দোকানের বাইরে শুধু জমাট অন্ধকার। কিন্তু তাদের মনে সেই ভয়ের রেশ তখনও রয়ে গেছে। বৃদ্ধ বলল, “ও আমাদের ছাড়বে না বাবু। ও আমাদের শান্তি দেবে না।” আর্ণব বুঝতে পারছিল, বৃদ্ধ ঠিকই বলছে। এই অশরীরী ছায়া তাকে ছাড়বে না, যতক্ষণ না সে এই বাড়ির রহস্যের সমাধান করতে পারছে। তার মনে এক নতুন দৃঢ়তা জন্মালো। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে রায় মঞ্জিলের রহস্যের সমাধান করবেই। সে জানে, এটা বিপজ্জনক হবে, কিন্তু তার আর কোনো উপায় নেই। সে এই ভূতুড়ে বাড়ির ফাঁদে আটকা পড়েছে, আর এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার একটাই পথ – রহস্যের গভীরে প্রবেশ করা। পরদিন সকালে, আর্ণব গ্রামবাসীদের কাছ থেকে বিদায় নিল। সে তাদের বলল, সে শহরে ফিরে যাবে। কিন্তু তার মনে ছিল অন্য পরিকল্পনা। সে জানে, তাকে আবার রায় মঞ্জিলে ফিরতে হবে। তবে এবার সে একা যাবে না। সে এমন কাউকে খুঁজবে, যে তাকে এই রহস্য সমাধানে সাহায্য করতে পারে। তার মনে হল, এই রহস্যের সমাধান করতে হলে তাকে রায় পরিবারের ইতিহাস, বিশেষ করে অপর্ণার ইতিহাস জানতে হবে। তৃতীয় অধ্যায়: শহরের পথে নতুন সঙ্গী শহরে ফিরে আসার পর আর্ণব নিজেকে এক অদ্ভুত শূন্যতার মধ্যে আবিষ্কার করল। তার পরিচিত শহর, তার ব্যস্ত কর্মজীবন, সবই যেন অর্থহীন মনে হচ্ছিল। তার মন জুড়ে শুধু রায় মঞ্জিল আর সেই অশরীরী নারীমূর্তি। সে জানে, এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। প্রথমেই সে তার বাবার সাথে দেখা করল। বাবা রায় মঞ্জিলের কথা তুলতেই আর্ণব তাকে থামিয়ে দিল। সে জানে, বাবা এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করবেন না, বরং তাকে পাগল ভাববেন। তাই সে শুধু বলল যে, বাড়িটা সংস্কারের জন্য আরও বেশি সময় এবং লোকবল লাগবে। বাবা কিছুটা বিরক্ত হলেও রাজি হলেন। আর্ণব এবার তার পুরনো বন্ধু, ইতিহাসবিদ এবং লোককথার গবেষক, ডঃ সুমিত সেনগুপ্তের সাথে যোগাযোগ করল। সুমিত সবসময়ই রহস্যময় বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিল, তাই আর্ণব মনে মনে জানত, সুমিতই তাকে সাহায্য করতে পারবে। সুমিতের সাথে দেখা হতেই আর্ণব তাকে সব খুলে বলল। রায় মঞ্জিলে তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা, গাড়ির কাঁচের ওপর সেই নারীমূর্তির উপস্থিতি, তার ফিসফিসানি, ফটকের বন্ধ হয়ে যাওয়া, এবং গ্রামে সেই ছায়ার অনুসরণ – সবটাই সে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করল। সুমিত মনোযোগ দিয়ে আর্ণবের কথা শুনল, তার চোখে কৌতূহল আর বিস্ময়। “আর্ণব, তুমি যা বলছ, তা অবিশ্বাস্য,” সুমিত বলল। “কিন্তু তোমার চোখে যে ভয় দেখছি, তা মিথ্যে হতে পারে না। রায় মঞ্জিল নিয়ে কিছু পুরনো লোককথা আমি শুনেছি, কিন্তু সেগুলো শুধুই গল্প বলে মনে করতাম।” “গল্প নয় সুমিত, এটা বাস্তব। আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি,” আর্ণব জোর দিয়ে বলল। “আর গ্রামের বৃদ্ধ যা বলল, অপর্ণার গল্প… আমার মনে হয়, এর পেছনে কোনো সত্য লুকিয়ে আছে।” সুমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “অপর্ণা… হ্যাঁ, এই নামটা আমার চেনা। রায় পরিবারের ইতিহাস নিয়ে আমি কিছু পুরনো নথিপত্র দেখেছি। কিন্তু অপর্ণার নিখোঁজ হওয়া বা তার বাবা-মায়ের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। শুধু কিছু অস্পষ্ট উল্লেখ আছে।” “আমাদের সেই অস্পষ্ট তথ্যগুলোই খুঁজে বের করতে হবে, সুমিত। আমার মনে হয়, অপর্ণার মৃত্যুর পেছনে কোনো গভীর রহস্য আছে, যা ওই অশরীরী সত্তাকে আটকে রেখেছে,” আর্ণব বলল। “কিন্তু কেন তুমি এই ঝুঁকি নিতে চাইছ? তুমি তো বাড়িটা ছেড়ে চলে আসতে পারতে,” সুমিত প্রশ্ন করল। আর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না কেন। হয়তো আমার পূর্বপুরুষদের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা, অথবা হয়তো সেই অশরীরী সত্তা আমাকে ছাড়ছে না। আমার মনে হচ্ছে, আমি এই রহস্যের সাথে জড়িয়ে গেছি, আর এর সমাধান না করা পর্যন্ত আমি মুক্তি পাব না।” সুমিত আর্ণবের চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখতে পেল। সে বুঝতে পারল, আর্ণবকে থামানো যাবে না। “ঠিক আছে, আর্ণব। আমি তোমার সাথে আছি। কিন্তু এটা সহজ হবে না। আমরা এক এমন কিছুর মুখোমুখি হতে চলেছি, যা আমাদের যুক্তির বাইরে।” “আমি জানি,” আর্ণব বলল। “কিন্তু আমি একা নই, তুমি আছ।” পরের কয়েকদিন আর্ণব আর সুমিত রায় পরিবারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করল। তারা শহরের পুরনো লাইব্রেরি, সংরক্ষণাগার এবং কিছু প্রবীণ ইতিহাসবিদের সাথে যোগাযোগ করল। কিন্তু রায় মঞ্জিল এবং অপর্ণা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া গেল না। যা কিছু পাওয়া গেল, তা ছিল অস্পষ্ট এবং পরস্পরবিরোধী। তারা জানতে পারল, রায় পরিবার এককালে খুব প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের পতন শুরু হয়। অপর্ণার নিখোঁজ হওয়া এবং তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর রায় মঞ্জিল দ্রুত পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কিছু পুরনো পত্রিকায় অপর্ণার নিখোঁজ হওয়ার খবর ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলোতেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না, শুধু অনুমান আর গুজব। একদিন, সুমিত একটি পুরনো পারিবারিক ডায়েরির খোঁজ পেল। ডায়েরিটি রায় পরিবারের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে ছিল, যিনি এটি বহু বছর ধরে সযত্নে রেখেছিলেন। ডায়েরিটি ছিল রায়বাহাদুরের ছোট ভাই, প্রমথ রায়ের লেখা। প্রমথ রায় ছিলেন একজন শিল্পী এবং কিছুটা নিভৃতচারী মানুষ। ডায়েরিটি হাতে পেয়ে আর্ণব আর সুমিতের মনে এক নতুন আশা জন্মালো। হয়তো এই ডায়েরিতেই লুকিয়ে আছে রায় মঞ্জিলের রহস্যের চাবিকাঠি। ডায়েরির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, অক্ষরগুলো আবছা, কিন্তু প্রতিটি পাতায় যেন এক চাপা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। তারা ডায়েরি পড়া শুরু করল। প্রথম দিকের পাতাগুলোতে প্রমথ রায়ের দৈনন্দিন জীবন, তার শিল্পচর্চা এবং রায় পরিবারের সুখ-দুঃখের বর্ণনা ছিল। কিন্তু যত তারা ডায়েরির গভীরে প্রবেশ করতে লাগল, ততই এক অন্ধকার সত্য তাদের সামনে উন্মোচিত হতে লাগল। ডায়েরির মাঝের কিছু পাতায় অপর্ণার কথা লেখা ছিল। প্রমথ রায় অপর্ণাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি অপর্ণার সৌন্দর্য, তার শান্ত স্বভাবের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ডায়েরির সুর পাল্টে গেল। প্রমথ রায় অপর্ণার আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। অপর্ণা নাকি মাঝে মাঝে উদাস হয়ে থাকত, একা একা কথা বলত, আর তার চোখে এক অদ্ভুত ভয় দেখা যেত। “আমার মনে হয়, অপর্ণা কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে,” প্রমথ রায় ডায়েরিতে লিখেছিলেন। “সে যেন অন্য কোনো সত্তার দ্বারা আচ্ছন্ন। আমি তাকে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু সে আমাকে কিছু বলতে চাইছে না।” আর্ণব আর সুমিত একে অপরের দিকে তাকাল। “অন্য কোনো সত্তা?” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। “তাহলে কি অপর্ণা শুধু নিখোঁজ হয়নি, তার সাথে আরও কিছু ঘটেছিল?” ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলো আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। প্রমথ রায় লিখেছিলেন যে, অপর্ণা নাকি রাতের বেলা বাড়ির ভেতরে অদ্ভুত শব্দ শুনত, আর সে নাকি মাঝে মাঝে এমন কিছু দেখতে পেত, যা অন্য কেউ দেখতে পেত না। প্রমথ রায় নিজে কিছু অদ্ভুত ঘটনা অনুভব করতে শুরু করেছিলেন, যেমন ঠান্ডা অনুভূতি, চাপা ফিসফিসানি, আর অদৃশ্য ছায়ার উপস্থিতি। “আমি বুঝতে পারছি না, এই বাড়িতে কী হচ্ছে,” প্রমথ রায় লিখেছিলেন। “আমার ভাই, রায়বাহাদুর, এসব বিশ্বাস করতে চান না। তিনি মনে করেন, অপর্ণা অসুস্থ। কিন্তু আমি জানি, এটা তার চেয়েও গভীর কিছু।” ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। প্রমথ রায় লিখেছিলেন যে, অপর্ণার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। সে নাকি মাঝে মাঝে উন্মত্ত হয়ে যেত, আর তার চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে জ্বলত। এক রাতে, প্রমথ রায় অপর্ণার ঘর থেকে এক বিকট চিৎকার শুনতে পান। তিনি দ্রুত অপর্ণার ঘরে ছুটে যান, কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখলেন, তা তাকে স্তম্ভিত করে দিল। ডায়েরির সেই পাতাটি এখানে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি অংশটি ছেঁড়া ছিল, অথবা হয়তো লেখা হয়নি। আর্ণব আর সুমিত হতাশ হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। তারা রহস্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, কিন্তু শেষ অংশটি তাদের কাছে অধরাই রয়ে গেল। “তাহলে অপর্ণার সাথে কী হয়েছিল?” আর্ণব প্রশ্ন করল। “আর সেই বিকট চিৎকারের পর কী ঘটেছিল?” “মনে হচ্ছে, এই ডায়েরিটা আমাদের রায় মঞ্জিলের রহস্যের গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,” সুমিত বলল। “কিন্তু শেষ অংশটা না জানা পর্যন্ত আমরা কিছুই নিশ্চিত হতে পারছি না.” আর্ণব ডায়েরিটা হাতে নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মনে হল, এই ডায়েরির শেষ অংশটা হয়তো রায় মঞ্জিলেই লুকিয়ে আছে। আর সেই শেষ অংশটা খুঁজে বের করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। সে জানে, আবার রায় মঞ্জিলে ফেরা মানেই মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেওয়া। কিন্তু তার মনে এক অদ্ভুত জেদ চেপে বসেছে। সে জানে, এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। “আমাদের আবার রায় মঞ্জিলে ফিরতে হবে, সুমিত,” আর্ণব বলল। “ডায়েরির বাকি অংশটা হয়তো ওখানেই আছে।” সুমিত আর্ণবের দিকে তাকাল। তার চোখে উদ্বেগ, কিন্তু তার সাথে এক ধরনের কৌতূহলও ছিল। “তুমি নিশ্চিত?” “আমি নিশ্চিত,” আর্ণব বলল। “আর এবার আমরা একা যাব না। আমাদের এমন কাউকে দরকার, যে এই ধরনের অশরীরী শক্তিকে মোকাবেলা করতে পারে।” সুমিত কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, “আমার একজন পরিচিত আছে। একজন প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর। তার নাম রুদ্র। সে এই ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করে। হয়তো সে আমাদের সাহায্য করতে পারবে।” আর্ণবের মনে এক নতুন আশার আলো দেখা দিল। রুদ্র! হয়তো এই রুদ্রই তাদের রায় মঞ্জিলের রহস্য সমাধানে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু সে জানে না, রুদ্র কি তাদের এই ভয়ঙ্কর যাত্রায় সঙ্গী হতে রাজি হবে কিনা। আর রায় মঞ্জিল কি তাদের এবারও সহজে ছাড়বে? চতুর্থ অধ্যায়: রুদ্রের আগমন ও প্রস্তুতি সুমিত রুদ্রকে ফোন করল। রুদ্রের সাথে সুমিতের পরিচয় হয়েছিল একটি লোককথা বিষয়ক সেমিনারে। রুদ্রের কাজ সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও, তার গবেষণা এবং অভিজ্ঞতা সুমিতকে মুগ্ধ করেছিল। রুদ্র একজন পেশাদার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর, যার কাছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রাচীন লোকবিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ছিল। রুদ্রের সাথে দেখা করতে আর্ণব আর সুমিত তার অফিসে গেল। অফিসটা শহরের এক কোলাহলপূর্ণ এলাকায় হলেও, ভেতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। চারদিকে পুরনো বই, অদ্ভুত যন্ত্রপাতির ছড়াছড়ি, আর ধূপের মৃদু গন্ধ। রুদ্র একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে হালকা দাড়ি। তাকে দেখে মনে হয়, সে যেন কোনো প্রাচীন গ্রন্থাগারের রক্ষক। আর্ণব আর সুমিতকে বসতে বলে রুদ্র তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। “কী ব্যাপার, সুমিত? হঠাৎ করে আমার কাছে? নিশ্চয়ই কোনো ভৌতিক সমস্যা?” তার মুখে এক হালকা হাসি। সুমিত আর্ণবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “আর্ণব, আমার বন্ধু। ও রায় মঞ্জিল নিয়ে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে। আমি ওকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।” আর্ণব এবার তার সমস্ত অভিজ্ঞতা রুদ্রকে খুলে বলল। প্রথম রায় মঞ্জিলে যাওয়া থেকে শুরু করে, সেই নারীমূর্তি, গাড়ির ঘটনা, গ্রামের অভিজ্ঞতা, এবং প্রমথ রায়ের ডায়েরির কথা – সবটাই সে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করল। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনল, মাঝে মাঝে তার চোখে এক অদ্ভুত দ্যুতি দেখা যাচ্ছিল। সে কোনো প্রশ্ন করল না, শুধু আর্ণবের কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। আর্ণবের কথা শেষ হলে রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সে উঠে দাঁড়াল এবং তার টেবিলের ওপর রাখা একটি অদ্ভুত যন্ত্র তুলে নিল। যন্ত্রটি দেখতে একটি ছোট বক্সের মতো, তাতে কিছু আলো আর ডায়াল লাগানো। “তোমার অভিজ্ঞতা খুবই বাস্তবসম্মত, আর্ণব,” রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলল। “এই ধরনের ঘটনা আমি আগেও শুনেছি। কিছু স্থান থাকে, যেখানে অতীত বর্তমানের সাথে মিশে যায়। যেখানে কিছু আত্মা আটকে থাকে, যারা মুক্তি চায়।” আর্ণব আর সুমিত রুদ্রের কথা শুনে অবাক হল। রুদ্র যেন তাদের কথাগুলো বিশ্বাস করছে, যা তারা অন্য কারো কাছে আশা করেনি। “তাহলে অপর্ণার আত্মা কি রায় মঞ্জিলে আটকে আছে?” আর্ণব প্রশ্ন করল। “সম্ভবত,” রুদ্র বলল। “কিন্তু কেন সে আটকে আছে, এবং কেন সে প্রতিশোধ নিতে চাইছে, সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রমথ রায়ের ডায়েরিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। বিশেষ করে সেই ছেঁড়া অংশটা।” “আমরা ভেবেছিলাম, ডায়েরির বাকি অংশটা হয়তো রায় মঞ্জিলেই আছে,” সুমিত বলল। “হতে পারে,” রুদ্র বলল। “অনেক সময়, আত্মা তাদের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো তাদের কাছাকাছি রেখে দেয়। কিন্তু রায় মঞ্জিল একটা সাধারণ বাড়ি নয়। এটা একটা শক্তিশালী শক্তির কেন্দ্র। ওখানে প্রবেশ করা বিপজ্জনক হবে।” “আমরা জানি,” আর্ণব বলল। “কিন্তু আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আমি এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না।” রুদ্র আর্ণবের চোখে সেই দৃঢ়তা দেখতে পেল, যা সুমিতও দেখেছিল। সে বুঝতে পারল, আর্ণবকে থামানো যাবে না। “ঠিক আছে। আমি তোমাদের সাহায্য করব। কিন্তু আমাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।” পরের কয়েকদিন রুদ্র তাদের প্রস্তুতিতে সাহায্য করল। সে তাদের কিছু বিশেষ সরঞ্জাম সম্পর্কে জানাল, যা প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছিল EMF মিটার (যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড পরিমাপ করে, যা অশরীরী উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়), থার্মাল ক্যামেরা (যা তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন রেকর্ড করে), ভয়েস রেকর্ডার (যা EVP বা ইলেকট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা রেকর্ড করে), এবং কিছু বিশেষ ধরনের আলো, যা অন্ধকার স্থানে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। রুদ্র তাদের কিছু প্রাথমিক সুরক্ষা কৌশলও শেখাল। “যখন তোমরা রায় মঞ্জিলে প্রবেশ করবে, তখন তোমাদের মনকে শান্ত রাখতে হবে,” রুদ্র বলল। “ভয় পেলে আত্মা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর কখনোই একা থাকবে না। সবসময় একসাথে থাকবে।” আর্ণব আর সুমিত রুদ্রের কথা মন দিয়ে শুনল। তারা বুঝতে পারছিল, এটা কোনো সাধারণ অভিযান নয়। এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক যাত্রা হতে চলেছে। রুদ্র তাদের রায় পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দিল। সে বলল যে, রায় পরিবার এককালে তন্ত্র সাধনার সাথে জড়িত ছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি গুপ্ত বিদ্যা চর্চা করত। এই তথ্য শুনে আর্ণব আর সুমিত অবাক হল। প্রমথ রায়ের ডায়েরিতে এই বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। “তন্ত্র সাধনা?” আর্ণব প্রশ্ন করল। “এর সাথে অপর্ণার কী সম্পর্ক?” “অনেক সময়, তন্ত্র সাধনার ভুল প্রয়োগ বা অসম্পূর্ণ সাধনা কিছু অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তোলে,” রুদ্র বলল। “আর সেই শক্তিগুলো সেই স্থানের সাথে চিরকালের জন্য জড়িয়ে যায়। অপর্ণার নিখোঁজ হওয়া বা তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পেছনে হয়তো এই তন্ত্র সাধনার কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।” এই নতুন তথ্য আর্ণব আর সুমিতের মনে আরও কৌতূহল সৃষ্টি করল। তারা বুঝতে পারছিল, রায় মঞ্জিলের রহস্য যতটা তারা ভেবেছিল, তার চেয়েও গভীর। রুদ্র তাদের কিছু প্রাচীন মন্ত্র এবং প্রার্থনাও শেখাল, যা অশুভ শক্তিকে শান্ত করতে বা দূরে রাখতে সাহায্য করে। আর্ণব, যে এতদিন যুক্তি আর বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ছিল, সেও এখন এই ধরনের বিষয়গুলো শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠল। তার মনে হল, এই পরিস্থিতিতে তার সমস্ত বিশ্বাসকে একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন কিছু গ্রহণ করতে হবে। অবশেষে, রায় মঞ্জিলে ফিরে যাওয়ার দিন এল। আর্ণব, সুমিত এবং রুদ্র, তিনজন মিলে রুদ্রের বিশেষ গাড়িতে করে রওনা দিল। গাড়িটা ছিল আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত, যেন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। তাদের সবার মনে এক চাপা উত্তেজনা আর ভয়। তারা জানে না, রায় মঞ্জিল তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। পথের দু’পাশের দৃশ্যগুলো আর্ণবের চেনা। সেই মেঠো পথ, তালগাছের সারি, আর সুপারি বাগান। কিন্তু এবার তার মনে কোনো শান্তি নেই, শুধু এক অজানা আশঙ্কার শীতল স্রোত। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। রায় মঞ্জিলের ফটকের সামনে এসে গাড়িটা থামল। ফটকটা তখনও ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে, তার ওপর লতিয়ে থাকা বুনো লতাগুলো যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে। বাড়িটা যেন এক প্রাচীন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু তার গভীরে লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য। রুদ্র গাড়ি থেকে নামল। তার হাতে একটি ছোট ব্যাগ, তাতে তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। আর্ণব আর সুমিতও গাড়ি থেকে নামল। তাদের সবার চোখে এক দৃঢ় সংকল্প, কিন্তু তাদের মনে এক চাপা ভয়। “আমরা প্রস্তুত?” রুদ্র শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল। আর্ণব আর সুমিত একে অপরের দিকে তাকাল। তারা জানে, এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। “প্রস্তুত,” আর্ণব বলল। রুদ্র তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। “তাহলে চলো। রায় মঞ্জিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।” তারা তিনজন ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকল। বিশাল উঠোনটা আগাছায় ভরে আছে, মাঝখানে সেই শুকনো পুকুর। আর তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রায় মঞ্জিল – এক বিশাল, ধূসর রঙের বাড়ি, যার জানালার কাঁচগুলো ভাঙা, দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। বাড়িটা যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তার গভীরে লুকিয়ে আছে এক অশরীরী ছায়া, যা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এবার তারা একা নয়। তাদের সাথে রুদ্র আছে, তার জ্ঞান আর সরঞ্জাম আছে। কিন্তু রায় মঞ্জিলের শক্তি কি তাদের চেয়েও বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। তারা জানে, এই যাত্রা তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। পঞ্চম অধ্যায়: রায় মঞ্জিলের গভীরে – প্রথম অনুসন্ধান সূর্য অস্ত যেতেই রায় মঞ্জিলের ওপর এক গাঢ় অন্ধকার নেমে এল। বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে যেন চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসছিল। রুদ্র তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটি ছোট, আধুনিক টর্চ বের করে জ্বালিয়ে দিল। তার আলোতে হলঘরের ভেতরের ধুলো আর মাকড়সার জালগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। “এমএফ মিটার চালু কর, আর্ণব,” রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলল। “সুমিত, তুমি থার্মাল ক্যামেরাটা প্রস্তুত রাখো।” আর্ণব তার হাতে ধরা যন্ত্রটির দিকে তাকাল। যন্ত্রটি চালু করতেই একটি মৃদু শব্দ হল, আর তার স্ক্রিনে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। “চালু করেছি,” আর্ণব বলল। তার গলা সামান্য কাঁপছিল। তারা তিনজন সাবধানে হলঘরের ভেতরে পা রাখল। রুদ্র সবার আগে, তারপর আর্ণব, এবং সুমিত সবার পেছনে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে পুরনো কাঠের মেঝে থেকে কর্কশ শব্দ ভেসে আসছিল, যেন বাড়িটা তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে। “তাপমাত্রা দ্রুত কমছে,” সুমিত ফিসফিস করে বলল। তার থার্মাল ক্যামেরার স্ক্রিনে ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। “সাধারণের চেয়ে প্রায় দশ ডিগ্রি কম।” “এমএফ রিডিংও বাড়ছে,” আর্ণব বলল। তার হাতের যন্ত্রটি মৃদু শব্দ করতে শুরু করেছে, আর স্ক্রিনের সংখ্যাগুলো দ্রুত বেড়ে চলেছে। “মনে হচ্ছে, এখানে কোনো শক্তিশালী উপস্থিতি আছে।” রুদ্র মাথা নাড়ল। “আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি।” তারা হলঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। ঝাড়লণ্ঠনটা তখনও স্থির, কিন্তু তার চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। আর্ণবের মনে হল, কেউ যেন তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। “আমরা প্রথমে দোতলায় যাব,” রুদ্র বলল। “প্রমথ রায়ের ডায়েরিতে অপর্ণার ঘরের কথা উল্লেখ আছে। হয়তো সেখানেই আমরা ডায়েরির বাকি অংশ বা অন্য কোনো সূত্র খুঁজে পাব।” তারা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ভাঙা, আর তাতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। রুদ্র সাবধানে পা ফেলে উপরে উঠতে লাগল। আর্ণব আর সুমিত তাকে অনুসরণ করল। সিঁড়ির মাঝপথে আসতেই আর্ণবের এমএফ মিটারটা তীব্র শব্দ করতে শুরু করল। স্ক্রিনের সংখ্যাগুলো পাগলের মতো ওঠানামা করছে। একই সাথে সুমিতের থার্মাল ক্যামেরায় তাপমাত্রা আরও দ্রুত নিচে নেমে গেল, প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি। “মনে হচ্ছে, এটা খুব শক্তিশালী উপস্থিতি,” রুদ্র বলল। তার চোখে এক অদ্ভুত দ্যুতি। “মন শান্ত রাখো, বন্ধুরা।” হঠাৎ, তাদের মাথার ওপর থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে এল। শব্দটা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে আর্ণব আর সুমিত চমকে উঠল। তারা উপরে তাকাল। দোতলার অন্ধকার করিডোরটা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। “ইভিপি রেকর্ডার চালু কর, সুমিত,” রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলল। সুমিত দ্রুত তার ভয়েস রেকর্ডার চালু করল। তারা শুনতে পেল, সেই গোঙানির শব্দটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার জায়গায় একটা চাপা ফিসফিসানি ভেসে আসছে। শব্দগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে তারা কিছুই বুঝতে পারছিল না। “এটা অপর্ণার আত্মা,” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। তার শরীর ভয়ে কাঁপছিল। “ভয় পেও না, আর্ণব,” রুদ্র বলল। “ও শুধু আমাদের উপস্থিতি অনুভব করছে।” তারা দোতলায় উঠে এল। করিডোরটা ছিল দীর্ঘ এবং অন্ধকার। দু’পাশে সারি সারি বন্ধ দরজা। রুদ্র তার টর্চের আলো ফেলে প্রতিটি দরজা পরীক্ষা করতে লাগল। “কোনটা অপর্ণার ঘর হতে পারে?” সুমিত প্রশ্ন করল। “ডায়েরিতে কোনো নির্দিষ্ট ঘরের কথা উল্লেখ নেই,” রুদ্র বলল। “কিন্তু সাধারণত, বাড়ির প্রধান সদস্যরা সামনের দিকে বা বড় ঘরগুলোতে থাকত।” তারা করিডোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছাল। সেখানে একটি বড় দরজা ছিল, তার কাঠের পাল্লাগুলো ভাঙা। রুদ্র দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আর্ণবের এমএফ মিটারটা আবার তীব্র শব্দ করতে শুরু করেছে। “এটা অপর্ণার ঘর হতে পারে,” রুদ্র বলল। “এখানে শক্তির উপস্থিতি খুব বেশি।” রুদ্র সাবধানে দরজাটা ঠেলে খুলল। ভেতরে জমাট অন্ধকার, আর ঠান্ডা বাতাস। তারা টর্চের আলো জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা ছিল বিশাল। মাঝখানে একটি ভাঙা খাট, তার ওপর ধুলোর আস্তরণ। ঘরের এক কোণে একটি পুরনো আলমারি, তার দরজা খোলা। আর ঘরের মাঝখানে, মেঝেতে, কিছু ভাঙা আসবাবপত্র আর ধুলোর স্তূপ। “থার্মাল ক্যামেরায় তাপমাত্রা আরও কমছে,” সুমিত বলল। “মনে হচ্ছে, এই ঘরের মাঝখানে কোনো শীতল স্থান আছে।” আর্ণবের এমএফ মিটারটা ঘরের মাঝখানে এসে আরও তীব্র শব্দ করতে লাগল। রুদ্র সেই শীতল স্থানের দিকে এগিয়ে গেল। সে তার টর্চের আলো ফেলে মেঝেতে কিছু খুঁজতে লাগল। “এখানে কিছু একটা আছে,” রুদ্র বলল। “মেঝেটা যেন অন্যরকম লাগছে।” তারা তিনজন মিলে মেঝেতে জমে থাকা ধুলো আর ভাঙা আসবাবপত্র সরাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর, তারা দেখতে পেল, মেঝের মাঝখানে একটি ছোট, কাঠের বাক্স। বাক্সটি পুরনো, তাতে ধুলোর আস্তরণ। “এটা কি প্রমথ রায়ের ডায়েরির বাকি অংশ?” আর্ণব উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল। রুদ্র সাবধানে বাক্সটি তুলে নিল। বাক্সটি খুলতেই তাদের চোখে পড়ল, তার ভেতরে একটি পুরনো, হলুদ হয়ে যাওয়া ডায়েরি। আর তার পাশে একটি ছোট, মরচে ধরা চাবির গোছা। “এটা ডায়েরির বাকি অংশ,” সুমিত ফিসফিস করে বলল। “আর এই চাবিগুলো… এগুলো কিসের চাবি?” রুদ্র ডায়েরিটি হাতে নিল। ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলো ছেঁড়া ছিল, ঠিক যেমনটা তারা ভেবেছিল। কিন্তু এই ডায়েরিতে আরও কিছু নতুন পাতা ছিল, যা প্রমথ রায়ের ডায়েরিতে ছিল না। “মনে হচ্ছে, এটা অপর্ণার নিজের ডায়েরি,” রুদ্র বলল। “বা হয়তো প্রমথ রায়ের অন্য কোনো ডায়েরি, যা তিনি অপর্ণার ঘটনার পর লিখেছিলেন।” আর্ণব আর সুমিতের মনে এক নতুন আশা জন্মালো। হয়তো এই ডায়েরিতেই লুকিয়ে আছে অপর্ণার নিখোঁজ হওয়ার আসল রহস্য। তারা দ্রুত ডায়েরি পড়া শুরু করল। ডায়েরির প্রথম দিকের পাতাগুলোতে অপর্ণার দৈনন্দিন জীবন, তার স্বপ্ন, তার ভালোবাসার কথা লেখা ছিল। সে তার হবু স্বামী, পাশের গ্রামের জমিদার পুত্র, রঞ্জনের কথা লিখেছিল। রঞ্জনকে সে খুব ভালোবাসত। তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আর অপর্ণা তার নতুন জীবন নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিল। কিন্তু ডায়েরির মাঝের কিছু পাতায় অপর্ণার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। সে তার বাবা-মায়ের তন্ত্র সাধনার কথা লিখেছিল। রায় পরিবার এককালে তন্ত্র সাধনার সাথে জড়িত ছিল, এই তথ্য রুদ্র তাদের দিয়েছিল। কিন্তু অপর্ণা জানত না যে, তার বাবা-মা এই সাধনার গভীরে এতটাই প্রবেশ করেছে যে তারা এক ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছে। অপর্ণা লিখেছিল যে, তার বাবা-মা নাকি এক অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। তারা নাকি বিশ্বাস করত যে, এই শক্তি তাদের আরও ক্ষমতা এবং সম্পদ এনে দেবে। কিন্তু এই সাধনার জন্য একটি বিশেষ বলিদানের প্রয়োজন ছিল। আর্ণব আর সুমিত একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মনে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। “বলিদান?” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। অপর্ণা লিখেছিল যে, তার বাবা-মা নাকি তাকেই সেই বলিদানের জন্য বেছে নিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, অপর্ণার বিশুদ্ধ আত্মা সেই অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। আর্ণবের হাত থেকে এমএফ মিটারটা পড়ে গেল। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। সুমিতের চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত। রুদ্রের মুখেও এক গভীর উদ্বেগ। “এটা অবিশ্বাস্য,” আর্ণব ফisফিস করে বলল। “তার বাবা-মা তাকেই বলিদান দিতে চেয়েছিল?” ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলোতে অপর্ণার শেষ মুহূর্তের বর্ণনা ছিল। বিয়ের দিনই তার বাবা-মা তাকে এক গোপন কক্ষে নিয়ে যায়। সেই কক্ষটি ছিল বাড়ির গভীরে, যেখানে তারা তাদের তন্ত্র সাধনা করত। অপর্ণা বুঝতে পারছিল, তার সাথে কী ঘটতে চলেছে। সে চিৎকার করেছিল, সাহায্য চেয়েছিল, কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পায়নি। ডায়েরির শেষ পাতায় অপর্ণা লিখেছিল: “আমি জানি না, আমার কী হবে। কিন্তু আমি জানি, আমার আত্মা এই বাড়িকে ছাড়বে না। যারা আমাকে এই যন্ত্রণা দিয়েছে, তাদের আমি শাস্তি দেব। এই বাড়ি আমার প্রতিশোধের সাক্ষী হবে।” ডায়েরিটা এখানে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর্ণব, সুমিত আর রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাদের মনে এক গভীর শোক আর আতঙ্ক। তারা বুঝতে পারছিল, অপর্ণার আত্মা কেন রায় মঞ্জিলে আটকে আছে, এবং কেন সে প্রতিশোধ নিতে চাইছে। “তাহলে সেই বিকট চিৎকারটা ছিল অপর্ণার,” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। “প্রমথ রায় যা শুনেছিলেন।” “হ্যাঁ,” রুদ্র বলল। “অপর্ণাকে তার বাবা-মা বলিদান দিয়েছিল, যাতে তারা সেই অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু তাদের সাধনা অসম্পূর্ণ ছিল, অথবা হয়তো সেই শক্তি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তারা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আর অপর্ণার আত্মা সেই বাড়িতে আটকে গেছে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে।” “আর এই চাবিগুলো?” সুমিত প্রশ্ন করল। রুদ্র চাবির গোছাটা হাতে নিল। “আমার মনে হয়, এই চাবিগুলো সেই গোপন কক্ষের চাবি, যেখানে অপর্ণাকে বলিদান দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সেই কক্ষটা খুঁজে বের করতে হবে।” আর্ণব আর সুমিত একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মনে এক নতুন দৃঢ়তা জন্মালো। তারা জানে, তাদের অপর্ণার আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে, এবং যারা তার সাথে অন্যায় করেছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু তারা জানে না, সেই গোপন কক্ষটা কোথায়, এবং সেখানে প্রবেশ করা কতটা বিপজ্জনক হবে। হঠাৎ, তাদের পেছনে একটি চাপা হাসির শব্দ ভেসে এল। সেই হাসিটা ছিল শীতল এবং বিকৃত। তারা দ্রুত পেছনে ফিরল। ঘরের মাঝখানে, যেখানে তারা বাক্সটি খুঁজে পেয়েছিল, সেখানে সেই নারীমূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে আরও স্পষ্ট, তার চোখ দুটো যেন অন্ধকারের গভীরে জ্বলছে, আর তার মুখে সেই বিকৃত হাসিটা যেন আরও চওড়া হয়েছে। তার শরীর থেকে এক তীব্র ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছিল, যা তাদের শরীর হিম করে দিচ্ছিল। “তোমরা জেনে গেছ… সত্যটা জেনে গেছ…” নারীমূর্তিটা ফিসফিস করে বলল। তার গলা থেকে যেন তীব্র যন্ত্রণা আর ক্রোধের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছিল। “এখন তোমরাও আমার সাথে থাকবে… এই বাড়ির অংশ হবে…” আর্ণব, সুমিত আর রুদ্র ভয়ে কাঁপতে লাগল। তারা জানে, তাদের হাতে বেশি সময় নেই। তাদের দ্রুত সেই গোপন কক্ষটা খুঁজে বের করতে হবে, নইলে তারা চিরকালের জন্য এই বাড়ির ফাঁদে আটকা পড়ে যাবে। রুদ্র দ্রুত তার হাতে থাকা যন্ত্রগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। এমএফ মিটার পাগলের মতো শব্দ করছে, আর থার্মাল ক্যামেরায় তাপমাত্রা দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। “আমাদের দ্রুত এখান থেকে বের হতে হবে,” রুদ্র বলল। “ও এখন খুব শক্তিশালী।” কিন্তু নারীমূর্তিটা তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটো যেন তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর তার মুখ থেকে সেই বিকৃত হাসিটা যেন আরও চওড়া হচ্ছে। তারা জানে না, এই ভয়ঙ্কর রাত থেকে তারা কিভাবে মুক্তি পাবে। ষষ্ঠ অধ্যায়: গোপন কক্ষের সন্ধানে – বিভ্রম ও আতঙ্ক অপর্ণার আত্মা তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তার উপস্থিতি এতটাই শক্তিশালী যে ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে, শ্বাস নেওয়াও কঠিন মনে হচ্ছে। আর্ণবের এমএফ মিটার পাগলের মতো শব্দ করছে, আর সুমিতের থার্মাল ক্যামেরায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেছে। “রুদ্র, কী করব?” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রুদ্র তার চোখ অপর্ণার আত্মার ওপর থেকে সরাল না। “ওকে উত্তেজিত করা যাবে না। আমাদের শান্ত থাকতে হবে।” সে তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট বোতল বের করল, তাতে কিছু পবিত্র জল ছিল। “এটা ছিটিয়ে দেবো। হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ওকে দুর্বল করতে পারব।” রুদ্র বোতল থেকে জল ছিটিয়ে দিল অপর্ণার আত্মার দিকে। জল স্পর্শ করতেই আত্মাটা যেন তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল, একটা বিকট চিৎকার করে উঠল, যা তাদের কানের পর্দায় আঘাত হানল। ঘরের আলো একবার জ্বলে উঠল, আবার নিভে গেল। এই সুযোগে রুদ্র, আর্ণব আর সুমিতকে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারা করিডোর ধরে ছুটতে লাগল। তাদের পেছনে সেই বিকট চিৎকার আর চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল, যেন অপর্ণার আত্মা তাদের অনুসরণ করছে। “গোপন কক্ষটা কোথায় হতে পারে?” সুমিত হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল। “ডায়েরিতে কোনো নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ নেই,” রুদ্র বলল। “কিন্তু সাধারণত, এই ধরনের গোপন কক্ষগুলো হয় বাড়ির সবচেয়ে পুরনো অংশে, নয়তো যেখানে তন্ত্র সাধনা করা হত, সেই স্থানের কাছাকাছি।” তারা করিডোর ধরে ছুটতে লাগল, প্রতিটি দরজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। আর্ণবের এমএফ মিটার তখনও তীব্র শব্দ করছে, যা নির্দেশ করছে যে আত্মা তাদের খুব কাছাকাছি আছে। হঠাৎ, করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি ছোট দরজা দেখতে পেল তারা। দরজাটি কাঠের, তাতে পুরনো নকশা করা। দরজাটি এতটাই ছোট যে তাদের মনে হল, এটা কোনো সাধারণ দরজা নয়। “এই দরজাটা!” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। “এটা অন্যরকম লাগছে।” রুদ্র দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তার হাতে থাকা চাবির গোছা থেকে একটি চাবি বের করে দরজার তালার মধ্যে ঢোকাল। চাবিটা ঘুরতেই একটা কর্কশ শব্দ হল, আর দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে জমাট অন্ধকার। রুদ্র তার টর্চের আলো ফেলে ভেতরে ঢুকল। আর্ণব আর সুমিত তাকে অনুসরণ করল। ভেতরে ঢুকতেই তাদের নাকে এক অদ্ভুত, পচা গন্ধ এসে লাগল, যা তাদের বমি বমি ভাব এনে দিল। “এটা কি সেই গোপন কক্ষ?” সুমিত প্রশ্ন করল। “মনে হচ্ছে,” রুদ্র বলল। তার এমএফ মিটারটা এখানে এসে শান্ত হয়ে গেছে। “এখানে কোনো অশরীরী উপস্থিতি নেই। হয়তো অপর্ণার আত্মা এখানে প্রবেশ করতে পারে না।” তারা সাবধানে ভেতরে ঢুকল। কক্ষটি ছিল ছোট এবং স্যাঁতসেঁতে। চারপাশের দেয়ালগুলো শ্যাওলায় ঢাকা, আর মেঝেতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। কক্ষের মাঝখানে একটি ছোট, পাথরের বেদি। বেদির ওপর কিছু পুরনো জিনিসপত্র পড়ে আছে – কিছু শুকনো ফুল, একটি মরচে ধরা ছুরি, আর কিছু অদ্ভুত প্রতীক আঁকা একটি পুরনো বই। “এগুলো তন্ত্র সাধনার জিনিস,” রুদ্র বলল। তার চোখে এক গভীর উদ্বেগ। “এই কক্ষেই অপর্ণাকে বলিদান দেওয়া হয়েছিল।” আর্ণব আর সুমিত বেদির দিকে এগিয়ে গেল। তাদের মনে এক চাপা ভয় আর ঘৃণা। তারা বুঝতে পারছিল, এই স্থানটি কতটা ভয়ঙ্কর। “ডায়েরিতে লেখা ছিল, অপর্ণার আত্মা প্রতিশোধ নিতে চায়,” আর্ণব বলল। “কিন্তু কিভাবে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে?” “এই ধরনের আত্মারা সাধারণত দুটি কারণে আটকে থাকে,” রুদ্র বলল। “হয় তাদের অপূর্ণ ইচ্ছা থাকে, নয়তো তাদের মৃত্যুর পেছনে কোনো অন্যায় থাকে, যার বিচার তারা চায়। অপর্ণার ক্ষেত্রে দুটিই সত্য।” রুদ্র পুরনো বইটি হাতে নিল। বইটির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, আর তাতে অদ্ভুত প্রতীক আঁকা। রুদ্র পাতা উল্টে দেখতে লাগল। “এখানে কিছু মন্ত্র লেখা আছে,” রুদ্র বলল। “এগুলো অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র। আর কিছু মন্ত্র আছে, যা আত্মাকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে।” আর্ণব আর সুমিত রুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মনে এক নতুন আশা জন্মালো। হয়তো এই মন্ত্রগুলোই অপর্ণার আত্মাকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে। “তাহলে আমাদের কী করতে হবে?” সুমিত প্রশ্ন করল। “আমাদের অপর্ণার আত্মাকে শান্ত করতে হবে,” রুদ্র বলল। “তাকে বোঝাতে হবে যে, তার প্রতিশোধের সময় শেষ হয়েছে। তারপর তাকে মুক্তি দিতে হবে।” রুদ্র বইয়ের একটি নির্দিষ্ট পাতা খুলল। তাতে একটি মন্ত্র লেখা ছিল, যা আত্মাকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। রুদ্র মন্ত্রটি পড়া শুরু করল। তার গলা ছিল শান্ত এবং দৃঢ়। মন্ত্র পড়তে শুরু করতেই কক্ষের ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল। বাতাসের গতি বেড়ে গেল, আর তাদের কানের কাছে চাপা ফিসফিসানি ভেসে আসতে লাগল। আর্ণব আর সুমিত ভয়ে কাঁপতে লাগল। “ভয় পেও না,” রুদ্র বলল। “ও আমাদের উপস্থিতি অনুভব করছে।” মন্ত্র শেষ হতেই কক্ষের ভেতরে এক তীব্র আলো জ্বলে উঠল। আলোটা এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে তাদের চোখ ঝলসে গেল। তারা চোখ বন্ধ করে ফেলল। যখন তারা আবার চোখ খুলল, তখন কক্ষের ভেতরে সেই নারীমূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে আরও স্পষ্ট, তার মুখটা শান্ত, তার চোখে কোনো যন্ত্রণা নেই, শুধু এক গভীর বিষাদ। তার চুলগুলো এলোমেলো, কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। “অপর্ণা?” আর্ণব ফিসফিস করে বলল। নারীমূর্তিটা তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তার হাসিটা ছিল শান্ত এবং বিষণ্ণ। সে কিছু বলল না, শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। “তুমি এখন মুক্ত, অপর্ণা,” রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলল। “তোমার প্রতিশোধের সময় শেষ হয়েছে। তুমি এখন শান্তিতে থাকতে পারো।” নারীমূর্তিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। তার শরীরটা যেন বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছিল। তার চোখ দুটো তখনও তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর তার মুখে সেই বিষণ্ণ হাসিটা লেগে ছিল। কিছুক্ষণ পর, নারীমূর্তিটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। কক্ষের ভেতরে সেই তীব্র আলোও মিলিয়ে গেল। কক্ষটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল, আর তাতে সেই পচা গন্ধটা তখনও রয়ে গেছে। আর্ণব, সুমিত আর রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাদের মনে এক অদ্ভুত শান্তি। তারা জানে, তারা অপর্ণার আত্মাকে মুক্তি দিতে পেরেছে। “আমরা কি সফল হয়েছি?” সুমিত প্রশ্ন করল। “হ্যাঁ,” রুদ্র বলল। “অপর্ণার আত্মা এখন মুক্ত। সে আর এই বাড়িতে আটকে নেই।” আর্ণব ডায়েরিটা হাতে নিল। তার মনে হল, এই ডায়েরিটা এখন আর শুধু একটি পুরনো বই নয়, এটি অপর্ণার জীবনের এক মর্মান্তিক সত্যের সাক্ষী। সে জানে, এই ডায়েরিটা তাকে সযত্নে রাখতে হবে, যাতে অপর্ণার গল্প চিরকাল বেঁচে থাকে। তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। করিডোরটা তখনও অন্ধকার, কিন্তু তাদের মনে আর কোনো ভয় নেই। তারা জানে, রায় মঞ্জিলের অভিশাপ শেষ হয়েছে। তারা হলঘরের দিকে এগিয়ে গেল। হলঘরটা তখনও ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা, কিন্তু তার চারপাশের বাতাস যেন হালকা হয়ে গেছে। ঝাড়লণ্ঠনটা স্থির, আর তার চারপাশের বাতাস আর ভারী নেই। তারা বাড়ির ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। ফটকটা তখনও ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে, তার ওপর লতিয়ে থাকা বুনো লতাগুলো যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এবার তাদের মনে কোনো ভয় নেই, শুধু এক অদ্ভুত শান্তি। তারা ফটক ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে তখন রাত গভীর, আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার আলোয় রায় মঞ্জিলকে শান্ত এবং নিরিবিলি দেখাচ্ছে। বাড়িটা যেন তার সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর্ণব তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সে জানে, তার গাড়িটা এখনও স্টার্ট হবে না। কিন্তু তার মনে কোনো চিন্তা নেই। সে জানে, সে এখন নিরাপদ। রুদ্র তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট যন্ত্র বের করল। যন্ত্রটি চালু করতেই একটি মৃদু শব্দ হল, আর তার স্ক্রিনে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। “এমএফ রিডিং শূন্য,” রুদ্র বলল। “রায় মঞ্জিল এখন শান্ত।” আর্ণব আর সুমিত একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মুখে এক অদ্ভুত হাসি। তারা জানে, তারা এক ভয়ঙ্কর অভিযান শেষ করেছে, আর তারা সফল হয়েছে। তারা রুদ্রের গাড়িতে উঠল। রুদ্র গাড়ি স্টার্ট করল, আর গাড়িটা রায় মঞ্জিল থেকে দূরে চলে যেতে লাগল। আর্ণব গাড়ির জানালা দিয়ে রায় মঞ্জিলের দিকে তাকাল। বাড়িটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল, যেন এক প্রাচীন রহস্য তার গভীরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর্ণব জানে, এই অভিজ্ঞতা সে কখনোই ভুলতে পারবে না। রায় মঞ্জিল তাকে শিখিয়েছে যে, এই পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের যুক্তির বাইরে। আর কিছু আত্মা থাকে, যারা মুক্তি চায়, এবং তাদের মুক্তি দিতে হলে আমাদের ভয়কে জয় করতে হবে। সে জানে, রায় মঞ্জিল এখন শান্ত। অপর্ণার আত্মা এখন মুক্ত। আর সে, আর্ণব রায়, একজন স্থপতি, যে একদিন একটি পুরনো বাড়ি সংস্কার করতে এসেছিল, সে এখন এক নতুন মানুষ। সে এখন জানে, প্রতিটি বাড়ির পেছনে একটি গল্প থাকে, আর কিছু গল্প এতটাই গভীর হয় যে তা আমাদের জীবনকে চিরকালের জন্য বদলে দেয়। গাড়িটা গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল, আর রায় মঞ্জিল ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তার স্মৃতি, তার রহস্য, আর্ণবের মনে চিরকাল থেকে গেল। সপ্তম অধ্যায়: নতুন ভোর, নতুন পথ রুদ্রের গাড়ি যখন শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছাল, তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, আর পূর্ব আকাশে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। আর্ণব আর সুমিতের চোখে ঘুম নেই, কিন্তু তাদের মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। সারা রাতের আতঙ্ক, ভয়, আর আবিষ্কারের ক্লান্তি যেন ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল। “তোমরা এখন কোথায় যাবে?” রুদ্র প্রশ্ন করল। তার গলাতেও ক্লান্তির রেশ, কিন্তু তার চোখে এক গভীর তৃপ্তি। “আমার বাড়িতেই,” আর্ণব বলল। “একটু বিশ্রাম দরকার।” সুমিত মাথা নাড়ল। “আমারও। এই রাতের অভিজ্ঞতা ভুলতে অনেক সময় লাগবে।” রুদ্র প্রথমে সুমিতকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল। সুমিত গাড়ি থেকে নেমে রুদ্র আর আর্ণবকে ধন্যবাদ জানাল। “তোমাদের ছাড়া এটা সম্ভব হত না,” সুমিত বলল। “সত্যিই, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমরা কীসের মুখোমুখি হয়েছিলাম।” “এই ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষকে বদলে দেয়, সুমিত,” রুদ্র বলল। “কিন্তু এটা তোমাকে আরও শক্তিশালী করবে।” সুমিত চলে যাওয়ার পর রুদ্র আর্ণবকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল। আর্ণব গাড়ি থেকে নেমে রুদ্রের দিকে তাকাল। “রুদ্র, তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাবো জানি না। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, আর অপর্ণাকে মুক্তি দিয়েছ।” রুদ্র হাসল। “এটা আমার কাজ, আর্ণব। আর অপর্ণা তার প্রাপ্য শান্তি পেয়েছে। তুমিও এখন শান্তি পাবে।” আর্ণব তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তার মনে হল, তার পরিচিত বাড়িটা যেন এখন অন্যরকম লাগছে। ভেতরের প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি কোণ, যেন এক নতুন অর্থ বহন করছে। সে জানে, এই অভিজ্ঞতা তাকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছে। পরের কয়েকদিন আর্ণব বিশ্রাম নিল। সে ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখে ঘুম ছিল না। তার মনে বারবার ভেসে আসছিল রায় মঞ্জিলের স্মৃতি – সেই অন্ধকার হলঘর, চাপা ফিসফিসানি, অপর্ণার বিকৃত মুখ, এবং শেষ মুহূর্তে তার শান্ত হাসি। সে জানে, এই স্মৃতিগুলো তাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো তাকে দুর্বল করেনি, বরং তাকে এক নতুন শক্তি দিয়েছে। সে এখন জানে, এই পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের যুক্তির বাইরে। আর কিছু আত্মা থাকে, যারা মুক্তি চায়, এবং তাদের মুক্তি দিতে হলে আমাদের ভয়কে জয় করতে হবে। আর্ণব তার বাবার সাথে আবার দেখা করল। এবার সে রায় মঞ্জিলের সংস্কারের কাজ শুরু করার কথা বলল। বাবা খুশি হলেন, কিন্তু আর্ণবের মনে অন্য পরিকল্পনা ছিল। সে জানে, রায় মঞ্জিলকে সে আর তার পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনবে না। সে একে এমনভাবে সংস্কার করবে, যাতে এটি অপর্ণার স্মৃতিকে সম্মান জানায়, এবং একই সাথে এটি যেন আর কোনো অশুভ শক্তির আশ্রয়স্থল না হয়। সে সুমিতের সাথেও যোগাযোগ করল। সুমিত তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র লেখার কথা ভাবছিল। আর্ণব তাকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিল। তারা দু’জন মিলে রায় মঞ্জিলের ইতিহাস, অপর্ণার গল্প, এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল, যাতে এই সত্যটা চিরকাল বেঁচে থাকে। রুদ্রের সাথে আর্ণবের যোগাযোগ বজায় রইল। রুদ্র তাকে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দিল। আর্ণবের মনে হল, সে যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছে। সে জানে না, ভবিষ্যতে সে এই ধরনের কোনো অভিযানে আবার অংশ নেবে কিনা, কিন্তু সে এখন এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিছুদিন পর, আর্ণব আবার রায় মঞ্জিলে ফিরে গেল। এবার সে একা নয়, তার সাথে ছিল কিছু শ্রমিক। তারা বাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করল। বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে ধুলো, মাকড়সার জাল, আর পুরনো আসবাবপত্র সরানো হল। বাড়িটা ধীরে ধীরে তার পুরনো জীর্ণ দশা থেকে মুক্তি পাচ্ছিল। আর্ণব রায় মঞ্জিলের নকশা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিল। সে বাড়ির ভেতরে এমন কিছু পরিবর্তন আনল, যা অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। সে কিছু বিশেষ ধরনের গাছ লাগাল, যা নেতিবাচক শক্তি শোষণ করে। সে বাড়ির প্রতিটি কোণে আলো এবং বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করল, যাতে অন্ধকার আর বদ্ধতা দূর হয়। রায় মঞ্জিলের সেই গোপন কক্ষটি, যেখানে অপর্ণাকে বলিদান দেওয়া হয়েছিল, সেই কক্ষটিকে আর্ণব একটি স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত করল। সে সেখানে একটি ছোট মন্দির তৈরি করল, যেখানে অপর্ণার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হবে। সে জানে, এই মন্দিরটি অপর্ণার আত্মাকে চিরকাল শান্তি দেবে, এবং একই সাথে এটি রায় মঞ্জিলের অন্ধকার অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন ভুল না করে। রায় মঞ্জিল ধীরে ধীরে এক নতুন রূপে সজ্জিত হতে লাগল। তার পুরনো জীর্ণ দশা কেটে গিয়ে এক নতুন প্রাণ ফিরে আসছিল। কিন্তু তার সৌন্দর্য ছিল অন্যরকম, যা তার অতীতকে সম্মান জানায়, এবং তার ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন আশা জাগায়। গ্রামের লোকজন রায় মঞ্জিলের পরিবর্তন দেখে অবাক হল। তারা জানত, এই বাড়িটা অভিশপ্ত। কিন্তু এখন তারা দেখছিল, বাড়িটা যেন তার সমস্ত অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তারা আর্ণবকে সম্মান জানাতে লাগল, কারণ সে তাদের গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে। আর্ণব রায় মঞ্জিলের সংস্কারের কাজ শেষ করল। বাড়িটা এখন আর শুধু একটি পুরনো বাড়ি নয়, এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ, একটি শিক্ষালয়, যা মানুষকে অন্ধকার অতীত থেকে শিক্ষা নিতে সাহায্য করে। আর্ণব জানে, তার জীবন এখন অন্যরকম। সে একজন স্থপতি, কিন্তু সে এখন আরও কিছু। সে একজন সত্যের সন্ধানী, একজন সাহসী মানুষ, যে ভয়কে জয় করতে শিখেছে। সে জানে, এই অভিজ্ঞতা তাকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছে। সে রায় মঞ্জিলের দিকে তাকিয়ে হাসল। বাড়িটা এখন শান্ত, নিরিবিলি। অপর্ণার আত্মা এখন মুক্ত। আর আর্ণব, সে এখন এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে, যেখানে তার স্থপতি সত্তা আর তার নতুন অর্জিত জ্ঞান একসাথে মিশে গেছে। সে জানে, তার এই নতুন পথ তাকে আরও অনেক রহস্যের গভীরে নিয়ে যাবে, কিন্তু সে এখন আর ভয় পায় না। সে জানে, সে প্রস্তুত।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion