কলকাতার বুকে, যেখানে পুরনো বাড়ির ইট-কাঠের পরতে পরতে ইতিহাস মিশে আছে, সেখানেই ছিল রঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়ি। দক্ষিণ কলকাতার এক নিরিবিলি গলির শেষে, বিশাল এক বাগানঘেরা এই বাড়িটা দেখলে মনে হতো যেন সময় এখানে থমকে গেছে, যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছেন আপনি। লতানো গাছপালা আর পুরনো আমলের স্থাপত্যের এক অদ্ভুত মিশেল ছিল এই বাড়ি, যার প্রতিটি কোণে লুকিয়ে ছিল শত শত বছরের গল্প, প্রতিটি ইটে যেন প্রতিধ্বনিত হতো অতীত দিনের ফিসফাস। রঞ্জন বাবু কোনো সাধারণ সংগ্রাহক ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রাচীন শিল্পের একজন নিবেদিতপ্রাণ পূজারী, একজন গবেষক, একজন সংরক্ষণবিদ এবং একজন নীরব দার্শনিক। তাঁর সংগ্রহশালা কোনো শখের প্রদর্শনী ছিল না, ছিল তাঁর জীবনের সাধনা, তাঁর অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি, তাঁর আত্মার আশ্রয়স্থল। প্রতিটি মূর্তি, প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি হাতে লেখা পুঁথি তাঁর কাছে শুধু বস্তু ছিল না, ছিল ইতিহাসের নীরব সাক্ষী, যা সহস্র বছর ধরে মানব সভ্যতার গল্প বলে আসছিল, মানুষের বিশ্বাস, সংগ্রাম, শিল্পকলার বিবর্তন এবং আধ্যাত্মিক যাত্রাকে ধারণ করে।
রঞ্জন বাবুর সংগ্রহে যা কিছু ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল একটি ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি। এটি ছিল পাল আমলের, প্রায় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। এই মূর্তিটি ছিল তাঁর সংগ্রহশালার মুকুটমণি, যার ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিত অন্য সব কিছুকে। মূর্তিটির গঠনশৈলী ছিল অপূর্ব, প্রতিটি রেখা যেন শিল্পীর গভীর ধ্যান ও নিষ্ঠার ফল, প্রতিটি বাঁক যেন এক অনন্ত শান্তির বার্তা বহন করত। বুদ্ধের মুখে যে প্রশান্তির ছাপ ছিল, তা দেখলে মনে হতো যেন সহস্র দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে এক দিব্য শান্তি বিরাজ করছে, যা দর্শকের মনেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিত, এক অলৌকিক আকর্ষণ অনুভব করাত। এই মূর্তিটি রঞ্জন বাবু বহু বছর আগে এক দুর্গম গ্রাম থেকে উদ্ধার করেছিলেন, যেখানে এটি অযত্নে পড়েছিল, প্রকৃতির হাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল, প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল। তিনি এটিকে নিজের সন্তানের মতো দেখতেন, নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন, এর প্রতিটি খুঁতকে তিনি পরম মমতায় সারিয়ে তুলেছিলেন। মূর্তিটিকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার কেন্দ্রে একটি বিশেষ কাঁচের বাক্সে রেখেছিলেন। এই বাক্সটি শুধু কাঁচের ছিল না, এটি ছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সুরক্ষিত, যা কলকাতার সেরা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। লেজার সেন্সর, মোশন ডিটেক্টর, এবং সাইলেন্ট অ্যালার্মের এক জটিল জাল ছিল এর চারপাশে, যা সামান্যতম নড়াচড়াতেও সতর্ক সংকেত দিত, এমনকি বাতাসের গতিতেও।
রঞ্জন বাবুর দিন কাটত তাঁর সংগ্রহ নিয়ে। তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের যত্ন নিতেন, তাদের ধুলো ঝাড়তেন, তাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতেন, আর তাদের নীরব সান্নিধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করতেন। তাঁর কোনো স্ত্রী বা সন্তান ছিল না; তাঁর এই প্রাচীন জিনিসগুলোই ছিল তাঁর পরিবার, তাঁর জগৎ, তাঁর একমাত্র সঙ্গী। তাঁর সকাল শুরু হতো সংগ্রহশালার প্রতিটি বস্তুকে একবার চোখ বুলিয়ে, তাদের সাথে যেন এক নীরব কথোপকথনে, তাদের কাছ থেকে যেন তিনি দিনের শক্তি সঞ্চয় করতেন। দুপুরে তিনি পুরনো পুঁথি নিয়ে বসতেন, তাদের পাঠোদ্ধার করতেন, নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কারের আনন্দে বিভোর হতেন, যেন তিনি নিজেই ইতিহাসের পাতায় বিচরণ করছেন। সন্ধ্যায় তিনি শিল্পকলার উপর বই পড়তেন, বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন, নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করতেন। শহরের নামকরা শিল্প সমালোচক, ইতিহাসবিদ, এবং এমনকি বিদেশি সংগ্রাহকরাও তাঁর সংগ্রহ দেখতে আসতেন, আর তাঁর জ্ঞান ও নিষ্ঠার প্রশংসা করতেন। রঞ্জন বাবু তাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাঁর সংগ্রহের গল্প বলতেন, প্রতিটি বস্তুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতেন, তাদের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর হাতে আসা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপের বর্ণনা দিতেন, যা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। তাঁর বাড়িটি ছিল যেন এক জীবন্ত জাদুঘর, যেখানে অতীত বর্তমানের সাথে মিশে যেত, যেখানে প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব একটি আত্মা ছিল।
শহরের অন্ধকার গলিপথে, যেখানে আলোর রেখা পৌঁছাত না, যেখানে কেবল অপরাধ আর রহস্যের গন্ধ মিশে থাকত, সেখানেই জন্ম নিয়েছিল এক কিংবদন্তী – “ছায়া”। কেউ তার আসল নাম জানত না, তার মুখ দেখেনি, তার অস্তিত্ব ছিল কেবল ফিসফাসে আর আতঙ্কের গল্পে। পুলিশ ফাইলগুলোতে তার নাম ছিল ‘অজ্ঞাতপরিচয় চোর’, কিন্তু অপরাধ জগতে সে পরিচিত ছিল ‘ছায়া’ নামেই। ছায়া ছিল একজন পেশাদার চোর, যার দক্ষতা ছিল অবিশ্বাস্য, প্রায় অলৌকিক। সে শুধু চুরি করত না, সে চুরিকে শিল্পে পরিণত করত, প্রতিটি অপারেশন ছিল তার কাছে এক একটি মাস্টারপিস। তার প্রতিটি অপারেশন ছিল নিখুঁত, কোনো সূত্র রাখত না, কোনো প্রমাণ ছাড়ত না, যেন সে বাতাসে মিলিয়ে যেত। পুলিশ তার নাম শুনলে ভয়ে সিঁটিয়ে যেত, কারণ ছায়া ছিল তাদের কাছে এক অমীমাংসিত রহস্য, এক দুঃস্বপ্ন, যা তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিত।
ছায়ার অতীত ছিল রহস্যময়। সে ছোটবেলা থেকেই অভাব আর বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। সমাজের অন্ধকার দিকটা তাকে তৈরি করেছিল একজন দক্ষ চোর হিসেবে। সে জানত, বেঁচে থাকতে হলে তাকে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। তার প্রথম চুরি ছিল একটি ছোট গয়নার দোকান থেকে, যেখানে সে মাত্র দশ বছর বয়সে প্রবেশ করেছিল। তারপর থেকে সে নিজেকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করল, প্রতিটি চুরির পর সে তার ভুলগুলো বিশ্লেষণ করত, নিজেকে আরও উন্নত করত। সে বিভিন্ন ধরণের লক সিস্টেম, অ্যালার্ম সিস্টেম, এবং নিরাপত্তা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করত। সে জানত, জ্ঞানই তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তার লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সেরা চোর হওয়া, এমন একজন যার নাম শুনলে সবাই ভয়ে কুঁকড়ে যাবে।
ছায়ার কানেও পৌঁছেছিল রঞ্জন বাবুর ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তির কথা। এই মূর্তিটি ছিল তার পরবর্তী লক্ষ্য, তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তার দক্ষতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। সে জানত, এই চুরি তাকে এনে দেবে অকল্পনীয় সম্পদ এবং খ্যাতি, যা তাকে অপরাধ জগতের শিখরে পৌঁছে দেবে, তাকে অমর করে তুলবে। ছায়া কয়েক মাস ধরে রঞ্জন বাবুর বাড়ির উপর নজর রেখেছিল। সে শুধু বাড়ির বাইরের কাঠামোই নয়, তার ভেতরের বিন্যাস, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি করিডোর, এমনকি রঞ্জন বাবুর ব্যক্তিগত অভ্যাসও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। সে জানত কখন দারোয়ান বদল হয়, কখন কুকুরগুলো ঘুমায়, কখন রঞ্জন বাবু ঘুমাতে যান, কখন তিনি চা পান করেন, এমনকি কখন তার কাজের লোকেরা বাজার করতে যায়। সে বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোর অবস্থান, অ্যালার্ম সিস্টেমের ধরন, এমনকি প্রতিবেশীদের গতিবিধিও মুখস্থ করে ফেলেছিল। তার পরিকল্পনা ছিল এতটাই নিখুঁত যে, মনে হতো সে যেন বাড়ির প্রতিটি ইটের সাথে পরিচিত, প্রতিটি দেয়ালের গোপন রহস্য তার জানা। সে একটি বিস্তারিত ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিল, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সম্ভাব্য বিপদ এবং তার সমাধান উল্লেখ করা ছিল।
এক অমাবস্যার রাতে, যখন আকাশ মেঘে ঢাকা, আর কলকাতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ছায়া তার অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হলো। সে কালো পোশাক পরেছিল, যা তাকে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য করে তুলত, যেন সে ছায়ারই এক অংশ। তার ব্যাগে ছিল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি – লেজার কাটলার, অ্যালার্ম বাইপাসার, লক পিকিংয়ের সরঞ্জাম, এবং কিছু বিশেষ ডিভাইস যা শব্দ শোষণ করতে পারত, এমনকি বাতাসের ফিসফিসানিও। তার সাথে ছিল একটি ছোট ট্যাবলেট, যেখানে বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি বিস্তারিত মানচিত্র লোড করা ছিল, যা তাকে প্রতিটি পদক্ষেপের নির্দেশনা দিচ্ছিল।
সে বাড়ির পিছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল নিঃশব্দ, যেন বাতাসের ফিসফিসানি, যেন সে মাটি স্পর্শই করছে না। সে প্রথমে বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো নিষ্ক্রিয় করল, তাদের তারগুলো কেটে দিল অথবা তাদের সংকেত জ্যাম করে দিল, যাতে কোনো ছবি রেকর্ড না হয়। তারপর একে একে অ্যালার্ম সিস্টেমগুলো বাইপাস করতে শুরু করল। তার আঙুলগুলো যেন জাদুর মতো কাজ করছিল, প্রতিটি তার, প্রতিটি সার্কিট তার হাতের ইশারায় বশ মানছিল। সে জানত, সামান্যতম ভুল তার পুরো পরিকল্পনাকে নষ্ট করে দিতে পারে, তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে, তার এতদিনের সাধনা ব্যর্থ করে দিতে পারে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল গভীর এবং নিয়ন্ত্রিত, তার হৃদস্পন্দন ছিল ধীর, যেন সে এক গভীর ধ্যানে মগ্ন। সে যেন এক রোবটের মতো কাজ করছিল, আবেগহীন, নির্ভুল, কেবল তার লক্ষ্য পূরণের দিকে মনোনিবেশ করে।
ধীরে ধীরে সে রঞ্জন বাবুর সংগ্রহশালার দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটি দরজা, প্রতিটি তালা তার কাছে ছিল এক একটি ধাঁধা, যা সে নিপুণভাবে সমাধান করছিল। সে জানত যে এই বাড়িতে তিনটি স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে, এবং প্রতিটি স্তরই আগেরটির চেয়ে বেশি জটিল। প্রথম স্তর ছিল বাড়ির বাইরের নিরাপত্তা, দ্বিতীয় স্তর ছিল সংগ্রহশালার প্রবেশপথ, এবং তৃতীয় স্তর ছিল বুদ্ধ মূর্তির কাঁচের বাক্স। কিন্তু ছায়া ছিল অদম্য। তার লক্ষ্য ছিল স্থির, তার মন ছিল অবিচল, তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত জেদ।
ঘরের মাঝখানে, আলোর ঝলকানিতে ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তিটি জ্বলজ্বল করছিল। তার চারপাশে কাঁচের বাক্সটি ছিল এক অদৃশ্য দেয়ালের মতো, যা মূর্তিটিকে বাইরের সব বিপদ থেকে রক্ষা করছিল, যেন এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। ছায়া বাক্সটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে জানত, এটাই তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, তার দক্ষতার চূড়ান্ত প্রমাণ, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। সে তার বিশেষ গ্লাভস পরল, যা কোনো আঙুলের ছাপ রাখত না, এবং যন্ত্রপাতির ব্যাগ থেকে একটি ছোট ডিভাইস বের করল।
সে লেজার সেন্সরগুলো স্ক্যান করল, তাদের ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করল। এই সেন্সরগুলো এতটাই সংবেদনশীল ছিল যে, সামান্যতম ধুলোর কণা পড়লেও অ্যালার্ম বেজে উঠত। ছায়া তার ডিভাইস দিয়ে লেজার রশ্মিগুলোকে ডাইভার্ট করল, যাতে তারা অ্যালার্ম ট্রিগার না করে। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ একটি ভুল পদক্ষেপেই পুরো বাড়িতে সাইরেন বেজে উঠত, এবং তার সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যেত। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল না। তার মনোযোগ ছিল একাগ্র, তার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল নিয়ন্ত্রিত, সে যেন এক গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিল, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় কেবল এই কাজের উপর নিবদ্ধ।
এরপর সে বাক্সের জটিল লক সিস্টেমে হাত দিল। এটি ছিল একটি ডিজিটাল লক, যা বায়োমেট্রিক এবং কোড কম্বিনেশনের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই লকটি খুলতে গেলে হাতের ছাপ, রেটিনা স্ক্যান, এবং একটি জটিল কোড প্রয়োজন ছিল। ছায়া তার অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কোডটি ক্র্যাক করার চেষ্টা করল। সে একটি বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করল, যা কোটি কোটি কম্বিনেশন পরীক্ষা করতে পারত, এবং একটি বিশেষ ধরণের স্ক্যানার ব্যবহার করে রেটিনা স্ক্যানকে বাইপাস করার চেষ্টা করল। কয়েক মিনিট ধরে পিনপতন নীরবতা। শুধু ছায়ার মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর যন্ত্রপাতির ক্ষীণ শব্দ। অবশেষে, একটি ক্ষীণ ‘ক্লিক’ শব্দ হলো এবং বাক্সের ঢাকনা সামান্য সরে গেল। এটি ছিল একটি ছোট বিজয়, কিন্তু ছায়া জানত যে আসল কাজ এখনও বাকি, কারণ এর নিচে আরও একটি স্তর ছিল।
কাঁচের বাক্সটি খুলতে গিয়ে ছায়া দেখল যে এর নিচে আরও একটি স্তর রয়েছে – একটি শক্তিশালী ইস্পাতের সিন্দুক। রঞ্জন বাবু জানতেন যে মূর্তিটি কতটা মূল্যবান, তাই তিনি এর সুরক্ষায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। এই সিন্দুকটি ছিল বিশেষ ধরণের ইস্পাত দিয়ে তৈরি, যা সাধারণ ড্রিল দিয়ে ভাঙা অসম্ভব ছিল। ছায়া হতাশ হলো না। সে তার ব্যাগে হাত দিল এবং একটি ছোট টর্চলাইট বের করল। সিন্দুকটি ছিল একটি টাইমার-লক সিস্টেম দ্বারা সুরক্ষিত, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যেত। কিন্তু ছায়ার কাছে এত সময় ছিল না। তাকে দ্রুত কাজ করতে হতো, কারণ ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছিল।
সে সিন্দুকের জয়েন্টগুলো পরীক্ষা করল এবং একটি বিশেষ ধরণের তরল পদার্থ প্রয়োগ করল, যা ইস্পাতকে দুর্বল করে দিত, তাকে নরম করে তুলত। তারপর সে একটি ছোট ড্রিল ব্যবহার করে একটি ছোট ছিদ্র করল। ছিদ্র দিয়ে সে একটি অপটিক্যাল ফাইবার প্রবেশ করাল এবং সিন্দুকের ভেতরের মেকানিজম দেখতে পেল। সে তার ট্যাবলেটে মেকানিজমের ছবি তুলল এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করল। এটি ছিল একটি জটিল গিয়ার সিস্টেম, যা একটি নির্দিষ্ট ক্রমে ঘুরলে সিন্দুকটি খুলত। ছায়া তার পিনপিকিংয়ের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে একে একে গিয়ারগুলো সরাতে শুরু করল। তার হাতগুলো দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে কাজ করছিল, যেন সে কোনো যন্ত্রের অংশ। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল হিসেবি, প্রতিটি নড়াচড়া ছিল নিখুঁত।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, আরেকটি মৃদু ‘ক্লিক’ শব্দ হলো এবং সিন্দুকের ভারী দরজা খুলে গেল। ছায়ার চোখে এক বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল। সে সাবধানে কাঁচের ঢাকনাটি তুলল এবং ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তিটি হাতে নিল। মূর্তিটির ঠান্ডা স্পর্শ তার হাতে এক অদ্ভুত অনুভূতি দিল – এক অদ্ভুত শক্তি, এক অদম্য আনন্দ। সে জানত, এই মূর্তিটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, তাকে অপরাধ জগতের কিংবদন্তী করে তুলবে, তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। সে মূর্তিটি একটি নরম কালো মখমলের কাপড়ে মুড়ে তার বিশেষ ব্যাগে রাখল, যা শব্দহীন এবং তাপ-নিরোধী ছিল, যাতে কোনোভাবেই এর অস্তিত্ব টের পাওয়া না যায়।
যে পথে সে এসেছিল, সেই পথেই সে ফিরে গেল। কোনো চিহ্ন রাখল না, কোনো প্রমাণ ছাড়ল না। সে তার সমস্ত যন্ত্রপাতি এবং চিহ্ন মুছে ফেলল, যেন সে কখনোই সেখানে ছিল না। রাতের অন্ধকারে ছায়া যেন বাতাসের মতোই অদৃশ্য হয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল এক শূন্য কাঁচের বাক্স আর এক গভীর রহস্য, যা কলকাতার পুলিশকে দীর্ঘকাল ধরে ভাবিয়ে তুলবে, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে।
পরদিন সকালে, রঞ্জন বাবুর ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে। তাঁর প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী, তিনি সবার আগে তাঁর সংগ্রহশালায় যেতেন, বুদ্ধ মূর্তির দিকে তাকিয়ে দিনের শুরু করতেন, তার প্রশান্ত মুখ দেখে দিনের জন্য অনুপ্রেরণা নিতেন, তার নীরব সান্নিধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করতেন। কিন্তু আজ যখন তিনি ঘরে ঢুকলেন, তাঁর চোখ পড়ল সেই শূন্য কাঁচের বাক্সের উপর। তাঁর হৃদয়ে যেন বজ্রপাত হলো, তাঁর সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল, যেন তার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেছে। তাঁর প্রিয় বুদ্ধ মূর্তিটি নেই!
রঞ্জন বাবু চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর আর্তনাদ শুনে বাড়ির লোকজন, দারোয়ান, এবং কাজের লোকেরা ছুটে এল। সবাই হতবাক, কারণ বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল নিশ্ছিদ্র, যা শহরের সেরা বলে পরিচিত ছিল। পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। ইন্সপেক্টর মুখার্জি, শহরের একজন অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসার, দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে এলেন। তিনি শুধু বুদ্ধিমানই নন, তাঁর ছিল গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বোঝার এক অদ্ভুত ক্ষমতা, যা তাকে অনেক কঠিন কেস সমাধানে সাহায্য করেছিল। তিনি প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করলেন, প্রতিটি সম্ভাব্য সূত্র খুঁজলেন। তিনি সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করলেন, কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না – শুধু সাদা পর্দা। অ্যালার্ম সিস্টেমের লগ ফাইল পরীক্ষা করলেন, সেখানেও কোনো অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেল না। ছায়া ছিল এতটাই নিখুঁত যে, কোনো আঙুলের ছাপ, কোনো পায়ের ছাপ, এমনকি কোনো ভাঙা কাঁচের টুকরোও পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছিল যেন মূর্তিটি বাতাসে মিলিয়ে গেছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে তুলে নিয়ে গেছে।
ইন্সপেক্টর মুখার্জি রঞ্জন বাবুকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রঞ্জন বাবুর চোখে ছিল শুধু শোক আর একরাশ হতাশা। তিনি জানতেন, এই মূর্তিটি শুধু একটি জিনিস ছিল না, এটি ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, তাঁর অস্তিত্বের প্রতীক, তাঁর সমস্ত সাধনার ফল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যেকোনো মূল্যে তিনি তাঁর বুদ্ধ মূর্তি ফিরে পাবেন। তাঁর চোখে এক অদম্য জেদ দেখা গেল, যা ইন্সপেক্টর মুখার্জিকে মুগ্ধ করল। তিনি ইন্সপেক্টর মুখার্জিকে বললেন, “ইন্সপেক্টর সাহেব, এই মূর্তি আমার কাছে শুধু ব্রোঞ্জের টুকরো নয়। এটি আমার জীবনের সাধনা, আমার আত্মার অংশ। আমি যেকোনো মূল্যে এটি ফিরে পেতে চাই। প্রয়োজনে আমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দেব, আমি ভিক্ষা করব, কিন্তু আমার বুদ্ধকে আমি ফিরে আনবই।”
পুলিশ তাদের তদন্ত শুরু করল। শহরের প্রতিটি প্রাচীন জিনিসপত্রের দোকানে তল্লাশি চালানো হলো, প্রতিটি সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ছায়া যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল, তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ইন্সপেক্টর মুখার্জি বুঝতে পারছিলেন যে এটি কোনো সাধারণ চোরের কাজ নয়। এটি ছিল একজন মাস্টারমাইন্ডের কাজ, যে পুলিশকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল, একজন অদৃশ্য শত্রু। তিনি তার সেরা গোয়েন্দাদের এই কেসের পেছনে লাগালেন, কিন্তু তারাও কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না। সংবাদমাধ্যম এই চুরির খবর ফলাও করে প্রচার করল, যা কলকাতার শিল্প ও সংস্কৃতি মহলে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল, মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে গেল।
রঞ্জন বাবু নিজে তদন্ত শুরু করলেন। তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু, শিল্প সমালোচক, এবং প্রাচীন জিনিসপত্রের ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি জানতেন, ছায়া যতই নিখুঁত হোক না কেন, এই মূর্তিটি বিক্রি করতে গেলে তাকে কোনো না কোনোভাবে বাজারে আসতে হবে, কারণ এত মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ এবং প্রভাব কাজে লাগালেন। তিনি কিছু ব্যক্তিগত গোয়েন্দা নিয়োগ করলেন, যারা শহরের অন্ধকার জগতে ছায়ার খোঁজ করতে শুরু করল। এই গোয়েন্দারা ছিল সমাজের প্রান্তিক মানুষ, যারা শহরের প্রতিটি কোণায় খবর রাখত, প্রতিটি ফিসফাস তাদের কানে পৌঁছাত, তাদের নেটওয়ার্ক ছিল বিশাল। রঞ্জন বাবু তাদের নির্দেশ দিলেন, “যেকোনো মূল্যে, যেকোনো উপায়ে, ছায়ার খোঁজ বের করো। তোমাদের যা লাগবে, আমি দেব। শুধু আমার বুদ্ধকে ফিরিয়ে আনো।” তিনি নিজেও দিনের পর দিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, পুরনো জিনিসপত্রের বাজার, নিলাম ঘর, এমনকি কালোবাজারের সম্ভাব্য আস্তানাগুলোতেও তিনি যেতেন, যদি সামান্যতম সূত্রও পাওয়া যায়। তাঁর এই অদম্য ইচ্ছা ইন্সপেক্টর মুখার্জিকে আরও অনুপ্রাণিত করল।
ছায়া ভেবেছিল সে নিরাপদ। মূর্তিটি চুরি করার পর সে কিছুদিন আত্মগোপন করে রইল, শহরের বাইরে একটি নির্জন বাড়িতে, যেখানে কেউ তাকে চিনত না। সে তার চুরি করা মূর্তিটি নিয়ে গবেষণা করল, তার ঐতিহাসিক মূল্য আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করল, তার গঠনশৈলী বিশ্লেষণ করল। সে জানত যে এই মূর্তিটির আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল চাহিদা রয়েছে। তারপর সে মূর্তিটি বিক্রি করার জন্য একজন আন্তর্জাতিক সংগ্রাহকের সাথে যোগাযোগ করল। এই সংগ্রাহকের নাম ছিল ভিক্টর, যে ছিল প্রাচীন জিনিসপত্রের কালোবাজারের একজন বড় খেলোয়াড়, যার নেটওয়ার্ক ছিল বিশ্বজুড়ে, এবং যার হাতে ছিল অঢেল অর্থ। ভিক্টর মূর্তিটির ঐতিহাসিক মূল্য জানত এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিতে রাজি ছিল। সে জানত যে এই মূর্তিটি তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে, তাকে আরও ক্ষমতাশালী করে তুলবে।
কলকাতার এক গোপন গুদামে, ভিক্টর এবং ছায়ার মধ্যে মিটিং ঠিক হলো। এই গুদামটি ছিল শহরের এক পরিত্যক্ত শিল্পাঞ্চলে, যেখানে কেউ সহজে প্রবেশ করত না, যেখানে কেবল অন্ধকার আর রহস্যের রাজত্ব ছিল। ছায়া জানত, এই লেনদেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় লেনদেন হবে, যা তাকে সারা জীবনের জন্য ধনী করে দেবে। সে সতর্ক ছিল, কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল, তাকে অতিরিক্ত সাহসী করে তুলেছিল। সে জানত না যে রঞ্জন বাবু তার পিছু নিয়েছেন, এবং ইন্সপেক্টর মুখার্জি তার জন্য এক জটিল জাল বুনেছেন, যা থেকে তার পালানো অসম্ভব হবে।
রঞ্জন বাবুর নিয়োগ করা গোয়েন্দারা ছায়ার গতিবিধি অনুসরণ করছিল। তারা জানতে পেরেছিল যে ছায়া ভিক্টরের সাথে যোগাযোগ করেছে এবং একটি গোপন নিলামের আয়োজন করা হয়েছে। এই তথ্য ছিল অমূল্য, যা রঞ্জন বাবুর দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফল। রঞ্জন বাবু ইন্সপেক্টর মুখার্জিকে সব জানালেন। ইন্সপেক্টর মুখার্জি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে একজন সাধারণ মানুষ এত বড় চোরের পিছু নিতে পারে, কিন্তু রঞ্জন বাবুর দৃঢ়তা এবং তাঁর দেওয়া তথ্যগুলো এতটাই সুনির্দিষ্ট ছিল যে তিনি মুগ্ধ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে রঞ্জন বাবু শুধু একজন সংগ্রাহক নন, তিনি একজন যোদ্ধা, একজন সত্যিকারের নায়ক।
পুলিশ একটি গোপন অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করল। তারা ছদ্মবেশে নিলামে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল। ইন্সপেক্টর মুখার্জি তার সেরা অফিসারদের বেছে নিলেন, যারা ছদ্মবেশ ধারণে পারদর্শী ছিল, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারত। তারা সাধারণ পোশাক পরে, সাধারণ মানুষের মতো গুদামে প্রবেশ করল। তাদের হাতে ছিল গোপন ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন, যা প্রতিটি মুহূর্ত রেকর্ড করছিল। রঞ্জন বাবুও তাদের সাথে যেতে চাইলেন, কারণ তিনি তাঁর মূর্তিটি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন, তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন, তার নীরব উপস্থিতি অনুভব করতে চেয়েছিলেন। ইন্সপেক্টর মুখার্জি প্রথমে রাজি না হলেও, রঞ্জন বাবুর আবেগ দেখে তাকে অনুমতি দিলেন, তবে তাকে সতর্ক থাকতে বললেন।
নিলামের দিন, গুদামটি ছিল লোকে লোকারণ্য। কালোবাজারের বড় বড় খেলোয়াড়রা উপস্থিত ছিল। তাদের চোখে ছিল লোভ আর উত্তেজনা, তাদের মুখে ছিল এক অদ্ভুত হাসি। ছায়া কালো পোশাকে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে এক বিজয়ের হাসি, তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য। সে জানত না যে তার চারপাশে পুলিশের জাল বুনে দেওয়া হয়েছে, এবং তার স্বপ্ন খুব শীঘ্রই ভেঙে যাবে। ভিক্টর মঞ্চে উঠে বুদ্ধ মূর্তিটি প্রদর্শন করল। মূর্তিটি দেখে রঞ্জন বাবুর চোখে জল এসে গেল। তিনি জানতেন, এই মূর্তিটি তাঁর জীবনের অংশ, তাঁর আত্মার প্রতিচ্ছবি, তাঁর সমস্ত অস্তিত্বের প্রতীক।
নিলাম শুরু হলো। দাম বাড়তে লাগল। কালোবাজারের সংগ্রাহকরা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে দাম হাঁকছিল, তাদের মুখে ছিল এক অদ্ভুত উন্মাদনা। যখন দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাল, এবং ভিক্টর হাতুড়ি নামাতে যাচ্ছিল, তখন ইন্সপেক্টর মুখার্জি এবং তার দল ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। “পুলিশ!” এই শব্দে পুরো গুদাম স্তব্ধ হয়ে গেল, যেন সময় থমকে গেছে। ছায়া হতবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার খেলা শেষ, তার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলল। তার সমস্ত কৌশল, তার সমস্ত দক্ষতা ব্যর্থ হয়ে গেল রঞ্জন বাবুর অদম্য ইচ্ছা আর ইন্সপেক্টর মুখার্জির কৌশলের কাছে। ছায়াকে হাতকড়া পরানো হলো, তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা, এক গভীর হতাশা।
ছায়াকে গ্রেপ্তার করা হলো। তার সাথে ভিক্টরকেও ধরা হলো। তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হলো, এবং তাদের সমস্ত অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ জগতেও এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। রঞ্জন বাবু তাঁর প্রিয় ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তিটি ফিরে পেলেন। মূর্তিটি হাতে নিয়ে তিনি এক গভীর স্বস্তি অনুভব করলেন। তাঁর চোখে আনন্দাশ্রু দেখা গেল, তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত হাসি। তিনি বুঝতে পারলেন, ইতিহাসের মূল্য শুধু টাকায় মাপা যায় না, এর মূল্য তার ঐতিহ্য এবং তার গল্পের মধ্যে নিহিত। এই মূর্তিটি শুধু একটি বস্তু ছিল না, এটি ছিল তাঁর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল – ধৈর্য, অধ্যবসায়, এবং ভালোবাসার গভীরতা।
ছায়ার কাছ থেকে পুলিশ আরও অনেক চুরির রহস্য উদ্ঘাটন করল। তার নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হলো, এবং সে তার কৃতকর্মের জন্য কঠোর শাস্তি পেল। এই ঘটনা কলকাতার অপরাধ জগতে এক নতুন বার্তা দিল – কোনো অপরাধীই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, যতই নিখুঁত হোক না কেন, সত্যের জয় হবেই।
রঞ্জন বাবু তাঁর সংগ্রহশালাকে আরও সুরক্ষিত করলেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি, তিনি শিখলেন যে ভালোবাসার জিনিসকে রক্ষা করতে হলে শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন হয় অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তিনি তাঁর জীবনের বাকিটা সময় প্রাচীন শিল্পের সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য উৎসর্গ করলেন। তিনি একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন শিল্পকর্ম উদ্ধার এবং তাদের সংরক্ষণ করা। তাঁর বাড়িটি আবার তার পুরনো গৌরব ফিরে পেল, আর ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তিটি আবার তার জায়গায় ফিরে এসে নীরব সাক্ষী হয়ে রইল মানব জীবনের উত্থান-পতনের, বিশ্বাস আর ভালোবাসার এক নতুন গল্পের। রঞ্জন বাবু জানতেন, এই গল্প কেবল একটি চুরির গল্প নয়, এটি ছিল বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধার গল্প, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মনে গেঁথে থাকবে। কলকাতার বুকে এক নতুন ভোরের সূচনা হলো, যেখানে শিল্প আর ইতিহাস সুরক্ষিত থাকবে, আর ছায়ার মতো অন্ধকার শক্তি পরাজিত হবে আলোর কাছে, এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে।
~সমাপ্ত~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion