বাংলার এক ছোট্ট গ্রাম, নাম কান্দাপাড়া। শহরের লোকেরা বলে, এই গ্রামে সময় আটকে গেছে। পাকা রাস্তা নেই, মোবাইল সিগনালও দুর্বল। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল—এই গ্রামের একদম প্রান্তে থাকা পুরনো রাজবাড়ি, যেখানে বহু বছর কেউ থাকে না।
সেই বাড়িতে একসময় বাস করত রাজেন্দ্র সিংহ—জমিদার, যার দাপটে একসময় কাঁপত গোটা এলাকা। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর জমিদারির বিলোপ হলে, রাজেন্দ্রবাবু একরকম ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। কেমন জানি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামের লোকেরা বলে, এক রাতে তিনি তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে খুন করে নিজেই গলায় দড়ি দেন। তারপর থেকেই রাজবাড়ি অভিশপ্ত হয়ে ওঠে।
সময় কাটে, কিন্তু গল্প থামে না। লোকেরা বলে, রাত নামলে সেই বাড়ির দেওয়ালের ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—কারও কান্না, কারও হাসি, কখনও আবার পায়ের আওয়াজ। বহু মানুষ সাহস করে সেখানে গিয়েছিল, কেউ কেউ ফিরেও আসেনি।
২০২০ সাল। সুদীপ সাহা, একজন যুবক লেখক, যার আগ্রহ পুরনো কাহিনি ও ভৌতিক ইতিহাসে। তার সর্বশেষ বই ‘অতীতের আয়নায়’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এবার সে খুঁজছে নতুন কিছু—যা বাস্তবের সাথে মিশে আছে, তবু রয়ে গেছে রহস্যে ঢাকা।
সুদীপ কাগজে পড়ল কান্দাপাড়া রাজবাড়ির কথা। রহস্য, আতঙ্ক আর অতীত—সব মিলে এটি যেন আদর্শ। সে ঠিক করল, নিজেই সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান করবে। বন্ধুদের কেউ রাজি হল না। অবশেষে একাই বেরিয়ে পড়ল।
গ্রামে পৌঁছাতেই, লোকজন ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। যখন জানল সে রাজবাড়িতে থাকবে—তারা বলল, “বাবু, পাপ করবেন না। সেই বাড়ি অভিশপ্ত। রাত্রি হইলে মরণ ডাক আসে।”
সুদীপ হেসে বলল, “ভূতের চেয়ে জীবিত মানুষেরাই বেশি ভয়ানক।” সে স্থানীয় একজন বৃদ্ধ, খোকন দার বাড়িতে উঠে পড়ল, যিনি রাজবাড়ি চেনে এবং অনেক পুরনো কথা জানেন।
রাতের খাবার শেষে খোকন দা ধীরে ধীরে বললেন, “বাবা, আমিও ছোটবেলায় গেছি ওই বাড়িতে। রাজেন্দ্র সিংহের ছেলে অভি ছিল আমার বন্ধু। কিন্তু সেদিন রাত… যেদিন ওদের খুন হল, আমিও ছিলাম ওদের বাড়ির কাছেই। আমি শুধু শুনেছিলাম, এক অসম্ভব কান্নার আওয়াজ, আর তারপর নিস্তব্ধতা। অনেক বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু সেই কান্না আজও কানে বাজে…”
সুদীপ সিদ্ধান্ত নিল, পরদিন সকালে রাজবাড়ি যাবে।
সকালবেলা, কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাজবাড়ি যেন জীবন্ত কোনও দানব। তার ছায়া পড়ে গোটা মাঠে। সুদীপ পা ফেলে ভেতরে ঢুকতেই শরীরজুড়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ খেলে গেল।
বাড়ির দরজা খোলা ছিল, যেন কেউ অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
মেঝেতে ধুলো জমে, তবু সুদীপ দেখতে পেল টাটকা চিহ্ন—পায়ের ছাপ, যা সিঁড়ির দিকে উঠে গেছে। ঘরে আলো নেই, শুধু এক পুরনো জর্দার আলমারির ওপরে ঝুলন্ত আয়না। সে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে গিয়ে চমকে উঠল—প্রতিচ্ছবিতে যেন কেউ দাঁড়িয়ে তার ঠিক পিছনে।
সে ঘুরে দাঁড়াল। কিছুই নেই।
তবু একটা শব্দ শোনা গেল—কী যেন ফিসফিস করছে, কোথাও দূর থেকে। “এখানে এসো…”
সুদীপ পা ফেলল ধীরে ধীরে। একটা ঘরে ঢুকতেই বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, যেন কারও নিঃশ্বাস তার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালের গায়ে লেখা:
“ওরা ফিরে আসতে চায়।”
ঘরের এক কোণে পাওয়া গেল পুরনো এক খাতা—চাঁদমণি দেবীর ডায়েরি, রাজেন্দ্র সিংহের স্ত্রী।
সেখানে লেখা:
“আজ অভিকে দেখলাম বারান্দায়, কিন্তু ও তো… ও তো মরে গেছে। সে বলল, ‘মা, আমি ফিরে এসেছি’। কিন্তু ওর চোখ ছিল ফাঁকা, মুখে কোনো আবেগ নেই। ওটা অভি ছিল না…”
সুদীপ বুঝল, এ কেবল হত্যা নয়, এ এক প্রাচীন কিছু—যা মানুষকে টেনে রাখে, কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রতারণা করে।
রাতে, খোকন দার বাড়ি ফিরে, সে সব ঘটনা খুলে বলল।
খোকন দা মুখ ফ্যাকাশে করে বললেন, “তুই ফিরে আসতে পেরেছিস, সেটাই আশ্চর্য। জানিস, ওই আয়নাটা… ওইটা নাকি আত্মার দরজা। কেউ যদি ভিতরে তাকায় আর ডাক শুনে সাড়া দেয়, ওর আত্মা আটকে যায়।”
সুদীপ চুপচাপ শুনল।
খোকন দা বললেন, “যদি সত্যিই সত্য জানতে চাস, তোর ওই ডায়েরি নিয়েই কাল আবার ঘুরে যা। কিন্তু সাবধান—কোনো ডাকেই সাড়া দিবি না।”
পরদিন ভোরবেলা, কুয়াশা আরও ঘন। খোকন দা সুদীপকে বললেন, “আজ পূর্ণিমা। এই রাতে সব আত্মা তীব্র হয়ে ওঠে। সাবধানে যা।”
সুদীপ ব্যাগে ডায়েরি, একটি পকেট লাইট, সেল ফোন, আর এক টুকরো সিদ্ধ গন্ধরাজ ফুল নিয়ে বের হল। তার ঠাকুরমা বলতেন, “ভূতের গায়ে গন্ধরাজ লাগে না।”
রাজবাড়ির সামনে পৌঁছাতেই আবার শুনল সেই গলার আওয়াজ, এবার স্পষ্ট:
“তুমি এসেছো… ঠিক সময়ে।”
সে ভিতরে ঢুকল। দেওয়ালজুড়ে পুরনো ছবি, যেগুলোর চোখ যেন তাকে অনুসরণ করছে। হঠাৎ এক দরজা খসে পড়ল, পেছনে বন্ধ হয়ে গেল। বাতাস হিম, নিঃশ্বাস আটকে আসে।
ডায়েরি খুলে দেখল এক নতুন পৃষ্ঠা, যেটা আগেরদিন ছিল না:
“তিন রাত্রি পর আত্মারা জাগে। যদি কেউ তাদের ডাকে, তারা ফিরে আসে, কিন্তু পূর্ণ রূপে নয়। অভিকে আমি ফিরিয়ে এনেছিলাম, কিন্তু ওর চোখে আমি নিজেকে চিনতে পারিনি…”
তখনই হঠাৎ সে অনুভব করল, কেউ যেন খুব কাছ থেকে তাকিয়ে আছে। ঘুরতেই দেখতে পেল ছায়া, লম্বা, অবয়বহীন, তবু চোখদুটি যেন জ্বলছিল।
সুদীপ চিৎকার করে ফেলল, “কে আছো?”
উত্তর এল—একটা শিশুর গলা, ভাঙা, অথচ পরিচিত:
“তুমি লেখক… তুমি আমাদের গল্প লেখো। আমাদের নাম দাও। তবেই মুক্তি…”
সুদীপ হঠাৎ বুঝল—এই আত্মারা আটকে আছে, কারণ তাদের কথা কেউ লেখেনি, কেউ বিশ্বাস করেনি। তারা চায় কেউ তাদের কথা শুনুক।
সে ডায়েরিতে লেখা শুরু করল—
• অভিজিৎ সিংহ: ৮ বছরের ছেলে, গুলির শব্দে মৃত্যু।
• চাঁদমণি দেবী: বিষ খেয়ে আত্মহত্যা, চোখে ছিল সন্তানহীন হতাশা।
• রাজেন্দ্র সিংহ: পাগল হয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে খুন করে নিজে ফাঁসি দেয়।
প্রতি নাম লেখার সাথে সাথে দেওয়াল কাঁপে, বাতাসে কান্নার শব্দ আর ছায়ারা এক এক করে মিলিয়ে যায়।
শেষ নামটা লিখতে গিয়ে তার হাত কেঁপে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে—ছোটবেলা থেকে পরিচিত মুখ—তার হারিয়ে যাওয়া বোন, রুনা, যাকে সে মনে করত হারিয়ে গেছে নদীর জলে।
রুনার গলা কাঁপছে, “তুই আমায় ভুলে গেছিস, দাদা।”
সুদীপের চোখ ভিজে গেল।
সে লিখল, “রুনা সাহা: নিখোঁজ, নয় বছর বয়সে, কিন্তু আত্মা ফিরে এসেছিল একদিন, কিছু বলার জন্য।”
রুনা হাসল, ফিসফিস করে বলল, “এবার আমিও যাব।”
তারপর ছায়া মিলিয়ে গেল।
সেই রাতে রাজবাড়ির দেয়াল ফেটে পড়ে। ভোরে লোকজন এসে দেখে—শুধু ধ্বংসস্তূপ। আর কিছুই নেই।
কিন্তু ধুলোয় ছাপ রাখা একখানি খাতা খুঁজে পাওয়া গেল—ডায়েরি, যেখানে লেখা ছিল সমস্ত নাম, সমস্ত আত্মার গল্প।
ঘটনার পর দুই দিন কেটে গেছে। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত, রাজবাড়ির ধ্বংসের পর ‘অভিশাপ’ শেষ। কিন্তু সত্যি কি তা-ই?
সুদীপ শহরে ফিরে গেল। সে ডায়েরির প্রতিলিপি তৈরি করল, লেখা শুরু করল একটি নতুন বই—“অভিশপ্ত দরজা”। তবে তার মন খালি লাগত। রাতে ঘুম ভাঙত—কানে আসত সেই শিশুকণ্ঠ: “তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো, দাদা?”
একদিন তার মেইলে এল একটি অচেনা নাম থেকে চিঠি: “আপনার লেখা গল্পটি পড়েছি। কিন্তু আপনি একজনকে বাদ দিয়েছেন।”
চিঠির নিচে লেখা: “R. S.”
সে বুঝল—রাজেন্দ্র সিংহ!
সেই রাতে আবার সে শুনল ফিসফিস:
“আমাকে তুমি লেখোনি। আমি এখনও আটকে আছি…”
সুদীপ ডায়েরি ঘেঁটে দেখল—সে সত্যিই রাজেন্দ্র সিংহের আত্মাকে ঠিকমতো ‘লিপিবদ্ধ’ করেনি। তার মৃত্যুর আগে কী ঘটেছিল, তার ভিতরের যুদ্ধ, নিজের সন্তানকে খুন করার পেছনের অন্ধকার… এসব অনুপস্থিত।
সে বুঝল—এ গল্প এখনও শেষ হয়নি।
সে ফিরে গেল গ্রামে। কিন্তু এবার রাজবাড়ির জায়গায় শুধু একটি বুনো বাগান, কাঁটাঝোপ আর ঘন জঙ্গল।
সে খোঁজ নিল পুরনো সরকারি রেকর্ডে—রাজেন্দ্র সিংহ শেষ জীবনে এক পুরোহিতের কাছে যেতেন, কারও আত্মা ফিরিয়ে আনতে চেয়ে। অর্থাৎ, হত্যার পেছনে ছিল তন্ত্র, অন্ধ বিশ্বাস।
এক বৃদ্ধ পুরোহিতের খোঁজ পেল সে—বদলপুর গ্রামে। তিনি এখন অন্ধ, কিন্তু বললেন, “জমিদার বলেছিল, ‘আমি আমার ছেলেকে আবার দেখতে চাই।’ আমি তাকে বলেছিলাম, আত্মা ডেকে আনা বিপজ্জনক। কিন্তু সে শোনেনি। যে আত্মা ফিরে আসে, সে খাঁটি নয়।”
“তারপর?” জিজ্ঞেস করল সুদীপ।
“সেই রাতে আমি শুধু শুনেছিলাম—রাজেন্দ্র কাঁদছে, বলছে, ‘এটা আমার ছেলে না… এটা শূন্য।’ তারপর নীরবতা।”
সুদীপ ঠিক করল, এবার সে রাজেন্দ্র সিংহের কাহিনি লিখবে শেষ পর্যন্ত—তার বিশ্বাস, তার ভুল, তার পাপ। সে বসে গল্প লিখল—নাম দিল “এক পিতার প্রেতপূরণ”।
সেই রাতে, শেষ লাইনে লেখা শেষে, সে শুনল জানালার পাশে হালকা আওয়াজ।
সে জানালা খুলে দেখল—দূর আকাশে যেন আলো জ্বলে উঠছে, এক অজানা শান্তির আবেশ।
কোথাও থেকে আসছে সেই ভয়েস:
“এবার আমি যেতে পারি।”
সুদীপ কলকাতায় ফিরে এসে গল্পটি শেষ করল, পাণ্ডুলিপির নাম দিল “দেওয়ালের ওপাশে”।
কিন্তু সেই রাতেই আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এল। ডায়েরির পাতা নিজে থেকেই উল্টে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ঠান্ডা নিঃশ্বাসের মতো শব্দে সে শুনল—
“তুমি সকলের নাম লিখেছো… কিন্তু নিজের নাম লিখোনি।”
সে হঠাৎ বুঝতে পারল—এই যাত্রায় তার নিজের আত্মাও কোনও একভাবে জড়িয়ে পড়েছে। রাজবাড়িতে যে ডাক সে শুনেছিল, তার প্রতিচ্ছবি—সব কিছু যেন তাকে টেনে নিয়েছে ওই জগতের সাথে।
ডায়েরির শেষ পাতায় হঠাৎ দেখা গেল তার নিজের নাম লেখা—
“সুদীপ সাহা: সেই লেখক, যে জানে বেশি, এবং ফিরে এলেও পুরোপুরি নয়।”
সে হিমশীতল হয়ে গেল। আয়নায় নিজের ছায়া দেখতে গিয়ে দেখে, মুখ একই রকম, কিন্তু চোখ যেন ফাঁকা। অনুভূতিহীন।
ঘরের এক কোণে টেবিলের ওপরে রাখা ক্যামেরাটি হঠাৎ নিজে থেকেই চালু হয়ে গেল। স্ক্রিনে তার মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তখনই ক্যামেরা স্ক্রিনে অন্য আরেকটি মুখ ভেসে উঠল, হুবহু তার মতো, কিন্তু অন্ধকারে ডুবে—চোখ নেই, মুখে বিকৃত হাসি।
পেছনে একটি আওয়াজ:
“তুই এখন আমাদেরই একজন…”
ঘর অন্ধকারে ঢেকে গেল।
পরদিন সকালে খোকন দা শহরে এসে তার বাড়ি খুঁজে পান। দরজা খোলা, ঘর এলোমেলো। কিন্তু সুদীপ নেই।
শুধু পড়ে আছে একটি খাতা—“দেওয়ালের ওপাশে”।
খোকন দা সেটি হাতে নিয়ে বাইরে বের হলেন। কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেলেন জানালায় একটি ছায়া—সুদীপ?
সে চোখে চোখ রাখল। কিন্তু মুখে ছিল কিছু নেই—একটা শূন্যতা, এক গভীর দৃষ্টির অভিশাপ।
আজও সেই ডায়েরি নিয়ে কেউ কিছু জানে না। কেউ পড়ে না। কারণ লোকেরা বলে—যে এই গল্প শেষ পর্যন্ত পড়ে, সে গল্পের একাংশ হয়ে যায়।
আর মাঝে মাঝে রাতে, পুরনো কোনো দেওয়ালের ফাঁকে ফিসফিস করে আওয়াজ আসে:
“তুমি কী সত্যিই সবটা লিখেছো…?”
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion