ডিজিটাল ভূত: স্ক্রিনের ওপার থেকে
সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বর্ষার এক অলস দুপুরে অর্ক, রিমা, সায়ন আর মিতুল অর্কের ফ্ল্যাটে আড্ডা দিচ্ছিল। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, আর ভেতরে তাদের ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলছিল নতুন ওয়েব সিরিজ দেখার প্রস্তুতি। অর্কের ফ্ল্যাটটা শহরের এক পুরনো পাড়ায়, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পুরনো বাড়ির গন্ধ এখনও লেগে আছে। জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ধারা নামছিল, আর ভেতরের উষ্ণ পরিবেশে তাদের গল্পগুজব জমে উঠেছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা হাসাহাসি করছিল, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছিল, যখন হঠাৎই রিমা পুরনো একটা আলমারি থেকে একটা ধুলোমাখা, প্রায় জং ধরা ল্যাপটপ বের করে আনল। ল্যাপটপের গা থেকে একটা পুরনো, ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে আসছিল, যেন বহুদিনের অব্যবহারের ছাপ। ল্যাপটপের কোণায় কোণায় লেগে থাকা ধুলো আর মাকড়সার জাল দেখে মনে হচ্ছিল, এটি যেন সময়ের সাথে থমকে থাকা এক অতিত। “আরে, এটা তো অর্কের মেজকাকুর ল্যাপটপ! উনি তো বছর পাঁচেক আগে উধাও হয়ে গেলেন, কেউ আর তাঁর খোঁজ পায়নি,” রিমা বলল, ল্যাপটপের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে। তার চোখে কৌতূহল আর হালকা ভয় মেশানো দৃষ্টি, যেন সে নিজেই কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর মুখোমুখি হয়েছে, যার সাথে জড়িয়ে আছে এক নিদারুণ রহস্য।
অর্ক ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে দেখল। তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা। “হ্যাঁ রে, কাকু তো এটা নিয়েই কাজ করতেন। তারপর একদিন সকালে দেখি উনি নেই, ল্যাপটপটাও বন্ধ। সবাই ভেবেছিল উনি হয়তো রাগ করে কোথাও চলে গেছেন।” অর্কের মেজকাকু, অভ্রনীল সেনগুপ্ত, ছিলেন একজন অদ্ভুত খেয়ালি মানুষ। তিনি ছবি তুলতেন, পুরনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করতেন, আর রহস্যময় সব বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা পরিবারের কাছে একটা বড় ধাক্কা ছিল, কিন্তু পুলিশও কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি। অভ্রনীলের স্ত্রী, অর্কের পিসি, এই ঘটনায় এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তিনি শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও ফিরে আসেননি। কাকুর ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল, আর এই ল্যাপটপটা আলমারির এক কোণে পড়ে ছিল বিস্মৃতির চাদরে মোড়া, যেন সে নিজেই কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছে, বহু বছর ধরে নীরব সাক্ষী হয়ে। ল্যাপটপের শীতল ধাতব স্পর্শ অর্কের হাতে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে তুলল, যেন যন্ত্রটি তার ভেতরের জমাট বাঁধা রহস্যের ভারে ভারী হয়ে আছে।
কৌতূহলবশত সায়ন ল্যাপটপটা চালু করার চেষ্টা করল। সে পাওয়ার বাটন টিপতেই একটা পুরনো, ধীরগতির ফ্যান চলার শব্দ শোনা গেল। ল্যাপটপটা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেগে উঠল। আশ্চর্যের বিষয়, বহু বছর বন্ধ থাকার পরেও ল্যাপটপটা চালু হয়ে গেল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে জাগিয়ে তুলল, দীর্ঘ ঘুম থেকে। স্ক্রিনে উইন্ডোজের পুরনো লোগো ভেসে উঠল, তারপর একটা পুরনো সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল খোলা ছিল – মেজকাকু, অর্থাৎ অভ্রনীল সেনগুপ্তের প্রোফাইল। প্রোফাইলটা শেষ আপডেট হয়েছিল পাঁচ বছর আগে, যেদিন তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। প্রোফাইলের শেষ পোস্টটি ছিল একটি অস্পষ্ট ছবি, যেখানে অভ্রনীল কাকু একটি ভাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যা কৌতূহল নাকি উন্মাদনা, তা বোঝা কঠিন। ক্যাপশনে লেখা, ‘রহস্যের সন্ধানে এক নতুন পথ…।’
তারা হাসাহাসি করছিল, ল্যাপটপের পুরনো মডেল আর ধীর গতি দেখে। তাদের কাছে এটা একটা পুরনো দিনের কৌতূহল ছাড়া আর কিছু ছিল না। তারা ভাবছিল, হয়তো কোনো পুরনো ভাইরাস বা সিস্টেমের ত্রুটি। কিন্তু হঠাৎই স্ক্রিনটা একবার কেঁপে উঠল, যেন কোনো বিদ্যুৎ চমকে গেল। প্রোফাইল পিকচারটা ঝাপসা হয়ে গেল, আর কভার ফটোতে একটা পুরনো, ভাঙা বাড়ির ছবি ভেসে উঠল – ঠিক যে বাড়িটার সামনে অভ্রনীল কাকু দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপরই একটা নতুন পোস্ট দেখা গেল, তারিখটা আজকের! শুধু একটা শব্দ লেখা, “দেখো।” আর তার নিচে একটা অদ্ভুত চিহ্ন, যা কোনো পরিচিত ভাষার অংশ নয়, বরং প্রাচীন কোনো চিত্রলিপির মতো। চিহ্নটা যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে হাসছে, তাদের অজ্ঞতাকে উপহাস করছে, এক অলৌকিক ইঙ্গিত নিয়ে। ল্যাপটপের ফ্যান দ্রুত ঘুরতে শুরু করল, যেন যন্ত্রটি নিজেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
চারজনই চমকে উঠল। হাসাহাসি থেমে গেল। ঘরের ভেতরের আবহাওয়া যেন হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে গেল, তাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। “এটা কী হলো? কাকু তো নেই!” অর্ক বলল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ। তার মনে হচ্ছিল, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তাদের কাঁধ ছুঁয়ে গেল, একটা শীতল স্পর্শ, যা তাদের মেরুদণ্ড বেয়ে নিচে নেমে গেল।
“হ্যাক হয়েছে হয়তো,” সায়ন বলল, কিন্তু তার গলাতেও একটা অজানা ভয়। ল্যাপটপের ঘড়িতে তারিখ আর সময় ঠিক দেখাচ্ছে, অথচ পোস্টের তারিখ আজকের! এটা কিভাবে সম্ভব? তাদের যুক্তি আর বাস্তবতার মধ্যে একটা অদৃশ্য ফাটল তৈরি হতে শুরু করল, যা তাদের স্বাভাবিক বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। তাদের মন মানতে চাইছিল না, কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছিল, তাকে অস্বীকার করারও কোনো উপায় ছিল না।
পরের কয়েকদিন ধরে ঘটনাগুলো বাড়তে লাগল, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে। ল্যাপটপটা বন্ধ রাখলেও মাঝেমধ্যে নিজে থেকেই চালু হয়ে যেত, স্ক্রিন থেকে একটা মৃদু নীলচে আলো বেরিয়ে আসত যা ঘরের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলত। অভ্রনীল কাকুর প্রোফাইলে নতুন নতুন পোস্ট আসত, শুধু একটা শব্দ বা একটা অস্পষ্ট ছবি। ছবিগুলো ছিল সেই ভাঙা বাড়িটার ভেতরের, যেখানে অন্ধকার আর ধুলো ছাড়া কিছুই দেখা যেত না। কখনও একটা ভাঙা মূর্তি, কখনও একটা পুরনো লোহার সিন্দুক, আবার কখনও শুধু একটা দেয়ালের ফাটল। ছবিগুলোর কোণায় কোণায় যেন এক অশুভ ছায়া লুকিয়ে থাকত, যা চোখ এড়িয়েও মনকে অস্বস্তিতে ফেলত। তাদের মেসেঞ্জারেও অদ্ভুত মেসেজ আসত, এলোমেলো অক্ষর আর সংখ্যা। এই অক্ষর আর সংখ্যাগুলো যেন কোনো কোড, যা তারা বুঝতে পারছিল না। রাতে যখন তারা ঘুমিয়ে থাকত, ল্যাপটপ থেকে মৃদু ফিসফিসানির শব্দ আসত, যা তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিত। কখনও মনে হতো কেউ তাদের নাম ধরে ডাকছে, কখনও মনে হতো কেউ যেন তাদের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দরজা খুললে কেউ থাকত না। তাদের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে, তাদের প্রতিটি কথা শুনছে। তাদের ব্যক্তিগত কথোপকথনেও ল্যাপটপের মেসেজগুলো থেকে ইঙ্গিত আসত, যা তাদের আরও আতঙ্কিত করে তুলত। মিতুল তার ফোন চেক করত বারবার, মনে হতো যেন তার ফোনের ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর রিমা অভিযোগ করত তার ল্যাপটপও অদ্ভুতভাবে হ্যাং করছে। ডিজিটাল জগতের এই অদ্ভুত হস্তক্ষেপ তাদের দৈনন্দিন জীবনকে অস্থির করে তুলেছিল। এমনকি তাদের স্মার্টফোনেও মাঝে মাঝে কাকুর প্রোফাইলের নোটিফিকেশন আসত, যদিও তারা সেই প্রোফাইল ফলো করত না। একবার রিমা তার ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল পেয়েছিল, যেখানে শুধু স্ট্যাটিকের শব্দ আর কিছু অস্পষ্ট শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
রিমা বলল, “আমার মনে হয় কাকু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। হয়তো উনি মারা গেছেন, আর তার আত্মাই আমাদের কিছু বলতে চাইছে।” রিমার কথা শুনে মিতুল রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। তার চেহারায় স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ। “কিন্তু কী? আর কেন এই ল্যাপটপ দিয়ে? এটা তো একটা ডিজিটাল ভূত!” মিতুল ল্যাপটপটা ছুঁতে চাইছিল না, তার মনে হচ্ছিল ওটা যেন একটা জীবন্ত সত্তা, তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তার রাতের ঘুম কমে গিয়েছিল, আর দিনের বেলায়ও সে কেমন যেন অস্থির থাকত, চারপাশে অদ্ভুত কিছু আছে কিনা, তা নিয়ে সর্বদা সন্দিহান থাকত। সায়ন, যে সবসময় যুক্তিবাদী ছিল, সেও এখন দ্বিধায় ভুগছিল। তার বৈজ্ঞানিক মন এই ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না। সে ইন্টারনেটে ‘ডিজিটাল প্রেতাত্মা’ বা ‘ইলেকট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা’ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল, কিন্তু কোনো বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পেল না।
অর্ক আর সায়ন সিদ্ধান্ত নিল, তারা অভ্রনীল কাকুর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা নিয়ে আবার তদন্ত করবে। তারা কাকুর পুরনো ডায়েরি আর ফাইলপত্র ঘাঁটা শুরু করল। অর্ক কাকুর পুরনো লাইব্রেরিতে একটা ধুলোমাখা ট্রাঙ্ক খুঁজে পেল, যার ভেতরে কাকুর হাতে লেখা কিছু নোটবুক আর গবেষণাপত্র ছিল। নোটবুকগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে তারা জানতে পারল, অভ্রনীল কাকু একজন শখের প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি একটি প্রাচীন পুঁথি নিয়ে গবেষণা করছিলেন, যেখানে একটি হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের কথা লেখা ছিল। সেই গুপ্তধন নাকি একটি অভিশপ্ত মন্দিরের নিচে লুকানো। কাকু বিশ্বাস করতেন, মন্দিরের অভিশাপের কারণে বহু মানুষ মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে। তার নোটবুকগুলোতে সেই মন্দিরের বর্ণনা ছিল, যা তিনি ‘ছায়ামন্দির’ নামে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “ছায়ামন্দির কেবল একটি স্থান নয়, এটি একটি প্রবেশদ্বার। যে একবার এর গভীরে প্রবেশ করে, সে আর ফিরে আসতে পারে না, যদি না অভিশাপের মূল উৎস ধ্বংস করা হয়।” কাকুর লেখাগুলো পড়ে তাদের গা ছমছম করে উঠল। প্রতিটি পাতায় যেন কাকুর ভয় আর উন্মাদনা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তার শেষ দিনগুলোর মানসিক অবস্থা যেন তারা অনুভব করতে পারছিল। নোটবুকগুলোর শেষ কয়েকটি পাতা ছিল অস্পষ্ট ছবি আর এলোমেলো আঁকা, যেন কোনো আতঙ্কিত হাতে আঁকা।
তারা কাকুর ডায়েরিতে সেই ভাঙা বাড়িটার একটা হাতে আঁকা ম্যাপ পেল। বাড়িটা শহরের উপকণ্ঠে, বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। কাকুর শেষ পোস্টের ছবিটা সেই বাড়িরই ছিল। ডায়েরির শেষ পাতায় কাঁপাকাঁপা অক্ষরে লেখা ছিল, “আমি মন্দিরের প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছি। অভিশাপ ভাঙার একমাত্র উপায় পুঁথিটি ধ্বংস করা। কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে… ওরা আসছে… তাদের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি… তারা আমার ডিজিটাল পদচিহ্ন অনুসরণ করছে… এটাই আমার শেষ আশা।” লেখাটা যেন কাকুর শেষ আর্তনাদ হয়ে তাদের কানে বাজছিল, এক অসহায় মানুষের শেষ আকুতি, যা সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছেছে। ডায়েরির নিচে একটা ছোট, পুরনো চাবির গোছা পাওয়া গেল, যা দেখে মনে হলো কোনো পুরনো সিন্দুকের চাবি।
“তার মানে কাকু ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন!” সায়ন উত্তেজিত হয়ে বলল। “আর হয়তো সেখানেই কিছু একটা হয়েছে।” অর্ক কাকুর নোটবুক থেকে সেই অদ্ভুত চিহ্নটা খুঁজে পেল, যা ল্যাপটপের প্রথম পোস্টে এসেছিল। এটা ছিল সেই অভিশপ্ত মন্দিরের প্রতীক, যা প্রাচীন কোনো সভ্যতার অংশ। চিহ্নটা দেখে তাদের মনে হলো, যেন তারা কোনো নিষিদ্ধ জ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যার গভীরে প্রবেশ করলে আর ফেরা সম্ভব নয়। সেই চিহ্নটি যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, এক অদেখা বিপদ সংকেত নিয়ে।
তারা চারজন মিলে সেই ভাঙা বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাড়িটা শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, একটা নির্জন এলাকায় অবস্থিত। চারপাশে ঘন জঙ্গল, আর বাড়িটার ওপর একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। বাড়িটা সত্যিই ভৌতিক। চারদিকে আগাছা আর ভাঙা দেয়াল, যেন বাড়িটা নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আকাশ তখনো মেঘলা, আর বাড়িটার ওপর একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। ভেতরে ঢুকতেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর পচা পাতার স্তূপ। ল্যাপটপের স্ক্রিনে যে অস্পষ্ট ছবিগুলো দেখেছিল, সেগুলো এখন স্পষ্ট চোখের সামনে। প্রতিটি ঘরেই একটা অদ্ভুত নীরবতা, যা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। তাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিল না। ঘরের কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল, আর ভাঙা আসবাবপত্রগুলো যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, তাদের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছে না, বরং সতর্ক করছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক অদেখা ভয়ের উপস্থিতিতে, যেন প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ভয়ের কণা মিশে আছে। তাদের মনে হচ্ছিল, বাড়িটা যেন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করছে। বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির শব্দও যেন ভেতরে প্রবেশ করে না, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা পুরো বাড়িটাকে গ্রাস করে রেখেছে।
তারা কাকুর প্রোফাইলে আসা মেসেজগুলোর সূত্র ধরে এগোতে লাগল। মেসেজগুলোতে কিছু সংখ্যা ছিল, যেগুলো আসলে ঘরের নম্বর আর কিছু তারিখ। তারা প্রতিটি ঘর খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, দেয়ালে আঁকা পুরনো ছবি, ভাঙা আসবাবপত্র। একটা ঘরে তারা একটা পুরনো রেডিও পেল, যেটা নিজে থেকেই চালু হয়ে অদ্ভুত স্ট্যাটিক শব্দ করতে লাগল। রিমার মনে হলো, স্ট্যাটিকের মধ্যে যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে, কিন্তু শব্দগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। মিতুল ভয়ে অর্কের হাত শক্ত করে ধরেছিল, তার হাত কাঁপছিল। সায়ন বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল, যেন কেউ তাদের অনুসরণ করছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছে। তাদের মনে হচ্ছিল, বাড়িটার প্রতিটি কোণায় যেন অদৃশ্য চোখ লুকিয়ে আছে, তাদের প্রতিটি নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎই তাদের ফোনের নেটওয়ার্ক উধাও হয়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
একসময় তারা একটা পুরনো লাইব্রেরি ঘরে এসে পৌঁছাল। ঘরটা বই আর পুঁথিতে ভরা ছিল, যদিও বেশিরভাগই পোকায় কাটা বা নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে এসেই ল্যাপটপটা আবার নিজে থেকেই চালু হয়ে গেল, আর স্ক্রিনে কাকুর প্রোফাইল থেকে একটা নতুন মেসেজ ভেসে উঠল: “শেলফের পেছনে… আলো… চিহ্ন।” ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে একটা মৃদু আলো এসে একটা নির্দিষ্ট শেলফের দিকে নির্দেশ করল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের পথ দেখাচ্ছে, তাদের গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শেলফের নিচে মেঝেতে কিছু পুরনো, শুকনো রক্ত ও কাদা লেগে ছিল, যা তাদের মনে আরও ভয় ধরিয়ে দিল। রক্তের দাগগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বহু বছর আগে এখানে কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল।
তারা শেলফগুলো সরাতে শুরু করল। পুরনো কাঠের ঘষা লেগে একটা কর্কশ শব্দ হলো, যেন বাড়ির পুরনো আত্মাগুলো জেগে উঠছে, তাদের আগমনে বিরক্ত হয়ে। শেলফের পেছনে একটা গুপ্ত দরজা। দরজাটা খুলতেই একটা সরু, অন্ধকার সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই একটা ছোট, স্যাঁতসেঁতে কক্ষ, যা ল্যাপটপের ছবিতে দেখা গিয়েছিল। কক্ষের মাঝখানে একটা ভাঙা বাক্স আর কিছু পুরনো পুঁথি ছড়ানো। আর সেখানেই পড়েছিল অভ্রনীল কাকুর চশমা, তার কাঁচ ভাঙা, যেন কোনো সংঘর্ষের চিহ্ন। কক্ষের এক কোণে একটা ছোট পাথরের মূর্তি, যার চোখ থেকে যেন এক অশুভ লাল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। মূর্তিটার চারপাশে কিছু শুকিয়ে যাওয়া ফুল আর ছাই পড়েছিল, যেন কোনো প্রাচীন পূজার চিহ্ন, যা বহু বছর ধরে চলে আসছিল, এক অশুভ শক্তির উপাসনা। কক্ষের বাতাসে একটা পচা, মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল, যা তাদের বমি বমি ভাব এনে দিচ্ছিল, যেন মৃত্যুর গন্ধ। দেয়ালগুলোতে অদ্ভুত সব চিত্র আঁকা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন উপজাতির রহস্যময় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ। চিত্রগুলো যেন নড়ছে, তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।
হঠাৎই ল্যাপটপটা, যেটা তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, সেটা নিজে থেকেই চালু হয়ে গেল। স্ক্রিনে অভ্রনীল কাকুর প্রোফাইল পিকচারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন তিনি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন, তার চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি – ভয়, আশা আর এক গভীর ক্লান্তি। তারপর একটা ভিডিও প্লে হতে শুরু করল। ভিডিওতে দেখা গেল, অভ্রনীল কাকু এই কক্ষেই বসে পুঁথিগুলো পড়ছেন, তার চোখে মুখে গভীর মনোযোগ। তিনি কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন, তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন তিনি বহুদিনের রহস্যের সমাধান করতে চলেছেন। হঠাৎই কক্ষের পাথরের মূর্তিটা থেকে একটা তীব্র লাল আলো বিচ্ছুরিত হলো, যা পুরো কক্ষকে রক্তিম করে তুলল। একটা বিকট শব্দে কক্ষটা কেঁপে উঠল, যেন দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ছে। কাকুর মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল, তার হাত থেকে পুঁথিটা পড়ে গেল। ক্যামেরাটা পড়ে গেল, আর একটা অস্পষ্ট, কালো ছায়া কাকুর দিকে দ্রুত এগিয়ে এল, তার শরীর যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে, যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে কোনো অতিলৌকিক শক্তি। কাকুর শেষ আর্তনাদ শোনা গেল, “মুক্তি…!” তারপর সব অন্ধকার। ভিডিওর শেষে একটা ঠান্ডা, অশুভ হাসি শোনা গেল, যা কক্ষের নীরবতাকে আরও ভয়াবহ করে তুলল, তাদের হৃদপিণ্ড যেন থেমে গিয়েছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, তাদের চোখে একই প্রশ্ন – এটা কি সত্যি? নাকি তাদের মনের ভ্রম?
ভিডিওটা শেষ হতেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা নতুন মেসেজ ভেসে উঠল: “আমাকে মুক্তি দাও। পুঁথিটা পুড়িয়ে ফেলো। অভিশাপ ভাঙো।” এবার মেসেজটা শুধু টেক্সট ছিল না, কাকুর নিজের গলা শোনা গেল, দুর্বল কিন্তু স্পষ্ট, যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে, তার শেষ আকুতি, তার শেষ অনুরোধ। তাদের মনে হলো, কাকু যেন তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তার আত্মা যেন ল্যাপটপের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ করছে।
তারা বুঝতে পারল, অভ্রনীল কাকু সেই মন্দিরের অভিশাপের শিকার হয়েছিলেন। তিনি মারা যাননি, বরং সেই অশুভ শক্তি তাকে বন্দি করে রেখেছিল, আর তিনি তার ডিজিটাল পদচিহ্ন ব্যবহার করে তাদের সাহায্য চাইছিলেন। পুঁথিটা ছিল সেই অভিশাপের উৎস, যা এই মন্দিরের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত এবং আত্মাদের আটকে রাখত, তাদের মুক্তি দিত না। এই পুঁথিই ছিল অভ্রনীল কাকুর ‘রহস্যলোক’-এর চাবিকাঠি, এবং তাদেরও মুক্তির একমাত্র পথ।
তারা দ্রুত সেই পুঁথিটা খুঁজে বের করল। পুঁথিটা হাতে নিতেই একটা ঠান্ডা স্রোত তাদের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। পুঁথির পাতায় অদ্ভুত সব চিহ্ন আর অশুভ মন্ত্র লেখা ছিল, যার দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভয় লাগছিল। পুঁথির প্রতিটি অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাদের মনের গভীরে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে খোলা আকাশের নিচে পুঁথিটা আগুনে পুড়িয়ে দিল। পুঁথিটা পুড়তে শুরু করতেই একটা তীব্র নীল আলো জ্বলে উঠল, আর একটা দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল, যা তাদের চারপাশ থেকে ধুলো আর শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে গেল, যেন কোনো প্রাচীন অভিশাপের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাতাসে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে অভ্রনীল কাকুর প্রোফাইলটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। তার শেষ পোস্টটা ছিল শুধু একটা হাসিমুখের ইমোজি, আর তার নিচে লেখা, “ধন্যবাদ।” যেন তিনি শেষবারের মতো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন, এবং চিরতরে বিদায় নিলেন, এক নতুন জগতে।
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, বৃষ্টির ফোঁটা তাদের মুখে এসে পড়ছিল, যেন প্রকৃতির অশ্রু। অভ্রনীল কাকু হয়তো মুক্তি পেয়েছেন। ডিজিটাল মাধ্যমই হয়ে উঠেছিল তার ‘রহস্যলোক’, যেখান থেকে তিনি তার শেষ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তারা জানত না, এই ঘটনার পর তাদের জীবন আর আগের মতো থাকবে কিনা। হয়তো সেই অভিশাপের রেশ তাদের পিছু ছাড়বে না, হয়তো সেই ভাঙা বাড়ির ছায়া তাদের মনে গেঁথে থাকবে। তাদের রাতের ঘুম হয়তো আরও ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে ভরে উঠবে, আর প্রতিটি ডিজিটাল ডিভাইস তাদের কাছে এক নতুন রহস্যলোকের প্রবেশদ্বার মনে হবে। তারা কি সত্যিই অভিশাপ ভেঙেছে, নাকি শুধু এক নতুন চক্রের শুরু করেছে? এই প্রশ্ন তাদের মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। তাদের মনে হলো, অভ্রনীল কাকুর আত্মা হয়তো শান্তি পেয়েছে, কিন্তু তাদের নিজেদের শান্তি কি আর কোনোদিন ফিরবে? এই ডিজিটাল ভূতের গল্প তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইল, এক অমীমাংসিত রহস্যের মতো। রহস্য শুধু পুরনো বাড়িতেই থাকে না, তা লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের হাতের মুঠোয় থাকা ডিজিটাল জগতেও, যা আমাদের অজান্তেই এক নতুন ‘রহস্যলোক’ তৈরি করে। আর সেই রহস্যলোকের দরজা একবার খুললে, তাকে বন্ধ করা কঠিন, কারণ তার প্রভাব আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়তে পারে, আমাদের বাস্তবতাকে চিরতরে বদলে দিতে পারে, এক অদেখা ভয়ের জগতে।
~ সমাপ্ত~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion