Episode 12114 words0 views

ডিজিটাল দুনিয়ার বিচ্ছিন্নতা

ডিজিটাল দুনিয়ার বিচ্ছিন্নতা নন্দিনী তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে বসেছিল, বাইরের পৃথিবীর সাথে তার কোনো সংযোগ ছিল না। জানালার কাঁচ ভেদ করে যে নরম রোদ এসে পড়ছিল তার পড়ার টেবিলে, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপও ছিল না। বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমেছে, পাখির কলরব থেমে গিয়ে শহরের চেনা কোলাহল শুরু হয়েছে – গাড়ির হর্ন, ফেরিওয়ালার হাঁক, পাশের বাড়ির টেলিভিশন থেকে ভেসে আসা সিরিয়ালের সুর। কিন্তু নন্দিনীর কাছে এসবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তার জগতটা ছিল এই চৌকো স্ক্রিনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ – অনলাইন গেমের ভার্চুয়াল যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে সে এক অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে প্রোফাইল যেখানে তার জীবনটা নিখুঁত আর আনন্দময়, আর ইউটিউবের অন্তহীন ভিডিও যা তাকে বাস্তবতার কঠিন দিকগুলো থেকে দূরে রাখত। নন্দিনীর দিন শুরু হতো মোবাইল ফোনের অ্যালার্মে নয়, বরং অনলাইন গেমের নোটিফিকেশনে। ঘুম ভাঙতেই প্রথম কাজ ছিল ফোনের স্ক্রিন আনলক করে নতুন মেসেজ বা আপডেটের খোঁজ করা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে মা-বাবা যখন দিনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতেন, নন্দিনী তখন কানে হেডফোন গুঁজে ইনস্টাগ্রামের রিলস দেখত। তাদের কথার কোনো অর্থই তার কাছে পৌঁছাত না। মা হয়তো বলতেন, “নন্দিনী, আজ বিকেলে রমা কাকিমার বাড়ি যাবি? অনেকদিন যাসনি।” নন্দিনী শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিত, কিন্তু তার চোখ থাকত ফোনের দিকেই। বাবা হয়তো অফিসের কোনো গল্প বলতে শুরু করতেন, কিন্তু নন্দিনী ততক্ষণে অন্য কোনো ভিডিওতে মগ্ন। তাদের কথার কোনো অর্থই তার কাছে পৌঁছাত না। মা-বাবার চোখে মাঝে মাঝে একরাশ হতাশা ফুটে উঠত, যা নন্দিনী ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেত। তাদের প্রশ্ন, তাদের উদ্বেগ – সবকিছুই তার কাছে অনাবশ্যক মনে হতো। সে ভাবত, “কেন তারা আমাকে বোঝে না? আমার নিজের একটা জগত আছে, যেখানে আমি খুশি।” এই ভার্চুয়াল জগতটা তার কাছে এক নিরাপদ আশ্রয় ছিল, যেখানে তাকে কারো প্রত্যাশা পূরণ করতে হতো না, কোনো সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা পড়তে হতো না। কলেজেও তার উপস্থিতি ছিল কেবল শারীরিক। ক্লাসে স্যারের লেকচার তার কানে ঢুকত না, কারণ তার মন পড়ে থাকত ফোনের স্ক্রিনে। লেকচারের ছবি তুলে নিয়ে পরে গুগল করে বুঝে নেওয়ার প্রবণতা তাকে আরও অলস করে তুলেছিল। নোটস নেওয়া বা গ্রুপ স্টাডি করার আগ্রহ তার ছিল না। ক্লাসের বন্ধুরা যখন গ্রুপ করে ক্যান্টিনে যেত বা লাইব্রেরিতে পড়ত, নন্দিনী তখন একা একা নিজের ফোনেই মগ্ন থাকত। তার কাছে মনে হতো, বাস্তব জীবনের এই সব ছোটখাটো মিথস্ক্রিয়াগুলো বড্ড ক্লান্তিকর। মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করা, তাদের প্রত্যাশা পূরণ করা – এসবের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে লুকিয়ে রাখা অনেক সহজ। অনলাইনে সে হাজারো মানুষের সাথে কথা বলতে পারত, হাসতে পারত, এমনকি ভার্চুয়াল পার্টিও করত। সেখানে কোনো বিচার ছিল না, কোনো প্রত্যাশা ছিল না। সে যা খুশি তাই বলতে পারত, যে কোনো পরিচয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারত। বাস্তব বন্ধুদের সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ এলে সে অজুহাত দিত, “আজ শরীরটা ভালো নেই” অথবা “একটা জরুরি কাজ আছে”। এই অজুহাতগুলো দিতে দিতে সে নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে সে সত্যিই অসুস্থ বা ব্যস্ত। বই পড়া? তার বদলে অডিওবুক বা সামারি ভিডিও, যেখানে দ্রুত তথ্য পাওয়া যায়, গভীর চিন্তার প্রয়োজন হয় না। এমনকি খাবারও সে অর্ডার করত অ্যাপ থেকে, যাতে বাইরে বেরোতে না হয়, মানুষের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে না হয়। বাইরের রেস্তোরাঁর ভিড়, ক্যাফেতে বন্ধুদের সাথে হাসি-ঠাট্টা – এসব তার কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। সে মনে করত, ভার্চুয়াল জগতে সে অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত। সেখানে সে তার নিজের নিয়মে চলত, কারো কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। তার ভার্চুয়াল প্রোফাইল ছিল তার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি – যেখানে সে ছিল আত্মবিশ্বাসী, জনপ্রিয় এবং সর্বদা হাসিখুশি। কিন্তু এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গভীর শূন্যতা। নন্দিনী জানত, সে একা নয়। তার মতো আরও অনেকেই এই ভার্চুয়াল জগতে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। তারা একে অপরের “ডিজিটাল বন্ধু”, যারা স্ক্রিনের ওপারে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। তাদের কাছে ভার্চুয়াল লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারই ছিল সম্পর্কের মাপকাঠি। তারা নিজেদের একটি অনলাইন কমিউনিটি তৈরি করেছিল, যেখানে তারা নিজেদেরকে “ডিজিটাল যাযাবর” বলত। তারা বিশ্বাস করত, বাস্তব জগতটা বড্ড জটিল আর অপ্রীতিকর। সেখানে প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাদের কাছে অনলাইন জগতটাই ছিল আসল মুক্তি। কিন্তু সে কি সত্যিই খুশি ছিল? মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা লাগত, এক অদ্ভুত একাকীত্ব ঘিরে ধরত তাকে, যা সে শত চেষ্টা করেও ভার্চুয়াল কোলাহলের আড়ালে ঢাকতে পারত না। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, তখন এই একাকীত্ব আরও তীব্র হতো। তার ফোনের উজ্জ্বল আলো তার মুখের উপর পড়ত, কিন্তু তার চোখ থাকত শূন্য। সে শুয়ে শুয়ে ভাবত, তার কি সত্যিই কোনো বন্ধু আছে? যারা বিপদে তার পাশে দাঁড়াবে? এই প্রশ্নটা তাকে প্রায়ই কুরে কুরে খেত। সে জানত, তার অনলাইন বন্ধুরা হয়তো তার পোস্টে লাইক দেবে, তার ভার্চুয়াল সাফল্যে অভিনন্দন জানাবে, কিন্তু যখন তার সত্যিই সাহায্যের প্রয়োজন হবে, তখন তারা কেউ থাকবে না। এই ভাবনাটা তাকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে তুলত। সে জানত, তার অনলাইন প্রোফাইলটা একটা মুখোশ, আর সেই মুখোশের আড়ালে সে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তার পড়াশোনার মান কমতে শুরু করেছিল, কলেজে তার উপস্থিতি কমে গিয়েছিল, আর মা-বাবার সাথে তার দূরত্ব বাড়ছিল। কিন্তু সে এসব নিয়ে ভাবত না, কারণ তার কাছে ভার্চুয়াল জগতের “সাফল্য”ই ছিল সব। একদিন সকালে নন্দিনীর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হঠাৎ করেই মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ দুটো বন্ধ। তিনি শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে “জল” বলে ডাকলেন। নন্দিনী প্রথমে বুঝতেই পারল না কী করবে। তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। তার ডিজিটাল দক্ষতা এই বাস্তব সংকটে কোনো কাজে এল না। সে দ্রুত তার অনলাইন বন্ধুদের কাছে মেসেজ করল, “আমার মা খুব অসুস্থ, কী করব? প্লিজ হেল্প!” কিন্তু উত্তরগুলো ছিল অস্পষ্ট, অকার্যকর। কেউ বলল, “ডাক্তার ডাকো,” কেউ বলল, “অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করো।” এই সাধারণ কথাগুলোও তার মাথায় ঢুকছিল না। তার মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ু যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে ফোনটা হাতে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর খুঁজছিল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল, চোখে জল আসছিল। তার অনলাইন কমিউনিটির হাজারো সদস্যের মধ্যে একজনও তাকে বাস্তব পরামর্শ দিতে পারল না, বা তার পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা ভাবল না। ভার্চুয়াল পৃথিবীটা হঠাৎ করেই অর্থহীন মনে হতে লাগল। তার হাজারো ডিজিটাল বন্ধু, তার গেমের শক্তিশালী চরিত্র – কেউই এই মুহূর্তে তার মায়ের কষ্ট কমাতে পারল না। মা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, আর নন্দিনী অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে, তার চোখে জল। তার মনে হলো, সে যেন এক বিশাল মরুভূমির মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কোনো সাহায্যের হাত নেই। তার অনলাইন জগতের কোনো ‘হিরো’ তাকে বাঁচাতে এল না। এই প্রথম সে উপলব্ধি করল, তার এই ভার্চুয়াল জগত কতটা ভঙ্গুর, কতটা অগভীর। তার চোখের সামনে তার মা কষ্ট পাচ্ছেন, আর সে কিছুই করতে পারছে না। এই অসহায়তা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল পাশের বাড়ির রমা কাকিমার কথা। রমা কাকিমা তাদের পারিবারিক বন্ধু, যিনি সবসময় তাদের খোঁজখবর নিতেন, মাঝে মাঝে শখের বশে রান্না করা নতুন পদ পাঠিয়ে দিতেন। তিনি প্রায়ই নন্দিনীকে ডাকতেন, “আয় মা, একটু গল্প করে যা।” নন্দিনী তখন বিরক্ত হতো, তার কাছে কাকিমার এই আন্তরিকতা বাড়াবাড়ি মনে হতো, কিন্তু আজ সেই ডাকটাই তার কাছে আশার আলো হয়ে দেখা দিল। নন্দিনী দ্রুত রমা কাকিমাকে ফোন করল। কাকিমা এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে এলেন। তার চোখে মুখে উদ্বেগ, কিন্তু তার উপস্থিতিই নন্দিনীকে এক অদ্ভুত ভরসা দিল। কাকিমা দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেন, নন্দিনীর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন এবং নন্দিনীকে সাহস দিলেন। তিনি নন্দিনীর হাত ধরে বললেন, “ভয় পেও না মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।” কাকিমার এই কথাগুলো নন্দিনীর কানে যেন অমৃতের মতো শোনাল। তার উষ্ণ হাতের স্পর্শ নন্দিনীর মনে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল, যা সে বহু দিন অনুভব করেনি। রমা কাকিমা শুধু নন্দিনীর মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি, তিনি নন্দিনীকে মানসিক শক্তিও জুগিয়েছিলেন। তিনি নন্দিনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “মাঝে মাঝে জীবনে এমন কিছু ঘটে যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোনটা আসল আর কোনটা নকল।” হাসপাতালের করিডোরে বসে নন্দিনী প্রথম বারের মতো অনুভব করল বাস্তব জীবনের গুরুত্ব। সে দেখল, রমা কাকিমা কীভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ডাক্তারদের সাথে কথা বলছেন, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, এমনকি তার বাবাকে ফোন করে খবর দিচ্ছেন। রমা কাকিমা তার জন্য চা নিয়ে এলেন, তাকে জোর করে কিছু খেতে বললেন। নন্দিনী লক্ষ্য করল, কাকিমার চোখেও উদ্বেগের ছাপ, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের জন্য সবকিছু করছেন। তিনি যেন একাই পুরো পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছেন। এই অনুভূতিটা তার অনলাইন গেমের কোনো জয়ের থেকেও অনেক বেশি বাস্তব এবং গভীর ছিল। মানুষের স্পর্শ, সহানুভূতি আর পাশে থাকার অনুভব – এইগুলোই তো আসল শক্তি। ভার্চুয়াল জগতের লাইক বা কমেন্ট এই এক মুহূর্তের বাস্তবতার কাছে কিছুই নয়। নন্দিনী সেদিন বুঝল, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে ডিজিটাল স্ক্রিন কোনো সমাধান দিতে পারে না, পারে কেবল মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর সঙ্গ। সে দেখল, কীভাবে রমা কাকিমা তার মা-বাবার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে সাহায্য করছেন, হাসপাতালের ফর্ম পূরণ করছেন, এবং তাদের মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করছেন। এই সব ছোট ছোট কাজগুলো, যা কোনো ভার্চুয়াল বন্ধু করতে পারত না, নন্দিনীর চোখে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর নন্দিনীর জীবনে এক বড় পরিবর্তন এল। সে ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকাল বাইরের পৃথিবীর দিকে। সে দেখল, তার চারপাশে কত মানুষ আছে, কত সম্পর্ক আছে যা সে এতদিন অবহেলা করেছে। প্রথম কয়েকদিন তার খুব অস্বস্তি হতো। সে যখন ফোন ছেড়ে মায়ের সাথে কথা বলতে যেত, তার মনে হতো যেন সে অন্য কোনো ভাষায় কথা বলছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েও সে প্রথমে চুপ করে থাকত, কী বলবে বুঝতে পারত না। তার অনলাইন বন্ধুদের সাথে যে সাবলীলতা ছিল, তা বাস্তব জীবনে ছিল না। সে নিজেকে যেন এক অচেনা দ্বীপে খুঁজে পেল। তার পুরনো অভ্যাসগুলো ভাঙা সহজ ছিল না। বারবার তার হাত ফোনের দিকে চলে যেত, কিন্তু মায়ের ফ্যাকাসে মুখ আর রমা কাকিমার স্নেহমাখা চোখ তাকে থামিয়ে দিত। কিন্তু রমা কাকিমা তাকে ছাড়লেন না। প্রতিদিন তিনি একবার করে তাদের বাড়িতে আসতেন, মায়ের খোঁজ নিতেন, আর নন্দিনীকে গল্পে ব্যস্ত রাখতেন। কাকিমা একদিন বললেন, “জানিস নন্দিনী, তোর মা যখন অসুস্থ ছিল, তখন তোর স্কুলের বন্ধু শ্রেয়া আর অনন্যা এসেছিল। তারা খুব চিন্তায় ছিল।” নন্দিনী অবাক হলো। সে তো তাদের সাথে অনেকদিন কথা বলেনি। কাকিমা আরও বললেন, “ওরা তোর খোঁজ করছিল, বলছিল তুই নাকি আজকাল ফোনও ধরিস না।” নন্দিনীর মনে এক অপরাধবোধ জন্মাল। সে বুঝতে পারল, তার অবহেলার পরেও এই মানুষগুলো তার কথা ভেবেছে। তাদের ভালোবাসা ছিল নিঃস্বার্থ, কোনো লাইক বা কমেন্টের বিনিময়ে নয়। ধীরে ধীরে নন্দিনী ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে শুরু করল। প্রথমে সে ফোনের স্ক্রিন টাইম কমানোর চেষ্টা করল। রাতে ঘুমানোর আগে ফোনটা অন্য ঘরে রেখে দিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর সঙ্গে সঙ্গে ফোন দেখত না। ব্রেকফাস্ট টেবিলে মা-বাবার কথার উত্তর দিতে শুরু করল, তাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। মা প্রথমে অবাক হলেও, পরে খুশি হলেন। বাবার মুখেও এক স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। তারা নন্দিনীর এই পরিবর্তনে আনন্দিত হলেন, কিন্তু কোনো চাপ দিলেন না। তারা শুধু পাশে থাকলেন, নন্দিনীকে তার নিজের গতিতে এগোতে দিলেন। একদিন বিকেলে সে সাহস করে শ্রেয়াকে ফোন করল। শ্রেয়া ফোন ধরেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। “নন্দিনী! তুই কেমন আছিস? তোর মায়ের শরীর এখন কেমন?” নন্দিনী অবাক হলো, শ্রেয়া তার মায়ের অসুস্থতার খবর জানে! কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর নন্দিনী শ্রেয়াকে দেখা করার প্রস্তাব দিল। প্রথম দেখাটা ছিল কিছুটা অদ্ভুত। তারা দুজনেই জানত না কী বলবে। কিন্তু ধীরে ধীরে পুরনো দিনের গল্প, কলেজের স্মৃতি, আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে বলতে তারা আবার নিজেদের খুঁজে পেল। নন্দিনী বুঝতে পারল, এই যে মুখোমুখি বসে হাসা, একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলা – এর আনন্দ ভার্চুয়াল জগতের কোনো চ্যাটের থেকে অনেক বেশি গভীর। শ্রেয়া তাকে জড়িয়ে ধরল, আর সেই উষ্ণ আলিঙ্গনে নন্দিনী অনুভব করল এক সত্যিকারের বন্ধুত্বের স্পর্শ। এই স্পর্শে ছিল বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালোবাসা। নন্দিনী এরপর অনন্যা এবং তার অন্যান্য বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ শুরু করল। তারা সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করল। তারা নন্দিনীকে তাদের গ্রুপে আবার ফিরিয়ে নিল। নন্দিনী তাদের সাথে মাঠে খেলতে যেত, সিনেমা দেখতে যেত, এমনকি কলেজের প্রজেক্টেও অংশগ্রহণ করতে শুরু করল। সে দেখল, বাস্তব জীবনেও বন্ধুত্ব কতটা সুন্দর হতে পারে। তার একাকীত্ব ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগল। সে বুঝতে পারল, ভার্চুয়াল জগতের হাজারো ‘ফলোয়ার’ বা ‘বন্ধু’র চেয়ে এই কয়েকজন প্রকৃত বন্ধু অনেক বেশি মূল্যবান। তারা তার দুর্বলতা জানত, কিন্তু তাকে বিচার করত না। তারা তাকে ভালোবাসত তার সব ত্রুটি নিয়েই। রমা কাকিমাও নন্দিনীকে বাগানের কাজে সাহায্য করতে ডাকতেন। প্রথমে অনিচ্ছা থাকলেও, ধীরে ধীরে নন্দিনী প্রকৃতির কাছাকাছি এসে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। মাটির গন্ধ, ফুলের রঙ, পাখির গান – এই সব কিছু তার জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করল। সে উপলব্ধি করল, এই যে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়া, মানুষের সাথে মিশে যাওয়া – এটাই তো জীবন। সে এখন সকালে উঠে ছাদে গিয়ে পাখির ডাক শোনে, বিকেলে পার্কে হাঁটতে যায়, আর রাতে পরিবারের সাথে বসে গল্প করে। তার জীবন এখন আর স্ক্রিনে বন্দী নয়, বরং খোলা আকাশের নিচে বিস্তৃত। সে কলেজেও নিয়মিত হতে শুরু করল, পড়াশোনায় মন দিল, এবং তার ফলাফলও ভালো হতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই যে বাস্তব জীবনে নিজেকে নিয়োজিত করা, এটাই আসল সুখ। নন্দিনী এখনও মাঝে মাঝে গেম খেলে, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। তবে এখন সে জানে, জীবনের আসল আনন্দটা লুকানো আছে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের গভীরে, ভার্চুয়াল স্ক্রিনের ওপারে থাকা বাস্তব পৃথিবীতে। তার কাছে এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনই আসল সুখের চাবিকাঠি। সে শিখেছে, ডিজিটাল সংযোগের চেয়ে মানবিক সম্পর্ক অনেক বেশি মূল্যবান। ভার্চুয়াল জগতটা তার কাছে এখন শুধু একটি টুল, যা সে প্রয়োজনে ব্যবহার করে, কিন্তু তার জীবন আর তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। নন্দিনী এখন মুক্ত, স্বাধীন এবং বাস্তবতার সাথে সংযুক্ত। তার ভেতরের একাকীত্ব উধাও হয়ে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে সত্যিকারের আনন্দ আর শান্তি। এই পরিবর্তন শুধু তার নিজের জীবনেই আসেনি, তার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনেও এনেছে এক নতুন আনন্দ। নন্দিনী এখন জানে, জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতে, যা ভাগ করে নেওয়া যায় ভালোবাসার মানুষদের সাথে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion