Episode 14749 words0 views

ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি

VDJ-এর উন্মোচন: এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা যন্ত্রের সৃষ্টি ও অর্ণবের স্বপ্ন ড. অর্ণব রায়, একজন প্রতিভাবান কিন্তু খানিকটা নিভৃতচারী বিজ্ঞানী, তার ল্যাবের নিস্তব্ধতায় ডুবে ছিলেন। তার চারপাশে ছড়ানো ছিল তার জীবনের একমাত্র ধ্যান – “ভবিষ্যৎ-দর্শন যন্ত্র” (VDJ)। ল্যাবের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি সরঞ্জাম যেন তার পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের নীরব সাক্ষী। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি এই যন্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন, নিজের সবটুকু মেধা আর শ্রম ঢেলে দিয়েছেন এর পেছনে। তার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, প্রায় দেবদূতের মতো: মানুষের অনিশ্চয়তা দূর করা, তাদের ভবিষ্যৎকে আরও সুরক্ষিত করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি মানুষ তাদের ভবিষ্যতের একটি ক্ষুদ্র ঝলক দেখতে পায়, তবে তারা ভুল পথ থেকে সরে আসতে পারবে, বিপদ এড়াতে পারবে, এবং একটি উন্নত জীবন গড়তে পারবে। তার চোখে ছিল এক স্বপ্ন, এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা – মানবতাকে এক নতুন, আলোকিত পথে নিয়ে যাওয়ার, যেখানে ভয়ের কোনো স্থান থাকবে না, শুধু থাকবে নিশ্চিত সাফল্যের হাতছানি। যন্ত্রটি দেখতে ছিল একটি বৃহৎ স্ফটিকের গোলকের মতো, যা জটিল সার্কিট এবং অপটিক্যাল ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা। এর কেন্দ্র থেকে একটি মৃদু নীলচে আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যা ল্যাবের নিস্তব্ধতাকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল, যেন মহাবিশ্বের কোনো গোপন শক্তি সেখানে বন্দি। সূক্ষ্ম তারের জালিকা, অপটিক্যাল লেন্সের সারি এবং ন্যানো-প্রসেসরের জটিল বিন্যাস দেখে মনে হতো যেন এটি কোনো এলিয়েন সভ্যতার প্রযুক্তি, যা মানবজাতির ধারণারও অতীত। এর কেন্দ্রে ছিল একটি ছোট প্রজেক্টর, যা ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিত্রগুলি প্রক্ষেপণ করত। অর্ণব জানতেন, এটি কোনো স্থির ভবিষ্যৎ নয়, বরং বর্তমানের গতিপথ অনুযায়ী একটি সম্ভাব্য চিত্র। কিন্তু এই সূক্ষ্ম পার্থক্যটি তখন তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তার মনে হয়েছিল, মানুষ এই পার্থক্য বুঝতে পারবে এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এটিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে, যা তাদের জীবনকে আরও সুসংগঠিত করবে। সায়রার সংশয় ও প্রথম পরীক্ষা দীর্ঘ পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর, আজ সেই দিনটি এসেছিল। যন্ত্রটি প্রস্তুত। অর্ণব গভীর নিঃশ্বাস নিলেন, তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, যেন এক বিশাল আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তার একমাত্র সহকর্মী এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু, সায়রা, ল্যাবের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। সায়রা একজন পদার্থবিজ্ঞানী, অর্ণবের মতোই মেধাবী, কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক বাস্তববাদী সংশয়। তার চোখে ছিল এক মিশ্র অনুভূতি – বন্ধুর সাফল্যের আনন্দ এবং এক অজানা আশঙ্কার ছায়া, যা তার মনের গভীরে বাসা বেঁধেছিল। “অর্ণব, তুমি নিশ্চিত তো?” সায়রার কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট। তার চোখ VDJ-এর দিকে নিবদ্ধ, যেন সে যন্ত্রটির ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিপদ দেখতে পাচ্ছিল। “ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করাটা… বিপজ্জনক হতে পারে। প্রকৃতির নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করছো তুমি। এর ফল কী হবে, তা কি আমরা জানি?” অর্ণব হাসলেন, তার চোখে বিজয়ের ঝলক। তার আত্মবিশ্বাসের সামনে সায়রার উদ্বেগ যেন ম্লান হয়ে গেল। “বিপদ? সায়রা, এটা বিপদ নয়, এটা বিপ্লব। ভাবো, মানুষ যদি জানতে পারে তাদের সামনে কী আসছে, তাহলে কত ভুল এড়ানো যাবে! কত জীবন বাঁচানো যাবে! কত হতাশা দূর হবে! এটা মানবজাতির জন্য এক নতুন ভোর।” তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক অদম্য আত্মবিশ্বাস, যা তার বহু বছরের সাধনার ফল। সায়রা মাথা নাড়ল, তার সংশয় কাটল না। “কিন্তু অর্ণব, অনিশ্চয়তাই তো জীবনের সৌন্দর্য। যদি সব জানা হয়ে যায়, তাহলে তো আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, কোনো চেষ্টা থাকবে না। মানুষ কেন বাঁচবে? কিসের জন্য চেষ্টা করবে? জীবনের রোমাঞ্চটাই তো হারিয়ে যাবে।” তার কথায় ছিল এক দার্শনিক গভীরতা, যা অর্ণব তখনো উপলব্ধি করতে পারেননি। অর্ণব তার কথায় কান দিলেন না। তার মন তখন শুধু তার আবিষ্কারের সম্ভাবনায় মগ্ন। তিনি যন্ত্রের সামনে বসলেন, তার চোখ স্ফটিকের গোলকের দিকে নিবদ্ধ। যন্ত্রটি চালু হলো। একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল, যা ধীরে ধীরে একটি গভীর, অনুরণিত শব্দে পরিণত হলো, যেন মহাবিশ্বের কোনো প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। গোলকের ভেতরে নীলচে আলো ঝলমল করে উঠল, যেন মহাবিশ্বের তারারাজির প্রতিচ্ছবি তার চোখের সামনে। অর্ণব চোখ বন্ধ করলেন, তার মস্তিষ্কের তরঙ্গ যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত হলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল, উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার মনে ছিল এক অদম্য কৌতূহল। কয়েক মুহূর্ত পর, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি চিত্র। তিনি দেখলেন, আগামী সপ্তাহে তার প্রিয় কফি মগের হাতল ভেঙে যাচ্ছে, যখন তিনি সেটি টেবিল থেকে তোলার চেষ্টা করছেন। একটি সাধারণ, তুচ্ছ ঘটনা। অর্ণব মৃদু হাসলেন। এই তো! যন্ত্র কাজ করছে। তার মুখে এক বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল, যা তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সার্থকতা ঘোষণা করছিল। পরের দিন, অর্ণব সচেতনভাবে তার কফি মগটি সাবধানে ধরলেন। হাতল ভাঙল না। তিনি বিজয়ীর হাসি হাসলেন। “দেখেছ, সায়রা? আমি ভবিষ্যৎ বদলাতে পেরেছি!” তার কণ্ঠে ছিল শিশুর মতো আনন্দ, যেন সে একটি নতুন খেলনা আবিষ্কার করেছে। সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তার মুখে ছিল এক মিশ্র অভিব্যক্তি – কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা উদ্বেগ। “তুমি শুধু একটি কফি মগের হাতল ভাঙা এড়িয়েছ। এর গভীরতা অনেক বেশি, অর্ণব। তুমি কি বুঝতে পারছ না, এর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে? এটা শুধু একটি কফি মগ নয়, এটা মানুষের ভাগ্যের প্রশ্ন।” অর্ণব তার কথা উড়িয়ে দিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই যন্ত্র মানবতাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে তার কাছের মানুষদের ওপর যন্ত্রটি পরীক্ষা করবেন, তারপর এটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করবেন। তার মনে তখন শুধু একটিই স্বপ্ন – একটি অনিশ্চয়তাহীন, নিরাপদ ভবিষ্যৎ। তিনি তখনো জানতেন না, তার এই স্বপ্ন কত বড় দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে, এবং তার এই আবিষ্কার মানবজাতির জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আশার ঝলক ও অপ্রত্যাশিত পরিণতি রাজুর সাফল্য: VDJ-এর ইতিবাচক দিক অর্ণব তার প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহারকারী হিসেবে বেছে নিলেন তার ছোটবেলার বন্ধু রাজুকে। রাজু ছিল একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবক, যে একটি ছোট কোম্পানিতে কাজ করত এবং সবসময়ই আর্থিক টানাপোড়েনে ভুগত। তার চোখে ছিল এক ক্লান্তির ছাপ, যা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা থেকে জন্ম নিয়েছিল। রাজু যন্ত্রের সামনে বসতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তার মনে ছিল ভয় আর আশা দুইয়েরই মিশ্রণ, কিন্তু অর্ণবের উৎসাহে সে রাজি হলো। অর্ণব তাকে আশ্বস্ত করলেন যে এটি তার জীবনকে আরও সহজ করে তুলবে। রাজু যখন যন্ত্রটি ব্যবহার করল, সে দেখল আগামী ছয় মাসের মধ্যে তার পদোন্নতি হচ্ছে এবং তার বেতন বাড়ছে। চিত্রটি ছিল স্পষ্ট এবং আশাব্যঞ্জক। সে নিজেকে একটি বড় অফিসে, নতুন চেয়ারে বসে কাজ করতে দেখল, তার হাতে একটি নতুন ল্যাপটপ। রাজু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তার চোখে ঝলমল করছিল নতুন আশার আলো, যেন এক মরুভূমির পথিক হঠাৎ জলের সন্ধান পেয়েছে। সে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরল, তার কণ্ঠে ছিল অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা, যা তার দীর্ঘদিনের হতাশা দূর করে দিয়েছিল। “অর্ণব! এটা অবিশ্বাস্য! আমি কি তাহলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি?” রাজুর চোখে ঝলমল করছিল নতুন আশার আলো। তার মনে হলো তার জীবনের সব সমস্যা বুঝি এবার শেষ। অর্ণব হাসলেন। “নিশ্চিন্তে নয়, রাজু। তুমি জানো কী হতে চলেছে। এখন তুমি সেই লক্ষ্যে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। তোমার সুযোগ আরও বাড়ল। তুমি তোমার ভাগ্য নিজেই গড়ে নিতে পারবে, আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে।” রাজু সেই দিন থেকেই বদলে গেল। সে তার কাজে আরও মনোযোগী হলো, আরও পরিশ্রম করতে লাগল। তার মনে কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না, কারণ সে জানত সাফল্য তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার সহকর্মীরা তার এই আকস্মিক পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হলো, কিন্তু তারা জানত না এর পেছনের রহস্য। ছয় মাস পর, সত্যিই তার পদোন্নতি হলো। রাজু অর্ণবের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা জানাল, তার চোখে ছিল এক নতুন দীপ্তি, যা তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছিল। এই ঘটনা অর্ণবের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করল। তিনি ভাবলেন, এই যন্ত্র মানুষকে তাদের সেরাটা দিতে উৎসাহিত করবে, তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলবে। মায়ার ট্র্যাজেডি: ভবিষ্যতের ভুল ব্যাখ্যা এরপর যন্ত্রটি ব্যবহার করল মায়া, একজন তরুণী যে তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধায় ছিল। তাদের সম্পর্ক ছিল ভালোবাসার, কিন্তু অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা, যা তাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল। মায়া যন্ত্রের সামনে বসতেই দেখল, আগামী এক বছরের মধ্যে তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। চিত্রটি ছিল স্পষ্ট এবং হৃদয়বিদারক। সে নিজেকে একা, বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখল, তার চারপাশে শুধু শূন্যতা। মায়া যন্ত্রের সামনেই ভেঙে পড়ল, তার চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরছিল, যেন তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অর্ণব তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। “মায়া, এটা শুধু একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ। তুমি চাইলে এটা বদলাতে পারো। তোমার হাতেই তোমার সম্পর্কের ভাগ্য। তুমি চেষ্টা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু মায়ার মন মানল না। ভবিষ্যতের এই ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি তাকে গ্রাস করল। তার মনে জন্ম নিল গভীর অবিশ্বাস আর আতঙ্ক। সে তার প্রেমিকের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠল। সামান্য বিষয়ে ঝগড়া, অবিশ্বাসের ছায়া তাদের সম্পর্কে ঢুকে পড়ল। মায়া তার প্রেমিককে অতিরিক্ত আঁকড়ে ধরতে চাইল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল, তার ফোন চেক করতে শুরু করল, যা তার প্রেমিকের কাছে দমবন্ধ মনে হলো। প্রেমিকের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ায় সে ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল, তাদের সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে শুরু করল। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই, মায়ার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেল। মায়ার দেখা ভবিষ্যৎটিই সত্যি হলো, কিন্তু তা যন্ত্রের কারণে নয়, বরং যন্ত্রের দেখানো ভবিষ্যতের প্রতি মায়ার প্রতিক্রিয়ার কারণে, তার নিজের ভয় এবং অবিশ্বাসের কারণে। এই ঘটনা অর্ণবকে কিছুটা ভাবিয়ে তুলল। সায়রা আবার তাকে সতর্ক করল। “অর্ণব, তুমি যা দেখাচ্ছো, তা মানুষের মনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা বুঝতে পারছ না। আশার পাশাপাশি ভয়ও জন্ম নিচ্ছে। আর ভয় মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।” কিন্তু অর্ণব তখনো তার আবিষ্কারের সম্ভাবনায় মগ্ন। তিনি ভাবলেন, মায়া হয়তো সঠিকভাবে যন্ত্রের বার্তাটি গ্রহণ করতে পারেনি, অথবা তার মানসিক শক্তি কম ছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই যন্ত্র মানবতাকে আরও ভালো পথে চালিত করবে। তিনি তখনো তার আবিষ্কারের বিশালতা এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি, তার মন তখনো তার স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন ছিল। জনসমক্ষে VDJ: এক নতুন যুগের আগমন খবর ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে অর্ণবের ল্যাবরেটরিতে, তারপর সংবাদমাধ্যমে। “ভবিষ্যৎ-দর্শন যন্ত্র” নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে গেল। এটি রাতারাতি বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হলো। মানুষ ভিড় করতে লাগল অর্ণবের ল্যাবের সামনে, তাদের চোখে ছিল কৌতূহল আর এক নতুন আশার ঝলক। সরকার এবং বড় বড় কর্পোরেশনগুলো যন্ত্রটির প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। তারা বুঝতে পারছিল এর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব, এবং এর মাধ্যমে কী বিশাল ক্ষমতা অর্জন করা যেতে পারে। অর্ণব, তার আদর্শে অটল থেকে, যন্ত্রটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত, এবং এটি সবার জীবনকে উন্নত করবে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি “ভবিষ্যৎ-দর্শন কেন্দ্র” খোলা হলো। লম্বা লাইন পড়তে শুরু করল, যা দিনের পর দিন বাড়তে লাগল, যেন এক তীর্থযাত্রার ভিড়। মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ জানতে মরিয়া। কেউ চাকরির ভবিষ্যৎ, কেউ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, কেউ বা স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ জানতে চায়। সবাই চায় তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা দূর করতে, একটি নিশ্চিত জীবনের সন্ধান পেতে। মিঃ সেন, একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, প্রথম সারির একজন ছিলেন। তিনি যন্ত্রটি ব্যবহার করে দেখলেন, আগামী কয়েক মাসে শেয়ারবাজারে একটি বড় উত্থান-পতন হবে, এবং তিনি যদি নির্দিষ্ট কিছু শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তবে তিনি বিপুল লাভ করতে পারবেন। মিঃ সেন সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ করলেন এবং রাতারাতি তার সম্পদ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। তার সাফল্যের গল্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, এবং আরও অনেক ব্যবসায়ী যন্ত্রটি ব্যবহার করে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। তারা VDJ-কে তাদের নতুন বাইবেল মনে করতে লাগল, যা তাদের ভাগ্যের চাবিকাঠি। প্রথম দিকে সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চলছিল। যারা ভালো ভবিষ্যৎ দেখছিল, তারা আরও উৎসাহিত হয়ে কাজ করছিল, তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। যারা খারাপ ভবিষ্যৎ দেখছিল, তারা তা এড়ানোর চেষ্টা করছিল, তাদের মনে ছিল এক নতুন দৃঢ়তা। কিন্তু এই আপাত সাফল্যের আড়ালে এক গভীর সংকট দানা বাঁধছিল, যা ধীরে ধীরে সমাজের প্রতিটি স্তরে বিষাক্ত প্রভাব ফেলবে, এবং অর্ণবের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করবে। সমাজের উপর VDJ-এর প্রভাব: বিশৃঙ্খলার ঢেউ “ভবিষ্যৎ-দর্শন যন্ত্র” (VDJ) যখন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলো, তখন প্রথম কয়েক মাস যেন এক উৎসবের মেজাজ ছিল। মানুষ লাইন ধরে তাদের ভবিষ্যৎ দেখছিল, আর মনে করছিল তাদের জীবন এবার সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে, এই তথ্যের ঢেউ সমাজে এক অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসতে শুরু করল। অর্ণব তার ল্যাবে বসে এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করছিলেন, প্রথমে বিস্মিত, তারপর আতঙ্কিত হয়ে। তার চোখে ফুটে উঠছিল এক গভীর উদ্বেগ, যা তিনি আগে কখনো অনুভব করেননি। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বেকারত্ব প্রথম আঘাতটা এল অর্থনীতিতে। মিঃ সেনের মতো বহু ব্যবসায়ী VDJ ব্যবহার করে শেয়ারবাজারের গতিবিধি সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। তারা সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে উঠল। কিন্তু যখন হাজার হাজার মানুষ একই তথ্য পেয়ে একই শেয়ারে বিনিয়োগ করতে শুরু করল, তখন বাজারের স্বাভাবিক গতিপথ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে বা কমতে লাগল, যা বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিল। বহু ছোট বিনিয়োগকারী, যারা VDJ ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি বা ভুল তথ্য পেয়েছিল, তারা তাদের সব সঞ্চয় হারাল। শেয়ারবাজারের পতন এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনল, যা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিল। কেউ আর দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে চাইল না, কারণ যদি ভবিষ্যৎ জানা থাকে, তাহলে ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর ঝুঁকি না থাকলে উদ্ভাবন বা নতুন উদ্যোগের জন্ম হয় না। বহু কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল, কারণ তাদের পণ্যের ভবিষ্যৎ চাহিদা VDJ-এর মাধ্যমে “জানা” হয়ে গিয়েছিল, এবং সেই চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা উৎপাদন বন্ধ করে দিল। বেকারত্বের হার আকাশ ছুঁল, মানুষের জীবনযাত্রার মান দ্রুত হ্রাস পেল। সম্পর্কের ভাঙন ও সামাজিক অস্থিরতা এরপর এল সামাজিক সংকট। মায়ার মতো বহু মানুষ তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। যদি কেউ দেখে তার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, বা তার প্রিয়জন তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তবে সে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মরিয়া চেষ্টা প্রায়শই সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে, অবিশ্বাস আর সন্দেহের জন্ম দেয়। অনেক দম্পতি VDJ ব্যবহার করার পর একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলল, কারণ তারা তাদের সম্পর্কের “শেষ” দেখে ফেলেছিল। বিবাহবিচ্ছেদের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ল, যা সমাজের মূল কাঠামোকে দুর্বল করে দিল। অন্যদিকে, যারা তাদের সম্পর্কের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেছিল, তারা সেই সম্পর্ককে মূল্যহীন মনে করতে শুরু করল, কারণ “সবকিছু তো জানাই আছে, তাহলে আর চেষ্টা কীসের?” জীবনের স্বাভাবিক রোমাঞ্চ আর অনিশ্চয়তা হারিয়ে গেল। ডেটিং অ্যাপগুলো বন্ধ হয়ে গেল, কারণ কেউ আর অজানা মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে চাইল না, সবাই শুধু নিশ্চিত সম্পর্ক খুঁজছিল। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ও আত্মহত্যার বৃদ্ধি সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ল মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। যারা VDJ ব্যবহার করে একটি নেতিবাচক ভবিষ্যৎ দেখেছিল – যেমন গুরুতর অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, বা প্রিয়জনের মৃত্যু – তারা গভীর উদ্বেগ, হতাশা এবং আতঙ্কে ডুবে গেল। তারা যেন এক জীবন্ত নরকে বাস করছিল, যেখানে তাদের ভবিষ্যৎ দুঃখ পূর্বনির্ধারিত। অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিল, কারণ তারা জানত তাদের জীবনে কী দুঃখ অপেক্ষা করছে। আত্মহত্যার হার বাড়তে লাগল, কারণ কিছু মানুষ তাদের “অনিবার্য” দুঃখের ভবিষ্যৎ এড়াতে চাইল। অন্যদিকে, যারা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেছিল, তারা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ল। যদি তাদের সাফল্য নিশ্চিত হয়, তবে আর পরিশ্রম করার প্রয়োজন কী? জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেল, কারণ লক্ষ্য অর্জনের পথটি পূর্বনির্ধারিত মনে হলো। সমাজে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল, যেখানে মানুষের চোখে ছিল হয় ভয়, নয়তো এক উদাসীন শূন্যতা, যা এক মৃতপ্রায় সমাজের প্রতিচ্ছবি। অপরাধ জগতে নতুন চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক বিতর্ক অপরাধ জগতেও এর প্রভাব পড়ল। পুলিশ VDJ ব্যবহার করে সম্ভাব্য অপরাধীদের শনাক্ত করতে শুরু করল। কিন্তু এর ফলে “প্রি-ক্রাইম” (Pre-crime) নামক এক নতুন নৈতিক বিতর্ক শুরু হলো। একজন ব্যক্তি যদি ভবিষ্যতে অপরাধ করে, তবে কি তাকে এখনই শাস্তি দেওয়া উচিত? এই বিতর্কের ফলে বহু নিরপরাধ মানুষ সন্দেহের শিকার হলো, এবং সমাজে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হলো। মানুষ একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলল, কারণ কে জানে কার ভবিষ্যৎ কী দেখাচ্ছে? অপরাধীরাও VDJ ব্যবহার করে তাদের অপরাধের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে শুরু করল, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল, কারণ তাদের চিরাচরিত পদ্ধতিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। অর্ণব তার ল্যাবে বসে সংবাদ দেখছিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠছিল অর্থনৈতিক ধস, সামাজিক অস্থিরতা, মানুষের মানসিক যন্ত্রণা – সবকিছুর মূলে তার আবিষ্কার। তার চোখে অবিশ্বাস, তারপর গভীর হতাশা। তিনি তার স্বপ্ন দেখেছিলেন মানবতাকে সাহায্য করার, কিন্তু তার যন্ত্রটি যেন এক দানবে পরিণত হয়েছে। তার ল্যাব, যা একসময় তার স্বপ্নের আশ্রয় ছিল, এখন তার কাছে এক কারাগার মনে হচ্ছিল, যেখানে তিনি নিজের ভুলের জন্য বন্দি। সায়রা তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল এক গভীর বিষাদ, যা অর্ণবের যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। “আমি তোমাকে বলেছিলাম, অর্ণব। অনিশ্চয়তাই জীবনের চালিকাশক্তি। যখন তুমি সেই চালিকাশক্তি কেড়ে নাও, তখন জীবন এক স্থবির জলাশয়ে পরিণত হয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, চেষ্টা, সব শেষ হয়ে যায়। তারা শুধু পুতুলের মতো বাঁচতে শুরু করে।” অর্ণব মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তার কাঁধ ভেঙে পড়ছিল যেন এক বিশাল বোঝার নিচে। “কিন্তু আমি তো শুধু একটি ঝলক দেখতে চেয়েছিলাম। আমি তো চাইনি এমনটা হোক। আমি তো শুধু ভালো চেয়েছিলাম, সায়রা। আমি চেয়েছিলাম মানুষ সুখে থাকুক।” “তুমি চেয়েছিলে অনিশ্চয়তা দূর করতে,” সায়রা বলল। “কিন্তু তুমি ভুলে গেছিলে, অনিশ্চয়তাই মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, চেষ্টা করতে শেখায়, বাঁচতে শেখায়। অনিশ্চয়তাই আমাদের মানব করে তোলে, আমাদের শক্তিশালী করে তোলে।” এই সময়, সমাজে এক নতুন আন্দোলনের জন্ম হলো। কিছু মানুষ, যারা VDJ-এর নেতিবাচক প্রভাব উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তারা নিজেদের “ভবিষ্যৎ-অন্ধ” (Future-Blind) হিসেবে ঘোষণা করল। তারা VDJ ব্যবহার করতে অস্বীকার করল এবং অন্যদেরও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে আলিঙ্গন করার জন্য উৎসাহিত করল। তারা বিশ্বাস করত, প্রতিটি মুহূর্তই একটি নতুন সম্ভাবনা, এবং সেই সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভবিষ্যৎকে অজানা রাখাই শ্রেয়। তারা ছোট ছোট দল গঠন করে মানুষকে বোঝাতে শুরু করল যে জীবনকে তার স্বাভাবিক গতিপথে চলতে দেওয়া উচিত, এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেই আসল সৌন্দর্য নিহিত। কিন্তু ততদিনে যন্ত্রটি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে এই আন্দোলন খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারছিল না। অর্ণব বুঝতে পারলেন, তার আবিষ্কারের নিয়ন্ত্রণ তার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। তার স্বপ্ন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে, যা তাকে প্রতিনিয়ত দংশন করছিল। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও নৈতিক জাগরণ যন্ত্রটির ব্যাপক ব্যবহার এবং তার ফলস্বরূপ সামাজিক বিশৃঙ্খলা অর্ণবকে এক গভীর নৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দিল। তিনি ল্যাবে নিজেকে আটকে রাখলেন, বাইরের পৃথিবীর কোলাহল আর যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার বিবেক তাকে দংশন করছিল। রাতের পর রাত তিনি ঘুমাতে পারতেন না, তার কানে বাজত মানুষের আর্তনাদ, তার চোখের সামনে ভাসত বিধ্বস্ত সমাজের চিত্র। প্রতিটি সংবাদ শিরোনাম যেন তার ভুলের সাক্ষ্য দিচ্ছিল। মিঃ সেনের লোভ ও VDJ-এর অপব্যবহার একদিন, মিঃ সেন অর্ণবের ল্যাবে এলেন। তার চোখে ছিল এক শয়তানি হাসি, যা অর্ণবের মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলল। তার পরনে ছিল দামি স্যুট, যা তার নতুন অর্জিত ক্ষমতার প্রতীক। তার সাথে ছিল দুজন বিশালদেহী দেহরক্ষী, যারা ল্যাবের প্রবেশপথ আটকে রেখেছিল। “ড. রায়, আপনার যন্ত্রটি অসাধারণ। কিন্তু আপনি এর আসল ক্ষমতা বুঝতে পারছেন না। আপনি তো শুধু একজন বিজ্ঞানী, ক্ষমতার খেলা বোঝেন না। আমি এখন এই শহরের রাজা।” অর্ণব অবাক হয়ে তাকালেন। তার কণ্ঠে ছিল দুর্বলতা। “ক্ষমতা? এটা তো শুধু ধ্বংস ডেকে আনছে। আপনি কি দেখেন না চারপাশে কী হচ্ছে? মানুষ মরছে, অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে।” “ধ্বংস? না, ড. রায়। এটা ক্ষমতা। আমি এই যন্ত্র ব্যবহার করে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি জানি কে দেউলিয়া হবে, কে সফল হবে। আমি এখন এই শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। আমার হাতে এখন ভবিষ্যৎ।” মিঃ সেনের কণ্ঠে ছিল অহংকার আর এক অশুভ দৃঢ়তা। তার চোখ লোভে চকচক করছিল। “আমি চাই আপনি আমার জন্য আরও উন্নত সংস্করণ তৈরি করুন। এমন একটি যন্ত্র, যা শুধু ভবিষ্যৎ দেখাবে না, ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণও করবে। আমি চাই আমি যা চাইব, সেটাই ঘটবে। আপনি আমার হাতের পুতুল।” অর্ণব ঘৃণাভরে তাকালেন। তার চোখে ছিল আগুন, যা তার ভেতরের ক্রোধকে প্রকাশ করছিল। “আমি কোনো দানব তৈরি করিনি, মিঃ সেন। আর আমি আপনার মতো মানুষের হাতে এই যন্ত্রের অপব্যবহার হতে দেব না। আমার আবিষ্কার মানবতাকে সাহায্য করার জন্য ছিল, ধ্বংস করার জন্য নয়। আমি বরং এই যন্ত্র ভেঙে দেব।” মিঃ সেন হাসলেন, তার হাসি ছিল বিদ্রূপাত্মক। “আপনি হয়তো দেবেন না, কিন্তু আপনার তৈরি যন্ত্রটি তো বাজারে আছে। হাজার হাজার মানুষ এটি ব্যবহার করছে। আপনি কি জানেন, আপনার যন্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট এখন কালো বাজারে বিক্রি হচ্ছে? আপনার আবিষ্কার এখন আর আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনি এখন শুধু একজন পুতুল, ড. রায়। আপনার কোনো ক্ষমতা নেই।” মিঃ সেনের কথাগুলো অর্ণবের বুকে তীরের মতো বিঁধল। তিনি বুঝতে পারলেন, তার সরল আদর্শবাদ তাকে কত বড় ভুল পথে চালিত করেছে। তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন তিনি। তিনি যন্ত্রটি বন্ধ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অসংখ্য অননুমোদিত “ভবিষ্যৎ-দর্শন কেন্দ্র” গজিয়ে উঠেছে, যেখানে VDJ-এর নকল সংস্করণ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই কেন্দ্রগুলো কোনো নিয়ম মানত না, শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষের ভয় আর আশাকে কাজে লাগাচ্ছিল, যা সমাজের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তুলছিল। অনামিকার মর্মান্তিক পরিণতি: এক স্ব-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণী এই সময়, অর্ণবের ব্যক্তিগত জীবনেও এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। তার ছোট বোন, অনামিকা, যে তার একমাত্র পরিবার ছিল, সেও VDJ ব্যবহার করেছিল। অনামিকা ছিল প্রাণচঞ্চল, জীবনের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা, সে ছিল অর্ণবের একমাত্র আশ্রয়। সে দেখেছিল, আগামী মাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হবে। এই ভবিষ্যৎ জানার পর থেকে অনামিকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তার চোখে ছিল এক গভীর শূন্যতা, তার হাসি হারিয়ে গিয়েছিল। সে ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিল, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। অর্ণব তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে এটি কেবল একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, কিন্তু অনামিকা তার ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার মন VDJ-এর দেখানো চিত্রটিকেই চূড়ান্ত সত্য বলে মেনে নিয়েছিল, যেন তার ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। একদিন, অনamিকা তার ভয় কাটিয়ে বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করল। সে ভেবেছিল, যদি সে সতর্ক থাকে, তবে সে ভবিষ্যৎ বদলাতে পারবে। সে রাস্তা পার হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে ছিল তীব্র ভয়, তার হাত-পা কাঁপছিল। তার মনে দুর্ঘটনার চিত্রটি এতটাই জেঁকে বসেছিল যে, রাস্তা পার হওয়ার সময় সে আতঙ্কিত হয়ে একটি চলন্ত গাড়ির সামনে পড়ে গেল। যন্ত্রের দেখানো ভবিষ্যৎটিই সত্যি হলো, কিন্তু তা অনামিকার অতিরিক্ত ভয়ের কারণে, তার মানসিক দুর্বলতার কারণে, যা তাকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। অর্ণব যখন হাসপাতালে অনামিকার নিথর দেহ দেখলেন, তখন তার পৃথিবী ভেঙে পড়ল। তার নিজের আবিষ্কার তার বোনকে কেড়ে নিয়েছে। তার চোখে জল ছিল না, ছিল শুধু এক গভীর শূন্যতা আর অনুশোচনা, যা তার আত্মাকে বিদ্ধ করছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, যন্ত্রটি মানুষকে ভবিষ্যৎ দেখায় না, বরং ভবিষ্যতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়াকেই প্রভাবিত করে। এটি একটি স্ব-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণীর মতো কাজ করে। মানুষ যখন একটি ভবিষ্যৎ দেখে, তখন তারা সেই অনুযায়ী আচরণ করে, এবং প্রায়শই তাদের আচরণই সেই ভবিষ্যৎকে বাস্তব করে তোলে। সায়রা অর্ণবের পাশে এসে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল গভীর সহানুভূতি, যা অর্ণবের ক্ষত কিছুটা হলেও প্রশমিত করছিল। সে অর্ণবের কাঁধে হাত রাখল। “অর্ণব, যন্ত্রটি ভবিষ্যৎ দেখায় না। এটি বর্তমানের গতিপথের একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র। মানুষের প্রতিক্রিয়া সেই প্রতিচ্ছবিকে পরিবর্তন করে, অথবা তাকে আরও দৃঢ় করে তোলে।” অর্ণব যন্ত্রের দিকে তাকালেন। তার মনে হলো, এটি কোনো বিজ্ঞানের বিস্ময় নয়, এটি একটি আয়না। একটি আয়না যা মানুষের ভয়, লোভ, এবং দুর্বলতাকে প্রতিফলিত করে। তিনি উপলব্ধি করলেন, ভবিষ্যৎ জানার ক্ষমতা মানুষকে মুক্ত করে না, বরং তাদের এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। অনিশ্চয়তা ছিল আশীর্বাদ, যা মানুষকে চেষ্টা করতে, স্বপ্ন দেখতে এবং প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্য দিতে শেখাত। এই যন্ত্র সেই আশীর্বাদকে অভিশাপে পরিণত করেছে। অর্ণব সিদ্ধান্ত নিলেন। তাকে এই যন্ত্রের আসল সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে, এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? যখন পুরো বিশ্ব তার আবিষ্কারের মোহে আচ্ছন্ন, তখন এই সত্য কে বিশ্বাস করবে? তার সামনে এক কঠিন পথ অপেক্ষা করছিল। তাকে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে, তা সে যে মূল্যেই হোক না কেন। সত্যের উন্মোচন: VDJ-এর ত্রুটি সংশোধন অর্ণব তার ল্যাবে ফিরে এলেন, অনামিকার স্মৃতি তাকে তাড়া করছিল প্রতিটি মুহূর্তে। তার চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুন নয়, বরং এক গভীর অনুশোচনা এবং সত্য প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প। তার মন স্থির ছিল – এই ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটাতেই হবে, মানবতাকে এই অন্ধকারের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে। সায়রা তার পাশে ছিল, তার নীরব সমর্থন অর্ণবকে শক্তি যোগাচ্ছিল, যেন এক নিস্তব্ধ স্তম্ভ, যা তাকে ভেঙে পড়তে দিচ্ছিল না। “সায়রা,” অর্ণব বললেন, তার কণ্ঠে ছিল এক নতুন দৃঢ়তা, যা তার ভেতরের শক্তিকে প্রকাশ করছিল, “আমাকে মানুষকে বোঝাতে হবে যে VDJ যা দেখায়, তা স্থির ভবিষ্যৎ নয়। এটা শুধু বর্তমানের গতিপথের একটি সম্ভাব্য চিত্র। মানুষের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ সেই গতিপথকে পরিবর্তন করতে পারে। তাদের হাতেই তাদের ভাগ্য, তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ।” সায়রা বলল, “কিন্তু কীভাবে? মানুষ তো এখন VDJ-এর উপর অন্ধভাবে নির্ভরশীল। তারা সত্য শুনতে চাইবে না, তারা শুধু নিশ্চিত ভবিষ্যৎ চায়। এটা খুব কঠিন হবে, অর্ণব।” ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক (Future-Alteration Index) আবিষ্কার অর্ণব একটি নতুন পরিকল্পনা করলেন। তিনি VDJ-এর একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি করবেন – এমন একটি সংস্করণ যা শুধু ভবিষ্যৎ দেখাবে না, বরং দেখাবে কীভাবে একটি ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের চিত্রকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে পারে। তিনি এর নাম দিলেন “ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক” (Future-Alteration Index)। এই যন্ত্রটি VDJ-এর মতো একটি চিত্র দেখাবে, কিন্তু তারপর ব্যবহারকারীকে একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে বলবে, এবং সেই বিকল্প সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের একটি নতুন চিত্র দেখাবে। এর মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারবে যে তাদের হাতেই তাদের ভবিষ্যতের চাবিকাঠি, তারা তাদের ভাগ্যের নির্মাতা, এবং তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই কাজ সহজ ছিল না। মিঃ সেনের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা VDJ-এর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তারা অর্ণবকে হুমকি দিতে শুরু করল, যাতে তিনি কোনো নতুন যন্ত্র তৈরি না করেন বা VDJ-এর ত্রুটি প্রকাশ না করেন। তাদের গুপ্তচররা অর্ণবের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছিল, ল্যাবের চারপাশে সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অর্ণবকে লুকিয়ে কাজ করতে হলো, তার ল্যাব যেন এক দুর্গ হয়ে উঠল, যেখানে শুধু বিশ্বাসী কয়েকজন প্রবেশাধিকার পেত। সায়রা তাকে সবরকমভাবে সাহায্য করছিল, তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো এই কঠিন সময়ে, তারা যেন এক অদম্য দল। কয়েক মাস ধরে অর্ণব এবং সায়রা দিনরাত এক করে কাজ করলেন। তাদের চোখে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু মনে ছিল এক অদম্য জেদ, যা তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে, “ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক” প্রস্তুত হলো। এটি দেখতে VDJ-এর মতোই, কিন্তু এর কার্যকারিতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা মানুষের মনকে নতুনভাবে প্রভাবিত করবে। জনসমক্ষে সত্য প্রকাশ ও VDJ-এর পতন অর্ণব একটি গোপন সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। তিনি জানতেন এটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, হয়তো শেষ মুহূর্তও হতে পারে, কিন্তু তাকে এই ঝুঁকি নিতেই হবে। সংবাদ সম্মেলনে অর্ণব VDJ-এর কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এবং তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন। তার কণ্ঠ ছিল আবেগপ্রজ্বলিত, তার চোখে ছিল যন্ত্রণার ছাপ, যা উপস্থিত সবার মন ছুঁয়ে গেল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে VDJ মানুষের মনকে প্রভাবিত করে একটি স্ব-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি করে। তিনি তার নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন, যা উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করল এবং তাদের মনে অর্ণবের প্রতি এক নতুন শ্রদ্ধার জন্ম দিল। তারপর তিনি “ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক” প্রদর্শন করলেন। তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবককে মঞ্চে ডাকলেন। স্বেচ্ছাসেবক VDJ ব্যবহার করে দেখল যে আগামী মাসে তার চাকরি চলে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবক হতাশ হয়ে পড়ল, তার মুখে নেমে এল বিষাদের ছায়া। এরপর অর্ণব তাকে “ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক” ব্যবহার করতে বললেন। যন্ত্রটি তাকে একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে বলল: “আজ থেকে তুমি প্রতিদিন এক ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করবে এবং নতুন দক্ষতা শেখার চেষ্টা করবে।” স্বেচ্ছাসেবক সেই সিদ্ধান্তটি মনে মনে গ্রহণ করল। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটি ভবিষ্যতের একটি নতুন চিত্র দেখাল – যেখানে সে শুধু তার চাকরি হারায়নি, বরং একটি নতুন, আরও ভালো চাকরি পেয়েছে, যেখানে তার বেতনও বেশি এবং সে আরও সুখী! দর্শকরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। পিনপতন নীরবতা নেমে এল হলে। এই প্রথম তারা বুঝতে পারল যে ভবিষ্যৎ স্থির নয়। তাদের নিজেদের হাতেই ক্ষমতা আছে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করার। তাদের চোখে ফুটে উঠল এক নতুন আশা, এক নতুন সম্ভাবনা, যা তাদের জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখাল। সংবাদ সম্মেলনটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা অর্ণবের বার্তাটি গ্রহণ করতে শুরু করল। “ভবিষ্যৎ-অন্ধ” আন্দোলন আরও শক্তিশালী হলো। তারা অর্ণবের পাশে দাঁড়াল, তার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করল, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে। মানুষ VDJ কেন্দ্রগুলো বর্জন করতে শুরু করল, তাদের আর অনিশ্চয়তার ভয় ছিল না, কারণ তারা তাদের নিজেদের শক্তিকে চিনতে পেরেছিল। সরকারগুলো VDJ-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল এবং অবৈধ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিল। মিঃ সেন এবং তার সহযোগীরা অর্ণবকে থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে জনমত অর্ণবের পক্ষে চলে গেছে। মানুষ তাদের হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে চেয়েছিল। মিঃ সেনের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল, কারণ তার ক্ষমতার উৎস ছিল VDJ-এর উপর মানুষের বিশ্বাস, যা এখন ভেঙে গেছে। তাকে গ্রেফতার করা হলো এবং তার সব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। অর্ণব তার আবিষ্কারের ভুল শুধরে নিলেন। তিনি VDJ-এর সমস্ত ব্লুপ্রিন্ট ধ্বংস করে দিলেন, যাতে কেউ আর এর অপব্যবহার করতে না পারে। এবং “ভবিষ্যৎ-পরিবর্তন সূচক” এর প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করে দিলেন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো যন্ত্র নয়, এটি একটি শিক্ষা। অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য: এক নতুন সমাজের জন্ম ধীরে ধীরে, সমাজ আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করল। অর্থনৈতিক মন্দা কাটতে শুরু করল, কারণ মানুষ আবার ঝুঁকি নিতে এবং চেষ্টা করতে শুরু করল, নতুন ব্যবসা শুরু হলো, কর্মসংস্থান বাড়ল। সম্পর্কের টানাপোড়েন কমতে লাগল, কারণ মানুষ বুঝতে পারল যে ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের উপর ভরসা রাখা কতটা জরুরি। জীবনের উদ্দেশ্য ফিরে এল, কারণ প্রতিটি দিনই নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল, যা তাদের নিজেদের হাতে গড়ার সুযোগ ছিল। অর্ণব আর VDJ নিয়ে কাজ করলেন না। তিনি তার ল্যাব বন্ধ করে দিলেন এবং সায়রার সাথে মিলে একটি নতুন গবেষণা শুরু করলেন – মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর। তিনি বুঝতে পারলেন, সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বিজ্ঞানে নয়, বরং মানুষের ভেতরের ইচ্ছাশক্তি এবং অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করার ক্ষমতায় নিহিত। পৃথিবী আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সৌন্দর্যকে গ্রহণ করল। মানুষ বুঝতে পারল, জীবন একটি খোলা বইয়ের মতো, যার প্রতিটি পৃষ্ঠা তাদের নিজেদের হাতে লেখা হয়। ভবিষ্যৎ কোনো স্থির প্রতিচ্ছবি নয়, বরং বর্তমানের প্রতিটি সিদ্ধান্তের এক চলমান সৃষ্টি। আর এই অনিশ্চয়তাই জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার – আশা, প্রচেষ্টা এবং ভালোবাসার অনন্ত সম্ভাবনা। অর্ণবের নতুন পথ ও মানবজাতির পুনরুত্থান ড. অর্ণব রায়, যিনি একসময় ভবিষ্যৎকে হাতের মুঠোয় আনতে চেয়েছিলেন, তিনি এখন জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটি উপলব্ধি করেছেন: অনিশ্চয়তাই জীবনের আসল সৌন্দর্য। তার আবিষ্কার, “ভবিষ্যৎ-দর্শন যন্ত্র”, মানবতাকে এক ভয়ংকর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সংকটই মানুষকে শিখিয়েছিল তাদের নিজস্ব শক্তি এবং ইচ্ছাশক্তির মূল্য। অর্ণব এখন আর যন্ত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দেখেন না। তিনি প্রতিদিন সকালে উঠে নতুন দিনের সূর্যোদয় দেখেন, আর প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্য দেন, প্রতিটি শ্বাসকে উপভোগ করেন। তার পাশে সায়রা থাকে, যে সবসময় তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছে, তার নীরব সঙ্গী হিসেবে। তারা এখন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর গবেষণা করেন, যাতে মানুষ তাদের ভেতরের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। তাদের গবেষণা কেন্দ্র এখন মানুষকে শেখায় কীভাবে অনিশ্চয়তাকে ভয় না পেয়ে, তাকে আলিঙ্গন করতে হয়, এবং প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে হয়। সমাজ ধীরে ধীরে VDJ-এর প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসেছে। মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, ঝুঁকি নিতে শুরু করেছে, এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে ভবিষ্যৎ কোনো স্থির গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সিদ্ধান্তই নতুন পথের জন্ম দেয়। অনিশ্চয়তা এখন আর ভয়ের কারণ নয়, বরং সম্ভাবনার প্রতীক, যা জীবনকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। অর্ণব জানতেন, তার আবিষ্কারের দাগ পুরোপুরি মুছে যাবে না। কিন্তু তিনি আশাবাদী ছিলেন। মানুষ ভুল করে, কিন্তু সেই ভুল থেকে শেখে। আর এই শেখার প্রক্রিয়াতেই জীবনের আসল অর্থ নিহিত। ভবিষ্যৎ অজানা, আর সেই অজানা পথেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এবং অপ্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো। এই গল্পটি শুধু একটি যন্ত্রের নয়, এটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি, ভুল থেকে শেখা, এবং জীবনের অনিশ্চিত সৌন্দর্যকে পুনরায় আবিষ্কার করার গল্প। এটি মানবজাতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে তোলে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion