চরিত্র:
অনির্বাণ: প্রায় তিরিশের কোঠায় থাকা এক তরুণ বেসরকারি গোয়েন্দা। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণাত্মক মন এবং একরোখা সংকল্প তার মূল শক্তি। কিন্তু এই রহস্যময় শহরে নিজের জায়গা করে নেওয়ার লড়াই তার ব্যক্তিগত জীবনকেও প্রভাবিত করছে।
শর্মিলা দেবী: রোহন সেনের স্ত্রী। মধ্যবিত্ত পরিবারের শান্ত, গৃহবধূ, যার জীবন স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার পর পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তার চোখে স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং এক অসহায় আকুতি।
রোহন সেন: সুপরিচিত স্থপতি। তার পেশাগত দক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল প্রাচীন ইতিহাস ও গুপ্ত রহস্যের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ।
দেবাশীষ রায়: একজন প্রভাবশালী, ধুরন্ধর এবং নির্মম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার। তার ঠান্ডা চোখের দৃষ্টিতে লোভ আর ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা জ্বলজ্বল করে।
মিসেস মিত্র: পুরনো জমিদার বাড়ির বৃদ্ধা মালিক। তার কণ্ঠস্বরে যেন এক শতাব্দীর ইতিহাস মিশে আছে, আর চোখে এক অজানা ভয়।
গণেশ: পরিত্যক্ত কারখানার তত্ত্বাবধায়ক। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তার চোখে এক পুরনো দিনের আতঙ্ক বাসা বেঁধে আছে।
বিক্রম সেন: এক উন্মাদ প্রত্নতত্ত্ববিদ, যার মন প্রাচীন রহস্য এবং গুপ্তধনের প্রতি আচ্ছন্ন। ‘কুয়াশার উপাসক’ নামক এক গুপ্ত সম্প্রদায়ের শেষ সক্রিয় সদস্য।
প্রথম অংশ: আঁধারের শুরু
শরৎ শেষের কলকাতা এক অদ্ভুত মায়াবী রূপ ধারণ করে। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডার আমেজ, আর শহরের আলো যেন এক নরম আভা ছড়ায় দ্রুত নেমে আসা আঁধারের উপর। তবে অনির্বাণের জন্য এই সৌন্দর্য ছিল এক গভীর অস্বস্তির আড়ালে ঢাকা। উত্তর কলকাতার এক ঘিঞ্জি গলির শেষ মাথায় তার ছোট, এক কামরার গোয়েন্দা সংস্থা, “অনুসন্ধান”। অফিসের বোর্ডটা সবে এক মাস আগে লাগানো, তার রঙ এখনো ফিকে হয়নি। কিন্তু ফোন বাজে না বললেই চলে। মাসের শেষে ভাড়ার টাকা জোগাড় করাও যেন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছিল। বাবা-মা চেয়েছিলেন সে যেন সরকারি চাকরির পেছনে ছোটে, নয়তো অন্তত কোনো বহুজাতিক সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরি নেয়। কিন্তু গোয়েন্দা হওয়ার অদম্য, পাগলাটে নেশা তাকে এই অনিশ্চিত পথে টেনে এনেছে। তার আত্মবিশ্বাসই ছিল একমাত্র পুঁজি, যা দিয়ে সে কলকাতার এই বিশাল, রহস্যময় শহরের গভীরে ডুব দিতে চেয়েছিল।
এক বিশেষ মেঘলা সন্ধ্যায়, যখন তার অফিসের একমাত্র জানালায় অবিরাম বৃষ্টি আছড়ে পড়ছিল, অনির্বাণ টেবিলের উপর রাখা পুরোনো ফোনটার দিকে তাকিয়ে ছিল। রিং বাজে না। বাজলেও সেটার উৎস সাধারণত কোনো বন্ধুর দেনা শোধের তাগাদা, নয়তো পাড়ার কোনো খুঁটিনাটি ঝগড়া সমাধানের অনুরোধ। ঠিক তখনই দরজায় একটি মৃদু টোকা পড়লো। অনির্বাণ অবাক হলো, এত রাতে কেউ আসে না। সে মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয়ই কোনো ভুল করে ঢুকে পড়েছে।
দরজা ঠেলে এক মহিলা প্রবেশ করলেন। তিনি একটি সাধারণ সুতির শাড়িতে আবৃত ছিলেন, যেন তার দুঃখকেই তিনি পোশাকে ধারণ করেছেন। তার মুখ ফ্যাকাশে এবং গভীর দুশ্চিন্তায় ভরা, যেন অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে। তবে তার চোখে ছিল মরিয়া আশার এক ঝলক, যা অনির্বাণকে তার নিজের ভেতরের সুপ্ত আশাকে জাগিয়ে তুললো। “আপনিই কি অনির্বাণবাবু?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার কণ্ঠস্বর সামান্য কাঁপছিল, যেন অনেক কাঁদার পর শুকিয়ে গেছে।
অনির্বাণ, যে অলসভাবে একটি পুরনো গোয়েন্দা পত্রিকা উল্টাচ্ছিল, সেটা একপাশে রেখে সোজা হয়ে বসলো। “হ্যাঁ, আমিই। আসুন, বসুন।” সে টেবিলের উপর থেকে ফাইলগুলো সরিয়ে বসার জায়গা করে দিল। অফিসের স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠলো।
মহিলা নিজের পরিচয় দিলেন শর্মিলা দেবী হিসেবে। তার গল্প ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো, তার স্নায়বিক দীর্ঘশ্বাস আর বাইরের বৃষ্টির অবিরাম ছন্দে ছেদ পড়ে। তার স্বামী, রোহন সেন, একজন সুপরিচিত স্থপতি, গত তিন দিন ধরে নিখোঁজ। তিনি শহরের উপকণ্ঠে একটি সাইট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং তারপর থেকে আর ফিরে আসেননি বা কারো সাথে যোগাযোগ করেননি। পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য সূত্র খুঁজে পায়নি। তারা এটিকে একটি সম্ভাব্য ব্যবসায়িক ভ্রমণ বা ব্যক্তিগত বিচ্যুতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। “তারা বলছে, হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছে… কিন্তু আমার রোহন এমন মানুষ নয়, অনির্বাণবাবু। সে আমায় না জানিয়ে এক পা-ও নড়তো না। ফোন বন্ধ রাখার কথা তো ভাবাই যায় না,” শর্মিলা দেবীর চোখে জল ছলছল করে উঠলো। তার হাতে ধরা ব্যাগটা শক্ত মুষ্টিতে চেপে ধরলেন।
শর্মিলা দেবীর কথা শেষ হতেই অনির্বাণ লক্ষ্য করলো, তার হাতে একটি ছোট, ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটি যেন তার অস্থিরতার সাক্ষী। “এটা কি?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো, তার চোখ কৌতুহলী হয়ে উঠলো।
শর্মিলা কাগজটি এগিয়ে দিলেন। “এটা আমার স্বামীর ড্রইং টেবিলের উপর পড়েছিল। পুলিশ এটাকে গুরুত্ব দেয়নি, বললো হয়তো কোনো পুরোনো প্রজেক্টের কাগজপত্র।”
কাগজটি ছিল একটি পুরনো, বিবর্ণ মানচিত্রের অংশ, সম্ভবত কোনো শিল্প এলাকার। মানচিত্রের এক কোণে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল একটি তারিখ – ‘১৩ই কার্তিক, ১৯৪০’ – এবং একটি রহস্যময় শব্দ: “কুয়াশা”। অনির্বাণ মানচিত্রটি দেখে চমকে উঠলো। পরিত্যক্ত বস্ত্র কারখানাটি ঠিক তেমনই ছিল যেমনটা শর্মিলা বর্ণনা করেছিলেন – একটি কঙ্কালসার কাঠামো, যা বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। কিন্তু এই “কুয়াশা” শব্দটি তাকে ভাবিয়ে তুললো। এটা কি শুধু একটি শব্দ, নাকি কোনো গোপন কোড? অনির্বাণ যেন এক অদৃশ্য সুতোর টান অনুভব করলো।
রোহন সেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, যার কোনো পরিচিত শত্রু বা আর্থিক সমস্যা ছিল না। শর্মিলা দেবীর কষ্ট সত্যিকারের মনে হচ্ছিল। এটিই হতে পারে সেই কেস যা অনির্বাণকে “অনুসন্ধান”-কে পরিচিতি দেবে, তাকে এই অনিশ্চয়তার কুয়াশা থেকে বের করে আনবে। এই কেস তার জন্য শুধু অর্থ নয়, সম্মানও এনে দেবে।
“আমি চেষ্টা করতে পারি,” অনির্বাণ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, শর্মিলাকে আশ্বস্ত করার জন্য এক ঝলক হাসি দিয়ে। “আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিন। আর এই মানচিত্রটা… এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আমি এটা রাখছি।”
শর্মিলা অনির্বাণকে রোহনের বিবরণ, তার পরিচিতি, সাইট পরিদর্শনের স্থান এবং একটি সাম্প্রতিক ছবি দিলেন। রোহন ছিলেন চল্লিশের কোঠায় একজন সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ, যার মুখে ছিল চিন্তাশীল অভিব্যক্তি। সাইট পরিদর্শনের স্থানটি ছিল শহরের পূর্ব প্রান্তে একটি পুরনো, পরিত্যক্ত বস্ত্র কারখানা – এমন একটি জায়গা যা তার স্থাপত্যের প্রতিশ্রুতি থেকে তার নির্জন নীরবতার জন্য বেশি পরিচিত। এই কারখানাটি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত, স্থানীয়দের মধ্যে এটি ‘ভূতুড়ে কারখানা’ নামেই পরিচিত ছিল।
পরের দিন সকালে, তথ্য এবং নতুন করে পাওয়া উদ্দেশ্য নিয়ে অনির্বাণ বেরিয়ে পড়লো। তার পকেটে ছিল শেষ কিছু টাকা, যা দিয়ে তাকে এই কেসটা চালাতে হবে। তার বাইকের ইঞ্জিনের ঘরঘর শব্দ যেন তার মনের ভেতরের অস্থিরতাকে চাপা দিতে পারছিল না। পরিত্যক্ত বস্ত্র কারখানাটি ঠিক তেমনই ছিল যেমনটা শর্মিলা বর্ণনা করেছিলেন – ইঁট এবং মরিচা ধরা ধাতুর এক কঙ্কালসার কাঠামো, এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢাকা। কারখানার তত্ত্বাবধায়ক, গণেশ নামে একজন বৃদ্ধ লোক, যার চোখে মুখে ছিল অদম্য ভয়, সে তার সাথে কথা বললো। গণেশ বহু বছর ধরে এই কারখানার প্রহরী, কিন্তু তার প্রতিটি কথা যেন এক গভীর রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করছিল। সে রোহনকে তিন দিন আগে দেখতে পাওয়ার কথা মনে করতে পারলো। তিনি তার গাড়িতে এসেছিলেন এবং মূল ভবনের ভিতরে গিয়েছিলেন। গণেশ তাকে চলে যেতে দেখেননি। “বাবা, ওই জায়গাটা ভালো না। রাতে কেমন যেন শব্দ হয়। কারা যেন আসে যায়। কুয়াশার মতো অদৃশ্য হয়ে যায়,” গণেশ ফিসফিস করে বললো, তার চোখে আতঙ্ক। “কেমন একটা ঠান্ডা, ভেজা গন্ধ বেরোয় রাতের বেলা। পুরনো পাথরের আর মাটির গন্ধ। যেন মাটির তলা থেকে উঠে আসছে। কুয়াশার গন্ধ।” অনির্বাণ তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো, গণেশের চোখে সে এক অদ্ভুত ভয় দেখতে পেল, যা কেবল কল্পিত নয়, বরং বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতার ফল।
অনির্বাণ কারখানাটি ঘুরে দেখলো, তার বিশাল, ধুলো ভরা হলগুলো তার পদধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বাতাসে পচন এবং স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছিল, যা সত্যিই গণেশের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল না, কোনো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পড়ে ছিল না, শুধু এক অস্বস্তিকর শূন্যতা। রোহনের গাড়িটিও নিখোঁজ ছিল। অনির্বাণ প্রতিটি কোণা খুঁটিয়ে দেখছিল। একটি পুরনো ভাঙা মেশিনের নিচে অনির্বাণ একটি ছোট, চকচকে ধাতব টুকরা খুঁজে পেল। এটি একটি ছোট লকেট, যার উপর একটি অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা – একটি চক্রের মধ্যে একটি ক্রিপ্টিক আঁকিবুকি। প্রতীকটি অনির্বাণের কাছে অচেনা ছিল, কিন্তু তার মনে হলো এর একটি গভীর অর্থ আছে। সে লকেটটি সাবধানে তুলে নিল, তার ঠান্ডা স্পর্শ যেন এক পুরনো দিনের গল্প বলছিল।
তার অফিসে ফিরে এসে, অনির্বাণ ধাঁধাটি মেলাতে শুরু করলো। সে রোহনের ব্যবসায়িক অংশীদার এবং বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করলো। তারা সবাই হতবাক এবং চিন্তিত ছিল। কেউ তার কাছ থেকে কোনো খবর পায়নি। কোনো খারাপ চুক্তি বা পরিচিত বিরোধ ছিল না। তবে, রোহনের এক পুরনো বন্ধু, যিনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং প্রাচীন পুঁথির গবেষক, অনির্বাণকে জানালেন যে রোহন সম্প্রতি পুরনো কলকাতার ইতিহাস এবং লুকানো সুড়ঙ্গপথ নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। “রোহন বলতো, কলকাতার মাটির নিচে নাকি অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। পুরনো জমিদার বাড়ির নিচে, গঙ্গার ধারে, অনেক কিছু নাকি গুপ্ত আছে। সে এসব নিয়ে অনেক রিসার্চ করছিল,” বন্ধুটি বললো। “আর সেই পুরনো কারখানার ইতিহাসও নাকি বেশ রহস্যময়। ওটা নাকি একসময় ব্রিটিশ আমলের কোনো গুপ্ত সমিতির মিটিং প্লেস ছিল, যারা নিষিদ্ধ জ্ঞান আর ক্ষমতার সন্ধান করত।”
দিনগুলো এক সপ্তাহে পরিণত হলো, এবং কলকাতা পুলিশ, রোহন বা তার গাড়ির কোনো চিহ্ন খুঁজে না পেয়ে, কেসটিকে একজন নিখোঁজ ব্যক্তি হিসেবে বন্ধ করার দিকে ঝুঁকছিল, পরামর্শ দিচ্ছিল যে তিনি স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। শর্মিলা বিধ্বস্ত ছিল। অনির্বাণ, তবে, অনুভব করছিল যে কিছু একটা ভুল আছে। রোহন সেন কেবল অদৃশ্য হননি; তাকে অপহরণ করা হয়েছে, এবং এই রহস্যের গভীরে আরও কিছু লুকিয়ে আছে। তার মনে সেই মানচিত্রের ‘কুয়াশা’ আর গণেশের ‘কুয়াশা’ গন্ধের কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই কুয়াশা যেন শুধু আবহাওয়ার অংশ নয়, বরং এক অদৃশ্য রহস্যের আবরণ।
তার তদন্ত তাকে রোহনের পেশাগত জীবনে আরও গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য করলো। সে আবিষ্কার করলো যে রোহন সম্প্রতি একটি বিতর্কিত নগর উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছিলেন, যেখানে একটি প্রধান স্থানে কয়েকটি পুরনো সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা জড়িত ছিল। সেখানে কিছু দীর্ঘদিনের বাসিন্দাদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধ ছিল। এই প্রকল্পের সাথে দেবাশীষ রায় নামে এক প্রভাবশালী রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের নাম বারবার উঠে আসছিল।
দ্বিতীয় অংশ: রহস্যের জাল
দেবাশীষ রায় সম্পর্কে অনির্বাণের অনুসন্ধান থেকে জানা গেল যে তিনি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অধিকারী এবং যা তিনি চান তা পেতে যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। তিনি কঠোর পদ্ধতির জন্য পরিচিত ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে সন্দেহজনক জমি লেনদেনের ইতিহাস ছিল। রোহন কি তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল? না কি আরও গভীর কোনো স্বার্থের টানে সে এই জালে জড়িয়ে পড়েছে? অনির্বাণ জানতো রায়ের মতো মানুষ শুধু টাকার জন্য যেকোনো কাজ করতে পারে।
অনির্বাণ রায়কে একবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। তার অফিস ছিল শহরের বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রে একটি ঝকঝকে, আধুনিক বহুতল। কাঁচের বিশাল দেওয়ালে কলকাতার ব্যস্ত জীবন প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই জাঁকজমক অনির্বাণের বিনয়ী সেটআপের সম্পূর্ণ বিপরীত। রায়, একজন স্থূলকায় ব্যক্তি যার তীক্ষ্ণ চোখে অহংকারের ইঙ্গিত ছিল, রোহনের নিখোঁজ হওয়ার সাথে কোনো জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেন। তার মুখে ছিল এক শীতল, কাঠিন্য। তিনি দাবি করলেন যে তিনি প্রকল্পের বিষয়ে রোহনের সাথে কয়েকবার দেখা করেছেন কিন্তু জোর দিয়ে বললেন যে তাদের মিথস্ক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে পেশাদার ছিল। “মি. সেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার সাথে আমার কোনো বিবাদ ছিল না,” রায় শীতল কণ্ঠে বললো, তার ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি। “তার উধাও হওয়াটা আমার জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। এই প্রকল্পটি তার অনুপস্থিতিতে আরও বিলম্বিত হচ্ছে।” অনির্বাণ লক্ষ্য করলো, রায়ের টেবিলের উপর একটি ছোট পাথরের মূর্তি রাখা আছে, যার উপর সেই একই অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা, যা সে কারখানায় খুঁজে পাওয়া লকেটে দেখেছিল। অনির্বাণ কিছু বললো না, তার চোখ রায়ের মুখের দিকে নিবদ্ধ ছিল। রায় হয়তো এই প্রতীকের গুরুত্ব জানে, কিন্তু তার ভান দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুই জানে না। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, রায় একজন দক্ষ অভিনেতা।
সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুঁজে পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে, অনির্বাণ নগর উন্নয়ন প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্যে আরও গভীরে প্রবেশ করলো। সে জড়িত সম্পত্তির তালিকা সংগ্রহ করলো এবং তাদের মালিকানার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করলো। সে আবিষ্কার করলো যে একটি নির্দিষ্ট সম্পত্তি, একটি পুরনো পৈতৃক বাড়ি, একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। মালিক, মিসেস মিত্র, একজন বৃদ্ধা মহিলা, আবেগিক মূল্যের কথা উল্লেখ করে বিক্রি করতে অস্বীকার করছিলেন। রোহন তার সাথে আলোচনার চেষ্টা করছিলেন। এই বাড়িটির প্রাচীনত্ব এবং স্থাপত্যের বিশেষত্বের কারণে রোহন নিজেও নাকি এর প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন, যা দেবাশীষ রায়কে আরও বিরক্ত করছিল।
অনির্বাণ মিসেস মিত্রের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি একটি শান্ত, পুরনো পাড়ায় থাকতেন, তার বাড়িটি এক ম্লান আভিজাত্যের অনুভূতি ছড়াচ্ছিল। বাতাসে ধূপের গন্ধ আর পুরনো আসবাবপত্রের চিরচেনা ঘ্রাণ। বাড়ির দেওয়ালে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমা হওয়া ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। মিসেস মিত্র রোহনকে ভালোভাবে মনে রেখেছিলেন, তাকে একজন দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি তার বাড়ি বিক্রি করতে অস্বীকার করেছিলেন, এবং রোহন তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারছিলেন না যে কেউ তাকে ক্ষতি করতে চাইবে।
তবে, তাদের কথোপকথনের সময়, মিসেস মিত্র এমন কিছু উল্লেখ করলেন যা অনির্বাণের মনোযোগ আকর্ষণ করলো। “কয়েক দিন আগে, রোহন আসার ঠিক আগে, একজন লোক এসেছিল। তার চোখ দুটি ছিল অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল, কেমন যেন একটা উন্মাদনা ছিল তার চোখে। সে শুধু বাড়ির কথা বলছিল না, বলছিল মাটির নিচের কিছু একটা নাকি এখানে লুকিয়ে আছে। পুরনো গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ, প্রাচীন প্রতীক, আর একটা কুয়াশার কথা বলছিল। বলছিল, এটা নাকি তাদের ‘অমরত্বের পথ’,” মিসেস মিত্র বললেন, তার চোখে ভয়। “সে একটা অদ্ভুত লকেট পরেছিল, ঠিক এইরকম,” বলে তিনি তার শাড়ির আঁচল থেকে একটি পুরনো লকেট বের করলেন, যার উপর সেই একই প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা অনির্বাণ কারখানায় পেয়েছিল! লকেটটি তার হাতে যেন শত শত বছরের পুরনো রহস্যের ভার বয়ে এনেছিল।
অনির্বাণ চমকে উঠলো। এই লকেটটি তার খুঁজে পাওয়া লকেটের সাথে হুবহু মিলে যায়। “তার নাম কি মনে আছে আপনার?” অনির্বাণ দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠলো।
মিসেস মিত্র মাথা নাড়লেন। “না বাবা, নাম বলেনি। তবে তার সাথে একটা কালো এসইউভি ছিল যার নম্বরটা কেমন যেন অদ্ভুত ছিল – ‘৭৭৭ কুয়াশা’। আর তার সাথে আরও দুজন লোক ছিল, তাদের চোখ কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল, যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।”
অনির্বাণ ধন্যবাদ জানিয়ে মিসেস মিত্রের কাছ থেকে বিদায় নিল। এই তথ্যটা তাকে নতুন এক জটের মধ্যে ফেলে দিল। রায় তো অন্য লোক ছিল। তাহলে এই লোকটা কে? এই ‘৭৭৭ কুয়াশা’ নম্বরটাও কি কোনো কোড? রায়ের সাথে তার কি সম্পর্ক? রায় কি শুধু এই লোকের হাতের পুতুল? অনির্বাণের মনে হলো, সে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে পরিচিত মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অজানা শক্তি।
অনির্বাণ তার প্রত্নতত্ত্ববিদ বন্ধুর সাথে লকেটের প্রতীক এবং “কুয়াশা” শব্দটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলো। বন্ধুটি দীর্ঘক্ষণ প্রতীকটি পরীক্ষা করে বললো, “অনির্বাণ, এটা একটা প্রাচীন গুপ্ত সমিতির প্রতীক। যারা ‘কুয়াশার উপাসক’ নামে পরিচিত ছিল। তারা কলকাতার মাটির নিচে, পুরনো জমিদার বাড়ির গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর মন্দিরে লুকানো প্রাচীন পুঁথি আর গুপ্তধনের সন্ধানে থাকে। তাদের বিশ্বাস, কুয়াশার গভীরে প্রবেশ করলে নাকি অমরত্ব পাওয়া যায়, অথবা এক অদৃশ্য শক্তি তাদের হাতে আসে।” বন্ধুটি আরও জানালো যে, এই ধরনের কিছু সমিতি ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতায় সক্রিয় ছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য সব সময় ভালো ছিল না। তারা রহস্যময়ভাবে লোক তুলে নিত, তাদের ওপর গবেষণা চালাতো। রোহন সেনের এই বিষয়টিতে আগ্রহ ছিল, এবং সম্ভবত তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যা তার জন্য বিপদ ডেকে এনেছে।
অনির্বাণ অনুভব করলো এই রহস্য আরও গভীরে প্রোথিত। সে রায়কে অনুসরণ করার জন্য একজন স্থানীয় পরিচিতকে নিয়োগ করলো। কিন্তু তার মনে এক অস্থিরতা কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। রাতের বেলা, যখন সে তার অফিসের কাজ সারছিল, তখন বাইরের গলিতে এক ছায়ামূর্তির আনাগোনা দেখতে পেল। পরদিন সকালে, অনির্বাণের অফিসের দরজায় একটি বেনামী চিঠি এসে পড়লো। চিঠিতে শুধু একটি লাইন লেখা ছিল: “যে কুয়াশার গভীরে প্রবেশ করে, সে আর আলোর মুখ দেখে না। সাবধান, অনির্বাণ! তোমার অনুসন্ধানের পথ হয়তো তোমার শেষ পথ হতে পারে।”
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, সে নিজেই এখন বিপদের মুখে। এই গোপন সমিতি তাকে নজরে রেখেছে। তাদের শক্তি কতটা বিস্তৃত, তা সে জানে না। তবুও, সে পিছপা হবে না। রোহনকে খুঁজে বের করা এখন শুধু একটি কেস নয়, এটি তার নিজের অস্তিত্বের লড়াইও বটে। তার চোখে জেদ, মনে প্রতিশোধের আগুন।
কয়েকটা দিন কাটল টানটান উত্তেজনায়। অনির্বাণ ছায়ার মতো ঘুরতে লাগলো দেবাশীষ রায়ের পেছনে। তার পরিচিতের কাছ থেকে খবর এলো, রায়কে প্রায়ই রাতের বেলা একটি বিশেষ ক্লাবে যেতে দেখা যায়। ক্লাবের নাম ‘অন্ধকার ঘর’। সেখানে কিছু অদ্ভুত চেহারার মানুষজন যাতায়াত করে, যারা প্রায়ই ওই লকেট পরে থাকে। তাদের চোখে এক অদ্ভুত শূণ্যতা, যেন তারা কোনো উচ্চতর শক্তির দ্বারা চালিত।
অনির্বাণ রাতের বেলা ক্লাবের বাইরে নজরদারি শুরু করলো। সে দেখলো, সেই অদ্ভুত চোখের উন্মাদনা নিয়ে লোকটি ক্লাবের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তার নাম বিক্রম সেন। তার সাথে দেবাশীষ রায়ও ছিল। তারা একটি কালো এসইউভিতে উঠলো, যার লাইসেন্স প্লেটের শেষ অক্ষরগুলো ছিল ‘৭৭৭ কুয়াশা’! অনির্বাণ দ্রুত তার জীর্ণ বাইক চালিয়ে তাদের অনুসরণ করলো।
গাড়িটি শহরের উপকণ্ঠে, হুগলি নদীর কাছাকাছি একটি নির্জন, পরিত্যক্ত গুদামের দিকে এগিয়ে গেল। স্থানটি ছিল কলকাতার এক কোণ, যেখানে সভ্যতার আলো পৌঁছায় না বললেই চলে। গুদামটি একটি বড়, জরাজীর্ণ কাঠামো ছিল, চারদিকে ভাঙা কাঁচ আর মরিচা ধরা ধাতু। বাতাসে এক তীব্র, পচনশীল গন্ধ ভাসছিল, যা গণেশের বলা ‘কুয়াশার গন্ধের’ সাথে মিলে গেল। অনির্বাণ বাইকটা একটু দূরে রেখে সাবধানে গুদামের দিকে এগিয়ে গেল। তার মনে ভয় আর কৌতূহলের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সে জানতো, সে এখন কুয়াশার গভীরে প্রবেশ করছে। এই পথে পা রাখলে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু তার পিছু হটার কোনো উপায় ছিল না।
তৃতীয় অংশ: অন্ধকারের কিনারে
চাঁদহীন রাতের আড়ালে, অনির্বাণ বাইকটা একটা পুরোনো বটগাছের আড়ালে রেখে সাবধানে গুদামের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে শুধু তার পুরোনো টর্চলাইট আর পকেটে একটা ছোট সুইস আর্মি নাইফ। এই স্বল্প সরঞ্জাম নিয়ে সে এক অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হতে চলেছে। গুদামটি একটি পরিত্যক্ত শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত ছিল, নীরবতা কেবল পাতার মর্মর ধ্বনি এবং নদীর দূরবর্তী শব্দে ভাঙছিল। গুদামটি নিজেই ছিল একটি বিশাল, জরাজীর্ণ কাঠামো যার ভাঙা জানালা এবং একটি ভারী, তালাবদ্ধ গেট ছিল। বাতাসে এক অদ্ভুত, পচনশীল গন্ধ ভাসছিল – যেন শতাব্দী প্রাচীন কোনো রহস্যের শ্বাস-প্রশ্বাস। বাতাসে এক ভারী, ভেজা আর্দ্রতা, যা যেন মাটির তলা থেকে উঠে আসা কোনো অজানা কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
অনির্বাণ একটি ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢোকার একটি উপায় খুঁজে পেল। গুদামের উঠোন আগাছায় ভরে ছিল, আর ভাঙা ইঁটের স্তূপ পড়ে ছিল এখানে ওখানে। শেওলা ধরা দেওয়াল যেন শতাব্দীর পুরনো গল্প বলছিল। সে সাবধানে মূল ভবনের দিকে এগিয়ে গেল, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ ছিল। ঠান্ডা, ভেজা মাটি তার জুতোর তলায় ক্রাঞ্চ করে উঠলো। ভিতর থেকে ক্ষীণ শব্দ আসছিল – চাপা কণ্ঠস্বর, লোহার জিনিসপত্রের ঘষা লাগার শব্দ, এবং মাঝে মাঝে একটি দুর্বল গোঙানির শব্দ। প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃদস্পন্দনকে আরও দ্রুত করে তুলছিল।
একটি ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে, অনির্বাণের রক্ত হিম হয়ে গেল। সে দেখলো রোহন, একটি চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়, তার মুখ বন্ধ করা এবং তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তার পোশাক ছেঁড়া, চোখে এক গভীর যন্ত্রণা আর হতাশা। রোহনের পাশেই দাঁড়ানো দেবাশীষ রায়, তার মুখে বিজয়ের হাসি, কিন্তু তার চোখ ছিল এক অদ্ভুত উন্মাদনায় ভরা। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সেই অদ্ভুত লোকটি, বিক্রম সেন, যার হাতে একটি পুরনো, জং ধরা ছুরি চকচক করছিল। বিক্রমের চোখে ছিল এক হিংস্রতা, যা দেখলে যে কারো মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাবে। তার মুখে এক জঘন্য হাসি, যেন কোনো গোপন খেলা খেলছে।
“আর কতক্ষণ লুকাবে রোহন? সেই মানচিত্রটা কোথায়? ‘কুয়াশার উপাসকদের’ আসল মানচিত্রটা,” বিক্রমের কণ্ঠস্বর হিসহিস করে উঠলো। তার প্রতিটি শব্দে এক ধরণের পাগলামি মিশে ছিল, যা অনির্বাণকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। “তোমার স্থপতি বুদ্ধির আর কী দাম রইল এখন? ওই সামান্য জ্ঞানের জন্য তুমি আমাদের হাজার বছরের সাধনাকে নষ্ট করতে চাইছো?”
রোহন শুধু গোঙানির শব্দ করলো, তার শরীর কাঁপছিল। তার চোখগুলো যেন অনির্বাণের দিকে আকুতি জানাচ্ছিল।
রায় বললো, “ওকে আর বেশি সময় দিও না বিক্রম। ও বোধহয় ভাবছে আমরা ওর চালাকি বুঝতে পারছি না। আমরা জানি ওটা তোর কাছেই আছে। ওই তোর দেওয়া সেই পুরনো পাথরের লকেটটাই তোকে ফাঁসাচ্ছে।”
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, রোহনকে শুধু সম্পত্তির জন্য অপহরণ করা হয়নি, আরও গভীর কোনো রহস্য এর পেছনে লুকিয়ে আছে। মানচিত্র! সেই পুরনো মানচিত্রের অংশ! রোহনের হাতে যে মানচিত্রের অংশ ছিল, তা ছিল কেবল একটা ছোট টুকরো। আসল মানচিত্র হয়তো আরও বড় কিছু নির্দেশ করছে, যা এই উন্মাদ বিক্রমের কাছে অমরত্বের চাবিকাঠি।
অনির্বাণ জানতো তাকে দ্রুত কাজ করতে হবে। সে সরাসরি রায় এবং তার লোকেদের মুখোমুখি হতে পারতো না; সে outnumbered ছিল এবং রোহনও চরম বিপদে ছিল। সে দ্রুত তার পকেট থেকে ফোন বের করলো। ভাগ্যক্রমে, এখানে ক্ষীণ একটি সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল। দ্রুত ডায়াল করলো পুলিশের ইমারজেন্সি নম্বর। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার উদ্দেশ্য স্থির ছিল। “স্যার, উত্তর কলকাতার পরিত্যক্ত বস্ত্র কারখানা, হুগলি নদীর পাশে। এখানে একজন অপহৃত ব্যক্তি আছে… বিপদ! তারা ‘কুয়াশার উপাসক’ নামে একটি গোপন সমিতির সদস্য… একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিক্রম সেন, এবং একজন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার, দেবাশীষ রায়… তাড়াতাড়ি আসুন!” সে দ্রুত কথাগুলো বলে লাইনটা কেটে দিল। এখন তাকে একা লড়তে হবে যতক্ষণ না পুলিশ আসে।
সে দ্রুত গুদামের পিছনের দিকে চলে গেল। সেখানে একটি ছোট, অরক্ষিত লোহার দরজা ছিল। দরজাটা ভাঙা, মরিচা ধরা। অনির্বাণ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। ভিতরে অন্ধকার আর ধুলো ভরা স্টোরেজ এলাকা। তীব্র পচনশীল গন্ধ এখানে আরও বেশি প্রকট, যেন মাটির তলা থেকে উঠে আসা হাজার বছরের পুরোনো কিছুর গন্ধ। সে সাবধানে স্টোরেজ তাকের গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেল, চেষ্টা করছিল তাদের কাছাকাছি যেতে।
সে শুনতে পেল বিক্রমের কণ্ঠস্বর, এবার আরও স্পষ্ট। “ওই পুরনো কারখানার নিচে কী লুকিয়ে আছে, রোহন? ‘কুয়াশার’ আসল রহস্য কী? তুই একা জানিস না। আমাদের পূর্বপুরুষরা শত শত বছর ধরে এই রহস্যের পেছনে ছুটেছে, আর তুই কিনা সাধারণ একজন স্থপতি হয়ে সেটা আবিষ্কার করে ফেললি! বল, নইলে তোর এই স্থাপত্যবিদ্যা আর তোর ভবিষ্যৎ, সবই এখানে শেষ হয়ে যাবে।” বিক্রমের চোখে উন্মাদনা আরও বেড়ে উঠলো, তার হাতের ছুরিটা রোহনের মুখের খুব কাছে চলে এলো।
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, “কুয়াশা” শুধু একটি কোডনেম নয়, এটি একটি গোপন রহস্যের চাবিকাঠি – যা হয়তো শতাব্দী প্রাচীন কোনো গুপ্তধনের দিকে নির্দেশ করছে। রোহন সেই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করেছিল। বিক্রম, এই প্রাচীন সমিতির এক উন্মাদ সদস্য, যে বংশপরম্পরায় এই রহস্যের সমাধান করতে চাইছে। আর দেবাশীষ রায়, সে শুধু অর্থের লোভে এদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, কিন্তু সে বিক্রমের এই উন্মাদনার গভীরতা বুঝতে পারেনি।
অনির্বাণ মেঝেতে পড়ে থাকা একটি ভারী লোহার রড খুঁজে পেল। সেটি শক্ত করে ধরে সে শব্দের দিকে এগিয়ে গেল। সে একটি বড় খোলা জায়গায় পৌঁছালো। রায়, বিক্রম এবং তাদের আরও দুজন সঙ্গী সেখানে ছিল, রোহনকে ঘিরে। বিক্রমের হাতে ছুরিটা ঝলসে উঠলো।
“শেষ সুযোগ, রোহন! বল, সুড়ঙ্গপথটা কোথায়? না হলে…” বিক্রমের চোখে উন্মত্ত। তার হাসিটা ছিল এক ভয়ঙ্কর শিকারীর মতো।
ঠিক যখন বিক্রম ছুরি দিয়ে রোহনকে আঘাত করতে উদ্যত হলো, অনির্বাণ দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়লো। “পুলিশ!” সে চিৎকার করে উঠলো, রড দিয়ে বিক্রমের হাতে সজোরে আঘাত করলো। বিক্রমের হাত থেকে ছুরিটা ছিটকে পড়লো একটা ধাতব শব্দ করে।
হঠাৎ করে এই আক্রমণে রায় এবং তার লোকেরা হকচকিয়ে গেল। রায় হতভম্ব হয়ে পেছনে সরে গেল। অনির্বাণ দ্রুত রোহনের দিকে ছুটে গেল, তার বাঁধন খুলতে শুরু করলো। রায়ের দুই সঙ্গী, যারা দেখতে অনেকটা নিস্তেজ ছিল, তারা অনির্বাণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। অনির্বাণ নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলো, রড দিয়ে তাদের আঘাত করলো, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল সে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। তারা সংখ্যায় বেশি এবং প্রশিক্ষিত, তাদের চোখগুলো যেন প্রাণহীন পুতুলের মতো।
বিক্রম, আঘাত পেলেও দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে ক্রোধ আর উন্মাদনা। সে ছিটকে পড়া ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার অনির্বাণ আর রোহনের দিকে এগিয়ে আসছিল। “তোকে বাঁচতে দেব না! তুই আমাদের অমরত্বের পথ বন্ধ করতে চাইছিস!” সে হিসহিস করে উঠলো, যেন তার গলা দিয়ে কোনো প্রাচীন দানব কথা বলছে।
ঠিক তখনই, বাইরে থেকে তীব্র পুলিশের সাইরেনের শব্দ গুদামের নীরবতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। রায় এবং তার সহযোগীরা জমে গেল। আতঙ্ক ফুটে উঠলো রায়ের মুখে। বিক্রম একবার অনির্বাণ এবং রোহনের দিকে তাকিয়ে, তার চোখে প্রতিজ্ঞা নিয়ে, গুদামের পিছনের এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে দৌড় লাগালো। অনির্বাণ আগে খেয়াল করেনি, কিন্তু সেখানে একটি ভারী লোহার ফটক ছিল, যা মাটির গভীরে নেমে গেছে। বিক্রম সেই ফটক খুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, যেন কুয়াশার মতোই অদৃশ্য হয়ে গেল।
পুলিশ গুদামে ঝাঁপিয়ে পড়লো, দ্রুত রায় এবং তার বাকি লোকেদের গ্রেপ্তার করলো। কিন্তু সেই অদ্ভুত লোকটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পুলিশ অফিসারের চোখেও বিস্ময় দেখা গেল যখন তারা সেই খোলা সুড়ঙ্গপথটা দেখলো।
শর্মিলা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালো, তার মুখে স্বস্তি এবং ক্লান্তির এক অদ্ভুত মিশ্রণ ছিল যখন সে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো। রোহন দুর্বলভাবে অনির্বাণকে ধন্যবাদ জানালো। “মানচিত্রটা… আমার পকেটে… আর সুড়ঙ্গের মুখে একটা প্রাচীন প্রতীক…” রোহন ফিসফিস করলো।
অনির্বাণ রোহনের পকেট থেকে মানচিত্রটি বের করলো। এটি সেই পুরনো মানচিত্রের বাকি অংশ ছিল, যেখানে কারখানার নিচে একটি গোপন সুড়ঙ্গপথের ইঙ্গিত ছিল। “কুয়াশা” শব্দটি সেই সুড়ঙ্গের প্রবেশপথের দিকে নির্দেশ করছিল। এটি শুধু একটি পথ নয়, এটি সেই রহস্যময় ‘কুয়াশার উপাসক’দের শতাব্দী প্রাচীন এক গোপন আস্তানার পথ। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এই গল্পের শেষ এখানে নয়।
চতুর্থ অংশ: কুয়াশার অবসান
গুদামের বিভীষিকাময় রাতের পর কলকাতার আকাশে ভোরের আলো ফুটলো এক নতুন গল্পের জন্ম দিতে। দেবাশীষ রায় এবং তার সহযোগীরা পুলিশের হেফাজতে। কিন্তু অনির্বাণের মনে স্বস্তির চেয়েও বেশি ছিল এক চাপা উদ্বেগ – বিক্রম সেন পালিয়ে গেছে। সে শুধু একজন উন্মাদ প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিল না, সে ছিল এক প্রাচীন, গোপন সম্প্রদায়ের শেষ জীবিত সদস্য, যে অমরত্বের লোভে যেকোনো সীমা অতিক্রম করতে প্রস্তুত। তার পালিয়ে যাওয়া মানে এই রহস্যের পরিসমাপ্তি নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
পুলিশের তদন্ত শুরু হলো দ্রুত গতিতে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ধর, একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, এই কেসটি হাতে নিলেন। শশাঙ্ক ছিলেন বিচক্ষণ এবং কিছুটা বাস্তববাদী। তিনি প্রথম দিকে অনির্বাণের “কুয়াশার উপাসক” বা প্রাচীন গুপ্ত সমাজের কথা শুনে কিছুটা সন্দিহান ছিলেন। “অনির্বাণবাবু, আপনার কল্পনাশক্তি নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু আমরা বাস্তব প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করি,” শশাঙ্ক প্রথম দিকে বলেছিলেন। কিন্তু গুদামের নিচে আবিষ্কৃত সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ এবং তার ভেতরের প্রাচীন লিপি ও যন্ত্রাংশ তাদের চিন্তাভাবনা বদলে দিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে খবর দেওয়া হলো। তাদের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গেল, এই সুড়ঙ্গপথটি সত্যিই শত শত বছরের পুরনো, এবং এর ভেতরে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে যা ভারতীয় ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে।
রোহন সেনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তার শারীরিক আঘাত গুরুতর না হলেও, মানসিক ধকল ছিল অপরিসীম। শর্মিলা দেবী দিনের পর দিন তার শিয়রে বসে থাকতেন। ধীরে ধীরে রোহন সুস্থ হতে শুরু করলো, কিন্তু তার চোখে এক গভীর শূন্যতা দেখা গেল। মাঝে মাঝে সে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠতো, “কুয়াশা! তারা আসছে! বীজ… বীজ!” তার মস্তিষ্কের গভীরে বিক্রমের দেওয়া মানসিক নির্যাতন এক স্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল।
অনির্বাণ প্রতিদিন একবার হাসপাতালে রোহনকে দেখতে যেত। রোহন ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুরু করলো। “অনির্বাণ, ওই কুয়াশার উপাসকরা… ওরা শুধু গুপ্তধন খোঁজে না। ওরা বিশ্বাস করে কলকাতার মাটির নিচে একটা প্রাচীন শক্তি লুকিয়ে আছে, যা ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ নামে পরিচিত। ওরা মনে করে, সেই বীজ যদি সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা যায়, তাহলে নাকি অমরত্ব পাওয়া যায়। ওরা আমার কাছে সেই বীজের অবস্থান জানতে চেয়েছিল।” রোহন ফিসফিস করে বললো, “আমি স্থাপত্যের নকশা নিয়ে কাজ করতে গিয়েই ওই কারখানার নিচে গুপ্ত সুড়ঙ্গের সন্ধান পাই। আমি ভাবিনি যে এটা এত ভয়ঙ্কর কিছু হবে। আমি সেই প্রাচীন পুঁথিগুলো পেয়েছিলাম, যাতে ওই সম্প্রদায়ের গোপন তথ্য লেখা ছিল। বিক্রমের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না, সে ওই শক্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছিল।”
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এই বিক্রম সেন এক বিপজ্জনক উন্মাদ, যে শুধু অর্থ বা সম্পত্তির জন্য কাজ করে না। তার উদ্দেশ্য ছিল আরও গভীর, আরও অন্ধকারময়। সে ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে থাকা এক উন্মাদ ধারণা বাস্তবায়িত করতে চাইছে। এই সত্য অনির্বাণকে ভাবিয়ে তুললো। তার আগেকার কেসগুলো ছিল চুরি, পারিবারিক বিবাদ বা ছোটখাটো প্রতারণা। কিন্তু এখন সে জড়িয়ে পড়েছে এক প্রাচীন গুপ্ত সমাজের ষড়যন্ত্রে, যার শিকড় কলকাতার মাটির গভীরে প্রোথিত।
অনির্বাণ তার প্রত্নতত্ত্ববিদ বন্ধুকে নিয়ে রোহন কর্তৃক উদ্ধারকৃত প্রাচীন পুঁথিগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করলো। পুঁথিগুলো ছিল পুরনো চামড়ার উপর লেখা, অদ্ভুত ভাষায়, যার কিছু অংশ বোঝা যাচ্ছিল না। “এই ভাষাটা প্রাচীন শাক্ত ধর্ম আর তান্ত্রিকতার মিশ্রণ,” তার বন্ধু ব্যাখ্যা করলো। “এতে কিছু গোপন কোড আছে, যা কেবল তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরাই বুঝতে পারবে।” পুঁথিগুলোতে ‘কুয়াশার উপাসক’দের ইতিহাস, তাদের গুপ্ত আস্তানাগুলো এবং ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ সম্পর্কিত মিথ বর্ণনা করা ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান এবং হুগলি নদীর শক্তি এই বীজকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদেরকে ‘নির্বাচিত’ মনে করত এবং মনে করত যে তারা সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চতর। তারা একসময় নাকি বেশ শক্তিশালী ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের সময় তারা আত্মগোপন করে। বিক্রম ছিল সেই বংশের শেষ কান্ডারী, যে লুপ্তপ্রায় এই সম্প্রদায়কে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিল।
পুঁথিগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনির্বাণ এক ভয়ঙ্কর সত্য আবিষ্কার করলো। ‘কুয়াশার উপাসক’রা শুধু গুপ্তধন বা অমরত্বের পেছনে ছুটতো না। তাদের কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান ছিল, যেখানে মানুষের উপর বিশেষ ধরনের পরীক্ষা চালানো হতো। সেইসব পরীক্ষার ফলস্বরূপ তাদের অনুসারীরা মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিকৃত হয়ে যেত, অনেকটা রায় এর সঙ্গীদের মতো, যারা পুলিশের জেরায় অসংলগ্ন কথা বলছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘অমরত্ব’ এবং ‘ক্ষমতা’র জন্য সাধারণ মানুষের জীবনকে পণ করা। এই তথ্য অনির্বাণের মনে এক গভীর ভীতির সঞ্চার করলো।
অনির্বাণ নিজেকে এই গবেষণায় পুরোপুরি ডুবিয়ে দিল। দিনের পর দিন সে পুরনো লাইব্রেরিতে কাটাতো, কলকাতার পুরনো মানচিত্র ঘেঁটে দেখতো, বিভিন্ন পুরনো বাড়ির ইতিহাস ঘাঁটতো। সে বুঝতে পারছিল, এই ‘কুয়াশার উপাসক’দের নেটওয়ার্ক হয়তো কলকাতার একাধিক প্রাচীন স্থানের সাথে যুক্ত। মিসেস মিত্রের বাড়ি, কারখানার সুড়ঙ্গপথ – এগুলো কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এক বিশাল জালের অংশ। তার ঘুম কমে গেল, চোখের নিচে কালি পড়লো। তার ব্যক্তিগত জীবন যেন এই রহস্যের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেল। বন্ধুরা ফোন করলে সে এড়িয়ে যেত, পাওনাদারদের ফোন ধরতো না। তার মনে হতো, সে একা এই বিশাল লড়াইয়ে নেমেছে।
এদিকে, বিক্রম সেনের খোঁজ চলছিল। পুলিশ শহর জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছিল, কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিক্রম ছিল ধূর্ত এবং শহরের মাটির নিচে তার বহু দিনের পরিচিতি ছিল। পুলিশ কমিশনার শশাঙ্ক ধরকে ডেকে পাঠালেন। “শশাঙ্ক, পাবলিক প্রেসার বাড়ছে। বিক্রমকে ধরাটা জরুরি। এই ‘কুয়াশার উপাসক’ বলে কিছু যদি সত্যি থাকে, তাহলে সেটা শহরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।” শশাঙ্ক তার অফিসারদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করতেন, কিন্তু বিক্রম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
একদিন মাঝরাতে অনির্বাণের অফিসের দরজায় আবার টোকা পড়লো। অনির্বাণ ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো। বাইরে কেউ ছিল না। শুধু দরজার নিচে একটি ছোট কাগজের টুকরা পড়েছিল। তাতে সেই একই লকেটের প্রতীক খোদাই করা, আর নিচে লেখা ছিল: “তুমি কুয়াশার গভীরে প্রবেশ করেছো, অনির্বাণ। এবার আর ফিরে যেতে পারবে না। আমরা তোমাকে দেখছি।” অনির্বাণ বুঝতে পারলো, বিক্রম তাকে নজরে রেখেছে। হয়তো সে এই মুহূর্তেও তাকে দেখছে। তার মনে এক তীব্র ভয় আর ক্রোধের জন্ম হলো।
এই ঘটনার পর অনির্বাণ আরও সতর্ক হয়ে উঠলো। সে তার বাইক ছাড়া পারতপক্ষে বাইরে বের হতো না। তার মনে হতো, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি অচেনা মুখ তাকে অনুসরণ করছে। রাতের কলকাতা তার কাছে এখন আর বন্ধুসুলভ মনে হতো না। সে যেন এক অদৃশ্য শত্রুর হাতে বন্দি।
এর মধ্যেই একটি নতুন ঘটনা ঘটলো। শহরের এক নামকরা আর্ট গ্যালারির মালিক, যিনি প্রাচীন শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন, তিনি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তার গ্যালারিতে একটি প্রাচীন কঙ্কালের খুলি প্রদর্শিত হচ্ছিল, যা বহু বছর আগে কলকাতার মাটির নিচ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা ছিল এটা সাধারণ চুরি বা অপহরণ। কিন্তু অনির্বাণ যখন খবরটা শুনলো, তার মনে সেই লকেটের প্রতীকটা ঝলসে উঠলো। সেই খুলির পাশেও কি কোনো প্রতীক ছিল? সে তৎক্ষণাৎ ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ধরকে ফোন করলো।
“শশাঙ্ক স্যার, এই নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ‘কুয়াশার উপাসক’দের হাত থাকতে পারে। ওই খুলিটা… ওটা হয়তো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।” অনির্বাণ দ্রুত তার অনুমান ব্যাখ্যা করলো।
শশাঙ্ক প্রথমে দ্বিধা করলেন, কিন্তু অনির্বাণের আগের সাফল্যের কারণে তিনি তাকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। “তুমি এসো, অনির্বাণবাবু। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেবে না।”
অনির্বাণ গ্যালারিতে পৌঁছালো। সেখানে পুলিশের তদন্ত চলছিল। গ্যালারির ম্যানেজার ভীত হয়ে সব কিছু দেখাচ্ছিলেন। অনির্বাণ খুঁটিয়ে দেখলো। খুলিটি যেখানে রাখা ছিল, তার আশেপাশে কিছু প্রাচীন লিপি খোদাই করা ছিল। সেই লিপির কিছু অংশ অনির্বাণের চেনা মনে হলো। পুঁথিতে দেখা কিছু প্রতীকের সাথে তার মিল খুঁজে পেলো। আরও গুরুত্বপূর্ণ, মেঝের এক কোণে একটি ছোট, শুকনো রক্তমাখা মাকড়সার জাল দেখতে পেলো। সাধারণ চোখে এটা হয়তো অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু অনির্বাণের মনে পড়লো, পুঁথিতে ‘কুয়াশার উপাসকদের’ এক গোপন প্রতীক ছিল – মাকড়সার জালের মতো একটি আঁকিবুকি।
অনির্বাণ নিশ্চিত হলো। বিক্রম সেন আবার সক্রিয় হয়েছে। সে শুধু পালিয়ে যায়নি, বরং নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। এই খুলি, এই মাকড়সার জালের প্রতীক, এগুলো সবই ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ এবং অমরত্বের রহস্যের সাথে যুক্ত। এই কেস অনির্বাণকে সরাসরি বিক্রমের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুযোগ দেবে।
অনির্বাণ এখন শুধু একজন সাধারণ গোয়েন্দা নয়, সে যেন কলকাতার মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একাই লড়ছে। তার মনে হলো, প্রতিটি নতুন রহস্যের উন্মোচন যেন তাকে আরও গভীর কুয়াশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই কুয়াশা থেকে কি তার মুক্তি আছে? সে জানে না। কিন্তু সে পিছপা হবে না। কারণ এখন আর এটা শুধু রোহনকে খুঁজে বের করার কেস নয়। এটা কলকাতা শহরকে এক ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে বাঁচানোর লড়াই। এই লড়াইয়ে সে একা হলেও, তার ভেতরে এক অদম্য শক্তি অনুভব করছিল। তার ভাগ্য যেন কলকাতার এই রহস্যময় ভূগর্ভস্থ জালের সাথে মিশে গেছে।
গল্পের কুয়াশা আরও ঘন হতে শুরু করেছে।
পঞ্চম অংশ: রক্তে আঁকা মাকড়সার জাল
আর্ট গ্যালারির মেঝেতে আবিষ্কৃত মাকড়সার জালের মতো সেই প্রতীক অনির্বাণের মনে এক ঠান্ডা ঢেউ খেলিয়ে দিল। এটি কেবল একটি প্রতীক ছিল না, এটি ছিল ‘কুয়াশার উপাসক’দের স্বাক্ষর, বিক্রম সেনের উপস্থিতি জানানোর এক ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত। ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ধরকে অনির্বাণ প্রতীকটি দেখালো। “স্যার, এই মাকড়সার জালের মতো চিহ্নটা ওদের গোপন প্রতীক। পুরনো পুঁথিতে এর উল্লেখ আছে। ওদের বিশ্বাস, মাকড়সার জাল যেমন সবকিছুকে নিজের জালে আটকে ফেলে, তেমনি তাদের জ্ঞান আর ক্ষমতাও সবকিছুকে গ্রাস করবে।”
শশাঙ্ক ভুরু কুঁচকালেন। তার অভিজ্ঞ পুলিশি মন এমন অলৌকিক বা গুপ্ত সমাজের ধারণাকে সহজে মেনে নিতে পারছিল না। “অনির্বাণবাবু, আপনি হয়তো সিনেমা বেশি দেখছেন। কিন্তু আমরা অপরাধীদের ধরতে চাই, কোনো মিথিক্যাল সোসাইটিকে নয়।” তার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।
“স্যার, এই লোকগুলো সাধারণ অপরাধী নয়। তারা রোহন সেনকে অপহরণ করেছিল, এখন এই আর্ট গ্যালারির মালিককে। তাদের উদ্দেশ্য অর্থ নয়, ক্ষমতা বা প্রাচীন জ্ঞান। এই খুলিটা তাদের কাছে কোনো সাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু নয়,” অনির্বাণ দৃঢ় কণ্ঠে বললো। “পুঁথিতে লেখা আছে, ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ নাকি কোনো প্রাচীন আত্মার সাথে সংযুক্ত। এই খুলি হয়তো সেই রহস্যের অংশ।”
শশাঙ্ক কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অনির্বাণের কথায় যুক্তি ছিল, কারণ প্রচলিত কোনো মোটিভই এই অপহরণগুলোর পেছনে পাওয়া যাচ্ছিল না। “ঠিক আছে, অনির্বাণবাবু। এই খুলিটা সম্পর্কে আপনি আরও খোঁজখবর করুন। আমরা গ্যালারির মালিকের সন্ধানে তল্লাশি চালাচ্ছি।” শশাঙ্ক তার অধীনস্থ অফিসারদের গ্যালারির সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন।
অনির্বাণ দ্রুত গ্যালারি থেকে বেরিয়ে তার বাইকে উঠলো। তার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে সেই প্রাচীন পুঁথির কথা। পুঁথিতে ‘মাকড়সার জাল’ প্রতীকটির সঙ্গে একটি প্রাচীন মন্দিরের উল্লেখ ছিল, যা কলকাতার এক পুরনো অংশে অবস্থিত। মন্দিরটি ছিল দেবী কালীর এক ভয়ঙ্কর রূপের উপাসনার স্থান, যা নাকি একসময় ‘কুয়াশার উপাসক’দের গোপন আস্তানা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এই মন্দির নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল, বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে মন্দিরের আশেপাশে নাকি অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে।
অনির্বাণ সরাসরি তার প্রত্নতত্ত্ববিদ বন্ধুর কাছে গেল। বন্ধুটি পুঁথির সেই অংশটি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। “অনির্বাণ, এই মন্দিরটা কলকাতার এক বিস্মৃত ইতিহাস ধারণ করে। এটা নাকি ব্রিটিশ শাসনের আগে ‘অকালিক’ নামে এক তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ছিল। তাদের আচার-অনুষ্ঠান ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দিরের নিচে এক বিশাল সুড়ঙ্গপথ আছে, যা হয়তো ওই কুয়াশার উপাসকদের মূল নেটওয়ার্কের অংশ।”
অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিল, সে সেই মন্দির পরিদর্শনে যাবে। কিন্তু একা নয়। সে জানতো বিক্রম সেন তাকে অনুসরণ করছে। সে তার পরিচিত, রাজুকে ফোন করলো। রাজু ছিল রাস্তার খবর সংগ্রহে ওস্তাদ। “রাজু, তুই কাল রাত থেকে আমার আশেপাশে নজর রাখবি। কোনো সন্দেহজনক লোক দেখলেই আমাকে জানাবি। আর আমার অফিসের আশেপাশেও নজর রাখিস।”
পরের দিন সকাল। আকাশ মেঘলা, যেন শহরের উপর এক বিশাল ছায়ার আবরণ। অনির্বাণ বাইকে করে সেই মন্দিরের দিকে রওনা হলো। মন্দিরটি ছিল শহরের এক কোণে, পুরোনো বাড়ি আর ঘিঞ্জি গলির মধ্যে প্রায় লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন স্থাপত্য। মন্দিরের কাছে পৌঁছাতেই অনির্বাণ এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করলো। মন্দিরের পাথরের গায়ে শেওলা আর পুরনো বটগাছের শিকড় জড়িয়ে আছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বার ছিল লোহার গ্রিল দিয়ে ঢাকা, তার পাশে একটি জং ধরা ফলকে লেখা ‘নিষেধাজ্ঞা’। স্থানীয়রা মন্দিরটি পরিহার করে চলতো। অনির্বাণ দেখলো, মন্দিরের প্রবেশপথে নতুন করে একটা তালা লাগানো আছে, যেন কেউ সম্প্রতি সেখানে প্রবেশ করেছে।
অনির্বাণ মন্দিরের চারপাশে ঘুরে দেখলো। একটি ভাঙা জানালার পাশে সে কিছু শুকনো পাতা দেখতে পেলো, যা সাধারণ গাছের পাতা নয়, বরং কিছু দুর্লভ ভেষজ পাতার মতো। অনির্বাণের মনে পড়লো, পুঁথিতে কিছু বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের কথা লেখা ছিল, যা ‘কুয়াশার উপাসক’রা তাদের আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। অনির্বাণ সাবধানে কিছু পাতা সংগ্রহ করলো।
মন্দিরের পিছনের দিকে, একটি প্রাচীরের গায়ে অনির্বাণ একটি অস্পষ্ট প্রতীক দেখতে পেলো – সেই লকেটের প্রতীক। প্রতীকটির পাশে কিছু নতুন আঁচড়ের চিহ্ন ছিল, যেন কেউ সম্প্রতি এখানে প্রবেশ করেছে। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এটাই সেই পথ। কিন্তু কিভাবে প্রবেশ করবে?
ঠিক তখনই তার ফোনে একটা মেসেজ এলো। রাজু পাঠিয়েছে: “অনির্বাণদা, একটা কালো এসইউভি আপনাকে ফলো করছে। ওটার নম্বরপ্লেটে ‘৭৭৭ কুয়াশা’ লেখা।” অনির্বাণ চমকে উঠলো। বিক্রম এত কাছে! সে দ্রুত নিজেকে আড়াল করার জন্য মন্দিরের ভাঙা অংশের দিকে সরে গেল।
কালো এসইউভিটা মন্দিরের সামনে এসে থামলো। বিক্রম সেন গাড়ি থেকে নামলো। তার চোখে সেই উন্মাদনা, আর তার পাশে আরও দুজন সঙ্গী। বিক্রমের হাতে একটা পুরোনো চামড়ার ব্যাগ। সে সরাসরি মন্দিরের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অনির্বাণ লুকিয়ে দেখলো, বিক্রম একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে তালাটা খুলে ফেললো। বিক্রমের সঙ্গী দুজন সাবধানে চারপাশ দেখছিল। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, তারা মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করবে। তার হাতে সময় খুব কম।
বিক্রম এবং তার সঙ্গীরা মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করতেই অনির্বাণ দ্রুত সেই ভাঙা জানালার কাছে গেল। সে জানালার ফাঁক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে অন্ধকার, দুর্গন্ধ আর এক চাপা বাতাসের স্রোত। আলো জ্বালতেই সে দেখলো, মন্দিরের মাঝখানে একটি বিশাল কালী মূর্তি, তার চোখ দুটি যেন অন্ধকারের গভীরে তাকিয়ে আছে। মূর্তির নিচে একটি বেদী, আর তার আশেপাশে প্রাচীন পুঁথির ছড়ানো ছিঁটানো পাতা। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এখানে কোনো আচার-অনুষ্ঠান চলছিল।
অনির্বাণ সাবধানে অগ্রসর হলো। বিক্রম এবং তার সঙ্গীরা মন্দিরের পিছনের দিকে একটি গুপ্ত কক্ষের প্রবেশপথ খোলার চেষ্টা করছিল। তাদের কথোপকথন অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছিল। “ওই খুলিটা এখানে রাখলেই সব মন্ত্র কাজ করবে। অমরত্বের পথ খুলে যাবে,” বিক্রম উত্তেজিত কণ্ঠে বললো।
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, গ্যালারির মালিককে তারা সেই খুলিটার জন্যই অপহরণ করেছে। সেই খুলি হয়তো ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ বা তার ক্ষমতা আনলক করার চাবিকাঠি। তার হাতে থাকা রডটা শক্ত করে ধরলো। তাকে এখনই কিছু করতে হবে।
ষষ্ঠ অংশ: কুয়াশার অন্দরে
অনির্বাণ মন্দিরের অন্ধকার অংশে লুকিয়ে রইলো। বিক্রম এবং তার সঙ্গীরা একটি পুরোনো পাথরের দেয়ালের কাছে গিয়ে কিছু প্রাচীন মন্ত্র পাঠ করছিল। বিক্রম তার হাতে থাকা চামড়ার ব্যাগ থেকে সেই অপহৃত আর্ট গ্যালারির মালিকের কঙ্কালের খুলিটি বের করলো। খুলিটি দেখে অনির্বাণের মনে এক বিতৃষ্ণার জন্ম হলো। খুলির উপরও সেই ‘মাকড়সার জাল’ প্রতীকটি খোদাই করা ছিল, যা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছিল।
“গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, ভায়েরা! এই খুলিই সেই প্রাচীন আত্মাকে জাগিয়ে তুলবে, যা ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’-এর পথ দেখাবে,” বিক্রম উন্মত্তের মতো হাসলো। তার চোখে তখন এক ঘোর।
তারা খুলিটি একটি পাথরের বেদীর উপর রাখলো। বেদীর নিচে চাপা এক অদ্ভুত শব্দ হলো। পাথরের দেয়ালের একটি অংশ ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলো, উন্মোচিত হলো এক অন্ধকার, গভীর সুড়ঙ্গপথ। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে এক ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে বাতাস বেরিয়ে এলো, যার সাথে মিশে ছিল পুরনো মাটি আর পচনের গন্ধ – সেই ‘কুয়াশার গন্ধ’।
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এটাই সেই ‘কুয়াশার উপাসক’দের মূল সুড়ঙ্গপথ, যার কথা পুঁথিতে লেখা ছিল। রোহন সেন সম্ভবত এই পথেরই কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিলেন।
বিক্রম তার সঙ্গীদের নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়ালো। “আজ আমরা ইতিহাসের অংশ হবো! অমরত্ব আমাদের হাতে!” বিক্রমের কণ্ঠে তখন এক উন্মাদ বিজয়োল্লাস।
অনির্বাণ জানতো, এখনই তাকে আটকাতে হবে। সে তার বাইকের চাবি বের করলো, তার মাথায় তখন একটিই চিন্তা – পুলিশকে খবর দিতে হবে। কিন্তু তার ফোনটা পকেট থেকে বের করতে গিয়েই তার হাত থেকে ফসকে গেল, ধাতব শব্দ করে অন্ধকারে পড়ে গেল। বিক্রমের এক সঙ্গী শব্দটা শুনে সতর্ক হলো। “কে ওখানে?” সে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো।
অনির্বাণ লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করলো, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বিক্রমের সঙ্গী দুজন বিদ্যুতের গতিতে তার দিকে ছুটে এলো। তাদের চোখে সেই নিস্তেজ, প্রাণহীন দৃষ্টি। অনির্বাণ রড দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তাদের আক্রমণের গতি ছিল অবিশ্বাস্য। তাদের শরীরে যেন মানুষের চেয়েও বেশি শক্তি ছিল। একজন অনির্বাণের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তাকে দেয়ালে ধাক্কা দিল। অনির্বাণের মাথায় চোট লাগলো, চোখে অন্ধকার দেখলো। সে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে রড দিয়ে তার আক্রমণকারীকে আঘাত করলো। লোকটা আর্তনাদ করে উঠলো, কিন্তু পুরোপুরি কাবু হলো না।
ঠিক তখনই, বিক্রম সেন সুড়ঙ্গের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তার হাতে একটা পুরোনো, নকশা করা পিস্তল। “অনির্বাণ সেন! তুমি খুব বেশি জেনে ফেলেছো! তোমার অনুসন্ধানের পথ এখানেই শেষ হবে!”
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, তার জীবন এখন চরম বিপদে। পিস্তলের নল তার দিকে তাক করা। তার মনে পড়লো শর্মিলা দেবীর মুখ, রোহনের অসহায় চাহনি। সে হার মানতে রাজি নয়।
“বিক্রম, তুমি ভুল করছো! এই জ্ঞান ধ্বংসাত্মক। এটা শুধু মৃত্যু আর উন্মাদনা ডেকে আনবে!” অনির্বাণ চিৎকার করে বললো।
“নির্বোধ! অমরত্ব আর ক্ষমতার পথে মৃত্যু কেবল একটি ধাপ!” বিক্রম হাসলো, তার হাসিটা মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। সে ট্রিগারে আঙুল রাখলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে, বাইরে থেকে সাইরেনের তীব্র শব্দ ভেসে এলো। ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ধর তার দলবল নিয়ে মন্দিরের প্রবেশপথে হাজির। শশাঙ্ক সিসিটিভি ফুটেজে বিক্রমের এসইউভি দেখে এই মন্দিরের দিকে এগিয়ে এসেছিলেন। অনির্বাণের ফোন আসার পর তার সন্দেহ আরও গভীর হয়েছিল।
পুলিশকে দেখেই বিক্রমের চোখে আতঙ্ক দেখা গেল। সে তার সঙ্গীদের দিকে চিৎকার করে উঠলো, “সুড়ঙ্গের দিকে! দ্রুত!” বিক্রম নিজেও সুড়ঙ্গের দিকে দৌড় লাগালো।
পুলিশ মন্দিরে প্রবেশ করলো, তাদের টর্চের আলো অন্ধকারে ঝলসিয়ে উঠলো। “পুলিশ! হাত উপরে তোলো!” শশাঙ্ক চিৎকার করলেন।
বিক্রমের সঙ্গী দুজন পালানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পুলিশ তাদের ঘিরে ফেললো। শশাঙ্ক অনির্বাণকে দেখলো, সে আহত অবস্থায় দেয়ালের ধারে বসে ছিল। “অনির্বাণবাবু, আপনি ঠিক আছেন তো?”
“স্যার, বিক্রম… সে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেছে!” অনির্বাণ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
শশাঙ্ক দ্বিধা করলেন না। তিনি তার কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখে প্রবেশ করলেন। অনির্বাণও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। তার মাথা ঘুরছিল, কিন্তু সে জানতো, বিক্রমকে ধরাটা জরুরি।
সুড়ঙ্গের ভেতরটা ছিল অন্ধকার আর গোলকধাঁধাময়। বাতাসে এক তীব্র, ধাতব গন্ধ ভাসছিল। আলো জ্বালতেই দেখা গেল, সুড়ঙ্গের দেওয়ালগুলোতে প্রাচীন প্রতীক আর লিপি খোদাই করা। কোথাও কোথাও জলের ধারা বইছে। তারা সাবধানে এগোচ্ছিল, পায়ের নিচে স্যাঁতসেঁতে মাটি।
“বিক্রম! তুই কোথায়?” শশাঙ্ক চিৎকার করলেন।
তাদের সামনে বিক্রমের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এলো। “তোমরা আমাকে থামাতে পারবে না! ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ আমার হবে! অমরত্ব আমার!”
হঠাৎ করে সুড়ঙ্গের এক পাশ থেকে বিক্রমের ছায়া বেরিয়ে এলো। তার হাতে সেই পিস্তল, যা দিয়ে সে পুলিশের দিকে গুলি চালালো। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালো। গুলির শব্দে সুড়ঙ্গের ভেতরে এক তীব্র প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হলো।
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এটা শুধু বন্দুকযুদ্ধ নয়। বিক্রম মরিয়া। সে কোনোভাবেই ধরা দিতে রাজি নয়।
সুড়ঙ্গের শেষে গিয়ে তারা একটি বিশাল চেম্বারে পৌঁছালো। চেম্বারের মাঝখানে একটি প্রাচীন পাথরের বেদী, তার উপর অদ্ভুত নকশা করা। বেদীর পাশে একটা ভাঙা লোহার বাক্স। বিক্রম বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে পাগলের মতো দ্যুতি। “তোমরা দেরি করে ফেলেছো! বীজ আমার হাতে!” সে চিৎকার করে উঠলো, তার হাতে একটি ছোট, চকচকে বস্তুকে ধরে তুলে ধরলো।
অনির্বাণ বুঝতে পারলো, ওটাই ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’।
সপ্তম অংশ: বীজ ও কুয়াশার শেষ
চেম্বারটি ছিল বিশাল, তার ছাদ যেন পাথরের দেয়ালের মধ্য দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে। বাতাসে সেই অদ্ভুত, পচনশীল গন্ধ আরও প্রকট। বিক্রম সেন, হাতে ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ নিয়ে পাথরের বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে উন্মত্তের মতো হাসছিল। তার চোখে তখন এক ভয়ঙ্কর উন্মাদনা।
“তোমরা আমাকে থামাতে পারবে না! এই বীজ আমাকে অমরত্ব দেবে! ‘কুয়াশার উপাসক’দের ক্ষমতা আবার ফিরে আসবে!” বিক্রম চিৎকার করে বললো, তার কণ্ঠস্বর চেম্বারে প্রতিধ্বনিত হলো। তার পাশে পড়েছিল সেই কঙ্কালের খুলি, যার দিকে সে মাঝে মাঝে উন্মত্তের মতো তাকাচ্ছিল।
ইন্সপেক্টর শশাঙ্ক ধর এবং তার দলবল বিক্রমকে ঘিরে ফেললেন। “বিক্রম সেন! তুমি ঘেরাও হয়ে গেছো! অস্ত্র ফেলে দাও!” শশাঙ্ক দৃঢ় কণ্ঠে আদেশ করলেন।
বিক্রমের চোখে তখন আগুন জ্বলছে। সে পিস্তলটা তুলে পুলিশের দিকে তাক করলো। “আমি মরবো না! আমি অমর হবো!” সে গুলি চালালো। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালো। চেম্বারের ভেতরটা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো, পাথরের খণ্ড ছিটকে পড়লো।
অনির্বাণ, মাথায় চোট নিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার মনে হলো, এই বীজের পেছনে এক ভয়ঙ্কর শক্তি লুকিয়ে আছে, যা বিক্রমকে আরও বেশি উন্মাদ করে তুলছে। পুঁথিতে লেখা ছিল, ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ ব্যবহার করার জন্য সঠিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশুদ্ধ আত্মার প্রয়োজন। বিক্রমের উন্মাদনা আর লোভ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। সে অমরত্ব পাওয়ার বদলে নিজের জীবন শক্তি হারাচ্ছিল।
গুলির লড়াইয়ের মধ্যে বিক্রম পাথরের বেদীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে বীজটি বেদীর মাঝখানে স্থাপন করলো, এবং তার হাতে থাকা ছোট ছুরি দিয়ে নিজের হাত কেটে রক্ত বের করে বীজের উপর ঢালতে লাগলো। তার চোখে এক অমানুষিক কষ্ট, কিন্তু তার মুখে এক উন্মত্ত হাসি।
“বলো না বিক্রম!” শশাঙ্ক চিৎকার করলেন। “এভাবে কাজ হবে না!”
কিন্তু বিক্রম কারো কথা শুনছিল না। তার রক্ত বীজের উপর পড়তে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে চেম্বারের মধ্যে এক অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠলো। বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠলো, এক শীতল, ভেজা কুয়াশা চেম্বারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। এটি ছিল সেই ‘কুয়াশার গন্ধ’ যা গণেশ বর্ণনা করেছিল। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, বিক্রম ‘কুয়াশার উপাসক’দের আচার-অনুষ্ঠান শুরু করেছে।
কিন্তু আলো আর কুয়াশার সাথে সাথে বিক্রমের শরীরের উপর এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যেতে লাগলো। তার চোখ আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, কিন্তু তার চামড়া শুকিয়ে যাচ্ছিল, চুল সাদা হয়ে যাচ্ছিল। সে যেন মুহূর্তের মধ্যে আরও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার শরীর কাঁপতে লাগলো, তার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে এক যন্ত্রণাময় চিৎকারে পরিণত হলো।
“আ-আমি…আমি অমর… না… এটা… এটা হচ্ছে না!” বিক্রম যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো।
অনির্বাণ মনে মনে ভাবলো, পুঁথিতে লেখা ছিল, ‘অবিশুদ্ধ আত্মা’ এই বীজ ব্যবহার করলে তার জীবন শক্তি শুষে নেবে। বিক্রমের উন্মাদনা আর লোভ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। সে অমরত্ব পাওয়ার বদলে নিজের জীবন শক্তি হারাচ্ছিল।
বিক্রমের শরীর থরথর করে কাঁপলো। চেম্বারের ভেতরে কুয়াশা আরও ঘন হলো। অবশেষে, এক বিকট চিৎকারের পর, বিক্রম সেন পাথরের বেদীর উপর লুটিয়ে পড়লো। তার শরীর তখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, যেন বহু বছর ধরে জীবিত ছিল না। তার হাতে ধরা সেই ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ থেকে আলো নিভে গেল।
সব কিছু শান্ত হয়ে গেল। কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। চেম্বারের নীরবতা আবারও ফিরে এলো, কিন্তু এবার এক গভীর শূন্যতা নিয়ে।
শশাঙ্ক এবং তার দল সাবধানে বিক্রমের মৃতদেহের কাছে গেলেন। তিনি মৃতদেহটি পরীক্ষা করে বললেন, “অদ্ভূত। যেন সব জীবনী শক্তি নিংড়ে নিয়েছে।”
অনির্বাণ সেই বীজটি তুলে নিল। এটি এখন নিষ্প্রভ, সাধারণ পাথরের মতো। ‘জীবন বৃক্ষের বীজ’ আর তার ক্ষমতা, সবই বিক্রমের উন্মাদনার সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে।
অষ্টম অংশ: কুয়াশার পরের দিন
বিক্রম সেনের মৃত্যু এবং ‘কুয়াশার উপাসক’ সম্প্রদায়ের এই ভয়ঙ্কর আচার-অনুষ্ঠানের খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘটনাকে ‘কলকাতার গুপ্ত রহস্যের উন্মোচন’ হিসেবে আখ্যা দিল। অনির্বাণ সেনের নাম শহর জুড়ে পরিচিত হয়ে উঠলো, তার “অনুসন্ধান” সংস্থা এখন একটি প্রতিষ্ঠিত নাম।
দেবাশীষ রায় এবং তার সহযোগীরা পুলিশের হেফাজতে ছিল। রায় তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল, তবে সে দাবি করেছিল বিক্রমের উন্মাদনার গভীরতা সে জানত না। সে শুধু অর্থ এবং সম্পত্তি নিয়ে আগ্রহী ছিল। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিল। আর্ট গ্যালারির মালিককে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হলো। রোহন সেনের মানসিক আঘাত ধীরে ধীরে সেরে উঠছিল। শর্মিলা দেবী এবং রোহন দুজনেই অনির্বাণের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত ছিল।
“অনির্বাণবাবু, আপনি আমাদের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন,” শর্মিলা দেবীর চোখে জল। “আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তা আমরা কোনোদিন ভুলবো না।”
রোহন অনির্বাণকে তার দেওয়া প্রাচীন পুঁথির বাকি অনুবাদ এবং সেই সুড়ঙ্গের একটি বিস্তারিত মানচিত্র দিল। “এই সুড়ঙ্গের জাল কলকাতার নিচে অনেক গভীরে বিস্তৃত। এখানে আরও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, অনির্বাণ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, তুমিই এই শহরকে রক্ষা করতে পারবে।”
অনির্বাণ পুঁথি এবং মানচিত্রগুলো হাতে নিল। তার মনে হলো, এটি শুধু একটি মামলার সমাপ্তি নয়, বরং তার জীবনের এক নতুন যাত্রার শুরু। সে এখন শুধু একজন গোয়েন্দা নয়, সে যেন কলকাতার মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার রহস্যের বিরুদ্ধে এক নতুন রক্ষাকর্তা। তার আগেকার আর্থিক সমস্যাগুলো এখন অতীত। নতুন কেসগুলো আসতে শুরু করেছে, প্রতিটিই আগের চেয়ে বেশি জটিল, বেশি রহস্যময়।
তবে অনির্বাণের মনে এক গভীর উপলব্ধি জন্মালো। এই শহরের কুয়াশা কেবল আবহাওয়ার উপাদান নয়, এটি এক অদৃশ্য পর্দার মতো, যা কলকাতার প্রাচীনতম রহস্যগুলোকে আড়াল করে রাখে। সে জানে, বিক্রমের মতো আরও অনেক উন্মাদ হয়তো এই কুয়াশার গভীরে লুকিয়ে আছে, যারা প্রাচীন জ্ঞান বা ক্ষমতার লোভে মানুষের জীবনকে পণ করতে প্রস্তুত।
অনির্বাণের অফিসের জানালার বাইরে তখন কলকাতার ব্যস্ত জীবন। ট্রামের শব্দ, মানুষের কোলাহল। কিন্তু অনির্বাণ জানে, এই আপাত স্বাভাবিকতার নিচেই লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার। সে চেয়ারে বসে পুঁথিটি খুললো। তাতে লেখা ছিল, “যখন কুয়াশা ঘন হবে, তখনই সত্য প্রকাশিত হবে। কিন্তু সেই সত্য দেখার জন্য চোখ এবং হৃদয়, উভয়ই প্রস্তুত থাকা চাই।”
অনির্বাণ জানতো, তার “অনুসন্ধান” সবেমাত্র শুরু হয়েছে। কলকাতার কুয়াশা ঘন হবে, আর সে সেই কুয়াশার গভীরে প্রবেশ করবে, প্রতিটি রহস্যের উন্মোচন ঘটাতে। তার জীবন এখন আর সহজ নয়, কিন্তু তার অদম্য স্পৃহা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে আর একা নয়। সে এখন কলকাতার কুয়াশার প্রহরী।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion