Episode 12300 words1 views

জাদুর তুলি

কল্পনা থেকে বাস্তবতা এক ছিল ছোট্ট মেয়ে, নাম তার রিয়া। বয়স মোটে সাত। রিয়া ছিল খুব কল্পনাপ্রবণ। তার দিন কাটতো ছবি এঁকে আর গল্পের বই পড়ে। তার ছোট্ট ঘরটি ছিল তার নিজের এক জগৎ, যেখানে দেয়াল জুড়ে ছিল তার আঁকা রঙিন ছবি আর শেলফে সাজানো ছিল রূপকথার বই। প্রতিটি বইয়ের পাতা যেন তাকে নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি দিত, আর সে কল্পনার ডানায় ভর করে উড়ে যেত দূর দূরান্তে, যেখানে রাজকুমারীরা ড্রাগনের সাথে যুদ্ধ করত আর পরীরাজ্যে ফুলেরা কথা বলত। তার ঘরে একটা পুরনো কাঠের বাক্স ছিল, যেটা তার ঠাকুমা তাকে আদর করে দিয়েছিলেন। বাক্সটা ছিল খোদাই করা নকশার, তার উপর লতাপাতা আর পাখির ছবি আঁকা ছিল, আর তার কাঠের রং সময়ের সাথে ফিকে হয়ে গিয়েছিল, যেন হাজারো গল্প বুকে নিয়ে সে চুপ করে বসে আছে, প্রতিটি দাগে লুকিয়ে আছে এক একটি স্মৃতি। বাক্সটা খুললেই একটা পুরনো কাগজের আর কাঠের মিষ্টি গন্ধ বের হতো, যা রিয়াকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত, যেন সে তার ঠাকুমার উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভব করত, আর তার কানে ঠাকুমার বলা রূপকথার ফিসফিসানি ভেসে আসত, যা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত রাতের বেলায়। ভেতরে ছিল তার শৈশবের স্মৃতি, ভর্তি ছিল পুরনো খেলনা, রং পেন্সিল আর কিছু ছেঁড়া গল্পের বইয়ে, যার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছিল আর মলাটগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল বারবার পড়ার কারণে, কিন্তু প্রতিটি পাতায় ছিল নতুন করে আবিষ্কার করার আনন্দ। একদিন দুপুরে, বাইরে যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল, জানালার কাঁচ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছিল যেন প্রকৃতি নিজেই কোনো মন খারাপের গল্প বলছে, আর গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলছিল এক অদ্ভুত ছন্দে। রিয়া তার নতুন আঁকার খাতা আর এক বাক্স নতুন রং পেন্সিল নিয়ে জানালার পাশে আরাম করে বসেছে, বৃষ্টির শব্দে তার মনটা শান্ত হয়ে আসছিল, আর সে তার কল্পনার জগতে ডুব দিচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো বাক্সের তলায় কিছু একটা চকচক করছে, যেন কোনো লুকানো রত্ন অপেক্ষা করছে তার আবিষ্কারের জন্য। কৌতূহলবশত সে বাক্সটা সাবধানে উল্টে দিল, যেন কোনো গুপ্তধন খুঁজছে, আর তার ছোট্ট হৃদয়টা অজানা উত্তেজনায় ধুকপুক করছিল। পুরনো খেলনা, যেমন ভাঙা পুতুল যার একটি চোখ নেই আর চুলগুলো জট পাকানো, চাকা ওঠা খেলনা গাড়ি যা আর চলে না, আর কিছু বিবর্ণ মার্বেলের ভিড়ে সে খুঁজে পেল একটা অদ্ভুত তুলি। তুলিটা দেখতে সাধারণ তুলির মতো ছিল না। তার হাতলটা ছিল হাতির দাঁতের মতো মসৃণ এবং হালকা সোনালী রঙের, আর তার ব্রাশের লোমগুলো ছিল উজ্জ্বল সোনালী রঙের, যেন সূর্যের আলো ধরে রেখেছে, বা কোনো জাদুর ধুলো লেগে আছে তাতে। রিয়া এমন তুলি আগে কখনো দেখেনি। তার হাতের ছোঁয়ায় তুলিটা কেমন যেন উষ্ণ মনে হলো, যেন তার ভেতরে কোনো লুকানো শক্তি আছে, যা তার ছোট্ট আঙুল দিয়ে তার শরীরে প্রবেশ করছে, আর তার শিরায় শিরায় এক অদ্ভুত শিহরণ জাগিয়ে তুলছে, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। সে তুলিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, তার মনে এক অজানা আনন্দ আর বিস্ময় খেলা করছিল। সে তুলিটা হাতে নিয়ে তার নতুন সাদা খাতায় একটা লাল গোলাপ আঁকল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে গোলাপের প্রতিটি পাপড়ি আঁকল, তার কুঁড়ি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া প্রতিটি স্তবক, সবুজ ডাঁটা আর ধারালো কাঁটাগুলোও বাদ দিল না, যেন সে প্রকৃতির প্রতিটি খুঁটিনাটি তার তুলির ডগায় নিয়ে এসেছে, আর তার কল্পনার রঙে সেটিকে জীবন্ত করে তুলছে। আঁকা শেষ হতেই সে অবাক হয়ে দেখল, তার আঁকা গোলাপটা খাতার পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে উঠল! গোলাপের পাপড়িগুলো ধীরে ধীরে খুলতে লাগল, তার কুঁড়িগুলো যেন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল, আর একটা মিষ্টি, তাজা সুবাস ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে, যেন সত্যি সত্যি কোনো বাগান থেকে সদ্য গোলাপ তুলে আনা হয়েছে, আর ঘরের বাতাস সেই সুবাসে ভরে উঠল, মনটা যেন জুড়িয়ে গেল। রিয়া আনন্দে লাফিয়ে উঠল, তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে, আর তার মুখে এক ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না তার চোখে যা দেখছে, তার ছোট্ট মনটা তখন এক অবিস্মরণীয় জাদুতে ভরে গিয়েছিল। সে গোলাপটা ছুঁয়ে দেখল, তার নরম, মখমলের মতো পাপড়িগুলো তার আঙুলে লেগে আছে, আর সে অনুভব করল এক অদ্ভুত শক্তি তার হাতের মুঠোয়, যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ। সে দ্রুত গোলাপটা তার মায়ের হাতে দিল, মাও অবাক হয়ে গেলেন, “এতো সুন্দর গোলাপ! কোথা থেকে পেলে রিয়া? মনে হচ্ছে এখনই বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে, আর এর সুবাসে মন ভরে যাচ্ছে!” রিয়া হাসল, কিন্তু জাদুর কথা বলল না। তার ছোট্ট মনটা তখন এক নতুন আবিষ্কারের আনন্দে উদ্বেলিত, সে ভাবল, “আমি তো যা খুশি তাই আঁকতে পারি! এখন আমার কোনো কিছুর অভাব হবে না, আর আমি যা চাইব, তাই পাবো!” প্রথম দিকে রিয়া তার জাদুর তুলি দিয়ে শুধু ভালো ভালো জিনিস আঁকল, যা তার এবং তার চারপাশের সবার মুখে হাসি ফোটাতো। সে তার মায়ের জন্য একগুচ্ছ সুন্দর রজনীগন্ধা ফুল আঁকল, যা মুহূর্তেই জীবন্ত হয়ে মায়ের হাতে চলে গেল। মা ফুলের সুবাস নিতে নিতে অবাক হয়ে বললেন, “এগুলো তো একদম তাজা! কোথা থেকে পেলে রিয়া? মনে হচ্ছে এখনই বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে!” রিয়া হাসল, তার চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। তার বাবার জন্য আঁকল একটা নতুন গল্পের বই, যেটা তার বাবা অনেকদিন ধরে কিনতে চাইছিলেন – একটা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনী, যার মলাটে একটা রহস্যময় চিত্র ছিল। বইটা হাতে পেয়ে বাবা আনন্দে চমকে উঠলেন, তার চোখে মুখে বিস্ময়, “আরে! এই বইটা তো আমি অনেক খুঁজেছি! তুমি কোথায় পেলে? এ তো আমার পছন্দের লেখকের বই!” তার ছোট ভাইয়ের জন্য আঁকল একটা ঝলমলে লাল খেলনা ট্রেন, যেটা সত্যি সত্যি ‘ছুক ছুক’ শব্দ করে চলতে শুরু করল, আর তার ভাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ট্রেনের পিছনে ছুটতে লাগল, তার ছোট্ট মুখটা খুশিতে ভরে গেল। তার বন্ধুদের জন্য আঁকল রঙিন প্রজাপতি, যা তাদের চারপাশে উড়ে বেড়াতে লাগল, তাদের হাসিতে ঘর ভরে উঠল, যেন তারা এক জাদুর বাগানে এসেছে। রিয়া তার স্কুলের শিক্ষকের জন্য আঁকল এক ঝুড়ি তাজা ফল, যা ক্লাসের সবাই ভাগ করে খেল। ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক ছেলেটির জন্য আঁকল একটি উড়ন্ত ঘুড়ি, যা সে কখনো কিনতে পারেনি। ঘুড়িটি আকাশে উড়ে যেতেই ছেলেটির মুখে যে হাসি ফুটল, তা দেখে রিয়ার মন ভরে গেল। একদিন তার প্রিয় পোষা বিড়ালটি অসুস্থ হয়ে পড়ল, রিয়া তার তুলি দিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর মাছ আঁকল, আর বিড়ালটি সেটি খেয়েই সুস্থ হয়ে উঠল। সবাই রিয়ার জাদুতে মুগ্ধ। রিয়া নিজেকে একজন সত্যিকারের শিল্পী মনে করতে লাগল, যার তুলির ছোঁয়ায় সব স্বপ্ন সত্যি হয়। তার মনটা আনন্দে ভরে থাকত, সে ভাবত এই জাদুর তুলি দিয়ে সে পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করে তুলবে, সবার মুখে হাসি ফোটাবে, আর কোনো দুঃখ থাকবে না। সে যেন এক ছোট পরী, যে তার জাদুর কাঠি দিয়ে সবার জীবনে আনন্দ নিয়ে আসছে। তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না, শুধু ছিল অফুরন্ত আনন্দ আর বিস্ময়। কিন্তু এই ক্ষমতার একটা অন্য দিকও ছিল, যা রিয়া ধীরে ধীরে বুঝতে পারল। ক্ষমতা যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, তেমনি তার সাথে আসে এক বড় দায়িত্ব, যা ছোট্ট রিয়ার বোঝার জন্য একটু কঠিন ছিল। একদিন রিয়া তার প্রিয় চকলেটের জন্য বায়না ধরল। মা বললেন, “এখন না, সন্ধ্যায় পাবে। দুপুরে বেশি মিষ্টি খাওয়া ভালো না।” রিয়ার খুব রাগ হলো, তার ছোট্ট মনটা অভিমানে ভরে গেল, তার মনে হলো মা তাকে ভালোবাসে না, তার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সে তার তুলি দিয়ে একটা বিশাল চকলেট আঁকল, যেটা একটা ছোট টেবিলের সমান বড় ছিল, তার উপর বাদামের গুঁড়ো আর ক্যারামেলের নকশা, যেন একটা চকলেটের পাহাড়, যা তার সব ইচ্ছে পূরণ করবে। চকলেটটা এত বড় ছিল যে সেটা ঘরের দরজা দিয়ে বের করা যাচ্ছিল না। শুধু তাই নয়, গরমের কারণে চকলেটটা দ্রুত গলে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল, আর একটা আঠালো, নোংরা বিশৃঙ্খলা তৈরি হলো। ঘরের বাতাস চকলেটের মিষ্টি, কিন্তু তীব্র গন্ধে ভরে গেল, যা কিছুক্ষণ পরেই অসহ্য লাগতে শুরু করল, যেন পুরো ঘরটা চকলেটের সমুদ্রে ডুবে গেছে, আর মাছিরা ভন ভন করতে শুরু করল। মা-বাবা দুজনেই খুব বিরক্ত হলেন। মা বললেন, “রিয়া, এটা কী করেছ? পুরো ঘর নোংরা করে ফেলেছ! এটা পরিষ্কার করবে কে? আর এত বড় চকলেট তো খাওয়াও যাবে না, নষ্ট হয়ে গেল! তোমার এই কাজটা ঠিক হয়নি।” রিয়া লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করল, তার জাদুর আনন্দ যেন এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল, তার মনে হলো সে একটা বড় ভুল করে ফেলেছে, তার নিজেরই বোকামি তাকে বিপদে ফেলল। সে বুঝতে পারল, তার ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে সে আসলে সমস্যা তৈরি করেছে। আরেকদিন, তার স্কুলের এক বন্ধু, যার নাম ছিল মিতু, তাকে খেলার সময় ধাক্কা মেরেছিল। রিয়ার খুব রাগ হলো, তার চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে গেল, আর তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল, যেন সে প্রতিশোধ নিতে চায়। সে আর কিছু না ভেবে তার তুলি দিয়ে একটা বড়, লোমশ মাকড়সা আঁকল, যার আটটা বড় বড় চোখ ছিল, আর তার শরীরটা কালো আর ভয়ংকর দেখাচ্ছিল, তার দাঁতগুলোও তীক্ষ্ণ ছিল, যেন এখনই কামড়ে দেবে, যেটা তার বন্ধুকে ভয় দেখানোর জন্য। মাকড়সাটা সত্যি সত্যি জীবন্ত হয়ে উঠল এবং তার বন্ধুর দিকে দ্রুত ছুটে গেল, তার আটটা পা দ্রুত নড়ছিল, যেন শিকার ধরছে। মিতু ভয়ে চিৎকার করে পালিয়ে গেল, তার চোখ দুটো আতঙ্কে বড় বড় হয়ে গিয়েছিল, আর তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কাছে গেল, আর রিয়ার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। রিয়া প্রথমে মজা পেলেও, পরে তার খুব খারাপ লাগল। মিতু সেদিন থেকে তার সাথে আর খেলতে চাইল না, এমনকি তার দিকে তাকাতোও না, স্কুলের মাঠে রিয়াকে দেখলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত, যেন রিয়াকে দেখলে তার ভয় লাগে। রিয়ার খুব একা লাগছিল, তার মনে হলো সে একটা ভুল করে ফেলেছে, তার জাদুর ক্ষমতা অন্যের ক্ষতি করতে পারে। সে বুঝতে পারল, তার রাগের বশে আঁকা ছবিগুলো শুধু তাকেই নয়, অন্যদেরও কষ্ট দিচ্ছে, আর সেই কষ্ট তার নিজের মনকেও ভারাক্রান্ত করছে, যেন তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তার মনে হলো, সে যদি এই তুলিটা না পেত, তাহলে হয়তো ভালোই হতো। রিয়া বুঝতে পারল যে এই জাদুর তুলি শুধু ভালো জিনিসই তৈরি করে না, তার আঁকা খারাপ জিনিসগুলোও সত্যি হয়ে যায়। সে যখন রেগে কিছু আঁকে, তখন সেটা তার নিজের জন্যই সমস্যার সৃষ্টি করে, অন্যদেরও কষ্ট দেয়। সে ভাবতে শুরু করল, এই ক্ষমতা তার জন্য কতটা ভালো, আর কতটা খারাপ। তার মনে একটা দ্বিধা সৃষ্টি হলো। সে কি এই তুলি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেবে? নাকি সে শিখবে কীভাবে এই ক্ষমতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয়? তার ছোট্ট মনটা এক বিশাল প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুভব করল, এই ক্ষমতা তাকে যেমন খুশি করতে পারে, তেমনি তাকে ভয়ও দেখাতে পারে, আর তার প্রতিটি আঁকা যেন এক পরীক্ষার মতো, যা তাকে সঠিক পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে। সে রাতে ঘুমাতে পারল না, তার মনে বারবার চকলেট আর মাকড়সার ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর সে ভাবছিল কীভাবে সে এই ভুলগুলো শোধরাবে। তার ঘুম ভেঙে যেত বারবার, আর সে বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। একদিন রাতে, রিয়া তার বিছানায় শুয়েছিল। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর দূরের কুকুরগুলো যেন কাঁদছিল, যেন তারাও রিয়ার মনের কষ্ট বুঝতে পারছিল। চাঁদের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে এসে তার বিছানায় পড়ছিল, আর সেই আলোয় তুলিটা কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছিল, তার সোনালী লোমগুলো চিকচিক করছিল। তার মনটা খুব খারাপ ছিল, তার চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছিল, বালিশ ভিজে গেল। সে তার জাদুর তুলিটা হাতে নিল। তুলিটা তার হাতে কেমন যেন ভারী মনে হচ্ছিল, যেন তার উপর এক বিশাল দায়িত্বের বোঝা চাপানো হয়েছে। সে ভাবল, সে কী করবে এই তুলি নিয়ে? সে কি এটা দিয়ে শুধু নিজের ইচ্ছে পূরণ করবে, যা কখনো কখনো অন্যের ক্ষতি করতে পারে? নাকি এটা দিয়ে এমন কিছু করবে যা সবার জন্য ভালো হবে, এমনকি যদি তাতে তার নিজের ছোটখাটো ইচ্ছেগুলো পূরণ নাও হয়? সে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাবল, তার ছোট্ট মাথায় বড় বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর তার চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, বালিশ ভিজে গেল। সে অনুভব করল, এই তুলি শুধু একটি খেলনা নয়, এটি একটি শক্তি যা তাকে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে, ঠিক যেমন বড়রা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়, আর তার এই সিদ্ধান্ত তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সে মনে মনে প্রার্থনা করল, যেন সে সঠিক পথ খুঁজে পায়, যেন সে তার ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। পরের দিন সকালে, রিয়া একটা সিদ্ধান্ত নিল। তার চোখে দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু তার মুখে ছিল এক শান্ত হাসি, যা তার ভেতরের পরিবর্তনকে প্রকাশ করছিল। সে তার তুলি দিয়ে প্রথমে একটা বড়, সবুজ বাগান আঁকল, যেখানে সব ধরনের সুন্দর ফুল আর ফল ছিল, আর পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছিল, প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল, যেন প্রকৃতি তার তুলির ডগায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই বাগানটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত, যেখানে যে কেউ এসে শান্তি পেতে পারত, আর তার সুবাসে মন জুড়িয়ে যেত। এই বাগানটি সে তার বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জমিতে আঁকল, যা মুহূর্তেই এক সবুজ স্বর্গে পরিণত হলো, আর সেখানে শিশুরা খেলতে শুরু করল। তারপর সে তার বন্ধুদের জন্য একটা বিশাল খেলার মাঠ আঁকল, যেখানে দোলনা, স্লিপার, ফুটবল খেলার জায়গা এবং একটি ছোট পুকুর ছিল, যেন সবাই একসাথে মজা করতে পারে, হাসতে পারে, আর তাদের শৈশব আনন্দে ভরে ওঠে। এই মাঠটি সে স্কুলের পাশে আঁকল, যেখানে আগে শুধু ধূলো আর আবর্জনা ছিল। সে আর নিজের জন্য কিছু আঁকল না। যখন তার মনে কোনো খারাপ চিন্তা আসত, সে তুলিটা সাবধানে সরিয়ে রাখত, তার মনকে শান্ত করার চেষ্টা করত, এবং নিজেকে মনে করিয়ে দিত যে তার ক্ষমতা শুধু ভালো কাজের জন্যই, অন্যের উপকারের জন্য। সে তার তুলি দিয়ে তার এলাকার দরিদ্র শিশুদের জন্য নতুন পোশাক আঁকল, তাদের মুখে হাসি ফুটল, তাদের চোখগুলো খুশিতে ঝলমল করে উঠল। সে অসুস্থ মানুষের জন্য আঁকল সুস্বাদু খাবার, যা তাদের শক্তি জোগাল, আর তাদের দুর্বল শরীর যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। এমনকি সে মিতুর জন্য একটি সুন্দর প্রজাপতি আঁকল, যা মিতুর কাছে উড়ে গিয়ে তার হাতে বসল। মিতু প্রথমে ভয় পেলেও, পরে প্রজাপতিটিকে দেখে মুগ্ধ হলো, আর রিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। তাদের বন্ধুত্ব আবার ফিরে এল, আর তারা একসাথে খেলতে শুরু করল। রিয়া শিখল যে আসল জাদু তুলিতে নয়, বরং তার নিজের মনে। সে যখন ভালো কিছু ভাবে, যখন তার মনটা উদার থাকে, যখন সে অন্যের ভালোর কথা চিন্তা করে, তখন তার তুলি দিয়ে আঁকা ছবিগুলোও সুন্দর হয় এবং সবার মুখে হাসি ফোটায়। আর যখন সে খারাপ কিছু ভাবে, যখন তার মনটা রাগ বা হিংসায় ভরে যায়, তখন তার আঁকা ছবিগুলো সমস্যা তৈরি করে, এমনকি তার নিজেরও মন খারাপ করে দেয়। রিয়া তার জাদুর তুলিটা সাবধানে তার বাক্সের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গায় রাখল, কিন্তু সে আর সেটা দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি তাই আঁকত না। সে বুঝল যে ক্ষমতা যত বড় হয়, তার সাথে দায়িত্বও তত বাড়ে। আর সেই দিন থেকে রিয়া শুধু ভালো কিছুর জন্যই তার তুলি ব্যবহার করত, আর তার জীবনটা আরও সুন্দর, আরও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল, কারণ সে বুঝেছিল সত্যিকারের জাদু লুকিয়ে আছে ভালোবাসায় আর ভালো কাজে, যা সবার জীবনকে আলোকিত করে তোলে, এবং এই জাদু তার নিজের মধ্যেই ছিল, তুলিটি ছিল কেবল সেই জাদুর একটি মাধ্যম, যা তাকে তার ভেতরের শক্তিকে চিনতে শিখিয়েছিল। রিয়া এখন জানত, তার তুলি শুধু একটি খেলনা নয়, এটি একটি উপহার, যা তাকে শিখিয়েছে কীভাবে একজন ভালো মানুষ হতে হয়।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion