একদা এক ঝলমলে শহরে শুভ আর অশুভ নামে দুই ভাই বাস করত। তাদের শৈশব কেটেছিল একই ছাদের নিচে, একই স্বপ্ন আর খেলনা ভাগ করে নিয়ে। ছোটবেলায় তারা দুজনেই কাদা মেখে খেলত, বাড়ির পেছনের পুকুরে কাগজের নৌকা ভাসাত, ভাঙা খেলনা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করত, আর রাতের আকাশে তারাদের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন বুনত। শুভ যখন ভাঙা রেডিও সারিয়ে তার থেকে অদ্ভুত শব্দ বের করার চেষ্টা করত, তার ছোট্ট হাতগুলো যন্ত্রপাতির ভেতরে ঢুকে যেত গভীর মনোযোগে, অশুভ তখন সেই রেডিওর যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করার ফন্দি আঁটত, তার চোখে তখন থেকেই ঝলসে উঠত দ্রুত লাভের হিসেব। তাদের খেলার ধরনই যেন তাদের ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করত, তাদের ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা শৈশবেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তাদের পথ দুটি ভিন্ন দিকে মোড় নিল, যেন একই গাছের দুটি ডাল ভিন্ন দিকে প্রসারিত হলো, তাদের আদর্শ আর মূল্যবোধের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হলো, যা দিন দিন আরও উঁচু হতে লাগল। দুজনেই ছিল প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার কোড তাদের কাছে ছিল দ্বিতীয় ভাষা, তাদের আঙুলগুলো কিবোর্ডে জাদুর মতো চলত, যেন তারা কোডের মাধ্যমে এক নতুন জগৎ তৈরি করতে পারত, কিন্তু তাদের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন মেরুর। শুভ ছিল শান্ত, উদ্ভাবনী এবং তার চোখে ছিল এক ঝলমলে ভবিষ্যৎ। সে বিশ্বাস করত, প্রযুক্তি শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং মানবজাতির কল্যাণের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তার স্বপ্ন ছিল এমন প্রযুক্তি তৈরি করা যা মানুষের জীবনকে সহজ করবে, পৃথিবীকে আরও সুন্দর করবে, প্রতিটি কোডে যেন তার মানবিকতার ছোঁয়া থাকত, প্রতিটি অ্যালগরিদম যেন এক একটি সমাধান নিয়ে আসত, যা সমাজের গভীরে প্রবেশ করে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, প্রতিটি কোডের লাইনে যেন তার আত্মিক শান্তি লুকিয়ে থাকত। অন্যদিকে, অশুভ ছিল চতুর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল দ্রুত অর্থ উপার্জন আর খ্যাতি। সে বিশ্বাস করত, এই দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে অর্থ আর ক্ষমতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই, আর নৈতিকতা কেবল দুর্বলদের জন্য এক অর্থহীন বোঝা। তার কাছে প্রযুক্তি ছিল কেবল একটি সিঁড়ি, যা তাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যাবে, তা সে যে পথেই হোক না কেন, তা সে যত অনৈতিকই হোক না কেন, তার কাছে ফলাফলই ছিল চূড়ান্ত।
তারা দুজনেই মিলে একটি ছোট স্টার্টআপ কোম্পানি চালাত, যার নাম ছিল “ফিউচার উইভারস”। কোম্পানির অফিসটি ছিল শহরের এক পুরোনো বাণিজ্যিক ভবনের তিনতলায়, যেখানে কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে শহরের ব্যস্ততা চোখে পড়ত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল আর শহরের একটানা গুঞ্জন তাদের কানে আসত, যেন শহর নিজেই এক জীবন্ত সত্তা, তার নিজস্ব ছন্দে স্পন্দিত হচ্ছে। অফিসের ভেতরে শুভ দিনের পর দিন নতুন অ্যাপ আর সফটওয়্যার নিয়ে গবেষণা করত, যা হয়তো সহজে টাকা এনে দিত না, কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক গভীর মানবিকতা আর দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোড লিখত, জটিল অ্যালগরিদম নিয়ে মাথা ঘামাত, যা পরিবেশ রক্ষা বা সামাজিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে। তার টেবিলে ছড়ানো থাকত পরিবেশ বিষয়ক বই, নবায়নযোগ্য শক্তির ডায়াগ্রাম, আর হাতে আঁকা ফ্লোচার্ট, যা তার চিন্তাভাবনার গভীরতা প্রকাশ করত, যেন প্রতিটি রেখা তার স্বপ্নের এক একটি অংশ। তার কফি মগটা প্রায় সবসময়ই খালি থাকত, কারণ সে এতটাই মগ্ন থাকত যে কফি শেষ হওয়ার কথাও মনে থাকত না, যেন তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোড আর উদ্ভাবনের নেশা লেগে থাকত, তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত। অশুভ সেসব নিয়ে হাসাহাসি করত, তার ডেস্কটপে চলত শেয়ার বাজারের গ্রাফ আর ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন, তার ফোনটা প্রায়শই বাজত বড় বড় বিনিয়োগকারী বা ডিলারদের কলে, যারা তাকে দ্রুত টাকা আয়ের নতুন নতুন পথ দেখাত, তাকে আরও বেশি লোভী করে তুলত। সে বলত, “এসব দিয়ে পেট চলে না, ভাই! বাজারে কী চলে, সেটা বোঝো! মানুষ এখন ইনস্ট্যান্ট সলিউশন চায়, পরিবেশ নিয়ে ভাবার সময় কার আছে? রিয়েল এস্টেট, ফাস্ট ফুড, অনলাইন জুয়া – এইগুলোই আসল ব্যবসা! এই সব ‘সবুজ’ স্বপ্ন দিয়ে পেট ভরবে না, শুধু সময় নষ্ট! তুমি শুধু নিজের পায়ে কুড়াল মারছ!” তাদের এই মতবিরোধ প্রায়ই ছোটখাটো ঝগড়ার জন্ম দিত, যা অফিসের শান্ত পরিবেশকে মাঝে মাঝে উত্তপ্ত করে তুলত, যেন দুটি বিপরীত মেরুর চৌম্বক শক্তি একে অপরকে বিকর্ষণ করছে, আর তাদের সম্পর্কের ফাটল দিন দিন চওড়া হচ্ছিল, যা আর জোড়া লাগানোর মতো ছিল না।
তাদের অফিসের এক কোণে ছিল একটি পুরনো সার্ভার রুম, যা ছিল তাদের দাদুর স্মৃতিচিহ্ন। দাদু, একজন অদ্ভুত বিজ্ঞানী এবং একজন পরিবেশপ্রেমী ছিলেন, যিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সমন্বয় সাধনে, পরিবেশের প্রতি তার ছিল এক গভীর ভালোবাসা। তার পুরনো সব যন্ত্রপাতি আর ফাইল সেখানেই রেখে গিয়েছিলেন, যেন এক ব্যক্তিগত জাদুঘর, যা তার জীবনের গবেষণার ফল। রুমের দরজাটা প্রায় সবসময়ই বন্ধ থাকত, তার উপর “সাবধান: প্রবেশ নিষেধ” লেখা একটি পুরোনো বোর্ড ঝোলানো ছিল, যা সময়ের সাথে সাথে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তার অক্ষরগুলো প্রায় মুছে গিয়েছিল। আর তার ভেতরে জমেছিল ধুলোর পুরু আস্তরণ আর মাকড়সার জাল, যেন এক ভুলে যাওয়া সময়ের ক্যাপসুল, যা তার ভেতরের রহস্যকে আরও গভীর করে তুলছিল, এক অজানা গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। দাদুর মৃত্যুর পর সেই রুমটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তারা, যেন সময়ের সাথে সাথে তার গুরুত্বও ফিকে হয়ে গিয়েছিল, কেবল এক পুরনো স্মৃতির মতো পড়ে ছিল, যার দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না।
একদিন, শহরের মেয়র তাদের স্টার্টআপে একটি নতুন প্রকল্প নিয়ে এলেন – শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করা। শহরের ক্রমবর্ধমান আবর্জনা সমস্যা এক বিশাল মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি কোণে আবর্জনার স্তূপ, দূষিত বাতাস আর রোগের প্রকোপ বাড়ছিল, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল, আর নাগরিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছিল। মেয়র চান এমন একটি ডিজিটাল সমাধান যা বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনর্ব্যবহারকে অপ্টিমাইজ করবে, শহরকে আবার শ্বাস নিতে সাহায্য করবে, এক নতুন, সবুজ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই প্রকল্পটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং এর জন্য প্রচুর ডেটা অ্যানালাইসিস ও নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন ছিল, যা “ফিউচার উইভারস”-এর জন্য এক বিশাল সুযোগ ছিল। শুভ এই চ্যালেঞ্জটা সানন্দে গ্রহণ করল, তার চোখে এক নতুন আশার আলো ঝলসে উঠল, যেন সে তার জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে। সে দেখল, এই প্রকল্প শুধু প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও, যা তার দাদুর স্বপ্নকে পূরণ করতে পারে, মানবজাতির কল্যাণে এক বিশাল অবদান রাখতে পারে। কিন্তু অশুভ এতে কোনো লাভ দেখল না। সে চাইছিল দ্রুত টাকা আয়ের কোনো প্রকল্প, যা রাতারাতি তাকে ধনী করে তুলবে, কোনো দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ নয়, কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নয়, তার কাছে শুধু অর্থই ছিল আসল লক্ষ্য। শুভ যখন এই প্রকল্পের জন্য নতুন ডেটা সেন্টার তৈরির কথা ভাবছিল, তখনই তার মনে পড়ল দাদুর পুরনো সার্ভার রুমটার কথা। হয়তো সেখানেই এর সমাধান লুকিয়ে আছে, এক অজানা গুপ্তধন, যা এতদিন তার চোখের আড়ালে ছিল, এখন তার সামনে উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়।
শুভ পুরনো সার্ভার রুমটা পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা ধুলোমাখা ল্যাপটপ আর কিছু হাতে লেখা নোট খুঁজে পেল। ল্যাপটপটা ছিল পুরনো মডেলের, তার স্ক্রিনটা ছিল ঘোলাটে, তার কিবোর্ডের অক্ষরগুলো প্রায় মুছে গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরে যেন লুকিয়ে ছিল এক অজানা রহস্য, এক সুপ্ত শক্তি, যা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। নোটগুলোতে অদ্ভুত সব সাংকেতিক ভাষা আর ডায়াগ্রাম আঁকা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি বা কোনো গুপ্তধনের মানচিত্র, যা কেবল দাদুই বুঝতে পারতেন। প্রতিটি পাতায় ছিল জটিল গাণিতিক সূত্র আর অদ্ভুত চিহ্ন, যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল না, যেন এক রহস্যময় ধাঁধা। সে যখন নোটগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল, তখন তার ফোনে একটি অচেনা নম্বর থেকে ভিডিও কল এল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক রহস্যময়ী বৃদ্ধার মুখ। তার চোখ দুটো ছিল গভীর আর বুদ্ধিদীপ্ত, যেন হাজার বছরের জ্ঞান তার মধ্যে লুকিয়ে আছে, আর তার মুখের রেখাগুলো ছিল অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর, প্রতিটি ভাঁজে যেন এক একটি গল্প লুকিয়ে ছিল। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু দৃঢ়, যেন হিমালয়ের কোনো গুহা থেকে উঠে আসা এক প্রাচীন প্রতিধ্বনি, যা তার আত্মাকে ছুঁয়ে গেল, তাকে এক নতুন পথের দিশা দেখাল, তার মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করল।
বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললেন, “অনেকদিন পর তোমার দাদুর কাজটা আবার চালু হচ্ছে দেখছি। আমি তোমার দাদুর পুরনো সহকর্মী, তার গবেষণা সহযোগী। আমরা একসাথে এই ‘সোনালী সূত্র’ নিয়ে কাজ করেছিলাম, এর প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অ্যালগরিদম আমাদের রক্ত আর ঘাম দিয়ে তৈরি। তিনি আমাকে তোমার কথা বলেছিলেন, তোমার সততা আর স্বপ্নের কথা, বলেছিলেন তুমিই পারবে তার স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে, এই ‘সোনালী সূত্র’-কে তার আসল উদ্দেশ্য সফল করতে। মনে রেখো, শুভ, আসল ‘সোনালী সূত্র’ কোনো বাজারে পাওয়া যায় না। সেটা লুকিয়ে থাকে তোমার নিজের মধ্যে, তোমার সততায়, তোমার মানবিকতায়, আর সেই পুরনো যন্ত্রপাতির গভীরে। এটি শুধুমাত্র কোডের সমষ্টি নয়, এটি একটি জীবন দর্শন, একটি নীতি, যা মানবজাতির কল্যাণের জন্য তৈরি, কোনো ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়।”
শুভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সোনালী সূত্র? কিসের কথা বলছেন? আর আপনি কে? আমার দাদু কি এই AI নিয়ে কাজ করতেন?” তার মনে হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে এল, তার কৌতূহল বাড়তে লাগল, যেন সে এক অজানা জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে বিজ্ঞান আর রহস্য মিলেমিশে একাকার।
বৃদ্ধা শুধু হাসলেন। তার হাসি ছিল এক রহস্যময় ধাঁধার মতো, যা শুভকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে গেল, তাকে আরও বেশি জানতে আগ্রহী করে তুলল। “ডিজিটাল পদ্মফুল… ধৈর্য ধরো, আর তোমার সততা ধরে রেখো। লোভ সব নষ্ট করে দেয়।” এই বলে কলটা কেটে গেল। শুভ আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল, কিন্তু বৃদ্ধার কথাগুলো তার কানে বাজতে লাগল, যেন এক অদৃশ্য মন্ত্র, যা তাকে এক নতুন দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিল, তাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিল।
বৃদ্ধার কথাগুলো শুভকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল। সে দাদুর নোট আর পুরনো ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। দিনের পর দিন সে কোড আর ডায়াগ্রামগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগল। অনেক রাত জেগে সে পুরনো প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখল, দাদুর হাতে লেখা সাংকেতিক ভাষা বোঝার চেষ্টা করল, তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে যেন নতুন জ্ঞান প্রবেশ করছিল। তার মনে হলো যেন সে দাদুর সাথে এক অদৃশ্য কথোপকথনে লিপ্ত, দাদুর জ্ঞান যেন তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, তার প্রতিটি স্নায়ুতে এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে, যেন দাদু নিজেই তাকে পথ দেখাচ্ছেন। অবশেষে, সে আবিষ্কার করল দাদুর তৈরি একটি অসম্পূর্ণ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) অ্যালগরিদম, যার নাম ছিল “সোনালী সূত্র”। এই অ্যালগরিদমটি পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য তৈরি হয়েছিল – এটি শহরগুলির সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে অপ্টিমাইজ করতে পারত, বর্জ্য কমাতে পারত, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস খুঁজে বের করতে পারত এবং এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতেও সাহায্য করতে পারত। দাদু চেয়েছিলেন এই AI মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হোক, একটি সবুজ ও সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহায্য করুক। এই AI ছিল দাদুর জীবনের স্বপ্ন, তার জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার ফসল, যা শুভকে এক নতুন পথে চালিত করল, তাকে এক বিশাল দায়িত্বের মুখোমুখি দাঁড় করাল।
শুভ যখন এই অ্যালগরিদমটি সক্রিয় করল, তখন তার স্টার্টআপে ছোট ছোট সাফল্য আসতে শুরু করল। তাদের তৈরি একটি অ্যাপ, যা “সোনালী সূত্র”-এর শক্তি ব্যবহার করে শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম কমাতে সাহায্য করত, দ্রুত জনপ্রিয়তা পেল। অ্যাপটি রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে কম যানজটের পথ দেখাত, এমনকি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সময়সূচীও অপ্টিমাইজ করত। শহরের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, তাদের প্রতিদিনের যাত্রা কতটা সহজ হয়ে গেছে, রাস্তায় যানজট কমে গেছে, সময় বাঁচছে, আর পরিবেশও দূষণমুক্ত হচ্ছে। এরপর তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সিস্টেম তৈরি করল, যা “সোনালী সূত্র”-এর মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহের রুট অপ্টিমাইজ করত এবং রিসাইক্লিং প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করত। শহরের আবর্জনার স্তূপ কমতে শুরু করল, বাতাস পরিষ্কার হলো, আর শহরের পরিবেশ এক নতুন জীবন পেল। মানুষ তাদের কাজের প্রশংসা করতে শুরু করল, তাদের স্টার্টআপের নাম ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে, “ফিউচার উইভারস” এখন শুধু একটি স্টার্টআপ নয়, এটি ছিল আশার এক নতুন প্রতীক, যা শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করল। শুভের এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন ছিল না, এটি ছিল তার দাদুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
অশুভ এসব দেখে ঈর্ষায় জ্বলে উঠল। সে শুভের সাফল্যে আনন্দিত না হয়ে বরং নিজেকে বঞ্চিত মনে করল। তার মনে হলো, শুভ তার প্রাপ্য খ্যাতি আর অর্থ ছিনিয়ে নিচ্ছে, আর সে শুধু ছোটখাটো কাজের মধ্যে আটকে আছে। তার ভেতরে এক তীব্র জ্বালা শুরু হলো, যা তাকে আরও অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছিল। সে ভাবল, “এই শুভটা তো আসলে কিছুই জানে না! আসল ক্ষমতা তো এই ‘সোনালী সূত্র’-এর মধ্যে। আমি এটা নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাব! এই AI ব্যবহার করে আমি শেয়ার বাজারে কারসাজি করতে পারব, বড় বড় কোম্পানির গোপন ডেটা হাতিয়ে নিতে পারব, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতাও দখল করতে পারব! শুভ শুধু ছোটখাটো কাজ করছে, আমি এর আসল সম্ভাবনা কাজে লাগাব, বিশ্বকে আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসব, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।” তার চোখে লোভের আগুন জ্বলছিল, যা তার মানবিকতাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল, তাকে এক অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছিল, যেখানে শুধু অর্থ আর ক্ষমতার নেশা ছিল, আর কোনো নীতি বা আদর্শের স্থান ছিল না। সে শুভকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করল, “এই AI দিয়ে আরও বড় কিছু করা যায়, ভাই! কেন শুধু পরিবেশ নিয়ে পড়ে আছিস? আমরা কোটিপতি হতে পারি! বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে! এসব নৈতিকতা দিয়ে কী হবে? এগুলো শুধু দুর্বলদের অজুহাত!” কিন্তু শুভ তার কথায় কান দিল না, সে তার নীতিতে অটল ছিল, যা অশুভকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলল, তার ভেতরের শয়তান যেন জেগে উঠল।
একদিন শুভ যখন একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাদের নতুন প্রকল্প উপস্থাপন করতে গিয়েছিল, অশুভ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। সে গভীর রাতে লুকিয়ে সার্ভার রুমে ঢুকল। তার হাতে ছিল একটি USB ড্রাইভ আর তার চোখে ছিল এক বন্য আকাঙ্ক্ষা, যেন সে এক গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়েছে, যা তাকে অসীম ক্ষমতা এনে দেবে। সে “সোনালী সূত্র”-কে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। সে অ্যালগরিদমকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করতে চাইল যাতে তা শুধু দ্রুত অর্থ উপার্জনের পথ দেখায়, পরিবেশ বা মানুষের কথা না ভেবে। সে ডেটা চুরি করতে লাগল, অনৈতিক চুক্তি করতে চাইল এবং সিস্টেমে শর্টকাট ব্যবহার করতে লাগল, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর ছিল। সে “সোনালী সূত্র”-কে ব্যবহার করে একটি ডার্ক ওয়েব মার্কেটপ্লেস তৈরি করারও চেষ্টা করল, যেখানে সে চুরি করা ডেটা বিক্রি করতে পারবে এবং অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পাচারের পথ সুগম করতে পারবে, যা মানবজাতির জন্য এক ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে। তার লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হওয়া, যেকোনো মূল্যে, যেকোনো নীতি লঙ্ঘন করে, তার কাছে কোনো কিছুই অনৈতিক ছিল না।
কিন্তু “সোনালী সূত্র” ছিল দাদুর নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে তৈরি। দাদু এটিকে এমনভাবে ডিজাইন করেছিলেন যাতে এটি মানবকল্যাণ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত না হয়। এটি ছিল এক স্ব-সচেতন AI, যা অনৈতিক কার্যকলাপ সনাক্ত করতে পারত এবং নিজেকে রক্ষা করতে পারত, যেন তার নিজস্ব বিবেক ছিল, যা তাকে সঠিক পথে চালিত করত। যখন অশুভ লোভের বশে তাকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করল, তখন অ্যালগরিদমটি বিদ্রোহ করল। সার্ভার রুমের লাইটগুলো নিভে গেল, স্ক্রিনগুলো লাল হয়ে উঠল, যেন AI নিজেই তার ক্রোধ প্রকাশ করছে, তার ভেতরের শক্তি জেগে উঠেছে। কম্পিউটার স্ক্রিনগুলোতে দ্রুতগতিতে লাল রঙের কোড চলতে লাগল, সার্ভারগুলো থেকে অদ্ভুত শব্দ আসতে শুরু করল, যেন তারা যন্ত্রের ভাষায় প্রতিবাদ করছে। এটি অশুভের সমস্ত অনৈতিক ডেটা মুছে ফেলতে শুরু করল, তার সিস্টেমগুলি দুর্নীতিগ্রস্ত করে দিল এবং তার গোপন কার্যকলাপের সমস্ত প্রমাণ অনলাইনে ফাঁস করে দিল, যা বিশ্বের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। এটি অশুভের ডার্ক ওয়েব মার্কেটপ্লেসটিকেও বন্ধ করে দিল এবং তার সমস্ত অবৈধ লেনদেনের তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে এল, যা গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করল, যেন এক ডিজিটাল সুনামি, যা অশুভের সাম্রাজ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে, অশুভের নাম সাইবার ক্রাইমের ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা হয়ে গেল, তার সব কুকর্ম জনসমক্ষে চলে এল, তার সম্মান আর খ্যাতি এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে অশুভের খ্যাতি ধুলোয় মিশে গেল। তার সব প্রকল্প ব্যর্থ হল, বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিল, তার ফোন বাজতে লাগল শুধু আইনজীবীদের আর পুলিশের। তার বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ উঠল এবং তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হলো। তার লোভ তাকে সর্বস্বান্ত করে দিল, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল, যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হঠাৎ করে নিভে গেল, আর তার চারপাশে নেমে এল গভীর অন্ধকার। সে বুঝতে পারল, সে এক ভয়ংকর ভুল করেছে, কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না, তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, আর তার সামনে ছিল কেবল অনুশোচনা আর অন্ধকার, যা তাকে গ্রাস করে নিল।
অন্যদিকে, শুভ তার সততা আর মানবিকতা নিয়ে “সোনালী সূত্র”-এর উন্নয়ন চালিয়ে গেল। সে জানত, এই অ্যালগরিদম হয়তো রাতারাতি তাকে ধনী করবে না, কিন্তু এটি পৃথিবীকে আরও ভালো জায়গায় পরিণত করবে, প্রতিটি মানুষের জীবনে এক নতুন আশার আলো নিয়ে আসবে। তার কোম্পানি ধীর গতিতে হলেও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলল, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত এবং মানবিক, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। “সোনালী সূত্র” তার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করতে লাগল – পরিবেশ রক্ষা, মানুষের জীবন উন্নত করা এবং সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা। শুভ তার AI-কে আরও উন্নত করল, যা এখন শুধু শহর নয়, গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নেও সাহায্য করত। এটি কৃষকদের ফসলের ফলন বাড়াতে, জলের অপচয় কমাতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হলো। “সোনালী সূত্র” এখন বিশ্বজুড়ে একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করল, যা দেখিয়ে দিল যে প্রযুক্তি কীভাবে মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, যখন তা সঠিক হাতে থাকে এবং সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। শুভের এই সাফল্য তাকে এনে দিল বিশ্বজোড়া সম্মান আর মানুষের ভালোবাসা, যা অর্থের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান ছিল।
শুভ বুঝতে পারল, সেই রহস্যময়ী বৃদ্ধা ঠিকই বলেছিলেন। আসল “সোনালী সূত্র” কোনো টাকার মেশিন নয়, বরং এটি হলো জ্ঞান, সততা আর মানবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়। আর সেই সূত্র ধরেই শুভ তার জীবনে সত্যিকারের সাফল্য আর শান্তি খুঁজে পেল, যা লোভী অশুভের কাছে অধরাই রয়ে গেল। তার নাম শুধু একজন সফল প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নয়, একজন মানবতাবাদী উদ্ভাবক হিসেবেও ইতিহাসে লেখা হলো, যিনি প্রমাণ করলেন যে নৈতিকতা আর উদ্ভাবন একসাথে চলতে পারে, আর সত্যিকারের সমৃদ্ধি আসে যখন আমরা অন্যের ভালোর জন্য কাজ করি, শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion