Episode 12992 words0 views

ডিজিটাল জালে- প্রযুক্তির মায়াজাল

ডিজিটাল জালে – প্রযুক্তির মায়াজাল আকাশের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কলেজ শেষ করে সবে একটা ছোটখাটো চাকরিতে ঢুকেছে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, তাই তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই তাকে ঘিরে। আকাশ নিজেও বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল, স্বপ্ন দেখত একদিন বড় কিছু করবে। একটি স্বনামধন্য আইটি ফার্মে জুনিয়র সফটওয়্যার ডেভেলপারের পদ পেয়েছিল সে, যা তার জন্য ছিল এক নতুন দিগন্ত। অফিসের প্রথম দিন থেকেই সে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। তার চোখে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, মনে ছিল অফুরন্ত উদ্দীপনা। সে জানত, এই চাকরি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেবে। কিন্তু তার অজান্তেই, এক অদৃশ্য, সূক্ষ্ম জাল তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছিল – ডিজিটাল জাল, যার অস্তিত্ব সে প্রথমে টেরও পায়নি, যেন কোনো গুপ্ত শিকারী নিঃশব্দে তার ফাঁদ পাতছিল, আর আকাশ ছিল সেই ফাঁদের প্রথম শিকার। শুরুটা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে। বন্ধুদের দেখাদেখি আকাশও স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের দুনিয়ায় পা রাখল। স্মার্টফোনটি হাতে আসার পর থেকেই তার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। চকচকে স্ক্রিন, হাজারো অ্যাপের হাতছানি – যেন এক মায়াবী জগৎ। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক, বিভিন্ন অনলাইন গেম – একের পর এক অ্যাপ তার ফোনের স্ক্রিন দখল করে নিল। প্রথমদিকে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, বন্ধুদের পোস্ট দেখা, মজার ভিডিও দেখা, বিভিন্ন গেম খেলা – সবকিছুই বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিল। কাজের ফাঁকে, অবসরে, এমনকি খাওয়ার টেবিলেও ফোনটা তার হাতে থাকত। সে দেখত, তার বন্ধুরা কীভাবে তাদের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো অনলাইনে শেয়ার করছে, ছুটির দিনের ছবি, নতুন কেনা জিনিসের ভিডিও, রেস্টুরেন্টের খাবারের ছবি, এমনকি তাদের পোষা প্রাণীর হাস্যকর ভিডিও – আর সে নিজেও সেই স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করল। নিজের ছবি পোস্ট করা, বন্ধুদের পোস্টে লাইক-কমেন্ট করা, আর প্রতি মুহূর্তে নতুন নোটিফিকেশনের অপেক্ষায় থাকা – এই সব যেন তার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। সে মনে করত, ভার্চুয়াল জগতে তার উপস্থিতি যত বাড়বে, ততই সে আধুনিক হবে, সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে, যেন ডিজিটাল জগতে তার পদচিহ্নই তার অস্তিত্বের প্রমাণ। এই ডিজিটাল দুনিয়া যেন তাকে এক নতুন পরিচয় এনে দিয়েছিল, যেখানে সে নিজেকে আরও বেশি আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করে অন্যের জীবন দেখত, তাদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হতো, আর নিজের জীবনকে আরও বেশি করে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করত ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে, যেখানে বাস্তবতার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেত প্রদর্শনী। সে বিশ্বাস করত, অনলাইনে তার জনপ্রিয়তা বাড়লে বাস্তব জীবনেও তার গুরুত্ব বাড়বে, যা ছিল এক নিছকই ভ্রান্ত ধারণা, এক মরীচিকার পেছনে ছোটা। সে বুঝতে পারছিল না, এই ভার্চুয়াল জগৎ তাকে ধীরে ধীরে তার বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে এই অভ্যাস আসক্তিতে পরিণত হতে শুরু করল। সকালে ঘুম ভাঙত ফোনের নোটিফিকেশন চেক করে, রাতে ঘুমানোর আগেও শেষ কাজ ছিল ফিড স্ক্রল করা। এমনকি মাঝরাতেও ঘুম ভেঙে গেলে সে একবার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখত কোনো নতুন মেসেজ বা নোটিফিকেশন এসেছে কিনা। তার ঘুম চক্র এলোমেলো হয়ে গেল, প্রায়শই সে অনিদ্রায় ভুগত, গভীর রাত পর্যন্ত স্ক্রিনের নীল আলোয় তার চোখ জ্বলত। সকালে ঘুম থেকে উঠতে তার ক্লান্তি লাগত, সারাদিন এক ধরনের ঝিমুনি থাকত, যা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। তার চোখ জ্বালা করত, মাথা ব্যথা ছিল নিত্যসঙ্গী, এবং তার হজম প্রক্রিয়াতেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক চাপের কারণে। তার ত্বক অনুজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল, মুখের হাসি প্রায় বিলীন, এবং তার চেহারায় এক ধরনের অবসাদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, যেন তার জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছিল, এক অদৃশ্য সত্তা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেই সে ডুবে যেত ভার্চুয়াল জগতে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পরিবারের সাথে সময় কাটানো – সবকিছুই যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছিল। ইনস্টাগ্রামে কে কত লাইক পেল, ফেসবুকে কার পোস্টে কী কমেন্ট এল, ইউটিউবে কোন ভিডিও ভাইরাল হল, টিকটকে কোন চ্যালেঞ্জ চলছে – এই সবকিছুর উপরই তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকত। সে প্রায়শই দেখত, তার অনলাইন বন্ধুরা কত সুখী, কত সফল, কত আকর্ষণীয় জীবন যাপন করছে, আর তার নিজের জীবন যেন তাদের তুলনায় ফিকে মনে হতো। এই তুলনা তাকে হীনমন্যতায় ভোগাত এবং আরও বেশি করে ভার্চুয়াল জগতে আটকে রাখত, যেখানে সে নিজের একটি ‘উন্নত’ সংস্করণ তৈরি করার চেষ্টা করত, যা বাস্তবতার থেকে অনেক দূরে ছিল। তার আত্মবিশ্বাস কমতে শুরু করল, কারণ সে বুঝতে পারছিল না যে কেন সে অন্যদের মতো ‘পারফেক্ট’ হতে পারছে না। তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল, সামান্য কারণেই সে রেগে যেত, এবং তার ধৈর্য প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সে কোনো গঠনমূলক সমালোচনাও সহ্য করতে পারত না, নিজেকে সবসময় সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করত, এমনকি ভুল হলেও। তার সামাজিক দক্ষতাও কমে গিয়েছিল, বাস্তব কথোপকথনে সে অস্বস্তি বোধ করত, চোখাচোখি এড়িয়ে চলত, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল, এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে তাকে আটকে রেখেছিল। আকাশের মা-বাবা প্রথমদিকে কিছু বুঝতে পারেননি। ভাবতেন, ছেলে হয়তো নতুন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, তাই সময় দিতে পারছে না। কিন্তু যখন দেখলেন আকাশ তাদের সাথে কথা বলার সময়ও ফোনে বুঁদ হয়ে থাকে, রাতের খাবার টেবিলে ফোনটা পাশে নিয়ে বসে, তখন তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। “আকাশ, এত কী দেখিস ফোনে? একটু আমাদের সাথে কথা বল,” মা বলতেন স্নেহভরা কণ্ঠে। তার কণ্ঠে ছিল এক অব্যক্ত বেদনা, এক চাপা ভয়, যেন তার সন্তান তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আকাশ হয়তো এক সেকেন্ডের জন্য ফোন থেকে চোখ তুলে বলত, “কিছু না মা, একটা জরুরি খবর দেখছি,” আর পরক্ষণেই আবার ডুবে যেত স্ক্রিনে, যেন মায়ের কণ্ঠস্বর তার কানে পৌঁছাচ্ছে না, যেন ফোনের স্ক্রিনের আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে। বাবাও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতেন, “আকাশ, ফোনটা রেখে একটু বাইরের দুনিয়ায় চোখ দে। সব সময় স্ক্রিনে মুখ গুঁজে থাকলে কি চলে? শরীর খারাপ হবে, চোখ নষ্ট হবে। আমরা কি তোমার সাথে কথা বলার জন্যও অ্যাপ ডাউনলোড করব?” তাদের কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট হতাশা, এক ধরনের অসহায়ত্ব। তারা যেন তাদের ছেলেকে চিনতে পারছিলেন না, যে ছেলেটি একসময় তাদের প্রাণ ছিল, সে এখন এক অচেনা মানুষ। কিন্তু আকাশের কানে যেন কিছুই যেত না। সে তাদের কথাকে পুরনো ধ্যান-ধারণা বলে উড়িয়ে দিত, তাদের আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি অনীহাকে হাস্যকর মনে করত। তাদের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে লাগল, পারিবারিক বন্ধন যেন আলগা হয়ে যাচ্ছিল। মা-বাবা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন, “আমাদের ছেলেটা কি বদলে গেল? আগে তো এমন ছিল না। ওর কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমরা কি ওর জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছি না? নাকি আমরাই ওকে বুঝতে পারছি না?” তাদের মনে এক অজানা ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল, যেন তাদের ছেলেটা তাদের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, এক অদৃশ্য প্রাচীর তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে, যা ভাঙা প্রায় অসম্ভব। তাদের পারিবারিক সান্ধ্য আড্ডাগুলো এখন নীরবতায় ভরে থাকত, যেখানে ফোনের স্ক্রিনের নীল আলোই ছিল একমাত্র সঙ্গী, যেন সে আলো এক অদ্ভুত ছায়া ফেলছিল তাদের পরিবারে, তাদের সুখ কেড়ে নিচ্ছিল। চাকরির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করল। আগে যে কাজগুলো সে দ্রুত শেষ করত, এখন সেগুলোতে অনেক সময় লাগত। মনোযোগের অভাবে ছোটখাটো ভুলও হতে শুরু করল। ডেডলাইন মিস করা, কোডিংয়ে ভুল করা, ক্লায়েন্টের মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকা – এমন ঘটনা বাড়তে লাগল। বসের চোখে পড়ল আকাশের কর্মদক্ষতা কমে গেছে। একদিন বস তাকে ডেকে সরাসরি বললেন, “আকাশ, তোমার কাজে মন নেই কেন? কোনো সমস্যা? তোমার পারফরম্যান্স আগের মতো নেই। আমরা তোমার উপর ভরসা করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমাদের হতাশ করছো। যদি এমন চলতে থাকে, তাহলে আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে, হয়তো তোমার পদোন্নতি আটকে যাবে বা আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। তোমার মনোযোগের অভাব স্পষ্ট। তোমার কাজের মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে।” বসের গম্ভীর কণ্ঠস্বর আকাশের মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার করলেও, আসক্তির তীব্রতা তাকে পুরোপুরি সচেতন হতে দিচ্ছিল না। সে মনে মনে ভাবত, “আমি তো সব ঠিকই করছি, বস বাড়াবাড়ি করছেন। তিনি হয়তো আমার আধুনিক জীবনযাপন বুঝতে পারছেন না।” আকাশ কোনোমতে সামলে নিল, মিথ্যা অজুহাত দিল যে সে ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে বুঝল, এভাবে চলতে থাকলে চাকরিটাও হারাতে পারে। সহকর্মীরাও তার থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করল, কারণ সে তাদের সাথে মিশত না, সবসময় নিজের ফোনেই ব্যস্ত থাকত। টিফিনের সময় সে একাই ফোন নিয়ে বসে থাকত, যখন অন্যরা গল্পগুজব করত। তার মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলো, সে যেন অফিসের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। তার মনে হতো সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে, যদিও এর কারণ ছিল তার নিজেরই আচরণ। সে নিজেকে আরও বেশি একা এবং কোণঠাসা অনুভব করত, যা তাকে আরও বেশি করে ভার্চুয়াল জগতে আশ্রয় নিতে প্রলুব্ধ করত, এক দুষ্ট চক্রের মতো। তার কর্মজীবনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা যেন ফিকে হয়ে আসছিল, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছিল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে তার লক্ষ্য থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল, তাকে এক অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সবচেয়ে বড় আঘাতটা এল যখন তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা, রিমির সাথে তার সম্পর্ক ভাঙল। রিমি ছিল আকাশের কলেজের বন্ধু, এবং তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর, প্রায় পাঁচ বছরের। তারা একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল, বিয়ের পরিকল্পনাও ছিল, এমনকি তাদের পরিবারেও তাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। তারা একে অপরের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল, সব কথা ভাগ করে নিত, একে অপরের শক্তি ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে রিমি বারবার অভিযোগ করত, আকাশ তাকে সময় দেয় না, তার কথা শোনে না, সবসময় ফোনেই ব্যস্ত থাকে। তাদের দেখা হলে আকাশ হয়তো রিমির কথা শুনতে শুনতে ফোনের নোটিফিকেশন চেক করত, বা রিমির সাথে কথা বলতে বলতে সোশ্যাল মিডিয়ার ফিড স্ক্রল করত। রিমির জন্মদিনেও আকাশ তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, যা রিমিকে ভীষণভাবে আঘাত করেছিল। সেদিনের ঘটনাটা রিমির মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, কারণ আকাশ তার উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল, এমনকি জন্মদিনের কেক কাটার সময়ও সে ফোনে ব্যস্ত ছিল, রিমির দিকে একবারও তাকায়নি, যেন রিমি তার কাছে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তার অস্তিত্বই যেন আকাশের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। “আকাশ, তুমি আর আগের মতো নেই। তোমার কাছে এখন তোমার ফোনটাই সব। আমি তোমার পাশে থেকেও যেন একা। আমাদের সম্পর্কটা কি শুধু নামেই চলছে? আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, তোমার মনোযোগ চাই, কিন্তু তুমি শুধু স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকো,” রিমি একদিন হতাশ হয়ে বলল, তার চোখে জল। তার কণ্ঠে ছিল এক তীব্র যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত কষ্ট। আকাশ প্রথমে পাত্তা দেয়নি, ভেবেছিল রিমি বাড়াবাড়ি করছে, বা অতিরিক্ত সংবেদনশীল হচ্ছে। সে রিমির অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয়নি, বরং তাকেই দোষারোপ করত যে সে তাকে বুঝতে পারছে না, তার ‘আধুনিক’ জীবনযাপনকে মেনে নিতে পারছে না। সে রিমির আবেগগুলোকে তুচ্ছ করে দেখত, এমনকি রিমির অভিযোগগুলোকে ‘নাটক’ বলেও মনে করত। কিন্তু যখন রিমি সম্পর্ক শেষ করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন আকাশ যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল, পায়ের নিচে মাটি সরে গেল, যেন এক তীব্র ভূমিকম্প তার জীবনকে নাড়িয়ে দিল। সে চেষ্টা করল রিমিকে বোঝাতে, ক্ষমা চাইতে, বারবার অনুরোধ করতে লাগল, কিন্তু রিমি অনড় ছিল। “তুমি আগে নিজেকে বদলাও, তারপর অন্য কিছু ভেবো। আমি এমন একজন মানুষ চাই যে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবে, আমার কথা শুনবে, ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নয়। তুমি এখন ভার্চুয়াল জগতে এতটাই ডুবে গেছো যে বাস্তবতার সাথে তোমার কোনো সংযোগ নেই, তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ,” এই ছিল রিমির শেষ কথা। রিমির চোখের জল আকাশের হৃদয়কে বিদ্ধ করল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার মনে হলো, সে যেন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছে, যা আর কখনো ফিরে পাবে না। তার বুক ফেটে কান্না আসছিল, কিন্তু সে কাঁদতে পারছিল না, যেন তার সব অনুভূতি অসাড় হয়ে গিয়েছিল, এক গভীর অনুভূতিহীনতা তাকে গ্রাস করেছিল, যেন সে এক জীবন্ত লাশ, যার আত্মা হারিয়ে গেছে। রিমি চলে যাওয়ার পর আকাশ যেন একটা গভীর ধাক্কা খেল। তার জীবন থেকে যেন সব আলো নিভে গেল। সে অনুভব করল এক অসহ্য শূন্যতা, এক গভীর হতাশা। তার চারপাশের পৃথিবীটা যেন ধূসর হয়ে গিয়েছিল, সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছিল। একা ঘরে বসে সে তার ফোনটা দেখল। এই জিনিসটাই কি তার জীবন থেকে সব কেড়ে নিচ্ছে? চাকরি, পরিবার, প্রেম – সব? তার মনে পড়ল, কীভাবে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করে কাটাত, অথচ রিমি যখন তার পাশে থাকত, তখন সে তার দিকে ঠিকমতো তাকাতও না, তার অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করত না। সে বুঝতে পারল, সে শুধু রিমির সাথেই নয়, নিজের সাথেও প্রতারণা করেছে। নিজের স্বপ্ন, নিজের লক্ষ্য – সবকিছুই সে ভুলে গিয়েছিল এই ডিজিটাল জালের মোহে। একটা গভীর অনুশোচনা তাকে গ্রাস করল। তার মনে হলো, সে যেন এক গভীর খাদে পড়ে গেছে, আর এই খাদ তৈরি হয়েছে তার নিজেরই তৈরি করা ডিজিটাল জালের কারণে। সে উপলব্ধি করল, তার জীবনটা এখন কেবল একটি স্ক্রিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যেখানে সত্যিকারের সুখ বা শান্তি নেই। তার এই উপলব্ধি এতটাই তীব্র ছিল যে, সে আর এক মুহূর্তও এই অবস্থায় থাকতে চাইল না। সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে বদলাতেই হবে, এই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতেই হবে, নয়তো তার জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। সে তার নিজের প্রতিজ্ঞা করল, এই অন্ধকার থেকে সে আলোতে ফিরবেই, যে কোনো মূল্যে, যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে। সে যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করল নিজের বিরুদ্ধে, এক মরণপণ লড়াই। সেদিন রাতে আকাশ তার ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল এবং ফোনটা চার্জারে না দিয়ে টেবিলের এক কোণে রেখে দিল, যেন সে এক বিষাক্ত বস্তুকে দূরে সরিয়ে রাখছে, যা তার জীবনের সব বিষ শুষে নিচ্ছিল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে ফোনটা ধরল না। অফিসে গিয়ে সে মন দিয়ে কাজ করল। তার মনোযোগ যেন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। সে প্রতিটি কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করল, প্রতিটি কোড লাইন মনোযোগ দিয়ে লিখল, প্রতিটি মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিল এবং নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব নিতেও দ্বিধা করল না। দুপুরের খাবারের সময় সে ক্যান্টিনে সহকর্মীদের সাথে গল্প করল, তাদের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠল, ফোনটা পকেটেই রইল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মা-বাবার সাথে বসে অনেকক্ষণ গল্প করল, তাদের দিনের খবর জানতে চাইল, নিজের অফিসের গল্প শোনাল। মা-বাবা অবাক হলেও খুশি হলেন, তাদের চোখে যেন এক নতুন আশার আলো দেখতে পেলেন। তাদের হারানো ছেলে যেন ফিরে এসেছে। তারা বুঝতে পারলেন, আকাশ তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবং নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের মনে শান্তি ফিরে এল, যা বহু দিন ধরে অনুপস্থিত ছিল। তাদের মুখে হাসি দেখে আকাশের মনেও এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হলো, এক নতুন উদ্যম নিয়ে সে জীবনকে দেখতে শুরু করল, যেন এক নতুন ভোরের সূচনা হলো। আকাশ বুঝতে পারছিল, এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। প্রতি মুহূর্তে তার মন চাইত ফোনটা হাতে নিতে, নোটিফিকেশন চেক করতে, কী হচ্ছে অনলাইনে তা জানতে। তার আঙুলগুলো যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্রল করার জন্য নিশপিশ করত। তার মস্তিষ্কের এক অংশ যেন ক্রমাগত তাকে প্রলুব্ধ করত ভার্চুয়াল জগতের দিকে ফিরে যেতে, পুরনো অভ্যাসের টানে, যেন এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তাকে ডাকছিল, তাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে নিজেকে জোর করে থামাত। সে ঠিক করল, দিনে নির্দিষ্ট কিছু সময় ছাড়া সে ফোন ব্যবহার করবে না। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো আনইনস্টল করে দিল। ইউটিউব বাদে অন্য কোনো বিনোদনমূলক অ্যাপ রাখল না। সে তার ফোনের ব্যবহার ট্র্যাক করার জন্য একটি অ্যাপ ব্যবহার করা শুরু করল, যাতে সে দেখতে পারে সে কতটা সময় স্ক্রিনে ব্যয় করছে। সে ধীরে ধীরে নিজের জন্য একটি কঠোর ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ রুটিন তৈরি করল। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে যেত, মেডিটেশন করত, এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত। তার জীবনযাত্রায় এক আমূল পরিবর্তন এল। সে তার খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করল, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া শুরু করল, যা তার শারীরিক সুস্থতায় সাহায্য করল। সে নিয়মিত ব্যায়াম করা শুরু করল, যা তার মানসিক চাপ কমাতেও সহায়ক হলো এবং তাকে নতুন করে প্রাণশক্তি দিল। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি চোখে পড়ার মতো ছিল, যেন সে এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। প্রথম কয়েকদিন খুব কষ্ট হল। মনে হত যেন কিছু একটা হারিয়ে গেছে, জীবনটা যেন পানসে হয়ে গেছে, এক ধরনের শূন্যতা তাকে গ্রাস করত। সে অনুভব করত এক অস্থিরতা, যেন তার জীবনে কিছু একটা অনুপস্থিত। তার মেজাজ মাঝে মাঝে খারাপ হতো, কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। সে নিজেকে বোঝাত যে এই কষ্ট সাময়িক, এবং এর ফলস্বরূপ সে এক উন্নত জীবন পাবে। ধীরে ধীরে সে নতুন করে নিজের জীবনকে আবিষ্কার করতে শুরু করল। সে বই পড়া শুরু করল, যা সে বহু বছর ধরে করেনি। সাহিত্যের গভীরে সে এক নতুন আশ্রয় খুঁজে পেল, বিভিন্ন লেখকের চিন্তাধারা তাকে মুগ্ধ করত, তার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিচ্ছিল। সন্ধ্যায় পার্কে হাঁটতে যেত, যা তার মনকে শান্ত করত এবং তাকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসত, সূর্যাস্তের সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করত, পাখির কিচিরমিচির শব্দ তার কানে নতুন সুরের মতো লাগত, ফুলের সুবাস তাকে সতেজ করত। বন্ধুদের সাথে সরাসরি দেখা করে আড্ডা দিত, যা ভার্চুয়াল আড্ডার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিল এবং সত্যিকারের সংযোগ তৈরি করত। সে তার পুরনো শখগুলো আবার শুরু করল – ছবি আঁকা এবং গিটার বাজানো। এই কাজগুলো তাকে এক নতুন আনন্দ দিল, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। সে বুঝতে পারল, জীবনের আসল আনন্দ ভার্চুয়াল লাইক বা কমেন্টে নয়, বরং বাস্তব জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতে লুকিয়ে আছে – একটি বইয়ের পাতা উল্টানো, পাখির গান শোনা, বন্ধুদের সাথে হাসা, পরিবারের সাথে সময় কাটানো, এবং নিজের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করা। তার মনে এক নতুন শান্তি ও তৃপ্তি অনুভব করতে লাগল, যা আগে কখনো ছিল না। সে যেন নতুন করে শ্বাস নিতে শিখল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে শিখল। মাসখানেক পর আকাশ নিজেকে অনেক হালকা অনুভব করল। তার কাজে আবার মনোযোগ ফিরে এল, বসের কাছ থেকে প্রশংসা পেল। তার কর্মদক্ষতা আবার বাড়তে শুরু করল, এবং সে দ্রুতই তার পুরনো সুনাম ফিরে পেল। অফিসের সহকর্মীরাও তার পরিবর্তন দেখে অবাক হলো এবং তার সাথে আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করল। তারা তাকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে লাগল, এবং আকাশ সানন্দে তাতে অংশ নিত, মন খুলে মিশত সবার সাথে, তার মুখে এক সত্যিকারের হাসি ফুটে উঠল। মা-বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তাদের ছেলের মুখে হাসি দেখে তারাও খুশি হলেন। তাদের বাড়িতে আবার শান্তি ফিরে এল, এবং পারিবারিক সম্পর্ক আরও মজবুত হলো। একদিন রিমি তাকে ফোন করল। আকাশ অবাক হল। “কেমন আছো?” রিমি জানতে চাইল। আকাশ তার পরিবর্তনের কথা বলল, কীভাবে সে নিজেকে ডিজিটাল জাল থেকে মুক্ত করেছে, কীভাবে সে তার জীবনের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছে এবং কীভাবে সে এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করছে। রিমি সব শুনে হাসল। “আমি জানতাম তুমি পারবে। আমি তোমার এই পরিবর্তন দেখে খুব খুশি,” রিমি বলল। তাদের মধ্যে আবার নতুন করে কথা শুরু হলো, এবার আর কোনো ফোনের স্ক্রিন তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াল না। তারা আবার নতুন করে তাদের সম্পর্ককে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, এবার আরও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, যেখানে পারস্পরিক সম্মান, মনোযোগ এবং ভালোবাসাই ছিল মূল ভিত্তি। তাদের সম্পর্ক যেন নতুন জীবন পেল, এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। আকাশ জানত, ডিজিটাল দুনিয়াকে পুরোপুরি বর্জন করা সম্ভব নয়, আর তা উচিতও নয়। কারণ এই দুনিয়াতে অনেক ভালো জিনিসও আছে, যেমন তথ্য, জ্ঞান, এবং দূরের মানুষের সাথে যোগাযোগ। সে এখন ফোন ব্যবহার করে, তবে তা তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় না। সে এখন জানে, আসল জীবনটা স্ক্রিনের ওপরে নয়, বরং তার চারপাশে থাকা মানুষ, প্রকৃতি, এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে। ডিজিটাল জাল থেকে মুক্ত হয়ে আকাশ যেন নতুন করে বাঁচার স্বাদ পেল, এক সত্যিকারের, সম্পূর্ণ জীবনের। সে এখন একজন সচেতন ব্যবহারকারী, যে জানে কখন স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বাস্তব জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় এবং কীভাবে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হয়, chứ এর দাস হয়ে বেঁচে থাকতে হয় না। তার এই যাত্রা শুধু একটি আসক্তি থেকে মুক্তি নয়, বরং নিজের সত্তাকে নতুন করে আবিষ্কার করার এক অনুপ্রেরণামূলক গল্প, যা তাকে শিখিয়েছিল জীবনের মূল্যবোধ এবং সম্পর্কের গুরুত্ব। সে এখন একজন পরিপূর্ণ মানুষ, যে ডিজিটাল দুনিয়ার সুবিধা গ্রহণ করে, কিন্তু তার ফাঁদে পা দেয় না। তার জীবন এখন আরও অর্থপূর্ণ, আরও সমৃদ্ধ, এবং সত্যিকারের সুখ ও শান্তিতে ভরপুর।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion