মেঘে ঢাকা স্বপ্নের পথে: হিমালয়ের এক অবিস্মরণীয় যাত্রা
শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের জঙ্গল থেকে দূরে, হিমালয়ের কোলে এক নতুন জীবনের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল হিমালয়ের বুকে হেঁটে চলার, তার বিশালতা আর নীরবতার মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতেই অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, যখন কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের ট্রেকিং দলের যাত্রা শুরু হলো অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের (ABC) উদ্দেশে। মনে এক অদ্ভুত শিহরণ, অজানা এক রোমাঞ্চ আর প্রকৃতির বিশালতার সামনে নিজেকে সমর্পণের এক গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্লেন থেকে নামতেই হিমালয়ের শীতল বাতাস যেন স্বাগত জানাল, আর দূরের মেঘে ঢাকা চূড়াগুলো হাতছানি দিচ্ছিল এক অদেখা রাজ্যের দিকে। এ যেন এক অদৃশ্য চুম্বকের টান, যা আমাকে বারবার প্রকৃতির এই বিশালতার দিকে আকর্ষণ করছিল, এক অদম্য নেশার মতো, যা রক্তে মিশে গিয়েছিল, প্রতিটি শিরায় প্রবাহিত হচ্ছিল এক নতুন জীবনের স্পন্দন। আমার মন যেন বহু আগেই এই পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল, কেবল শরীরটাই এতদিনে তার পিছু পিছু আসতে পারল।
ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি পর্ব ছিল দীর্ঘ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ। শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মাসখানেক ধরে নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করেছিলাম। মানসিক প্রস্তুতিও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ; অজানা পথের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে তৈরি করা। অবশেষে সেই দিন এলো, যখন কাঠমান্ডুর ব্যস্ততা ছেড়ে পোখরার শান্ত পরিবেশে পৌঁছালাম। কাঠমান্ডুর ঘিঞ্জি রাস্তা, যানবাহনের হর্ন আর মানুষের কোলাহল ছেড়ে পোখরার লেকসাইডে পা রাখতেই এক অন্যরকম শান্তি অনুভব করলাম। ফেওয়া লেকের স্বচ্ছ জলে মাছাপুছরের প্রতিচ্ছবি, আর দূরের পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন এক ভিন্ন জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেখানে একদিন বিশ্রাম নিয়ে শরীরকে আসন্ন চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করলাম। লেকের ধারে বসে সূর্যোদয় দেখা, পাখির কলতান শোনা আর ঠান্ডা বাতাসে গা ভাসানো – এই সবকিছুই যেন আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মনকে আরও চাঙ্গা করে তুলছিল। ভোরের আলোয় লেকের শান্ত জলে নৌকার সারি আর দূরের পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম সূর্যের সোনালী আভা এক অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতি তার নিজস্ব তুলি দিয়ে এক বিশাল ক্যানভাসে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে।
পোখরার লজে আমাদের ট্রেকিং দলের বাকি সদস্যদের সাথে পরিচয় হলো। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ, সবার চোখে একই স্বপ্ন – হিমালয়কে ছুঁয়ে দেখা। স্থানীয় গাইড, শেরপা এবং পোর্টারদের সাথেও পরিচয় হলো, যারা আমাদের এই কঠিন যাত্রার সঙ্গী হবেন। তাদের অভিজ্ঞ চোখ, রোদে পোড়া মুখ আর আত্মবিশ্বাসী হাসি আমাদের মনে সাহস জোগালো। গাইড আমাদের ট্রেকিং রুট, সম্ভাব্য বিপদ এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। তিনি আমাদের আক্লিমাটাইজেশনের গুরুত্ব বোঝালেন এবং উচ্চতাজনিত অসুস্থতা (AMS) এড়াতে ধীর গতিতে হাঁটার পরামর্শ দিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন, “ধীরে চলুন, প্রকৃতির সাথে মিশে যান, তাড়াহুড়ো করবেন না। পাহাড় আপনাকে সময় দেবে, আপনিও পাহাড়কে সময় দিন। প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি পদক্ষেপ সচেতনভাবে নিন।” তার কথাগুলো যেন এক মন্ত্রের মতো আমাদের কানে বাজছিল। আমরা আমাদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন ট্রেকিং পোল, উষ্ণ পোশাকের স্তর (লেয়ারিং), ফার্স্ট এইড কিট (ব্যথা কমানোর ঔষধ, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, উচ্চতাজনিত অসুস্থতার ঔষধ), পর্যাপ্ত শুকনো খাবার যেমন এনার্জি বার, বাদাম, চকোলেট, জলের বোতল এবং একটি ওয়াটার ফিল্টার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা নিশ্চিত করলাম। প্রতিটি ছোট জিনিস যেন এই দীর্ঘ যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, কারণ একবার পাহাড়ে উঠে গেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া কঠিন, আর প্রতিটি ভুল পদক্ষেপের মূল্য হতে পারে অনেক বেশি, এমনকি জীবনও।
পরদিন সকালে জিপে করে নয়াপুল পর্যন্ত যাত্রা। কাঁচা-পাকা রাস্তা, দুপাশে সবুজের সমারোহ আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি নদীর কলকল ধ্বনি এক অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছিল। জিপের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতেই যেন শহরের ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছিল। ছোট ছোট গ্রাম, বাঁশের তৈরি সেতু, আর পাহাড়ি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আমাদের মুগ্ধ করছিল। প্রতিটি বাঁকে নতুন দৃশ্য, নতুন গন্ধ, নতুন শব্দ। বাতাসের সাথে মিশে আসছিল ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, আর দূর থেকে ভেসে আসছিল মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি। নয়াপুল পৌঁছে জিপ থেকে নামতেই এক তাজা বাতাসের স্পর্শ পেলাম, যা ফুসফুসকে সতেজ করে তুলল। এখান থেকেই শুরু হলো আসল ট্রেকিং। আমাদের পোর্টাররা আমাদের ভারী ব্যাগগুলো পিঠে তুলে নিলেন, তাদের পেশীবহুল শরীর দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা এই বোঝা বহন করার জন্যই তৈরি।
প্রথম কয়েক কিলোমিটার পথ ছিল সবুজ ধানক্ষেত আর ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে। বাতাসের মাটির সোঁদা গন্ধ, পাখির কিচিরমিচির আর ঝরনার একটানা শব্দ এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিচ্ছিল। গ্রামের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম, শিশুরা খেলছে, তাদের গালে লেগে আছে ধুলো আর হাসি, নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজ করছে, কেউ কাপড় ধুচ্ছে, কেউ লাকড়ি সংগ্রহ করছে, আর পুরুষরা ক্ষেতে কাজ করছে। তাদের সরল জীবনযাত্রা, তাদের আন্তরিক হাসি, আর শিশুদের কৌতূহলী চাহনি আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। তাদের চোখে ছিল এক অদ্ভুত সারল্য আর কৌতূহল, যা শহরের শিশুদের চোখে বিরল। তারা তাদের ছোট্ট বাড়িগুলোর সামনে বসে সূর্যাস্তের সোনালী আলোয় পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখতে দেখতে গল্প করছিল, যা এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল। সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছিল, তখন পাহাড়ের চূড়াগুলো সোনালী রঙে ঝলমল করছিল, যেন প্রকৃতির এক বিশাল ক্যানভাসে কেউ তুলি দিয়ে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম দিনের ট্রেকিং শেষে আমরা একটি স্থানীয় লজে রাত কাটালাম। কাঠের তৈরি ছোট্ট ঘর, গরম স্যুপ আর স্থানীয় খাবারের স্বাদ ছিল অসাধারণ। ডাল-ভাত, তরকারি আর গরম গরম রুটি – এই সাধারণ খাবারগুলোই যেন এক রাজকীয় ভোজের মতো মনে হচ্ছিল, কারণ সারাদিনের পরিশ্রমে ক্ষুধাও ছিল তীব্র। দিনের শেষে উষ্ণ চা আর সহযাত্রীদের সাথে গল্পে মেতে ওঠা – এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই যেন এই যাত্রাকে আরও স্মরণীয় করে তুলছিল। লজের মালিকের আতিথেয়তা আর তাদের সহজ জীবনযাপন আমাদের মুগ্ধ করেছিল। তারা আমাদের সাথে তাদের জীবনের গল্প ভাগ করে নিচ্ছিলেন, যা আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করছিল।
পথ যত উপরের দিকে উঠতে লাগল, প্রকৃতি ততই তার রূপ বদলাতে শুরু করল। প্রথম দিকে ছোট ছোট ঝোপঝাড় আর সাধারণ গাছপালা থাকলেও, ধীরে ধীরে ঘন জঙ্গল, সুউচ্চ পাইন গাছের সারি, আর রডোডেনড্রনের লাল-গোলাপি ফুল পথের দুপাশে এক অপরূপ শোভা ছড়াচ্ছিল। এই রডোডেনড্রনগুলো যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা কোনো চিত্রকর্ম, যা আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। বসন্তকালে এই ফুলগুলো যখন পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, তখন পুরো পাহাড় যেন লাল-গোলাপি রঙে সেজে ওঠে, এক জাদুকরী দৃশ্যের অবতারণা করে। দিনের বেলায় সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছিল, আর রাতের বেলায় তারাদের মেলা বসত মাথার উপরে। মাঝে মাঝে দেখা মিলছিল পাহাড়ি ঝরনার, যার শীতল জল আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিত এবং পিপাসা মেটাতো। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন প্রকৃতির নতুন কোনো রহস্য উন্মোচিত হচ্ছিল। পাখির গান, ঝরনার শব্দ আর বাতাসের ফিসফিসানি যেন এক প্রাকৃতিক সিম্ফনি তৈরি করছিল, যা আমাদের কানে বাজছিল। পথের ধারে ছোট ছোট বৌদ্ধ স্তূপ আর প্রার্থনা পতাকাগুলো যেন আধ্যাত্মিকতার এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করছিল। এই পতাকাগুলো বাতাসে উড়ে এক পবিত্র বার্তা বহন করছিল, যা আমাদের মনকে শান্ত ও স্থির করে তুলছিল, যেন প্রতিটি পতাকার দোলায় কোনো প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে, যা মনের গভীরে শান্তি এনে দিচ্ছিল।
ট্রেকিংয়ের পথে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল খাড়া চড়াইগুলো। বিশেষ করে উল্লেরি থেকে ঘোরোপানি পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ ধাপের সিঁড়ি ভেঙে ওঠা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। প্রতিটি ধাপ যেন আমাদের শারীরিক ও মানসিক ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল। পায়ের পেশিগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছিল, আর বুক ধড়ফড় করছিল, হৃদপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু মনের জোর ছিল অটুট। সহযাত্রীদের একে অপরের প্রতি অনুপ্রেরণা আর গাইডদের উৎসাহবাণী আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করছিল। “আর মাত্র কয়েকটা ধাপ!”, “প্রায় চলে এসেছি!”, “উপরে অসাধারণ দৃশ্য অপেক্ষা করছে!”—এই কথাগুলোই যেন আমাদের শক্তি জোগাচ্ছিল। যখন ঘোরোপানিতে পৌঁছালাম, তখন ক্লান্তি ভুলে গেলাম। ঘোরোপানির ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়ের সময় যখন ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা সাউথ, এবং মাছাপুছরের চূড়াগুলো প্রথম সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল, সেই দৃশ্য ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। বরফের সাদা চাদর যেন সোনালী আভায় ঝলমল করছিল, যা জীবনে দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতির এক বিশাল ক্যানভাসে কেউ তুলি দিয়ে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে, আর সেই রঙের ছটায় পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। ঠান্ডা বাতাসেও যেন এক উষ্ণ অনুভূতি হচ্ছিল, যা এই অসাধারণ দৃশ্যের কারণে। এই দৃশ্য দেখার পর মনে হলো, এই কষ্ট সার্থক, প্রতিটি ঘামের ফোঁটা যেন এক একটি হীরার মতো মূল্যবান, যা এই অভিজ্ঞতার মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘোরোপানিতে আমরা এক রাত কাটালাম, এবং পরদিন সকালে পুন হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য আরও আগে ঘুম থেকে উঠলাম। পুন হিলের চূড়ায় পৌঁছাতে আরও প্রায় এক ঘণ্টা খাড়া চড়াই ভাঙতে হলো, কিন্তু সেখানকার দৃশ্য ছিল কল্পনাতীত। চারপাশের ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক ভিউতে হিমালয়ের একাধিক চূড়া যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল, তাদের বিশালতা আর মহিমা নিয়ে।
পুন হিলের চূড়ায় পৌঁছানোর পর যে দৃশ্য দেখলাম, তা আমার সারা জীবনের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে। ভোর রাতের অন্ধকারে যখন আমরা চূড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কেবল আমাদের টর্চের আলো আর সহযাত্রীদের ফিসফিসানি ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না। আকাশে তারাদের মেলা, যা এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া যাবে। চূড়ায় পৌঁছেই আমরা পূর্ব দিগন্তে চোখ রাখলাম। ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করল। প্রথমে হালকা নীল, তারপর গোলাপী, কমলা এবং অবশেষে সূর্যের সোনালী আভা পুরো আকাশকে রাঙিয়ে তুলল। ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা রেঞ্জ, মাছাপুছরে, হিঁউচুলি এবং অন্যান্য অসংখ্য চূড়া যেন একে একে জেগে উঠছিল সূর্যের প্রথম কিরণে। বরফের সাদা চূড়াগুলো প্রথমে হালকা গোলাপী, তারপর সোনালী এবং সবশেষে উজ্জ্বল সাদা রঙে ঝলমল করে উঠল। এই দৃশ্য এতটাই পরাবাস্তব ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন আমি কোনো স্বপ্নের জগতে চলে এসেছি। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, কিন্তু এই দৃশ্যের উষ্ণতা আমাদের মনকে ভরে দিচ্ছিল। আমরা সবাই নীরব হয়ে প্রকৃতির এই মহিমা উপভোগ করছিলাম, যেন কোনো পবিত্র মুহূর্তে আমরা উপস্থিত। এই নীরবতা ছিল এক গভীর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষ একাকার হয়ে গিয়েছিল।
উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে অক্সিজেনের অভাব অনুভব হতে শুরু করল। শ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল, মাথা হালকা লাগছিল, শরীর কিছুটা দুর্বল মনে হচ্ছিল, কখনো কখনো সামান্য মাথা ব্যথাও অনুভব হচ্ছিল, কিন্তু হিমালয়ের আকর্ষণ এতটাই তীব্র ছিল যে কোনো বাধাই আমাদের আটকাতে পারছিল না। আমরা ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম, ঘন ঘন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, আর পর্যাপ্ত জল পান করছিলাম। গাইড আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ধীরে চলার জন্য এবং শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দিতে। তিনি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক কৌশল শিখিয়ে দিলেন, যা উচ্চতায় হাঁটার জন্য খুবই জরুরি – গভীর শ্বাস নেওয়া এবং ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়া। প্রতিটি বাঁকে নতুন দৃশ্য, নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল। মাচাপুছরে বেস ক্যাম্পের দিকে যেতে যেতে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মেঘের দল যেন আমাদের চারপাশে খেলা করছিল, মনে হচ্ছিল যেন মেঘের সমুদ্রে আমরা ভাসছি, আর পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন দ্বীপের মতো মেঘের উপরে ভেসে আছে। এই দৃশ্য আমাদের মনকে এক অন্যরকম প্রশান্তি দিচ্ছিল, যা শহরের কোলাহলে কখনো পাওয়া যায় না। পথের ধারে দেখা মিলছিল কিছু বন্যপ্রাণীর, যেমন হিমালয়ান থার বা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, যা এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। কখনো কখনো দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল ইয়াকের ঘণ্টা ধ্বনি, যা এই পাহাড়ি পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর তাদের শান্ত পদচারণা যেন পাহাড়ের নীরবতাকে আরও গভীর করে তুলছিল। পথ চলতে চলতে আমরা বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, ফুল এবং পাখির সাথে পরিচিত হলাম, যা এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের এক অসাধারণ নিদর্শন।
পুন হিল থেকে নেমে আসার পর আমরা মাচাপুছরে বেস ক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পথ আরও দুর্গম হতে শুরু করল। পাইন গাছের ঘন জঙ্গল ধীরে ধীরে বিরল হতে লাগল, আর তার বদলে দেখা দিল আলপাইন তৃণভূমি। তাপমাত্রা আরও কমে গিয়েছিল, আর বাতাসের আর্দ্রতাও ছিল কম। প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা যেন প্রকৃতির আরও গভীরে প্রবেশ করছিলাম। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বরফের টুকরো দেখা যাচ্ছিল পথের ধারে, যা উচ্চতার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এই পথে ট্রেকারদের সংখ্যাও কমে গিয়েছিল, যার ফলে এক অদ্ভুত নির্জনতা আর শান্তি অনুভব করছিলাম। এই নির্জনতা আমাদের নিজেদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছিল, নিজেদের ভেতরের শক্তিকে আবিষ্কার করার সুযোগ দিচ্ছিল।
মাচাপুছরে বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর আমরা এক রাত কাটালাম। এখানকার তাপমাত্রা আরও কমে গিয়েছিল, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা যেন প্রতিটি লোমকূপকে স্পর্শ করছিল, কিন্তু চারপাশের দৃশ্য ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর। মাছাপুছরে চূড়া, যা ‘ফিশটেইল’ নামে পরিচিত, তার অদ্ভুত সুন্দর আকৃতি নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল। চাঁদনী রাতে এর উপর চাঁদের আলো পড়ে এক রূপালী আভা তৈরি করছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো দেবভূমি, যেখানে দেবতারা বাস করেন। এখানকার লজের ভেতরে গরম চা আর মোমো খেয়ে শরীরকে কিছুটা চাঙ্গা করে নিলাম। মোমোর ধোঁয়া আর গরম চায়ের কাপের উষ্ণতা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি দিচ্ছিল, যা ঠান্ডার প্রকোপ কমিয়ে দিচ্ছিল। লজের ভেতরে অন্যান্য ট্রেকারদের সাথে গল্প করা, তাদের অভিজ্ঞতা শোনা – এই সবকিছুই যেন এই যাত্রাকে আরও সমৃদ্ধ করছিল। পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগে আমরা চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। অন্ধকার পথ, মাথার উপরে তারাদের আলো আর হাতে টর্চলাইট নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সতর্কতার সাথে, কারণ বরফে ঢাকা পথ ছিল পিচ্ছিল এবং যেকোনো মুহূর্তে পা পিছলে যাওয়ার ভয় ছিল। গাইডরা সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছিলেন, আর আমরা তাদের অনুসরণ করছিলাম, তাদের অভিজ্ঞতার উপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এলো, যখন আমরা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে পৌঁছালাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪১৩৯ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই স্থানটি যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে এসেছিল। চারপাশে বরফে মোড়া বিশাল পর্বতমালা, অন্নপূর্ণা, মাছাপুছরে, হিঁউচুলির মতো চূড়াগুলো আমাদের ঘিরে রেখেছিল। সেই মুহূর্তে মনে হলো, এতদিনের কষ্ট, এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। হিমালয়ের বিশালতা আর নীরবতা আমাদের মনকে শান্ত করে দিল। ঠান্ডা বাতাস আর বরফের স্ফটিকের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা প্রকৃতির এক অবিস্মরণীয় রূপ দেখলাম। সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছিল, তখন চূড়াগুলো রক্তিম আভায় ঝলমল করছিল, যা এক অলৌকিক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল। বেস ক্যাম্পের ছোট্ট লজগুলো বরফের মাঝে যেন এক আশ্রয়স্থল। লজের ভেতরে কাঠের আগুনে শরীর গরম করা আর গরম চা পান করা – এই সাধারণ বিষয়গুলোই যেন পরম আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছিল। বেস ক্যাম্পের চারপাশের নীরবতা এতটাই গভীর ছিল যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের সাথে কথা বলছে, তার প্রাচীন রহস্যগুলো ফিসফিস করে বলছে।
বেস ক্যাম্পে রাত কাটানো ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। প্রচণ্ড ঠান্ডা, যা হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তারার ঝলমলে আকাশ আর হিমালয়ের নীরবতা এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিয়েছিল। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গিয়েছিল, কিন্তু উলের টুপি, গ্লাভস আর স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতা আমাদের রক্ষা করছিল। রাত যত গভীর হচ্ছিল, তারারা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল যেন মহাবিশ্বের সব তারা আমাদের মাথার উপরে নেমে এসেছে, আর আমরা তাদের সাথে কথা বলতে পারছি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। এই তারার মেলা দেখে মনে হলো, আমরা কত ক্ষুদ্র এই বিশাল মহাবিশ্বে, আর আমাদের সমস্যাগুলো কত তুচ্ছ। পরের দিন সকালে সূর্যোদয়ের সময় বরফে ঢাকা চূড়াগুলো যখন কমলা রঙে সেজে উঠল, তখন সেই দৃশ্য ক্যামেরা নয়, শুধু চোখ দিয়েই ধারণ করার মতো ছিল। প্রতিটি চূড়া যেন এক একটি হীরার মতো ঝলমল করছিল, আর আমরা সেই সৌন্দর্যের সাক্ষী ছিলাম। সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন বরফের উপর পড়ছিল, তখন তা হাজারো রঙে ঝলমল করে উঠছিল, যা এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখার পর মনে হলো, জীবনের সব চিন্তা, সব চাপ যেন এই মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেছে, শুধু বর্তমান মুহূর্তের সৌন্দর্যই একমাত্র সত্য। এই নির্জনতা আর বিশালতা যেন আমাদের আত্মাকে এক নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
ফিরে আসার পথে মনটা কিছুটা ভারাক্রান্ত ছিল। হিমালয় তার বিশালতা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছে বিনয়, তার নীরবতা শিখিয়েছে আত্মদর্শন, আর তার সৌন্দর্য শিখিয়েছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। এই ট্রেকিং শুধু একটি শারীরিক যাত্রা ছিল না, এটি ছিল আত্মার এক অন্বেষণ। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি দৃশ্য আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে আমরা যেন নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেছি। নিচে নামার সময় আমরা আরও অনেক নতুন দৃশ্যের সাক্ষী হলাম, যা উপরে ওঠার সময় হয়তো তাড়াহুড়োতে চোখে পড়েনি। স্থানীয় গ্রামগুলোতে আবার ফিরে আসা, সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলা, তাদের জীবনযাত্রা দেখা – এই সবকিছুই যেন এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখতে শিখিয়েছিল। তাদের সরল জীবন, প্রকৃতির সাথে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক – এই সবকিছুই যেন আমাদের শহুরে জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তি দিচ্ছিল, এক নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছিল। তাদের মুখে হাসি, চোখে শান্তি আর অতিথিপরায়ণতা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
কাঠমান্ডু ফিরে আসার পর শহরের কোলাহল আর ব্যস্ততা আবার ঘিরে ধরল, কিন্তু হিমালয়ের স্মৃতি আমাদের মনে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। হিমালয় শুধু একটি পর্বতশ্রেণী নয়, এটি একটি অনুভূতি, একটি অভিজ্ঞতা, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে। এই ট্রেকিং আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে হয়, কীভাবে নিজের ভেতরের শক্তিকে আবিষ্কার করতে হয়, আর কীভাবে ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে দেখতে হয়। হিমালয় আমাদের শুধু একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দেয়নি, এটি আমাদের জীবনদর্শনকেই বদলে দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো প্রায়শই সবচেয়ে কঠিন পথ পেরিয়ে আসে, এবং সেই পথ পাড়ি দেওয়ার আনন্দই জীবনের আসল সার্থকতা। এই যাত্রা আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা আমাকে প্রকৃতির প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল এবং জীবনের প্রতি আরও কৃতজ্ঞ করে তুলেছে। হিমালয়ের প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঝরনা যেন এক একটি গল্প বলছিল, আর আমি সেই গল্পের অংশ হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এই স্মৃতিগুলো জীবনের বাকিটা পথ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে, যখনই আমি জীবনের কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব, তখনই এই হিমালয়ের স্মৃতি আমাকে সাহস জোগাবে, মনে করিয়ে দেবে যে, যদি আমি হিমালয় জয় করতে পারি, তাহলে জীবনের যেকোনো বাধাকেও অতিক্রম করতে পারব। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে, জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সরলতায়, প্রকৃতির সাথে একাত্মতায়, আর নিজের ভেতরের শক্তিকে আবিষ্কার করার মধ্যে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion