Episode 12464 words0 views

প্রেত বাড়ির শেষ রাত

  ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কলকাতা শহর তখন ধীরে ধীরে শহুরে ব্যস্ততায় ডুবে যাচ্ছে, আর সেই ব্যস্ততা থেকে পালিয়ে ইতিহাস গবেষক প্রতীক মুখার্জি পাড়ি দিলেন নদিয়ার এক অখ্যাত গ্রামে — নাম শিউলি। প্রতীক কোনও সাধারণ পর্যটক ছিলেন না। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা এই যুবক ইতিহাসের রহস্যময় অধ্যায়ে ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় কলকাতার এক পুরনো গ্রন্থাগারে খুঁজে পান ১৯৪৮ সালের জমিদার হরিশংকর রায়ের প্রাসাদের একটি বিবরণ। লেখাটা অসম্পূর্ণ, কিন্তু সেখানে উল্লেখ ছিল – “এ বাড়ি এখন নিষিদ্ধ। যারা ফিরে যায়, তারা আর আগের মতো থাকে না।” এই বাক্যটাই যেন আগুন ধরাল প্রতীকের কৌতূহলে। এই ইতিহাস তাকে ডাকে, এক অন্যরকম টান অনুভব করেন তিনি। শিউলি গ্রামে পৌঁছাতে গিয়ে তার প্রথম ধাক্কা লাগে লোকজনের মুখে। কেউ কথাই বলতে চায় না দক্ষিণেশ্বর বাড়ি নিয়ে। একটা চাপা ভয়, একটা অনুচ্চারিত ইতিহাস যেন পুরো গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে আছে। তবে এক বৃদ্ধা, নাম কমলা পিসি, তাকে চুপিসারে ডেকে নিয়ে বলে — “তুই ওই বাড়ির খোঁজ করছিস? শোন, তুই যেই হস, ওই বাড়ির মধ্যে গেলেই তোর ছায়া আর তোর কথা শুনবে না। আয়না তোর মুখ দেখাবে না। ফিরে আসবি না।” প্রতীক হাসলেন। ভৌতিক গল্পে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ভাবনা ছিল — “ভয় মানুষ নিজেই বানায়।” সে রাতেই তিনি দক্ষিণেশ্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিশাল প্রাসাদ, কাটা কাঁঠালের মতো ছিন্ন জানালা, ভাঙা দরজা, আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। দুপুরের আলোতেও বাড়িটা যেন অন্ধকার। প্রতীক জানতেন না, তিনি শুধু একটা ইতিহাসের খোঁজে আসেননি, বরং নিজেই সেই ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছেন। দক্ষিণেশ্বর বাড়িতে প্রবেশের আগে প্রতীক আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রামের একমাত্র “বিশ্রামকুটির” নামে পরিচিত কাঠের কুটিরে, যা স্থানীয় পঞ্চায়েত ঘর হিসেবেও ব্যবহৃত হত। একজন বৃদ্ধ, নাম চঞ্চল কাকু, সেখানে রাত্রিযাপন করতেন এবং মাঝে মাঝে বাইরের মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। প্রতীকের কথা শুনে চঞ্চল কাকুর চোখ মুখ থমকে গেল। “তুমি কি বলছ, তুমি ওই দক্ষিণেশ্বর বাড়িতে ঢুকবে?” প্রতীক দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ কাকু। ইতিহাসের জন্য… আমি জানি ওটা বিপজ্জনক শুনতে লাগে, কিন্তু এসব শুধু লোককথা।” চঞ্চল ধীরে ধীরে ঘরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “তুমি জানো? আমার ছোটোবেলায় ওই বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছি। জমিদারবাবুর বাজনা, নাচগান, উৎসব। আর তারপর হঠাৎ এক রাতেই সব শেষ। পঁচিশ জন লোক এক রাতেই হাওয়া হয়ে গেল। পুলিশ কিছুই খুঁজে পেল না। বাড়িটা সিল করে দেওয়া হল।” তিনি থেমে গেলেন। কিছু একটা যেন বলতে চাইছেন কিন্তু সাহস পাচ্ছেন না। তারপর নিচু গলায় বললেন, “হরিশংকর রায়ের মেয়ে ছিল সৌম্যশ্রী। সবাই বলত — দেবীর মতো সুন্দরী, কিন্তু চোখে ছিল শূন্যতা। একটা গুজব ছিল… জমিদার তাকে বলি দিতে চেয়েছিলেন।” প্রতীক বিস্মিত হয়ে চঞ্চলের দিকে তাকালেন। চঞ্চল বললেন, “অনেকে বলে, সেই রাতে ঘরে আগুন লেগেছিল। কেউ বলে সৌম্যশ্রীর আত্মা রক্ষা চেয়েছিল। কেউ বলে, সে নিজেই সকলকে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু বাড়িটার ভিতরে কী ঘটেছিল, কেউ জানে না।” প্রতীক হেসে ফেলে বললেন, “তাহলে তো এটা একদম পারফেক্ট ‘কেস স্টাডি’। আমি কালই ওখানে যাবো।” চঞ্চল হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, যদি যাও, একটা কথা মনে রেখো — রাত দশটার পর জানলা খুলে রাখো না। আয়নার সামনে দাঁড়িও না। আর সবচেয়ে বড় কথা — যদি তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে, কখনো ফিরেও তাকিও না।” সন্ধ্যা। প্রতীক তার নোটবুক, হারিকেন, ক্যামেরা ও রেকর্ডার ব্যাগে ভরে দক্ষিণেশ্বর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। জায়গাটা যেন অন্ধকার চুষে নিচ্ছিল। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছিল বড় বড় কালো চিলেরা ওড়াউড়ি করছে। রাস্তায় একটা মানুষ নেই, যেন পুরো গ্রাম রাত আটটার মধ্যেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে পৌঁছাতে গিয়ে তিনি থমকে গেলেন। ভাঙা ফটকের উপর ঝুলছে মরচে ধরা লোহার তক্তি — “অভিশপ্ত অঞ্চল। প্রবেশ নিষেধ।” তবে প্রতীক থামলেন না। দরজার ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। বাড়ির মেঝে জঙ্গলে ঢেকে গেছে। কাঠের সিঁড়িগুলো ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। দেয়ালে দেওয়ালচিত্রের আধছেঁড়া অংশ, আর আয়নাগুলো সব মলিন। প্রতীক হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরের একটি কোণে বসে পড়লেন, রেকর্ডার অন করলেন। রাত তখন ঠিক ৯টা ৫৫। তিনি বললেন, “রাতের প্রথম পর্যবেক্ষণ শুরু করছি। কোনো অস্বাভাবিক শব্দ বা চলাফেরা এখনো চোখে পড়েনি…” ঠিক তখনই, একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল। হারিকেনের আলো নড়ে উঠল। দেয়ালের আয়নার দিকে তাকাতেই তাঁর গায়ে কাঁটা দিল। আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে না তাঁর নিজের চেহারা। প্রতীক কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মলিন পুরনো আয়নাটার দিকে। হারিকেনের আলোয় দেওয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে, কিন্তু আয়নার মধ্যে তাঁর প্রতিফলন নেই। বরং এক মুহূর্তের জন্য তিনি মনে করলেন, আয়নার ভেতরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে — কোনো কুয়াশামানুষের মতো ধোঁয়াটে অবয়ব। তিনি জোরে চোখ মুছে আবার তাকালেন — কিছু নেই। নিজেকে বোঝালেন — “ভ্রম। হয়তো আলোর খেলা।” কিন্তু হারিকেনের ফ্লেম হঠাৎ আবার এক ঝাঁকুনিতে নিভে গেল। ঘর ভরে গেল ঘন আঁধারে। তিনি পকেট থেকে টর্চ বার করে জ্বালালেন — আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তখনই তিনি স্পষ্ট শুনলেন — “প্রতীক…” একটা নারীকণ্ঠ। চাপা কিন্তু আশ্চর্যভাবে পরিচিত। তিনি চমকে উঠে পেছনে তাকালেন। কেউ নেই। কণ্ঠটা আবার এল — “প্রতীক… জানো তো আমি কে?” শীতলতা যেন ঘরের তাপমাত্রা কেড়ে নিচ্ছিল। প্রতীক দৌড়ে বাইরে বারান্দায় এলেন। বাইরে পেঁচার ডাক, গাছের পাতার শব্দ, আর দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার দল। কিন্তু অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন — চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা। হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন বাড়ির ভিতরে হাঁটছে। ধীর, ভারী পদচিহ্নের শব্দ। তাঁর রেকর্ডার তখনও চলছিল, ঘরের মধ্যে পড়ে। তিনি সাহস সঞ্চয় করে আবার ভিতরে ঢুকলেন। নিজের রেকর্ডার হাতে তুলে শুনলেন — তাঁর নিজের আওয়াজের মাঝে মাঝেই একটা ফিসফিসে কণ্ঠ — “ওই আয়নার দিকে আর তাকিও না… ওটা আর আয়না নেই…” ঘড়িতে তখন রাত ১২টা বেজে ৭ মিনিট। দেয়ালের এক কোণে একটি দাগ চোখে পড়ল — দেখতে একেবারে হাতের ছাপের মতো। আঙুলগুলো ছিল লম্বাটে, পাতলা, যেন মানুষের নয়। নিচে এক লাইন লেখা — “সে এখন ঘুমোচ্ছে না। সে তোমার কথা জানে।” প্রতীক ঠিক করলেন, তিনি এখানেই রাত কাটাবেন। একটা সুরক্ষিত ঘর খুঁজে ভিতরে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লেন। টেবিলের উপর ডায়েরি খুলে লিখতে লাগলেন সব ঘটনা। তার কলম কাঁপছে। ঠিক তখনই, জানলার বাইরে আচমকা কী যেন পড়ল। যেন কেউ ছাদ থেকে ঝাঁপ দিল। তিনি জানলার কাছে গেলেন, তাকালেন বাইরে — কিছুই নেই। কিন্তু জানলার কাঁচে তখন স্পষ্ট ভেসে উঠছে একটি হাতের ছাপ। অন্ধকারের মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি। চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু যেন চেয়ে আছে সোজা তাঁর দিকেই। তারপর একটি শব্দ ভেসে এল খুব ধীরে — “আমার ঘুম ভেঙে দিলে কেন?” রাত কেটে গেল অস্থির অপেক্ষায়। ভোরের আলো ফোটার আগে প্রতীক কোনোভাবেই চোখ বন্ধ করতে পারেননি। মেঝের ধুলো, ছাদের খসে পড়া চুন, জানালার বাইরে কারা যেন সারারাত হেঁটে বেড়াচ্ছে — এই শব্দগুলি এক মুহূর্তের জন্যও স্তব্ধ হয়নি। সকালবেলা, এক কাপ চা বা কারো কণ্ঠের সান্ত্বনা পেলে প্রতীক হয়তো নিজেকে একটু সামলাতে পারতেন। কিন্তু দক্ষিণেশ্বর বাড়িতে সেই সুযোগ ছিল না। তিনি শুধু একটি জিনিস জানতেন — সত্য জানতে হবে। দোতলার দক্ষিণ কোণার ঘরটিতে তিনি প্রবেশ করলেন, যেটি হয়তো জমিদার হরিশংকর রায়ের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। ঘরজুড়ে বইয়ের পোকা, ছেঁড়া খাতা, আর মাঝেমাঝে ছিঁড়ে যাওয়া কাগজের পাতা উড়ছে। দেয়ালের এক কোণে পাথরের আলমারির ভেতর ছোট্ট একটি কাঠের বাক্স খুঁজে পেলেন তিনি। ধুলোর স্তর সরিয়ে, ভেতরে খুঁজে পেলেন একটি কালো চামড়ার মোড়ানো পুরনো ডায়েরি। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা: “এই বাক্যে যে অভিশাপ লেখা আছে, সে কেউ নয় — আমি নিজেই।” — সৌম্যশ্রী রায় প্রতীকের হাত কেঁপে উঠল। কৌতূহল আর আতঙ্ক একসাথে তার বুকে ঢেউ তুলল। তিনি পড়া শুরু করলেন। ডায়েরির পাতাগুলো থেকে: (তারিখ নেই) “আজ বাবা বললেন, আমার ভাগ্য বড় হবে। তিনি দেবতাদের আহ্বান জানাচ্ছেন। আমি জানি না কেন, তাঁর চোখে একটা উন্মাদনা। মা অনেকবার নিষেধ করেছিলেন তাঁকে — কিন্তু মা এখন কই? তিনি কথা বলেন না আর…” “বাড়ির ঘরে ঘরে এখন অচেনা লোক। ওরা মন্ত্র পড়ে, আগুন জ্বালে, আমার ঘরে কালি–ছোপ দেওয়া হয়েছে। কেউ বলছে আমি ‘উপযুক্ত’। আমি কি তবে… আমি কি তবে মানুষের মাংসের মূল্য?” “আজ রাতে তারা আমাকে বড় ঘরের মাঝখানে বসাবে। বাবা বলল, আমি যদি সহ্য করি, তবে অমরত্ব আসবে। আমি কাঁদি… কিন্তু কেউ শুনে না। বাতাস ভারী… আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে।” প্রতীক চোখ কপালে তুলে শেষ পাতাটি উল্টে দেখলেন: “যদি কেউ এই বাড়িতে আসে, তাকে সাবধান করছি — আমাকে ঘুমোতে দিও। জাগিও না। আমি এখন মাঝখানে, না জীবিত, না মৃত। যদি জাগি… তবে আমি আর আমি থাকব না।” সঙ্গে ছিল একটি আঁকা চিত্র — পেন্টাগ্রাম আকৃতির একটি মণ্ডপ, যার মাঝখানে একজন বসে আছে। মুখে নেই কোনো চেহারা — কেবল ফাঁকা চোয়াল। ডায়েরি পড়া শেষ হতে না হতেই ঘরের ভিতর বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। ছাদের উপরে যেন কারা হেঁটে বেড়াচ্ছে। জানলার বাইরে আচমকা সমস্ত পাখি উড়ে গেল একসাথে। তারপর, ঘরের এক কোণে রাখা আয়নাটি ফাটল ধরল — কিছু একটা ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে! প্রতীক পিছু হটে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল — চঞ্চল কাকু বলেছিলেন, “আয়নার দিকে তাকিও না…” তবে দেরি হয়ে গেছে। আয়নার ফাটলের মাঝে দেখা গেল একজোড়া রক্তাভ চোখ। তারপরে… একটি কণ্ঠ, এবার অনেক স্পষ্ট: “আমাকে মনে পড়ছে না? আমি সেই, যার ঘুম ভেঙে গেলে কেউ বাঁচে না…” ডায়েরি পড়ার পরে প্রতীক আর আগের মতো ছিলেন না। তাঁর মধ্যে কোথাও যেন একটা কিছু ভেঙে পড়ছিল। চিন্তার সুতোগুলো খুলে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। ভাবনার ভিতর ঢুকে পড়ছিল শূন্যতা। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন — সকাল ৯টা ১৮। কিন্তু জানলার বাইরে সূর্যের আলো নেই। পুরো বাড়ি ডুবে আছে ধূসর আলোতে, যেন সময় দাঁড়িয়ে গেছে। হঠাৎ তিনি শুনলেন নিজের পায়ের শব্দ — কিন্তু তিনি তখন বসে ছিলেন। তিনি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন, রেকর্ডার চালু করলেন। আশপাশে কিছু নেই। ঘরের এক কোনা থেকে একঝলক টান পড়ল। পর্দা উড়ে উঠল যেন কেউ সবে সরে গেল সেইখান থেকে। প্রতীক ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। আচমকা তার পেছন থেকে একটা ঠাণ্ডা হাত ধরা দিল তাঁর কাঁধে। তিনি ঘুরে তাকালেন — নিজেকেই দেখলেন দাঁড়িয়ে। সেই প্রতীকের মুখে হাসি নেই। চোখ ছিল গাঢ়, গভীর, শূন্য। ঠোঁট নড়ল। “তুই তো আমি… তবে কে দেখছে এখন?” প্রতীক পেছনে সরলেন, পা পিছলে পড়ে গেলেন মেঝেতে। ঘরের দেয়ালগুলো যেন সরে যাচ্ছে, ছাদ নিচু হয়ে আসছে, বাতাস ভারী হচ্ছে, আর তাঁর চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা। তিনি কিছুক্ষণের জন্য অচেতন হয়ে পড়ে থাকলেন। চোখ খুলে দেখলেন — নিজেকে একটা ঘরে, যেখানে দরজা নেই, জানলা নেই। চারপাশে শুধু আয়না। প্রতিটি আয়নায় নিজের চেহারা, কিন্তু একেকটা ভিন্ন। কোথাও চোখ নেই, কোথাও মুখ ফেটে গেছে, কোথাও মাথা কাটা। হঠাৎ সমস্ত আয়নার একসাথে ফাটার শব্দে চমকে উঠলেন। কিন্তু তিনি তখনও ঘুমিয়ে ছিলেন। আবার শুনলেন সেই কণ্ঠস্বর — “তুই বুঝতে পারছিস না, তুই কখন ঘুমোলি আর কখন জাগলি। আসল প্রতীক কে, সেটাই এখন প্রশ্ন।” হঠাৎ ঘরের বাইরে বাজ পড়ার শব্দে তিনি জেগে উঠলেন। তিনি নিজেকে পেলেন দ্বিতল লাইব্রেরির মেঝেতে শুয়ে, মাথার পাশে ডায়েরি। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯:১৮ — আবার। যেন সময় একই জায়গায় আটকে আছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, নিজের শরীর ছুঁয়ে দেখলেন — স্বাভাবিক। তবে দরজার বাইরে তাঁর জুতোজোড়া উল্টোভাবে রাখা। তিনি তো সেগুলো খুলে রাখেননি। এক মুহূর্তে তাঁর মনে হল — “আমি কি এখনও ঘুমিয়ে আছি? এই বাস্তব, নাকি আগেরটা?” তাঁর নোটবুকে নিজেই লিখে রেখেছিলেন একটি লাইন, মনে নেই কখন: “যদি কখনও মনে হয় তুমি ঘুমিয়ে আছো, তবে তুমি জেগে নেই।” তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন — দক্ষিণেশ্বর বাড়ির বাগানে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। দূরে একটা মূর্তির মতো বসে থাকা ছায়া, পেছন ঘুরে। তিনি ডাকলেন — “কে ওখানে?” ছায়াটা ঘুরে তাকাল না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর, সেই কণ্ঠ — “তুই জেগে আছিস না, প্রতীক। আমি তোর জায়গা নিয়েছি। আর তুই এখন আয়নার ও পাশে।” হঠাৎ সব অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে প্রতীক যেন শূন্যে ভেসে আছেন। শব্দ নেই, আলো নেই, অনুভূতিও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে ভেসে উঠল একটা নারীকণ্ঠ। নরম, মায়াবী, অথচ কোথাও যেন অদ্ভুত শীতলতা মিশে আছে। “তুই ওদের একজন হতে চাস?” “না।” — প্রতীকের মনের গভীর থেকে জবাব এল। “তাহলে কেন এলি?” “সত্য জানার জন্য।” “সত্য তো একটা অভিশাপ, প্রতীক। এখানে কেউ সত্য জানে না — সবাই নিজের ছায়া নিয়ে কথা বলে।” এক ঝলক আলো ফুটে উঠল। প্রতীক দেখতে পেলেন তিনি এখন একটা গোলঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে — ঠিক যেরকম সৌম্যশ্রীর ডায়েরিতে আঁকা ছিল। ঘরের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকৃতির ছায়ামূর্তি, মুখহীন, কেবল রক্তরঞ্জিত চোখ। মাঠের মাঝখানে বসে আছে একটা মেয়ের ছায়া — সাদা শাড়ি, খোলা চুল, মুখ নিচু করে রাখা। সামনে আগুন জ্বলছে, তার উপরে পেন্টাগ্রামের নকশা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি… সৌম্যশ্রী?” মেয়েটি মুখ তুলল। মুখভর্তি গভীর দাগ, ফাঁটা ঠোঁট, কিন্তু চোখ — তীব্র, তীক্ষ্ণ, মানুষের চোখ নয়। “আমি ছিলাম সৌম্যশ্রী। এখন আমি সেই অভিশাপ, যাকে বন্দি করা হয়েছিল প্রতিচ্ছবির মধ্যে।” “কে করেছিল?” — প্রতীক ফিসফিস করে। “আমার বাবা। তিনি চেয়েছিলেন অমরত্ব। তার জন্য চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের আত্মা বলি দিতে। কিন্তু দেবতারা তো মানুষ নয়। তারা যে আত্মা পায়, তাকেই পাথর করে দেয়।” “তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?” — প্রতীকের ঠোঁট কাঁপে। সৌম্যশ্রী উঠে দাঁড়াল। “আমি চাই না তুই মরিস, প্রতীক। আমি চাই তুই বুঝিস — এই বাড়ির ভেতর সময় থেমে আছে, কারণ আমি এখনও মুক্ত নই। আমি চাই কেউ আমাকে শেষ করুক।” “শেষ মানে?” “যে আয়নায় আমার আত্মা বন্দি, সেটা ভেঙে দে। ভাঙতে পারলে আমি মুক্ত হবো। না পারলে… তুই তোর চেহারা হারাবি। তোর চেতনা এখানেই থেকে যাবে।” প্রতীক হঠাৎ আবার জেগে উঠলেন — এবার নিজেকে পেলেন মাটির ঘরে, চারপাশে ছেঁড়া শাড়ির কাপড়, মাটির পাত্র, ধূপের গন্ধ। বাইরে সূর্যের আলো। তিনি দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন — দক্ষিণেশ্বর বাড়ি! সব আগের মতো, কিন্তু যেন কিছু একটা পাল্টে গেছে। তাঁর রেকর্ডারে ধরা পড়েছে আগের রাতের সব শব্দ: ফিসফিসানি, প্রতিধ্বনি, তার নিজের চিৎকার… আর একবার শেষে সেই কণ্ঠস্বর — “এটাই শেষ রাত… এরপর, তুই আমি হবি।” তিনি জানেন, তাঁকে সেই আয়নাটা খুঁজে বের করতে হবে। যেটা তাঁর নয়, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎ। প্রতীক এবার যেন দৌড়ে চলেছেন নিজের ছায়ার পেছনে। প্রতিটি ঘরের দেয়ালে, করিডোরে, জানলার কাচে— কোথাও না কোথাও সেই চেনা মুখটা উঁকি দিচ্ছে, এক অদ্ভুত বিকৃতিতে। হাসছে না, কাঁদছে না— শুধু দেখছে। “আমি তোকে ছেড়ে যাব না, প্রতীক।” — এই শব্দটা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাঁর মাথার ভিতর। কিন্তু তিনি জানেন, যাই হোক না কেন, সেই পুরনো আয়নাটা তাঁকে খুঁজে পেতেই হবে।   তিনি গেলেন সেই নিচতলার পেছনের ঘরে, যেখানে একবার নিজেকে হারিয়েছিলেন। এখন ঘরটা অনেক ঠাণ্ডা। মেঝেতে পায়ের ছাপ— জোড়া জোড়া। কারো একজোড়া সাধারণ, আরেক জোড়া যেন কারো হাঁটু ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া ছাপ। ঘরের মাঝখানে রাখা ছিল সেই আয়নাটা— ভাঙা, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। ফাটলের মাঝখানে কুয়াশার মতো কিছু নড়ছে। প্রতীক সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হঠাৎ তাঁর প্রতিবিম্ব যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। “তুই এত কাছে এলি, এবার ফিরে যেতে পারবি না।” “আমি জানি,” — প্রতীক ধীরে বললেন, “তোর সাথে শেষ করতে এসেছি।”   তিনি পকেট থেকে বের করলেন ডায়েরির সেই শেষ পৃষ্ঠাটি, যেখানে সৌম্যশ্রীর চিত্র আঁকা ছিল। হঠাৎ আয়নাটা ঝাঁকি খেল। কাচের ভেতর থেকে হাত বেরিয়ে এল— সেই মেয়ের হাত। রক্তমাখা, আঙুল বাঁকানো, কিন্তু কাঁপছে। সাথে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর: “আমাকে মুক্ত কর। আমি আর থাকবো না…” প্রতীক একটা লোহার রড তুলে সজোরে মারলেন আয়নায়। প্রথম আঘাতে আয়না ফাটল বাড়াল, ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। একরাশ আর্তনাদ ভেসে এল চারদিকে — ছাদের উপর, মেঝের নিচে, দেয়ালের ফাঁক থেকে যেন শত শত আত্মা কাঁদছে! তিনি দ্বিতীয় বার আঘাত করলেন। তখনই তাঁর নিজের প্রতিবিম্ব আয়নার ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল — “তুই ভুল করছিস! আমি তোকে নিতে এসেছি!” তৃতীয় আঘাত— আয়না চুরমার! সাথে সাথে ঘরের আলো নিভে গেল। একটা বিশাল শূন্যতার শব্দে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠল। কাঁচের টুকরোয় প্রতিফলিত হতে লাগল এক অদ্ভুত চিত্র— সৌম্যশ্রীর মুখ— নিঃশব্দে কাঁদছে। তারপর, এক মুহূর্তে সব নিস্তব্ধ। প্রতীক আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন দক্ষিণেশ্বর বাড়ির বাইরে— বাগানের মধ্যে শুয়ে। সকালে সূর্য উঠেছে। চেনা পাখির ডাক। বাড়ির জানালাগুলো সব খোলা, বাতাস ঢুকছে ধীরে ধীরে। বাড়ির ভেতর সেই ছায়া আর নেই। দেয়ালের সেই রক্তাক্ত ছাপ— মিলিয়ে গেছে। ডায়েরি আর নেই। রেকর্ডার কাজ করছে না। তিনি ধীরে ধীরে উঠলেন, হাঁটা শুরু করলেন গেটের দিকে। পেছনে আর একবার তাকালেন — প্রেতবাড়ি এখন শুধু একটা পুরনো কাঠামো। নিঃশব্দ, শূন্য। কিন্তু জানালার কাচে, সেদিকে তাকিয়ে ছিল একটা মেয়ে। সাদা শাড়ি, খোলা চুল। চোখে বিস্ময় আর গভীর কৃতজ্ঞতা। সৌম্যশ্রী। সে হাসল— হালকা করে। আর প্রতীক জানতেন — তিনি ফিরে এসেছেন। তবে একইরকম আর নন। কিছু একটা রেখে এসেছেন পেছনে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion