Episode 13648 words0 views

সময়-বাঁধা ছায়া

সময়-বাঁধা ছায়া  অয়ন, একুশ শতকের এক তরুণ চিত্রশিল্পী। তার তুলির ডগায় যেন জাদু ছিল, রঙের প্রতিটি ছোঁয়ায় সে ফুটিয়ে তুলত জীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলো। তার ক্যানভাসে কখনো ফুটে উঠত শহরের ব্যস্ত জনজীবন, কখনো গ্রামের শান্ত প্রকৃতি, আবার কখনো মানুষের মনের ভেতরের লুকানো বেদনা। কিন্তু ইদানীং তার মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ভর করেছে। পরিচিত বিষয়বস্তু আর তাকে টানছে না, নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা সে খুঁজে পাচ্ছে না। তার স্টুডিওর চার দেয়াল যেন তাকে গ্রাস করছিল, প্রতিটি আঁকা ছবি যেন তাকে উপহাস করছিল তার সৃষ্টিশীলতার এই বন্ধ্যাত্বের জন্য। কয়েক মাস ধরে এই অবস্থা। প্রদর্শনীতে তার নতুন কাজ নেই, পুরোনো কাজগুলোও যেন প্রাণহীন মনে হচ্ছে। তার বন্ধুরা, যারা একসময় তার শিল্পকর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, তারাও এখন তার নীরবতা দেখে চিন্তিত। অয়ন জানত, এই শূন্যতা কেবল তার মনের নয়, তার আত্মার। তার শিল্পই তার জীবন, আর সেই জীবনে যখন রঙ ফুরিয়ে যায়, তখন বেঁচে থাকার অর্থও যেন ফিকে হয়ে আসে। একদিন বিকেলে, তার প্রিয় কফি শপে বসে সে তার পুরোনো স্কেচবুক উল্টাচ্ছিল। পাতাগুলো ধূলোয় মলিন, রেখাগুলো যেন তার পুরোনো দিনের প্রাণবন্ততাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি অসম্পূর্ণ স্কেচ – একটি বিশাল বটগাছ, যার নিচে এক অস্পষ্ট অবয়ব। স্কেচটি সে বছরখানেক আগে এঁকেছিল, যখন সে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল নতুন বিষয়বস্তুর সন্ধানে। স্কেচটি দেখে তার মনে পড়ল সেই গ্রামের কথা। নামটা ঠিক মনে পড়ছিল না, তবে সেখানকার নির্জনতা আর প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষত সেই বটগাছটি, যা গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল একাকী, যেন শত শত বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে। তার মনে হল, এই একঘেয়েমি কাটাতে শহরের কোলাহল ছেড়ে পাড়ি জমানো উচিত সেই গ্রামে। হয়তো প্রকৃতির কোলে, সেই বটগাছের নীরব সান্নিধ্যে সে তার হারানো প্রেরণা ফিরে পাবে। সে তক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিল। পরদিনই সে তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, রঙ, তুলি আর ক্যানভাস গুছিয়ে নিল। তার বন্ধু রনি তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। “কোথায় যাচ্ছিস রে পাগলা? আবার কোনো আদিবাসী গ্রামে?” রনি হেসে বলল। অয়ন হাসল না। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। “নলডাঙ্গা,” সে বলল, “একটা গ্রাম, যেখানে একটা পুরনো বটগাছ আছে। মনে হচ্ছে, সেখানেই আমার উত্তর লুকিয়ে আছে।” রনি অবাক হল। “নলডাঙ্গা? ওটা তো খুব প্রত্যন্ত এলাকা। ওখানে কী পাবি?” “শান্তি,” অয়ন সংক্ষেপে উত্তর দিল। “আর হয়তো আমার হারানো রঙ।” পরের দিন ভোরে, অয়ন কলকাতার ব্যস্ততা পেছনে ফেলে নলডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা, তারপর ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে বাসে করে আরও কয়েক ঘণ্টা। শেষমেশ যখন সে নলডাঙ্গায় পৌঁছাল, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। গ্রামটি সত্যিই শান্ত। চারপাশে সবুজের সমারোহ, মাটির গন্ধ, আর পাখির কিচিরমিচির। শহরের দূষণ আর কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এক ভিন্ন জগৎ। গ্রামের প্রবেশমুখেই দেখা গেল সেই বিশাল বটগাছ। তার শিকড়গুলো মাটির গভীরে প্রোথিত, শাখা-প্রশাখাগুলো বিস্তৃত হয়েছে দিগন্তের পানে, যেন শত বাহু মেলে আকাশকে ছুঁতে চাইছে। গাছটির বিশালতা আর তার নীরব উপস্থিতি অয়নকে মুগ্ধ করল। তার মনে হল, এই গাছটি কেবল একটি গাছ নয়, এটি জীবন্ত ইতিহাস, যা সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে বুকে ধরে রেখেছে। গ্রামের মানুষজন সরল, অতিথিপরায়ণ। অয়নকে দেখে তারা অবাক হলেও, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। একজন যুবক তাকে শশীবালা দেবীর কুটিরের পথ দেখিয়ে দিল। শশীবালা দেবী গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, তার বয়স নব্বই পেরিয়েছে। তার চোখে মুখে লেগে আছে শত বছরের গল্প, আর তার কণ্ঠস্বরে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। অয়ন যখন তার পরিচয় দিল এবং তার এখানে আসার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করল, তখন শশীবালা দেবী মৃদু হাসলেন। “শিল্পী মানুষ! খুব ভালো। আমাদের এই নলডাঙ্গায় শিল্পীর পদধূলি পড়ল, এ তো আমাদের সৌভাগ্য।” তিনি অয়নের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন তার ছোট কুটিরের এক কোণে। কুটিরটি মাটির তৈরি, ছনের ছাউনি দেওয়া, কিন্তু পরিচ্ছন্ন আর আরামদায়ক। রাতে, জোছনার আলোয় যখন গ্রাম ভেসে যাচ্ছিল, অয়ন শশীবালা দেবীর সাথে উঠোনে বসেছিল। মৃদু বাতাস বইছিল, আর জোনাকিরা তাদের আলোয় চারপাশে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছিল। অয়ন বটগাছটির কথা জিজ্ঞেস করল। শশীবালা দেবীর মুখে এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল। “ওই গাছটা শুধু গাছ নয় বাবা,” তিনি বললেন, তার কণ্ঠস্বরে এক গভীর আবেগ। “ওটা সময়কে ধরে রেখেছে। পূর্ণিমার রাতে ওখানে নাকি একটা ছায়া দেখা যায়, ক্ষণিকের জন্য।” অয়ন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ছায়া? কিসের ছায়া?” শশীবালা দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সে এক পুরনো গল্প। কত যুগ ধরে যে তা মুখে মুখে ফিরছে, কে জানে! গ্রামের মানুষ বলে, ওটা নাকি এক অতৃপ্ত আত্মার ছায়া, যে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ফিরে আসে।” তিনি আর বিস্তারিত কিছু বললেন না, কেবল অয়নের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তার চোখে এক গভীর রহস্য লুকিয়ে ছিল, যা অয়নকে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলল। শশীবালা দেবী যেন তার এই নীরবতা দিয়ে আরও অনেক কিছু বলতে চাইলেন, যা কেবল অভিজ্ঞ চোখই পড়তে পারে। অয়ন জানত, তার এই যাত্রা কেবল হারিয়ে যাওয়া প্রেরণা খুঁজে পাওয়ার জন্য নয়, এটি এক অজানা রহস্যের উন্মোচনের যাত্রা। সেই বটগাছ, সেই রহস্যময় ছায়া, আর শশীবালা দেবীর নীরব হাসি – সবকিছু মিলেমিশে এক নতুন ক্যানভাস তৈরি হচ্ছিল তার মনের গভীরে। পরের দিন সকাল থেকেই অয়ন তার ইজেল আর ক্যানভাস নিয়ে বটগাছের নিচে গিয়ে বসল। দিনের আলোয় গাছটির বিশালতা, তার সবুজ পত্রপল্লব, আর তার নিচে বয়ে যাওয়া মৃদু বাতাস – সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করল। গাছটির প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি শিকড়, প্রতিটি পাতা যেন এক আলাদা গল্প বলছিল। অয়ন তুলি ধরল, কিন্তু তার মন কেবল সেই ‘সময়-বাঁধা ছায়া’র কথা ভাবছিল। সে গাছের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি শিকড়কে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল, যেন সে শুধু গাছ নয়, গাছের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যকেও ধরতে চাইছে। প্রথম কয়েকদিন সে কেবল গাছটির বাহ্যিক রূপই আঁকল। গাছের গুড়ির কর্কশতা, শিকড়ের জট, পাতার সবুজ আভা – সবকিছুই সে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, সে কেবল একটি ছবি আঁকছে, একটি পোর্ট্রেট নয়। গাছের প্রাণ, তার ভেতরের গল্প যেন তার তুলির ডগায় ধরা দিচ্ছিল না। সে অনুভব করল, এই গাছটির সঙ্গে তার এক গভীর সংযোগ স্থাপন করতে হবে, তার নীরব ভাষা বুঝতে হবে। সে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের নিচে বসে থাকত। গ্রামের মানুষজন তাকে দেখে অবাক হত। কেউ কেউ তাকে পাগলও ভাবত। “শহরের বাবু এসে গাছের ছবি আঁকছে,” তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করত। কিন্তু অয়ন এসবের তোয়াক্কা করত না। সে তার নিজের জগতে ডুবে থাকত। ধীরে ধীরে সে অনুভব করতে শুরু করল এক অদ্ভুত সংযোগ। গাছের প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি ডালে যেন এক অব্যক্ত বেদনা লুকিয়ে আছে। কখনো কখনো তার মনে হত, গাছের পাতাগুলো যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে, বাতাসের শব্দে যেন কোনো পুরনো কান্না ভেসে আসছে। সে গাছের নিচে বসে চোখ বন্ধ করে থাকত, আর তার কল্পনায় ভেসে উঠত পুরনো দিনের দৃশ্য। সে যেন শুনতে পেত গাছের নিচে মানুষের পদধ্বনি, হাসির শব্দ, কান্নার রোল। একদিন বিকেলে, যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, অয়ন গাছের নিচে বসে ধ্যান করছিল। হঠাৎ তার মনে হল, গাছের গুড়ির কাছে একটি অস্পষ্ট অবয়ব। প্রথমে সে ভাবল, এটা তার মনের ভুল। কিন্তু যখন সে চোখ খুলল, তখন দেখল, গাছের গুড়ির কাছে একটি আবছা ছায়া, যেন একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াটি এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে সে তার রূপ ঠিকঠাক দেখতে পারল না, কিন্তু তার উপস্থিতি অয়নকে এক অদ্ভুত অনুভূতি দিল। এটি কি সেই ‘সময়-বাঁধা ছায়া’? অয়ন দ্রুত তার স্কেচবুক বের করল এবং সেই অস্পষ্ট অবয়বটিকে আঁকতে শুরু করল। প্রথমে তা কেবলই একটি রূপরেখা ছিল, কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, সেই রূপরেখা যেন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল, এক নারী আর এক পুরুষের অবয়ব। তারা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুখে এক অমলিন হাসি। অয়ন বুঝতে পারল, তার তুলির টানে সে কেবল ছবি আঁকছে না, সে যেন অতীতের এক হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তকে পুনরুদ্ধার করছে। এই সময়, শশীবালা দেবী প্রায়ই অয়নের কাছে আসতেন। তিনি অয়নের আঁকা ছবি দেখতেন আর মৃদু হাসতেন। তিনি অয়নকে গ্রামের গল্প শোনাতেন, পুরনো দিনের কথা বলতেন। তার গল্পে উঠে আসত গ্রামের ইতিহাস, তার মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সুখ-দুঃখ। কিন্তু যখনই অয়ন সেই রহস্যময় ছায়ার কথা জিজ্ঞেস করত, শশীবালা দেবী কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন আর বলতেন, “সবকিছুর সময় আছে বাবা। সময় হলে সব জানতে পারবে।” অয়ন বুঝতে পারছিল, শশীবালা দেবী অনেক কিছু জানেন, কিন্তু তিনি এখনই সব বলতে চান না। হয়তো তিনি চান, অয়ন নিজেই এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করুক, নিজের চোখে সব দেখুক। একদিন, অয়ন যখন গাছের নিচে আঁকছিল, তখন তার চোখে পড়ল গাছের গুড়ির কাছে একটি ছোট পাথরের ফলক। ফলকটি শ্যাওলা আর লতাপাতায় ঢাকা পড়েছিল। অয়ন সাবধানে শ্যাওলা পরিষ্কার করল, আর দেখল ফলকে কিছু খোদাই করা আছে। অক্ষরগুলো পুরনো বাংলা হরফে লেখা, অনেকটাই অস্পষ্ট। সে অনেক কষ্টে কিছু শব্দ পড়তে পারল: “রূপা… মাধব… অপেক্ষা… পূর্ণিমা…” অয়ন উত্তেজিত হয়ে উঠল। রূপা আর মাধব! এই নামগুলোই কি সেই ছায়ার রহস্যের সঙ্গে জড়িত? সে দ্রুত শশীবালা দেবীর কাছে গেল এবং ফলকের কথা বলল। শশীবালা দেবী ফলকের কথা শুনে চমকে উঠলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠল। “রূপা আর মাধব,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তারা ছিল এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর প্রেম কাহিনী।” শশীবালা দেবী অয়নকে তাদের গল্প বলতে শুরু করলেন। বহু যুগ আগে, প্রায় শত বছর আগে, এই গ্রামে রূপা নামের এক মেয়ে থাকত। সে ছিল গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, তার হাসি ছিল চাঁদের আলোর মতো উজ্জ্বল। আর মাধব ছিল গ্রামের এক যুবক, সাহসী আর সুদর্শন। তাদের ভালোবাসা ছিল গ্রামের সবার মুখে মুখে। তারা একে অপরকে এতটাই ভালোবাসত যে তাদের দেখে মনে হত, তারা যেন একে অপরের জন্যেই জন্মেছে। মাধব ছিল এক গরীব কৃষক পরিবারের ছেলে। আর রূপা ছিল গ্রামের সম্পন্ন এক পরিবারের মেয়ে। তাদের সম্পর্ক নিয়ে রূপার পরিবারে আপত্তি ছিল। কিন্তু রূপা আর মাধব কাউকে পরোয়া করত না। তারা প্রতিদিন এই বটগাছের নিচে এসে দেখা করত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত। মাধব রূপাকে এই বটগাছের নিচে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। সে রূপার হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিতে চেয়েছিল, যা সে অনেক কষ্টে জোগাড় করেছিল। রূপা আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। তারা ঠিক করেছিল, পরের পূর্ণিমার রাতে তারা এই গাছের নিচে এসে বিয়ে করবে, সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বিয়ের ঠিক আগের দিন, মাধব গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। তার পরিবার তাকে জোর করে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে, যাতে সে রূপাকে ভুলে যায়। মাধবের পরিবার জানত, রূপার পরিবারের সাথে তাদের কোনোদিনই সম্পর্ক হবে না, আর এই সম্পর্ক তাদের জন্য কেবল বিপদই ডেকে আনবে। মাধব রূপাকে কিছু জানাতে পারেনি, তাকে বিদায় জানানোর সুযোগও পায়নি। রূপা মাধবের জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করেছিল। সে বিশ্বাস করত, মাধব একদিন ফিরে আসবে। প্রতিদিন সে এই বটগাছের নিচে এসে মাধবের পথ চেয়ে থাকত। তার চোখে লেগে থাকত এক অনন্ত অপেক্ষা। গ্রামের মানুষ তাকে পাগল বলত, কিন্তু রূপা তাদের কথা শুনত না। সে শুধু মাধবের ফিরে আসার স্বপ্ন দেখত। একদিন, এই গাছের নিচে বসেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, মাধবের জন্য তার অপেক্ষা আর ভালোবাসা নিয়ে। তার শেষ ইচ্ছা ছিল, মাধব যেন ফিরে আসে এবং তার হাতে সেই আংটিটি পরিয়ে দেয়, যা সে দিতে পারেনি। শশীবালা দেবী গল্প শেষ করলেন। তার চোখে জল চিকচিক করছিল। “সেই থেকে, পূর্ণিমার রাতে, রূপার ছায়া এই গাছের নিচে আবির্ভূত হয়,” তিনি বললেন, “সে মাধবের ফিরে আসার অপেক্ষা করে।” অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার ক্যানভাসে আঁকা সেই অস্পষ্ট অবয়বগুলো এখন তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই ছায়া কোনো ভূত নয়, এটি একটি অতৃপ্ত স্মৃতি, একটি অসমাপ্ত মুহূর্ত যা সময়ের বাঁধনে আটকে আছে। রূপার ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে তা সময়কেও অতিক্রম করে গিয়েছিল। গল্পটা শোনার পর অয়নের মন এক নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে পেল। তার শিল্প কেবল ছবি আঁকা নয়, এটি এখন এক মিশন – রূপার অসমাপ্ত গল্পকে সম্পূর্ণ করা, তার ভালোবাসাকে মুক্তি দেওয়া। সে তার ক্যানভাসে আরও নিবিষ্টভাবে কাজ করতে শুরু করল। তার তুলির টানে এখন শুধু রঙ নয়, আবেগ আর প্রতিজ্ঞা মিশে ছিল। সে রূপা আর মাধবের অবয়বগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলল, তাদের মুখের হাসি, রূপার চোখে সেই অনন্ত অপেক্ষা – সবকিছুই সে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলল। তার মনে হল, সে যেন রূপার আত্মাকে অনুভব করতে পারছে, তার বেদনা আর ভালোবাসাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারছে। পূর্ণিমা ঘনিয়ে এল। আকাশ ঝলমলে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। অয়ন তার ইজেল নিয়ে বটগাছের নিচে অপেক্ষা করছিল। গ্রামের সবাই তাকে বারণ করেছিল, “ওখানে যেও না বাবা, ওটা ভালো নয়।” শশীবালা দেবীও চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু অয়নের চোখে তিনি এক অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখেছিলেন, যা তাকে আশ্বস্ত করেছিল। রাত গভীর হল। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ। অয়ন চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল। সে জানত, আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল গাছের নিচে। চাঁদের আলোয়, গাছের গুড়ির কাছে, সত্যিই একটি ছায়া! কিন্তু এটি কোনো সাধারণ ছায়া নয়। এটি জীবন্ত, স্পষ্ট। দুটি অবয়ব – একজন পুরুষ, একজন নারী। তারা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন দেখল, পুরুষটি নতজানু হয়ে নারীর হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিচ্ছে। নারীর চোখে আনন্দাশ্রু। তাদের মুখে এক অমলিন হাসি। দৃশ্যটি এতটাই স্পষ্ট যে অয়ন যেন তাদের ফিসফিসানিও শুনতে পাচ্ছিল। সে যেন শুনতে পাচ্ছিল মাধবের প্রতিজ্ঞা, “রূপা, আমি তোমাকে কোনোদিন ছাড়ব না।” আর রূপার উচ্ছ্বাস, “আমি তোমারই মাধব, চিরকাল তোমারই থাকব।” কিন্তু মুহূর্তেই দৃশ্যটি পাল্টে গেল। পুরুষটির মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত দ্বিধা। তার চোখ দুটো যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সে নারীর হাত ছেড়ে দিল। রূপা হতবাক, তার চোখে অবিশ্বাস আর গভীর বেদনা। তার হাসি ম্লান হয়ে গেল, তার মুখটা যেন পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। মাধব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল, আর রূপা একা দাঁড়িয়ে রইল, তার ছায়া যেন গাছের সঙ্গে মিশে গেল। তার চোখে লেগে রইল এক অনন্ত অপেক্ষা, এক চিরন্তন বেদনা। এই দৃশ্যটি এতটাই জীবন্ত ছিল যে অয়ন অনুভব করল তার নিজের হৃদয়েও যেন সেই নারীর বেদনা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ল। সে অনুভব করল রূপার কষ্ট, তার অসহায়তা। ছায়াটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেমন করে কুয়াশা ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায়। অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার ক্যানভাসে আঁকা সেই অস্পষ্ট অবয়বগুলো এখন তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই ছায়া কোনো ভূত নয়, এটি একটি অতৃপ্ত স্মৃতি, একটি অসমাপ্ত মুহূর্ত যা সময়ের বাঁধনে আটকে আছে। রূপার ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে তা মৃত্যুর পরেও তার স্মৃতিকে এই গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। পরদিন সকালে, অয়ন শশীবালা দেবীর কাছে ফিরে গেল। তার চোখে বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা। শশীবালা দেবী তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। “দেখেছ তাহলে?” তিনি বললেন, “ওটা ছিল রূপা আর মাধবের ছায়া। তাদের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে সময়ও তাকে মুছে ফেলতে পারেনি।” অয়ন বলল, “কিন্তু মাধব কেন চলে গিয়েছিল? সে কেন রূপাকে ছেড়ে দিল?” শশীবালা দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মাধবের পরিবার খুব প্রভাবশালী ছিল। তারা এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। মাধবকে জোর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে রূপাকে ভালোবাসত, কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে তোমাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সে সারাজীবন তোমার জন্য অনুতপ্ত ছিল।” অয়ন সিদ্ধান্ত নিল, এই অসমাপ্ত গল্পটি তাকেই শেষ করতে হবে। রূপার ভালোবাসাকে মুক্তি দিতে হবে। সে শশীবালা দেবীকে বলল, “আমাকে মাধবের বংশধরদের খুঁজে বের করতে হবে। রূপার শেষ ইচ্ছাকে পূর্ণ করতে হবে।” শশীবালা দেবী প্রথমে দ্বিধা করলেন। “সে অনেক পুরনো কথা বাবা। এত বছর পর তাদের খুঁজে বের করা কি সম্ভব?” “চেষ্টা করে দেখতে হবে,” অয়ন দৃঢ় কণ্ঠে বলল। “রূপার জন্য, মাধবের জন্য, আর এই গাছের জন্য।” মাধবের বংশধরদের খুঁজে বের করা সহজ কাজ ছিল না। শশীবালা দেবী অয়নকে কিছু সূত্র দিলেন। মাধবের পরিবারের পদবী ছিল ‘চৌধুরী’। তারা নাকি একসময় গ্রামের সম্পন্ন পরিবার ছিল, কিন্তু মাধবের পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রভাব কমে যায় এবং তারা একসময় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়। শশীবালা দেবী মাধবের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কথা মনে করতে পারলেন, যিনি শহরে থাকতেন। তার নাম ছিল রতন চৌধুরী। অয়ন তার স্কেচবুক আর কিছু আঁকা ছবি নিয়ে শহরে ফিরে এল। তার মনে এক নতুন উদ্যম। সে যেন এক গোয়েন্দা, যে শত বছরের পুরনো এক রহস্যের সমাধান করতে এসেছে। শহরে এসে সে প্রথমে পুরোনো রেকর্ডপত্র ঘাঁটতে শুরু করল। গ্রন্থাগার, পুরোনো দলিলপত্র – যেখানেই মাধব চৌধুরী বা রতন চৌধুরীর নাম পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেখানেই সে খোঁজ শুরু করল। কাজটি ছিল সময়সাপেক্ষ এবং ক্লান্তিকর। অনেক সময় তাকে হতাশ হতে হল, অনেকবার মনে হল, সে ভুল পথে হাঁটছে। কিন্তু রূপার সেই বেদনাহত ছায়া তার চোখে ভাসত, আর তার মনে পড়ত শশীবালা দেবীর কথা। এই চিন্তাগুলো তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করত। সে জানত, এই গল্পটা তাকে শেষ করতেই হবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নিরলস চেষ্টার পর, অয়ন একটি পুরোনো ভূমি অফিসের নথিপত্রে রতন চৌধুরীর নাম খুঁজে পেল। তার ঠিকানা ছিল কলকাতার এক পুরোনো পাড়ায়। অয়ন দ্রুত সেই ঠিকানায় পৌঁছাল। বাড়িটি ছিল জীর্ণ, কিন্তু তার স্থাপত্যে এককালের আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। দরজায় কড়া নাড়তেই এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। অয়ন তার পরিচয় দিল এবং মাধব চৌধুরীর কথা জিজ্ঞেস করল। বৃদ্ধা প্রথমে সন্দিহান চোখে তাকালেন। “মাধব চৌধুরী? সে তো অনেক পুরনো কথা। আপনি কে?” অয়ন রূপা আর মাধবের গল্প সংক্ষেপে বলল, শশীবালা দেবীর নাম উল্লেখ করল, আর তার আঁকা সেই বটগাছের ছবি দেখাল, যেখানে রূপা আর মাধবের অস্পষ্ট ছায়া আঁকা ছিল। বৃদ্ধা ছবিটি দেখে চমকে উঠলেন। তার চোখে জল এসে গেল। “মাধব… আমার দাদু ছিলেন,” তিনি ফিসফিস করে বললেন। তার নাম ছিল সুধা দেবী, রতন চৌধুরীর পুত্রবধূ। সুধা দেবী অয়নকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তিনি মাধবের গল্প শোনালেন, যা তিনি তার শ্বশুর রতন চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছিলেন। মাধব গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর তার জীবন সুখের ছিল না। তার পরিবার তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল এক ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে। কিন্তু মাধব রূপাকে কোনোদিন ভুলতে পারেনি। সে সবসময় বিষণ্ণ থাকত, তার চোখে এক গভীর শূন্যতা লেগে থাকত। সে প্রায়ই নলডাঙ্গার কথা বলত, রূপার কথা বলত। তার শেষ দিন পর্যন্ত সে রূপার জন্য অনুতপ্ত ছিল, তাকে ছেড়ে আসার জন্য সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। মাধব তার পরিবারের কাছে রূপার কথা বলতে পারত না, কারণ তারা এই সম্পর্ককে ঘৃণা করত। সে তার বেদনা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিল। সুধা দেবী বললেন, “আমার শ্বশুরমশাই, রতন চৌধুরী, মাধবের ছোট ভাই ছিলেন। তিনি জানতেন মাধব রূপাকে কতটা ভালোবাসত। মাধব মারা যাওয়ার আগে রতন চৌধুরীকে অনুরোধ করেছিল, যদি কখনো সম্ভব হয়, রূপার কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু তখন আর রূপা বেঁচে ছিল না।” অয়ন জিজ্ঞেস করল, “মাধবের কোনো বংশধর কি এখনও আছে, যারা এই গল্পটা জানে?” সুধা দেবী বললেন, “আমার ছেলে অর্জুন, সে মাধবের প্রপৌত্র। সে আমার কাছে এই গল্পটা শুনেছে। সে এখন শহরেই থাকে, তার নিজের ব্যবসা আছে।” অয়ন অর্জুনের ঠিকানা নিয়ে দ্রুত তার সাথে দেখা করতে গেল। অর্জুন ছিল একজন আধুনিক যুবক, ব্যস্ত ব্যবসায়ী। সে প্রথমে অয়নকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। “এসব তো রূপকথা,” সে বলল, “আমার দাদু-পরদাদু এসব গল্প বলতেন বটে, কিন্তু এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।” অয়ন তার আঁকা ক্যানভাসটি অর্জুনকে দেখাল। ক্যানভাসে বটগাছের নিচে রূপা আর মাধবের স্পষ্ট অবয়ব। অয়ন তাকে শশীবালা দেবীর কথা বলল, রূপার শেষ ইচ্ছার কথা বলল, এবং পূর্ণিমার রাতে সে যা দেখেছিল, তার বর্ণনা দিল। “রূপার ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে তা সময়ের বাঁধনে আটকে আছে,” অয়ন বলল, “সে আপনার পূর্বপুরুষ মাধবের জন্য অপেক্ষা করছে। আপনিই পারেন তাকে মুক্তি দিতে।” অর্জুন প্রথমে দ্বিধা করল। সে বিজ্ঞানমনস্ক যুবক, এসব অলৌকিক ঘটনায় তার বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু অয়নের চোখে সে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখতে পেল। তার আঁকা ছবিতে এক অদ্ভুত মায়া ছিল, যা তাকে নাড়া দিল। সে অনুভব করল, অয়নের কথাগুলো কেবল গল্প নয়, এর পেছনে এক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। তার মনে হল, তার পূর্বপুরুষ মাধবের অসমাপ্ত কাজ তাকেই শেষ করতে হবে। তার পূর্বপুরুষের এই বেদনা, এই অনুশোচনা, তাকেও যেন স্পর্শ করল। অনেক আলোচনার পর, অর্জুন রাজি হল। সে বলল, “আমি আপনার সাথে নলডাঙ্গায় যাব। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়, তাহলে আমি রূপার শেষ ইচ্ছাকে পূর্ণ করব।” অয়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার মিশন প্রায় সফল হতে চলেছে। সে জানত, এই যাত্রা কেবল রূপা আর মাধবের জন্য নয়, এটি তার নিজের শিল্প আর জীবনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। পরের পূর্ণিমার রাতে, অয়ন, শশীবালা দেবী এবং অর্জুন বটগাছের নিচে জড়ো হল। আকাশ ঝলমলে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। গ্রামের অন্যান্য কৌতূহলী মানুষজনও দূর থেকে ভিড় করেছিল, তারা জানত আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে। তাদের চোখে ছিল ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণ। অয়ন তার আঁকা সেই ক্যানভাসটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, যেখানে রূপা আর মাধবের অবয়ব স্পষ্ট। অর্জুন, তার পূর্বপুরুষ মাধবের প্রতিনিধি হয়ে, একটি নতুন আংটি নিয়ে এল। আংটিটি ছিল সাধারণ, কিন্তু তার মধ্যে ছিল মাধবের প্রতিজ্ঞা আর রূপার ভালোবাসার প্রতীক। রাত গভীর হল। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ। অয়ন, শশীবালা দেবী এবং অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। অর্জুনের মুখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি – ভয়, কৌতূহল, আর এক অজানা দায়িত্ববোধ। হঠাৎ, চাঁদের আলোয়, গাছের গুড়ির কাছে সেই সময়-বাঁধা ছায়াটি আবার আবির্ভূত হল। এবার তা আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত। রূপা আর মাধব দুজনেই ছিল। তাদের অবয়বগুলো যেন বাতাসের সাথে মিশে তৈরি হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, তাদের মুখের অভিব্যক্তি ছিল স্পষ্ট। রূপার চোখে সেই অনন্ত অপেক্ষা, আর মাধবের চোখে সেই অনুশোচনা। অর্জুন এক পা এগিয়ে গেল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল। সে তার হাতে ধরা আংটিটি শক্ত করে ধরল। অয়ন তার ক্যানভাসটি গাছের গুড়ির কাছে রাখল, যেখানে রূপা আর মাধবের ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল। অর্জুন গাছের দিকে তাকিয়ে বলল, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু দৃঢ় ছিল, “রূপা, আমি মাধবের প্রপৌত্র অর্জুন। আমার পূর্বপুরুষের অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি আজ আমি পূর্ণ করতে এসেছি। আমার পরদাদু মাধব তোমাকে ভালোবাসত, কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে তোমাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সে সারাজীবন তোমার জন্য অনুতপ্ত ছিল।” অর্জুন আংটিটি গাছের গুড়ির কাছে রাখল, যেন সে রূপার অদৃশ্য হাতেই তা পরিয়ে দিচ্ছে। “তোমার ভালোবাসা আর অপেক্ষা যেন আজ মুক্তি পায়,” সে ফিসফিস করে বলল। মুহূর্তেই এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। ছায়াগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মাধব নতজানু হয়ে রূপার হাতে আংটি পরিয়ে দিল। রূপার মুখে ফুটে উঠল এক পরম তৃপ্তি আর শান্তি। তার চোখে আনন্দাশ্রু। মাধবের মুখেও ফুটে উঠল এক স্বস্তির হাসি, যেন শত বছরের ভার তার কাঁধ থেকে নেমে গেল। তাদের অবয়বগুলো যেন একে অপরের সাথে মিশে গেল, এক উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করে উঠল। তাদের চারপাশে এক স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোয় যেন রূপা আর মাধবের ভালোবাসা, তাদের প্রতীক্ষা, তাদের মুক্তি – সবকিছুই ফুটে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে সেই উজ্জ্বল আলো মিলিয়ে গেল বাতাসের সাথে, চিরতরে। গাছের নিচে আর কোনো ছায়া ছিল না, ছিল শুধু চাঁদের নরম আলো আর বাতাসের মৃদু ফিসফিসানি। রূপা আর মাধব, তাদের ভালোবাসা আর প্রতীক্ষা, অবশেষে মুক্তি পেল। অয়ন অনুভব করল, তার হৃদয়ের শূন্যতা পূর্ণ হয়ে গেছে। তার তুলির টানে এখন আর শুধু রঙ নয়, এক গভীর অনুভূতি, এক মুক্তি আর শান্তির বার্তা ফুটে উঠছে। সে তার ক্যানভাসে শেষ তুলি টানল, যেখানে বটগাছের নিচে আর কোনো ছায়া নেই, আছে শুধু এক নির্মল আলো, যা সময়ের বাঁধন পেরিয়ে ভালোবাসার চিরন্তন জয় ঘোষণা করছে। তার শিল্পকর্ম এখন কেবল একটি ছবি নয়, এটি একটি গল্প, একটি ইতিহাস, একটি অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী। অর্জুনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে জল। সে অনুভব করল, তার পূর্বপুরুষের আত্মা যেন আজ শান্তি পেল। সে অয়নের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। “ধন্যবাদ,” সে বলল, “আপনি শুধু একটি গল্প শেষ করেননি, আপনি একটি আত্মাকে মুক্তি দিয়েছেন।” শশীবালা দেবীও আনন্দাশ্রু ফেলছিলেন। তিনি জানতেন, শত বছরের পুরনো এই রহস্য আজ শেষ হল। গ্রামের মানুষজনও অবাক হয়ে দেখছিল। তাদের চোখে আর ভয় ছিল না, ছিল কেবল বিস্ময় আর এক অদ্ভুত শান্তি। অয়ন নলডাঙ্গা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল, কিন্তু তার হৃদয়ে রয়ে গেল ‘সময়-বাঁধা ছায়া’র এক অবিস্মরণীয় গল্প। সে জানত, এই অভিজ্ঞতা তার শিল্পকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে, যা তাকে চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে। তার ক্যানভাসে এখন আর কেবল রঙ আর রেখা নয়, আছে জীবন, মৃত্যু, ভালোবাসা, অপেক্ষা আর মুক্তির এক গভীর আখ্যান। সে ফিরে গেল তার স্টুডিওতে, এক নতুন প্রেরণা নিয়ে, এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তার তুলির ডগায় এখন কেবল তার নিজস্ব অনুভূতি নয়, রূপা আর মাধবের ভালোবাসার গল্পও জীবন্ত হয়ে উঠল, যা তাকে এক নতুন শিল্পী হিসেবে পরিচিত করে তুলল। তার প্রদর্শনীতে এবার শুধু ছবি নয়, ছিল সেই বটগাছের নিচে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার গল্প, যা মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল, আর তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল ভালোবাসার অনন্ত শক্তির কথা। ~সমাপ্ত~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion