Episode 12933 words0 views

হারানো ছবির হাসি

শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘অরুণোদয় মহাবিদ্যালয়’। ইটের তৈরি বিশাল দালানগুলো শ্যাওলা আর লতাপাতায় ঢাকা, যেন শত শত বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি ইটের ফাটলে, প্রতিটি শ্যাওলার স্তরে লুকিয়ে আছে অগণিত গল্প, যা সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে গেছে। চওড়া বারান্দাগুলো, যেখানে একসময় ছাত্রছাত্রীদের কলরবে মুখরিত থাকত, এখন সেখানে কেবল বাতাসের ফিসফিসানি আর পুরনো দিনের গন্ধ, যেন অদৃশ্য আত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায়। বর্ষার ভেজা দুপুরে যখন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যেত, তখন এই বারান্দাগুলো আরও রহস্যময় হয়ে উঠত, যেন প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে কোনো অব্যক্ত গোপন কথা, যা সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়েছে, আর তার সমাধান কেবল নীরবতার কাছেই। এমনই এক বর্ষার সকালে, যখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছিল, আর চারদিক ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন, কলেজের মালি রতনলাল নতুন করে বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে এক ঝোপের আড়ালে, ভিজে মাটির গভীরে খুঁজে পেল একটি বহু পুরনো ক্যামেরা। ক্যামেরাটি অদ্ভুতভাবে অক্ষত ছিল, যেন মাটির নিচে তাকে সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, কোনো এক অদৃশ্য হাতের স্পর্শে, যা তাকে প্রকৃতির রোষ থেকেও বাঁচিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের মডেল, তার ধাতব অংশে মরচে ধরেছে পুরু আস্তরণ, লেন্সের কাঁচ ঘোলাটে হয়ে গেছে বহু বছরের অযত্নে, কিন্তু তার ভেতরের যন্ত্রাংশগুলো যেন এক অলৌকিক উপায়ে অক্ষত ছিল। ক্যামেরাটি হাতে নিতেই রতনলালের মনে হলো, সে যেন কোনো গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে, অথবা এমন কিছু যা তার হাতে আসার কথা ছিল না, যা এক গভীর রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এবং তার মনে এক অজানা ভয় জাগিয়ে তুলল। সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মালি ক্যামেরাটি এনে দিল কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, প্রফেসর সাহার হাতে। প্রফেসর সাহা শুধু একজন শিক্ষকই নন, তিনি ছিলেন একজন নিবিষ্ট গবেষক, পুরনো প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক জিনিসের প্রতি তার ছিল এক গভীর কৌতূহল, যা কখনও কখনও প্রায় আবেশে পরিণত হতো। তার ল্যাবে পুরনো ঘড়ি, ভাঙা রেডিও, আর শত বছরের পুরনো বইয়ের স্তূপ ছিল, যা দেখে মনে হতো তিনি যেন অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন, তার প্রতিটি ধূলিকণায় লুকিয়ে থাকা গল্প খুঁজে বের করতে চাইছেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। তিনি যত্ন করে ক্যামেরাটি পরিষ্কার করলেন, সাবধানে তার প্রতিটি অংশ পরীক্ষা করলেন, যেন তিনি কোনো মূল্যবান প্রত্নবস্তু পরীক্ষা করছেন, যার প্রতিটি খুঁটিনাটি তাকে এক নতুন পথে পরিচালিত করবে, যা হয়তো তার জীবনকেও বদলে দেবে। অবাক হয়ে দেখলেন, ক্যামেরার ভেতরে একটি ফিল্ম এখনও অক্ষত আছে, তার ওপর যেন সময়ের কোনো প্রভাব পড়েনি, যা এক অলৌকিকতার ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যেন ফিল্মটি কোনো অদৃশ্য শক্তির দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। কৌতূহলবশত তিনি ফিল্মটি ডেভেলপ করার জন্য শহরের সেরা স্টুডিওতে পাঠালেন, তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল, যা এক নতুন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল, যা তাকে এক অজানা পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, যার শেষ কোথায় তিনি জানতেন না। কয়েকদিন পর যখন ছবিটি হাতে এল, প্রফেসর সাহা বিস্মিত হলেন। ছবিটি ছিল সাদা-কালো, কিন্তু তার গুণগত মান ছিল অসাধারণ, যেন সদ্য তোলা কোনো চিত্র, যার প্রতিটি পিক্সেল যেন জীবন্ত, এবং তার প্রতিটি রেখায় যেন এক গোপন বার্তা লুকিয়ে আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক হাসিখুশি তরুণী, তার চোখেমুখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, আর তার হাসিটা যেন অদ্ভুতভাবে জীবন্ত, যা দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াবে, এবং তার সাথে কথা বলবে, অথবা তাকে কোনো নির্দেশ দেবে। মেয়েটির হাসি এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে, প্রফেসর সাহা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তার মনে হলো এই হাসি যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে, কোনো গোপন কথা ফাঁস করতে চাইছে, যা এতদিন ধরে চাপা পড়ে ছিল, এবং যা উন্মোচিত হলে অনেক অজানা সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মেয়েটি কে, বা ছবিটি কখন তোলা হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনো তথ্যই ছবিতে ছিল না, এমনকি কোনো তারিখ বা নামও লেখা ছিল না। ছবির পেছনে শুধু একটি ছোট, প্রায় অস্পষ্ট স্বাক্ষর ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো পাখির পালক দিয়ে আঁকা, অথবা কোনো গুপ্ত সংকেত, যা কেবল বিশেষ চোখেই ধরা পড়বে। প্রফেসর সাহার মনে হলো, এই স্বাক্ষরটি যেন তাকে কোনো গোপন পথের দিকে ইশারা করছে। প্রফেসর সাহা ছবিটির রহস্য উন্মোচনে নামলেন। তিনি কলেজের পুরনো আর্কাইভ ঘেঁটে দেখতে শুরু করলেন। শত শত ফাইলের স্তূপ, ধুলো জমা পুরনো খাতা, বার্ষিক ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিলেন। পুরনো ছাত্রছাত্রীদের তালিকা, বার্ষিক ম্যাগাজিন, এমনকি ৫০-৬০ বছর আগের পরীক্ষার ফলাফলপত্রও তিনি খুঁটিয়ে দেখলেন। লাইব্রেরির কোণায় বসে তিনি চশমা এঁটে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন, যেন এক রহস্যময় ধাঁধার সমাধান করছেন, যার প্রতিটি টুকরো তাকে আরও গভীরে টানছে, এবং তার ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল, তাকে এক অজানা নেশায় আবিষ্ট করছিল। দীর্ঘ গবেষণার পর একসময় তিনি জানতে পারলেন, ছবিটি প্রায় ৫০ বছর আগের তোলা। আর ছবিতে যে মেয়েটি রয়েছে, তার নাম ছিল অরুণিমা সেন। অরুণিমা ছিল কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রীদের একজন, তার মেধা এবং হাসি দুটোই ছিল কলেজের গর্ব। সে শুধু ভালো ছাত্রীই ছিল না, তার ছিল এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যা সবাইকে মুগ্ধ করত, কিন্তু তার চোখের গভীরে যেন এক অজানা রহস্য লুকিয়ে ছিল, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল, এবং তাকে ঘিরে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল। কিন্তু তার গল্পে ছিল এক মর্মান্তিক মোড়। একটি বিশেষ পরীক্ষার ফলাফলের দিন, যখন তার প্রথম স্থান অধিকার করার কথা ছিল, সেদিনই সে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার অন্তর্ধান আজও এক রহস্য, যা কলেজের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। পুলিশ অনেক তদন্ত করেও তার কোনো খোঁজ পায়নি, তার পরিবারও একসময় আশা ছেড়ে দিয়েছিল। অরুণিমার নাম শুনলেই কলেজের পুরনো শিক্ষকরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, আর ছাত্রছাত্রীরা ফিসফিস করে কথা বলত, যেন তার নাম উচ্চারণ করাও এক নিষিদ্ধ কাজ, যা এক অশুভ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কেউ কেউ বলত, অরুণিমা নাকি নিজেই পালিয়ে গিয়েছিল, আবার কেউ বলত, তাকে নাকি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কেন? এই ‘কেন’ প্রশ্নটি প্রফেসর সাহার মনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করল। অরুণিমার গল্প জানার পর থেকে প্রফেসর সাহার মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। তিনি ছবিটি নিজের ডেস্কে রাখলেন, তার ল্যাবের টেবিলে, যেখানে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। প্রতিদিন তিনি ছবিটি দেখতেন, আর অরুণিমার হাসির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতেন। তার মনে হতো, এই হাসি যেন তাকে কোনো প্রশ্ন করছে, কোনো জবাব চাইছে, অথবা তাকে কোনো বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে, যার শেষ কোথায় তিনি জানতেন না, এবং যে পথ তাকে এক অজানা বিপদের দিকে নিয়ে যাবে। তার ঘুম কমে গেল, রাতের পর রাত তিনি ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতেন, যেন ছবিটি তার সাথে কথা বলছে, এবং তাকে কোনো গোপন সত্যের দিকে পরিচালিত করছে। কিন্তু তারপরই শুরু হলো এক অদ্ভুত ঘটনা, যা তার যুক্তিবাদী মনকে নাড়িয়ে দিল, এবং তাকে এক অজানা আশঙ্কার দিকে ঠেলে দিল, যা তার সমস্ত বিশ্বাসকে চূর্ণ করে দিল। প্রথমত, প্রফেসর সাহা লক্ষ্য করলেন, অরুণিমার হাসির ভঙ্গিটা যেন মাঝে মাঝে বদলে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে হাসিটা আরও উজ্জ্বল, যেন কোনো গোপন আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে; কখনও বা তাতে এক চাপা বিষাদের ছায়া, যেন কোনো গভীর কষ্ট লুকিয়ে আছে। আবার কখনও কখনও, সেই হাসিতে এক সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বা এমনকি এক শীতল ভয়ের ছাপ ফুটে উঠত, যা দেখে প্রফেসর সাহার গা শিউরে উঠত, তার মনে হতো যেন অরুণিমা তাকে উপহাস করছে, অথবা তাকে কোনো অশুভ খেলার অংশীদার হতে বলছে। প্রথমে তিনি ভাবলেন, এটা হয়তো তার চোখের ভুল, বা ল্যাবের আলোর তারতম্য। তিনি নিজেকে বোঝাতেন, “এসব মনের ভুল, একটা পুরনো ছবির আর কী বা পরিবর্তন হবে!” কিন্তু একদিন রাতে, যখন তিনি একাই ল্যাবে কাজ করছিলেন, বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, আর ল্যাবের পুরনো ঘড়িটার টিক টিক শব্দ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠছিল, তখন তিনি স্পষ্ট দেখলেন, ছবির অরুণিমার চোখ দুটি যেন তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, আর তার হাসিটা যেন এক নতুন অর্থ বহন করছে, যা তাকে এক গভীর জিজ্ঞাসার মুখে ফেলে দিল। তার মনে হলো, ছবিটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, এবং তাকে কোনো গোপন খেলার অংশীদার হতে বলছে, যার নিয়মকানুন তার অজানা, এবং যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এরপর আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। কখনও মনে হতো ছবিটি কথা বলছে। খুব ক্ষীণভাবে, যেন বাতাসের ফিসফিসানির মতো, কিছু শব্দ ভেসে আসত, যা কেবল তার কানেই পৌঁছাত। প্রফেসর সাহা প্রথমে কিছু বুঝতে পারতেন না, তিনি ভাবতেন হয়তো তার কানে ভুল শুনছেন, বা তার মন তাকে বিভ্রান্ত করছে, কিন্তু শব্দগুলো এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, তিনি তা উপেক্ষা করতে পারতেন না। তিনি যখন ছবির দিকে গভীর মনোযোগ দিতেন, তখন মনে হতো যেন অরুণিমা তাকে কিছু সংকেত দিচ্ছে, কোনো লুকানো বার্তা পাঠাচ্ছে, যা তাকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিচ্ছিল, যার কোনো শেষ ছিল না, এবং যার প্রতিটি মোড়ে নতুন রহস্য লুকিয়ে ছিল। একদিন তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন, “খাতা… খাতা… নকল… নকল… সাবধান… সাবধান… ওরা আসছে… ওরা আসছে…”। শব্দগুলো এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, প্রফেসর সাহা চমকে উঠলেন, তার শরীর হিম হয়ে গেল। তার মনে হলো, অরুণিমা যেন তাকে কোনো অন্যায়ের কথা বলতে চাইছে, অথবা তাকে কোনো মিথ্যা জালে জড়াচ্ছে, যা তাকে এক গভীর বিপদের দিকে ঠেলে দেবে, এবং তার জীবনও বিপন্ন হতে পারে। এই শব্দগুলো কি সত্যিই অরুণিমার, নাকি অন্য কোনো অশুভ শক্তির, যা তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে, অথবা তাকে এক অজানা শত্রুর দিকে পরিচালিত করছে? প্রফেসর সাহা অরুণিমার পরীক্ষার খাতার কথা ভাবলেন। তিনি আবার আর্কাইভ ঘাঁটলেন, এবার আরও নিবিষ্টভাবে, যেন তার জীবন এই খাতার ওপরই নির্ভর করছে, এবং এই খাতা তাকে এক নতুন সত্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে, যা হয়তো কলেজের অন্ধকার ইতিহাসকে উন্মোচন করবে। অরুণিমার পরীক্ষার খাতা খুঁজে বের করলেন। খাতার শেষ পাতায়, যেখানে সাধারণত শিক্ষকের মন্তব্য থাকে, সেখানে প্রফেসর সাহা এক অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পেলেন। সেটি একটি ছোট তারার মতো চিহ্ন, যা অরুণিমার নিজের হাতে আঁকা। এই চিহ্নটি তিনি আগেও অরুণিমার কিছু ব্যক্তিগত নোটবুকে দেখেছিলেন, যা তিনি আর্কাইভ ঘাঁটতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন। এই তারা চিহ্নটি অরুণিমার স্বাক্ষর ছিল, তার নিজস্ব প্রতীক, কিন্তু এর অর্থ কি শুধু একটি স্বাক্ষর? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গোপন বার্তা, যা তাকে এক বিপজ্জনক সত্যের দিকে পরিচালিত করবে, এবং তাকে এক অজানা শত্রুর মুখোমুখি দাঁড় করাবে? প্রফেসর সাহার মনে হলো, এই তারা চিহ্নটি যেন কোনো প্রাচীন গুপ্ত সমাজের প্রতীক, যার সাথে অরুণিমা কোনোভাবে জড়িত ছিল। তারার চিহ্নটি তাকে নতুন করে ভাবাল। অরুণিমার ডায়েরি বা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কি এখনও কলেজে কোথাও আছে? তিনি কলেজের পুরনো লাইব্রেরির সেই অংশটি খুঁজতে লাগলেন, যেখানে পুরনো বইপত্র আর অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্তূপ করে রাখা হতো, যেখানে বছরের পর বছর ধরে কেউ পা রাখত না, এবং যেখানে ধুলোর আস্তরণ ছিল কয়েক ইঞ্চি পুরু, আর বাতাসের প্রতিটি ঝাপটায় পুরনো কাগজের গন্ধ ভেসে আসত। দিনের পর দিন তিনি সেই ধুলো জমা ঘরে কাটালেন, তার পোশাক ধুলোয় ধূসর হয়ে যেত, কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে পরিচালিত করছিল, এবং তাকে এক অজানা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, যা তাকে এক গভীর সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। অবশেষে, একটি পুরনো আলমারির পেছনে, যেখানে মাকড়সার জাল আর ধুলোর আস্তরণ ছিল, তিনি একটি ছোট কাঠের বাক্স খুঁজে পেলেন। বাক্সটি খুলতেই তার ভেতরে পাওয়া গেল অরুণিমার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি, কিছু হাতে লেখা গান, আর একটি ছোট, রুপোর লকেট। লকেটটি ছিল একটি ভাঙা হার্টের আকৃতির, তার ভেতরে কোনো ছবি ছিল না, শুধু একটি ছোট, সূক্ষ্ম খোদাই করা সাপেল চিহ্ন ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি কোনো প্রাচীন গোপন সমাজের প্রতীক, অথবা কোনো নিষিদ্ধ বিদ্যার চিহ্ন, যা কেবল বিশেষ ব্যক্তিরাই বুঝতে পারবে। লকেটের ঠান্ডা স্পর্শ প্রফেসর সাহার মনে এক অজানা ভয় জাগিয়ে তুলল, তার মনে হলো তিনি যেন কোনো নিষিদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে চলেছেন। ডায়েরিটি খুলতেই প্রফেসর সাহা অরুণিমার হাতের লেখা দেখতে পেলেন। ডায়েরিতে অরুণিমা লিখেছিল তার স্বপ্ন, তার গান, আর তার ভালোবাসার কথা। সে লিখেছিল, সে তার পরীক্ষার ফলাফলের দিন খুব চিন্তিত ছিল, কারণ সে জানত, তার এক সহপাঠী, যে ছিল কলেজের অধ্যক্ষের ছেলে, সে তার খাতা থেকে কিছু অংশ নকল করেছিল। অরুণিমা এই বিষয়টি শিক্ষকদের জানাতে চেয়েছিল, কারণ সে ছিল সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ, কিন্তু ডায়েরির কিছু অংশে তার ভেতরের দ্বিধা এবং প্রতিশোধের এক সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও ছিল, যা প্রফেসর সাহাকে ভাবিয়ে তুলল। তাকে অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল যদি সে মুখ খোলে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হবে, এমনকি তার পরিবারেরও ক্ষতি হতে পারে, যা তাকে এক গভীর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। অরুণিমা লিখেছিল, এই হুমকি তাকে আরও দৃঢ় করেছে, কিন্তু একই সাথে তার মনে এক গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যা তাকে এক অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছিল, যেখানে সে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল। ডায়েরির শেষ পাতায় অরুণিমা লিখেছিল: “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমি জানি, সত্য প্রকাশ করতে গেলে আমাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে, হয়তো আমার জীবনও বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু আমি পিছু হটব না। আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। যদি কিছু ঘটে যায়, তাহলে এই ডায়েরি আর লকেট আমার শেষ কথা বলবে, আমার নীরব আর্তনাদ হবে, যা মৃত্যুর পরেও সত্যকে প্রকাশ করবে। আমার শেষ আশ্রয় হবে কলেজের সবচেয়ে পুরনো বটগাছটি, যেখানে আমি আমার গান গাইতাম, যেখানে আমি শান্তি খুঁজে পেতাম, এবং যেখানে আমার শেষ বার্তা লুকিয়ে থাকবে, যা কেবল যোগ্য ব্যক্তিরাই খুঁজে পাবে।” কিন্তু এই বার্তা কি কেবল সত্য প্রকাশের জন্য, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল? অরুণিমা কি সত্যিই নিছকই এক নিরীহ শিকার ছিল, নাকি তারও কোনো গোপন এজেন্ডা ছিল, যা তাকে এক বিপজ্জনক খেলায় ঠেলে দিয়েছিল? ডায়েরির প্রতিটি শব্দ প্রফেসর সাহার মনে এক নতুন সন্দেহ জাগিয়ে তুলছিল। প্রফেসর সাহা ডায়েরিটি শেষ করে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। অরুণিমা নিখোঁজ হয়নি, তাকে হয়তো জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তার নকলের বিষয়টি প্রকাশ না পায়। কিন্তু তার মন বলছিল, গল্পটা হয়তো আরও জটিল, আরও অন্ধকার। অরুণিমা কি কেবল একজন শিকার ছিল, নাকি সে নিজেই ছিল এক রহস্যময় পরিকল্পনার অংশীদার? আর সেই বটগাছ! কলেজের পুরনো ক্যাম্পাসের এক প্রান্তে একটি বিশাল বটগাছ ছিল, যার নিচে ছাত্রছাত্রীরা আড্ডা দিত, তার ছায়ায় বসে গল্প করত, কিন্তু তার ঝুরিগুলো যেন এক অজানা রহস্যকে আড়াল করে রেখেছিল, যা সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়েছিল। প্রফেসর সাহা দ্রুত সেই বটগাছের কাছে গেলেন। বটগাছের বিশাল ঝুরিগুলো যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছিল, অথবা তাকে কোনো ফাঁদে ফেলছিল, যা থেকে তার বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। বটগাছের নিচে তিনি অরুণিমার লেখা একটি ছোট চিরকুট পেলেন, যা একটি পাথরের নিচে চাপা দেওয়া ছিল। চিরকুটে লেখা ছিল: “সত্য একদিন প্রকাশিত হবে। আমার হাসিই হবে তার প্রমাণ। অন্ধকার চিরকাল সত্যকে ঢেকে রাখতে পারে না। কিন্তু সত্যের পথ সবসময় সরল হয় না। যারা সত্যকে আড়াল করতে চায়, তাদের পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।” এই শেষ বাক্যটি প্রফেসর সাহাকে ভাবিয়ে তুলল। এটি কি কেবল একটি হুমকি, নাকি এর পেছনে কোনো গভীর পরিকল্পনা ছিল, যা অরুণিমা মৃত্যুর পরেও কার্যকর করতে চেয়েছিল? চিরকুটের লেখা যেন তার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছিল। প্রফেসর সাহা বুঝতে পারলেন, অরুণিমা নিখোঁজ হয়নি, তাকে হয়তো খুন করা হয়েছিল, বা এমন কিছু ঘটেছিল যা তাকে চিরতরে নীরব করে দিয়েছিল। কিন্তু তার হাসি, তার ছবি, তার ডায়েরি – এই সবই ছিল সত্যের প্রমাণ। অরুণিমার হাসিটা যেন এখন আর কেবল হাসির ভঙ্গি নয়, সেটি যেন এক নীরব প্রতিবাদ, এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি, যা মৃত্যুর পরেও সত্যকে প্রকাশ করতে চাইছে, কিন্তু সেই সত্যের পেছনে কি কোনো অন্ধকার দিকও ছিল? অরুণিমা কি কোনো গোপন প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছিল, যা তার মৃত্যুর পরেও কার্যকর হবে? প্রফেসর সাহার মনে হলো, তিনি যেন এক অদৃশ্য শক্তির জালে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রফেসর সাহা অরুণিমার ডায়েরি আর চিরকুট নিয়ে পুলিশের কাছে গেলেন। প্রথমে পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি, ৫০ বছর আগের একটি পুরনো কেস নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? ইন্সপেক্টর রায়, যিনি এই কেসের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি প্রথমে প্রফেসর সাহাকে একজন পাগলাটে গবেষক ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রফেসর সাহা তার সমস্ত প্রমাণ, তার গবেষণা, এবং ছবিটির রহস্যময় পরিবর্তনের কথা তুলে ধরলেন। তিনি ছবিটির প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি ফিসফিসানি, প্রতিটি সংকেত ব্যাখ্যা করলেন। তার দৃঢ়তা এবং যুক্তির কাছে পুলিশ হার মানল। পুরনো ফাইল আবার খোলা হলো। অরুণিমার ডায়েরি, তার পরীক্ষার খাতা, এবং সেই রহস্যময় ছবিটি ছিল প্রধান প্রমাণ। ছবিটির হাসির ভঙ্গি, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছিল, তা যেন অরুণিমার মনের ভেতরের সত্যকে প্রকাশ করছিল, যা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করলেন। ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল, অরুণিমার খাতার কিছু অংশে সত্যিই অন্য হাতের লেখা ছিল, যা অধ্যক্ষের ছেলের হাতের লেখার সাথে মিলে যায়। দীর্ঘ তদন্তের পর, ৫০ বছর আগের সেই রহস্যের জট খুলল। অধ্যক্ষের ছেলে অরুণিমাকে ভয় দেখিয়েছিল, যাতে সে নকলের কথা প্রকাশ না করে। কিন্তু অরুণিমা রাজি হয়নি। ফলাফলের দিন, অরুণিমা যখন সত্য প্রকাশ করতে যাচ্ছিল, তখন অধ্যক্ষের ছেলে তাকে জোর করে আটকে রাখে এবং এক ধস্তাধস্তিতে অরুণিমা সিঁড়ি থেকে পড়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়। অধ্যক্ষ এবং তার ছেলে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়, অরুণিমার মৃতদেহ গোপনে সরিয়ে ফেলে, এবং অরুণিমার নিখোঁজ হওয়ার গল্প ফেঁদেছিল। অধ্যক্ষের ছেলে ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, এবং এত বছর ধরে অন্য নামে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু কিছু পুলিশ অফিসারের মনে সন্দেহ রয়ে গেল, অরুণিমার মৃত্যু কি সত্যিই নিছকই দুর্ঘটনা ছিল, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো ষড়যন্ত্র ছিল? অধ্যক্ষের ছেলের স্বীকারোক্তি কি সম্পূর্ণ ছিল? অরুণিমার ডায়েরিতে যে সাপেল চিহ্ন ছিল, তার অর্থ কী? লকেটের ভাঙা হার্ট কি কেবল প্রেমের প্রতীক, নাকি কোনো ভাঙা প্রতিজ্ঞার? ইন্সপেক্টর রায় এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আরও গভীরে যেতে চাইলেন। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর পুরো ‘অরুণোদয় মহাবিদ্যালয়’ যেন নড়ে উঠল। ৫০ বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা এক নির্মম সত্য উন্মোচিত হলো। অধ্যক্ষের ছেলে, যিনি এখন একজন বৃদ্ধ, তাকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হলো। তার স্বীকারোক্তির পর সব পরিষ্কার হয়ে গেল। অরুণিমার পরিবার, যারা এত বছর ধরে তাদের মেয়ের জন্য শোক পালন করছিল, তারা অবশেষে শান্তি পেল, কিন্তু তাদের চোখে ছিল এক গভীর ক্ষত। অরুণিমার স্মৃতিতে কলেজে একটি নতুন ভবন তৈরি হলো, যার নাম দেওয়া হলো “অরুণিমা স্মৃতি ভবন”। সেই পুরনো ক্যামেরা এবং ছবিটি কলেজের জাদুঘরে সযত্নে রাখা হলো, যা এখন শুধু একটি ছবি নয়, এটি সত্যের প্রতীক, ন্যায়ের প্রতীক। প্রতি বছর কলেজের নতুন শিক্ষার্থীরা যখন জাদুঘরে যায়, তারা অরুণিমার গল্প শোনে, আর বুঝতে পারে, সত্যকে কোনোদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না, তা যতই পুরনো হোক না কেন। প্রফেসর সাহা যখনই সেই ছবির দিকে তাকান, তখন অরুণিমার হাসিটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই হাসি আর কেবল একটি হারানো ছবির হাসি নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক বিজয়ী হাসি, যা ৫০ বছর ধরে নীরব ছিল, কিন্তু অবশেষে সত্যকে প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রফেসর সাহার মনে মাঝে মাঝে এক অজানা প্রশ্ন উঁকি দেয় – অরুণিমার ডায়েরিতে লেখা সেই সাপেল চিহ্ন, বা লকেটের ভাঙা হার্ট, এর পেছনের রহস্য কি সত্যিই উন্মোচিত হয়েছে? সাপেল চিহ্নটি কি কোনো গোপন সংস্থার প্রতীক ছিল, যারা অরুণিমাকে সাহায্য করেছিল, অথবা তাকে ব্যবহার করেছিল? লকেটের ভাঙা হার্ট কি কেবল অবিনাশের প্রতি অরুণিমার ভালোবাসার প্রতীক ছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গভীর অর্থ লুকিয়ে ছিল, যা অরুণিমার শেষ প্রতিশোধের ইঙ্গিত দিচ্ছিল? নাকি অরুণিমার হাসি আরও গভীর কোনো সত্যকে আড়াল করে রেখেছে, যা আজও অধরা? আর কলেজের দেওয়ালে, বাতাসের প্রতিটি ফিসফিসে, হারানো ছবির হাসি যেন চিরকাল প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী বার্তা নিয়ে – “সত্যের জয় অনিবার্য,” কিন্তু সেই জয় কি সবসময় সম্পূর্ণ হয়? প্রফেসর সাহা প্রায়ই ভাবেন, অরুণিমা কি কেবল একজন শিকার ছিল, নাকি সে নিজেই ছিল এক রহস্যময় পরিকল্পনার অংশীদার, যার শেষ অধ্যায় এখনও লেখা হয়নি, এবং যার পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে? তার মনে হয়, অরুণিমার হাসি যেন তাকে এক নতুন রহস্যের দিকে ইশারা করছে, যা হয়তো তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে তাড়া করে ফিরবে। ~সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion