ভুতুড়ে ডাকবাক্স: (The Hunted Postbox)
গ্রামের নাম শান্তিপুর। নামটা যেমন সুন্দর, গ্রামটাও তেমনই শান্ত, ছবির মতো। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, যেখানে বাতাসের প্রতিটি দোলায় যেন সবুজের ঢেউ খেলে যায়। আঁকাবাঁকা মেঠো পথগুলো গ্রামের প্রতিটি কোণকে যেন এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে, আর ছোট ছোট মাটির বাড়িগুলো, তাদের গায়ে লেগে থাকা লতাগুল্ম আর মাটির গন্ধ, যেন এক নিপুণ শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক জীবন্ত ক্যানভাস। সকালের নরম সোনালী আলোয় শিশির ভেজা ঘাস চিকচিক করে, আর বিকেলের সোনা রোদ যখন গাছের পাতায় এসে পড়ে, তখন পুরো গ্রামটাই যেন এক মায়াবী আবরণে ঢেকে যায়, যেখানে সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু এই শান্তিপুরের এক কোণে ছিল এক জীর্ণ, শ্যাওলা ধরা পুরনো বাড়ি। প্রায় শত বছরের পুরনো সেই বাড়িটি একসময় হয়তো কোনো সম্পন্ন গৃহস্থের বসতবাড়ি ছিল, যেখানে হাসি-ঠাট্টা আর জীবনের কোলাহল ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু বহু বছর ধরে এটি পরিত্যক্ত, তার ভাঙা জানলাগুলো, যেখানে কাঁচের বদলে এখন কেবল শূন্যতা, যেন ভেতরের অন্ধকার আর নীরবতাকে আরও রহস্যময় করে তুলত। বাতাসের প্রতিটি ঝাপটায় তার মরচে ধরা কপাটগুলো করুণ সুরে কেঁপে উঠত, আর ছাদের ভাঙা টালিগুলো থেকে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ত বাড়ির স্যাঁতসেঁতে উঠোনে, যেন বাড়িটিও কাঁদছে তার হারানো দিনের জন্য।
আর সেই বাড়ির সামনেই একাকী দাঁড়িয়ে ছিল একটি মরচে ধরা ডাকবাক্স। লোহা আর কাঠের মিশেলে তৈরি, তার লাল রঙটা সময়ের সাথে সাথে বিবর্ণ হয়ে ধূসর হয়ে গিয়েছিল, যেন এক দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন প্রহরী। এর গায়ে জমেছিল শতাব্দীর ধুলো আর শ্যাওলার আস্তরণ, যা তাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছিল।
লোকমুখে প্রচলিত ছিল, রাতের বেলা নাকি সেই ডাকবাক্স থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসে। কখনও ফিসফিস, যেন কেউ গোপন কথা বলছে; কখনও বা চাপা গোঙানি, যেন কেউ গভীর কষ্টে কাঁদছে। গ্রামের ছোটরা তো ভয়ে সেদিকে যেতই না, এমনকি দিনের বেলাতেও তারা ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করত, তাদের চোখমুখে এক অজানা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠত। আর বড়রাও পারতপক্ষে জায়গাটা এড়িয়ে চলত, তাদের মুখে মুখে ফিরত ডাকবাক্সের অলৌকিক গল্প। কেউ বলত, ওটা নাকি কোনো অতৃপ্ত আত্মার ডাকবাক্স, যারা তাদের প্রিয়জনের কাছে পৌঁছাতে না পারা চিঠিগুলোর জন্য কেঁদে মরে। আবার কেউ বলত, ওটা নাকি পুরনো দিনের কোনো গুপ্তধনের প্রহরী, যার ভেতরে লুকানো আছে এমন কিছু যা মানুষের লোভকে আকর্ষণ করে। একবার নাকি গ্রামের এক মাতাল যুবক রাতে সাহস করে ডাকবাক্সের কাছে গিয়েছিল, পরদিন সকালে তাকে পাওয়া গিয়েছিল বাড়ির উঠোনে জ্ঞানশূন্য অবস্থায়, তার মুখে ছিল এক বিকৃত ভয়ের ছাপ। সেই থেকে ডাকবাক্সের রহস্য আরও গভীর হয়।
রাতুল, শান্তিপুরের এক সাহসী যুবক। বয়স বাইশ-তেইশ, চোখে তার তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্য আর মনে অদম্য কৌতূহল। গ্রামের অন্য যুবকদের মতো সে আড্ডাবাজ হলেও, তার মনটা ছিল যুক্তিবাদী, আর তার চোখে ছিল অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। সে এসব ভূত-প্রেত বা অলৌকিক গল্পে বিশ্বাস করত না। তার কাছে সবই ছিল মানুষের মনের ভুল বা নিছকই কুসংস্কার। যখনই ডাকবাক্সের প্রসঙ্গ উঠত, সে মুচকি হেসে বলত, “আরে বাবা, ওসব হাওয়ার শব্দ! পুরনো লোহায় মরচে পড়লে কি আর বাঁশি বাজে নাকি? আর ইঁদুর-টিদুর তো আছেই, তারাই হয়তো ঘুরে বেড়ায়। মানুষের মনই আসল ভূত।”
তার বন্ধু সুমন, যে কিনা একটু ভীতু প্রকৃতির, সে চোখ বড় বড় করে বলত, “আরে না রে রাতুল! আমি নিজে শুনেছি। কেমন যেন একটা করুণ সুর ভেসে আসে, গা ছমছম করে ওঠে! মনে হয় যেন কেউ অনেক দূর থেকে গাইছে, কিন্তু কাছে গেলেই সব চুপ হয়ে যায়। তুই নিজে না গেলে বুঝবি না।”
একদিন আড্ডায় বসেই রাতুল বন্ধুদের সাথে বাজি ধরল। “ঠিক আছে, যদি এতই রহস্য থাকে, আমি আজ রাতেই যাব ওই ডাকবাক্সের কাছে। দেখব কীসের শব্দ আসে! আর প্রমাণ হিসেবে ডাকবাক্সের ভেতরের কিছু একটা নিয়ে আসব। যদি কিছু না পাই, তাহলে তোরা আমাকে একমাস বিনা পয়সায় চা খাওয়াবি।”
বন্ধুরা প্রথমে তাকে আটকাতে চাইল। “না রে রাতুল, ওসব ভালো না। কেন অকারণে বিপদ ডেকে আনছিস? মাতালটার কথা মনে নেই?” কিন্তু রাতুলের জেদের কাছে হার মানল। অবশেষে ঠিক হলো, রাতুল একাই যাবে, আর প্রমাণ হিসেবে ডাকবাক্সের ভেতরের কিছু একটা নিয়ে আসবে।
সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, তারার চিহ্নমাত্র নেই। গ্রামের পথঘাট নিস্তব্ধ, কেবল ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক আর নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। বাতাসের প্রতিটি ফিসফিসে যেন এক অজানা বার্তা ছিল, যা কেবল অনুভব করা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না। রাতুল একটা পুরনো হারিকেন হাতে নিয়ে রওনা দিল সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় তার ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে পেছনে দৌড়াচ্ছিল, যেন তাকে অনুসরণ করছে কোনো অদৃশ্য সত্তা। বুকের ভেতরটা একটু দুরুদুরু করলেও, রাতুল নিজেকে বোঝাল, “এসব মনের ভুল। কিচ্ছু হবে না। আমি তো আর ভূতের গল্প লিখতে যাচ্ছি না, আমি যাচ্ছি একটা রহস্যের জট খুলতে।” তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল।
ধীরে ধীরে সে সেই জীর্ণ বাড়ির কাছে পৌঁছাল। শ্যাওলা ধরা দেয়ালগুলো যেন তাকে গ্রাস করতে চাইছে। ভাঙা জানলাগুলো দিয়ে ভেতরের অন্ধকার উঁকি মারছে, মনে হচ্ছে যেন অগণিত চোখ তাকে দেখছে। আর তার ঠিক সামনেই, একাকী দাঁড়িয়ে আছে সেই মরচে ধরা ডাকবাক্স। হারিকেনের আলোয় তার ওপরের লালচে আভাটা আরও গাঢ় দেখাচ্ছিল, যেন রক্তিম এক রহস্যের প্রবেশদ্বার। ডাকবাক্সের গা থেকে এক পুরনো, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আসছিল, যা বহু বছর ধরে জমে থাকা নীরবতার গন্ধ।
একটু ইতস্তত করে রাতুল কান পাতল ডাকবাক্সের গায়ে। প্রথমে কিছুই শুনতে পেল না। শুধু নিজের হৃদপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। তারপর হঠাৎ, খুব ক্ষীণভাবে, যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে, এক অদ্ভূত সুর তার কানে এল। এ সুর কোনো ভয়ের সুর নয়, কোনো গোঙানিও নয়। এ যেন এক পুরনো, চাপা পড়া ভালোবাসার গান। সুরটা তার চেনা মনে হলো না, কিন্তু তার প্রতিটি নোটেই ছিল গভীর আবেগ, এক অব্যক্ত বেদনা। সুরটা এতটাই করুণ ছিল যে রাতুলের মনে হলো, এই সুর যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে, ৫০ বছরের পুরনো কোনো গল্প শোনাতে চাইছে। তার সমস্ত সত্তা যেন সেই সুরের টানে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
সাহস সঞ্চয় করে রাতুল ডাকবাক্সের ঢাকনাটা খুলল। মরচে ধরা কব্জাগুলো কঁকিয়ে উঠল এক কর্কশ শব্দে, যেন ডাকবাক্সটা বহুদিনের নীরবতা ভেঙে কথা বলতে চাইছে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সে অনুভব করল কিছু একটা। সাবধানে সেটা বের করে আনল। হারিকেনের আলোয় সে দেখল, সেটা একটা বহু পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি। চিঠিটা ভাঁজ করা ছিল, তার ওপরের অংশে হালকা লালচে কালিতে লেখা একটি নাম – “অরুণিমা”। অক্ষরগুলো এতই পুরনো যে মনে হচ্ছিল একটু চাপ দিলেই বুঝি গুঁড়ো হয়ে যাবে। চিঠিটা হাতে নিয়ে রাতুলের মনে হলো, সে যেন এক প্রাচীন সময়ের টুকরো হাতে ধরে আছে।
চিঠিটা হাতে নিয়ে রাতুল যখন শান্তিপুরের দিকে ফিরছিল, তখন তার মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি। একদিকে বন্ধুদের সাথে বাজিতে জেতার আনন্দ, অন্যদিকে এক গভীর রহস্যের হাতছানি। তার যুক্তিবাদী মনে এই আবেগপ্রবণ সুর আর চিঠি এক নতুন চিন্তার জন্ম দিচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো এক পুরনো উপন্যাসের পাতায় ঢুকে পড়েছে। বন্ধুদের সামনে চিঠিটা বের করতেই তাদের চোখ কপালে উঠল। সুমন ভয়ে ভয়ে বলল, “কিরে রাতুল, এটা কী এনেছিস? কোনো ভূতের চিঠি নয় তো? তোর গা থেকে কেমন যেন একটা পুরনো গন্ধ আসছে, মনে হচ্ছে তুই কোনো পুরনো দিনের জাদুঘরে ঘুরে এসেছিস।”
রাতুল হাসল। “ভূত নয় রে, একটা পুরনো চিঠি। মনে হচ্ছে এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে ডাকবাক্সের রহস্য। চল, কাল সকালে এটা নিয়ে বসব।”
পরদিন সকালে, রাতুল চিঠিটা নিয়ে বসল। সকালের নরম আলোয় চিঠিটা যেন আরও বেশি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। সাবধানে ভাঁজ খুলতেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের ওপর ফুটে উঠল হাতের লেখা। পুরনো দিনের সেই টানা টানা অক্ষরগুলো যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, প্রতিটি অক্ষরে যেন লুকিয়ে আছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। চিঠির উপরে কোনো তারিখ ছিল না, শুধু লেখা ছিল “প্রিয় অরুণিমা”।
চিঠিতে লেখা ছিল:
“প্রিয় অরুণিমা,
জানি না এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে কিনা। হয়তো পৌঁছাবে না। কারণ আমি জানি, তুমি আর কোনোদিন ফিরবে না। আমার দোষেই তুমি চলে গেছ। আমার ভীরুতা, আমার সিদ্ধান্তহীনতা তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমি পারিনি তোমার পাশে দাঁড়াতে, যখন তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে আমি নিজেকে ধিক্কার দিই, আমার কাপুরুষতার জন্য।
সেই ঝড়ের রাতের কথা মনে আছে? যখন তুমি বলেছিলে, তুমি চলে যাবে, আর আমি তোমাকে আটকাতে পারিনি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি নির্বাক ছিলাম, যেন আমার কণ্ঠনালী অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার পা দুটি যেন মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল। তুমি বলেছিলে, যদি কখনো ফিরি, এই ডাকবাক্সেই আমার জন্য একটি চিঠি রেখে যেও। আমি সেই আশায় আজও এই ডাকবাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকি, প্রতিদিন, প্রতি রাতে। জানি, তুমি আসবে না, কিন্তু তবুও আমার মন মানে না।
আমার জীবনটা এখন অর্থহীন। তোমার হাসি, তোমার গান ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। তোমার মিষ্টি হাসি, যা আমার প্রতিটি দুঃখ ভুলিয়ে দিত, আজ তা শুধু স্মৃতি। তোমার গানের সুর, যা আমার হৃদয়ে শান্তি এনে দিত, আজ তা কেবল নীরবতা। এই গ্রামে তোমার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। তুমি যদি জানো, আমি কত অনুতপ্ত। যদি আর একবার সুযোগ পেতাম, আমি সব ছেড়ে তোমার হাত ধরে চলে যেতাম, এই সমাজের কোনো বাধা মানতাম না, কোনো জমিদারী বা সম্মান আমার কাছে তোমার চেয়ে বড় ছিল না… কিন্তু সে সুযোগ আর আসবে না। আমার জীবন এখন এক জীবন্ত নরক।”
ইতি,
তোমার চিরন্তন অনুরাগী,
অবিনাশ”
চিঠিটা পড়ে রাতুল স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক করুণ প্রেমের গল্প। অবিনাশ আর অরুণিমা। ৫০ বছর আগে, শান্তিপুরের এই ডাকবাক্সের সামনেই হয়তো তাদের শেষ দেখা হয়েছিল, বা হয়তো শেষ দেখা হয়নি। কিন্তু কেন অরুণিমা চলে গিয়েছিল? কী এমন ঘটেছিল সেই ঝড়ের রাতে? আর অবিনাশই বা কে? তার মনে হলো, এই চিঠি শুধু একটি প্রেমপত্র নয়, এটি একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের প্রথম পাতা, যার বাকি অংশ খুঁজে বের করা তার দায়িত্ব।
রাতুল গ্রামের প্রবীণদের কাছে খোঁজ নেওয়া শুরু করল। প্রথমে কেউ কিছু বলতে পারল না। পুরনো দিনের কথা, অনেকেই ভুলে গেছে, বা হয়তো মনে রাখতে চায় না। গ্রামের চায়ের দোকানে, বটতলার আড্ডায় সে ঘুরতে লাগল, সবার কাছে অবিনাশ আর অরুণিমার নাম জানতে চাইল। অবশেষে, গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, নবীন কাকা, যিনি প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁই, তিনি রাতুলের কথা মন দিয়ে শুনলেন। তার চোখেমুখে ফুটে উঠল পুরনো দিনের স্মৃতি, যেন এক ধূসর পর্দা সরে যাচ্ছে তার মনের সামনে থেকে।
“অবিনাশ আর অরুণিমা? হ্যাঁ, মনে পড়ছে,” নবীন কাকা চোখ বুজে বললেন। তার কণ্ঠস্বরে এক গভীর বিষাদ, যেন তিনি নিজেই সেই পুরনো দিনের সাক্ষী। “অবিনাশ ছিল গ্রামের জমিদার বাড়ির ছেলে। খুব ভালো ছেলে ছিল, শান্ত স্বভাবের, লেখাপড়ায় ভালো। আর অরুণিমা ছিল এক সাধারণ ঘরের মেয়ে, তার বাবা ছিলেন গ্রামের সামান্য একজন শিক্ষক। কিন্তু তার গান ছিল অসাধারণ। কোকিলের মতো গলা ছিল তার, সে যখন গাইত, তখন মনে হতো যেন স্বর্গের অপ্সরা গান গাইছে। গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত, দূর দূরান্ত থেকে লোক আসত তার গান শুনতে। তারা একে অপরকে ভালোবাসত খুব, ছোটবেলা থেকেই তাদের প্রেম ছিল যেন রূপকথার গল্পের মতো। লুকিয়ে লুকিয়ে তারা দেখা করত, চিঠি চালাচালি করত। কিন্তু জমিদার বাড়ির লোক এই সম্পর্ক মানতে চায়নি। তাদের কাছে বংশমর্যাদা ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এক সাধারণ শিক্ষকের মেয়ের সাথে তাদের ছেলের বিয়ে তারা কল্পনাও করতে পারত না।”
নবীন কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “সেই ঝড়ের রাতে, অরুণিমা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল অবিনাশের সাথে। তারা ঠিক করেছিল, গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে দেখা করবে, তারপর সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যাবে, যেখানে তাদের কেউ চিনবে না। কিন্তু অবিনাশের বাবা কোনোভাবে তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিলেন। তিনি অবিনাশকে ঘরে আটকে রেখেছিলেন, পাহারা বসিয়েছিলেন যাতে সে বের হতে না পারে। অরুণিমা একাই বেরিয়ে পড়েছিল, প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে, ভেবেছিল অবিনাশ তার জন্য অপেক্ষা করবে। সে ডাকবাক্সের কাছে এসেছিল, হয়তো অবিনাশের জন্য কোনো বার্তা রেখে যেতে। কিন্তু অবিনাশ পৌঁছাতে পারেনি। অরুণিমা সেই রাতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি, তার কোনো খোঁজ মেলেনি। গ্রামের মানুষ অনেক খুঁজেছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অবিনাশ এরপর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল, তার চোখে আর সেই ঔজ্জ্বল্য ছিল না। জমিদার বাড়ির লোকজনও এই ঘটনা নিয়ে আর কথা বলতে চাইত না।”
রাতুল অবাক হয়ে শুনছিল। “তাহলে কি অরুণিমা সেই ডাকবাক্সের কাছে এসেছিল?”
“হতে পারে,” নবীন কাকা বললেন। “ওরা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি কখনো আলাদা হতে হয়, তাহলে এই ডাকবাক্সেই একে অপরের জন্য শেষ বার্তা রেখে যাবে। অবিনাশ হয়তো সেই চিঠিটা অরুণিমার জন্য লিখেছিল, তার অপেক্ষায়, কিন্তু অরুণিমা আর আসেনি। সেই ডাকবাক্সটা যেন তাদের ভালোবাসার এক নীরব সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে।”
রাতুল বুঝতে পারল, ডাকবাক্স থেকে ভেসে আসা সেই করুণ সুর আসলে অবিনাশের ভালোবাসার প্রতিধ্বনি। যে ভালোবাসা ৫০ বছর ধরে ডাকবাক্সের ভেতরে চাপা পড়ে ছিল, নিঃশব্দে কেঁদে মরেছিল। কিন্তু অরুণিমা কোথায় গেল? সে কি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল, নাকি তার ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল? রাতুলের মনে হলো, এই গল্পের শেষ এখনো হয়নি। অরুণিমার অন্তর্ধানের রহস্য এখনো অধরা।
রাতুল আবার সেই চিঠির দিকে তাকাল। অবিনাশের প্রতিটি শব্দে ছিল গভীর বেদনা, এক তীব্র অনুশোচনা। নবীন কাকার কথা মনে পড়ল – অরুণিমার গানের গলা ছিল অসাধারণ। রাতুল ভাবল, ডাকবাক্স থেকে যে সুর ভেসে আসত, সেটা কি শুধুই অবিনাশের বিরহ? নাকি অরুণিমার স্মৃতির কোনো প্রতিধ্বনি?
চিঠির শেষ অংশে অবিনাশ লিখেছিল, “এই গ্রামে তোমার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই।” রাতুল ভাবল, অরুণিমার স্মৃতি বলতে কি শুধু তার উপস্থিতি? নাকি তার গানের কোনো বিশেষ জায়গা? নবীন কাকার কাছে সে আবার গেল।
“কাকা, অরুণিমা কি কোথাও বসে গান গাইত? কোনো বিশেষ জায়গা ছিল যেখানে সে তার গান গাইত? যেখানে সে তার সুর ছড়িয়ে দিত?”
নবীন কাকা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। তার চোখে এক ঝলক আলো দেখা গেল। তারপর বললেন, “হ্যাঁ, ছিল। গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে নদীটা একটা বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা পুরনো বটগাছ আছে। বটগাছের নিচে একটা ছোট শিবমন্দির। অরুণিমা নাকি প্রায়ই সেখানে বসে গান গাইত। তার গানের সুর নাকি নদীর স্রোতের সাথে মিশে যেত, আর বাতাস সেই সুর বয়ে নিয়ে যেত বহুদূর। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের অনেকেই যেত তার গান শুনতে। সে বলত, ওই বটগাছ আর নদী নাকি তার গানের প্রেরণা।”
রাতুল আর দেরি করল না। সেদিনই বিকেলে সে বেরিয়ে পড়ল সেই বটগাছের খোঁজে। শান্তিপুরের শেষ প্রান্তে গিয়ে সে দেখল, সত্যিই একটা বিশাল বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে, তার ঝুরিগুলো মাটির গভীরে প্রোথিত, যেন শত শত বছর ধরে সে মাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে। গাছের নিচে একটা ছোট, ভাঙাচোরা শিবমন্দির, শ্যাওলা আর লতাপাতায় ঢাকা। জায়গাটা বেশ নির্জন, কেবল নদীর কুলকুল শব্দ আর পাখির কিচিরমিচির। বাতাসের প্রতিটি ঝাপটায় বটগাছের পাতাগুলো যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।
রাতুল মন্দিরের চারপাশে খুঁটিয়ে দেখল। কোথাও কিছু নেই। সে হতাশ হয়ে ফিরতে যাবে, এমন সময় তার চোখ পড়ল মন্দিরের এক কোণে, একটা ছোট পাথরের নিচে। পাথরটা সরাতেই সেখানে একটা ছোট, কাঠের বাক্স লুকানো ছিল, শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে প্রায় অদৃশ্য। বাক্সটা এতটাই ছোট যে সহজে চোখে পড়ার কথা নয়, মনে হচ্ছিল যেন মাটি নিজেই তাকে লুকিয়ে রেখেছিল।
সাবধানে বাক্সটা বের করে আনল রাতুল। বাক্সটা খুলতেই তার ভেতরে সে পেল একটা ছোট, হলদে হয়ে যাওয়া ডায়েরি আর একটা ভাঙা বাঁশি। বাঁশিটা অরুণিমার হতে পারে, কারণ নবীন কাকা বলেছিলেন, সে বাঁশি বাজাতেও পারত। বাঁশিটার গায়ে খোদাই করা ছিল একটি ছোট প্রজাপতির ছবি, যা অরুণিমার প্রিয় ছিল বলে জানা যায়। ডায়েরি আর বাঁশি দুটোই বহু পুরনো, তাদের গায়ে সময়ের ছাপ স্পষ্ট।
ডায়েরিটা খুলতেই অরুণিমার হাতের লেখা ফুটে উঠল। অবিনাশের চিঠির মতোই টানা টানা অক্ষর, কিন্তু তাতে ছিল এক দৃঢ়তা, এক আত্মবিশ্বাস, যা অবিনাশের চিঠির বিষাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। ডায়েরিতে অরুণিমা লিখেছিল সেই ঝড়ের রাতের কথা।
“আজ অবিনাশ আসেনি। আমি অপেক্ষা করেছিলাম, প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে, কিন্তু সে আসেনি। জমিদার বাড়ির লোকেরা তাকে আটকে রেখেছে, আমি জানি। আমার মন ভেঙে গেছে, আমার হৃদয় রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু আমি হার মানবো না। আমি জানি, এই গ্রামে থাকলে আমার আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই সমাজ আমাকে মেনে নেবে না, অবিনাশও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। আমি আর ফিরব না। আমার গানই এখন আমার একমাত্র সঙ্গী, আমার আশ্রয়, আমার শক্তি। আমি চলে যাচ্ছি, বহুদূর, যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না, যেখানে আমি নতুন করে বাঁচতে পারব, আমার গানকে সম্বল করে। আমি জানি আমার পথ সহজ হবে না, কিন্তু আমি আমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখব। অবিনাশের জন্য আমার ভালোবাসা চিরকাল থাকবে, কিন্তু আমার আত্মসম্মান আর আমার স্বপ্ন তার চেয়েও বড়। এই বাঁশি আর এই ডায়েরি, আমার শেষ স্মৃতিচিহ্ন, এখানে রেখে গেলাম। যদি কখনো কেউ আমার খোঁজ পায়, সে যেন জানে, আমি হেরে যাইনি, আমি পালিয়ে যাইনি, আমি আমার পথ খুঁজে নিয়েছি, নিজের শর্তে।”
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল, অরুণিমা শান্তিপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে কোনো ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করেনি, বরং নিজের জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল। সে হয়তো কোনো বড় শহরের সঙ্গীতশিল্পী হয়েছিল, বা কোনো আশ্রমে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল গানের সাধনায়, বা হয়তো অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছিল, যেখানে তার গানকে কেউ বেঁধে রাখতে পারেনি। তার আত্মসম্মান আর ভালোবাসার মিশ্রণে সে এক নতুন পথ বেছে নিয়েছিল, যেখানে তার গানই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।
রাতুল ডায়েরিটা বন্ধ করল। তার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। ডাকবাক্স থেকে যে করুণ সুর ভেসে আসত, সেটা আসলে অবিনাশের বিরহ আর অরুণিমার চাপা পড়া বেদনার প্রতিধ্বনি। অবিনাশের চিঠি আর অরুণিমার ডায়েরি – দুটি ভিন্ন গল্প, যা একটি ডাকবাক্স আর একটি বটগাছের নিচে এসে মিলেছিল। এই ডাকবাক্স কোনো ভূতের নয়, বরং মানুষের গভীর আবেগ, ভালোবাসা আর হারানোর এক নীরব সাক্ষী। এটি দুটি জীবনের এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের প্রতীক, যেখানে ভালোবাসা আর আত্মসম্মান মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল।
রাতুল সেই পুরনো ডাকবাক্সের কাছে ফিরে গেল। অবিনাশের চিঠিটা সে সাবধানে আবার ডাকবাক্সের ভেতরে রাখল। এবার আর কোনো ভয় নয়, কেবল এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ। সে বুঝতে পারল, কিছু রহস্যের সমাধান হয় না, শুধু অনুভব করতে হয়। শান্তিপুরের ডাকবাক্স এখন আর কেবল একটি মরচে ধরা বাক্স নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক নীরব স্মারক, যেখানে দুটি হৃদয়ের গল্প ৫০ বছর ধরে ফিসফিস করে চলেছে, বাতাসের প্রতিটি শোঁ শোঁ শব্দে, আর ঝিঁঝিঁর ডাকে। রাতুল সেই গল্পকে সম্মান জানিয়ে, এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে শান্তিপুরের পথে পা বাড়াল, তার মনে এখন আর কৌতূহল নয়, বরং এক গভীর প্রশান্তি। সে জানত, এই গল্প শান্তিপুরের বাতাসে চিরকাল ভেসে বেড়াবে, আর ডাকবাক্সটি হয়ে থাকবে এক চিরন্তন প্রেমের স্মারক।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion