ট্রামের শেষ যাত্রা” (The Last Journey of the Tram)
কলকাতার ধুলোমাখা রাজপথে, লোহার চাকার ঘর্ষণে এক অদ্ভুত সুর তুলে চলত বিজলি। বিজলি, মানে আমাদের হরিবাবুর ট্রাম। হরিবাবু, যাঁর পুরো নাম হরিমোহন দাস, গত চল্লিশ বছর ধরে এই শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিজলিকে টেনে নিয়ে গেছেন। তার চুল পেকেছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, কিন্তু বিজলির স্টিয়ারিংয়ে তার হাত আজও অটল। সকালের প্রথম আলোয় যখন শহরের ঘুম ভাঙত, তখন হরিবাবু আর বিজলি প্রস্তুত থাকত নতুন দিনের যাত্রার জন্য। বিজলির ভেতরের কাঠের আসনগুলো মসৃণ হয়ে গিয়েছিল অজস্র যাত্রীর স্পর্শে, জানালার কাঁচগুলো যেন শহরের হাজারো গল্প ধরে রেখেছিল, আর তার পুরনো লোহার কাঠামো থেকে ভেসে আসত এক মৃদু ধাতব গন্ধ, যা হরিবাবুর কাছে ছিল পরিচিতির সুবাস। ট্রামের ঘণ্টা বাজিয়ে হরিবাবু যখন যাত্রা শুরু করতেন, তখন সে শব্দ শুধু একটি যানের আগমনী বার্তা দিত না, তা ছিল কলকাতার এক পরিচিত সুর, এক দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, যা এই শহরের প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি বাড়িতে এক ভিন্ন অর্থ বহন করত। প্রতিটি সকালে, ডিপো থেকে বিজলিকে বের করে আনার সময়, হরিবাবু তার ইঞ্জিন পরীক্ষা করতেন, চাকাগুলোয় হাত বুলিয়ে দেখতেন, যেন কোনো প্রিয় সন্তানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। এই ট্রাম যেন তার শরীরেরই একটি অংশ ছিল, যার প্রতিটি স্পন্দন তিনি অনুভব করতে পারতেন, প্রতিটি কম্পন তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যেত। বিজলির প্রতিটি নাট-বোল্ট, প্রতিটি তার যেন হরিবাবুর কাছে জীবন্ত ছিল। তিনি জানতেন, কোন চাকাটি সামান্য বেশি শব্দ করে, কোন ব্রেকটি একটু দেরিতে ধরে। এই জ্ঞান শুধু অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি, এসেছিল নিবিড় ভালোবাসা আর সহমর্মিতা থেকে।
বিজলি শুধু একটা ট্রাম ছিল না হরিবাবুর কাছে। সে ছিল তার সঙ্গী, তার বন্ধু, তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। তার যৌবন কেটেছে বিজলির সঙ্গে, তার পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে বিজলির চাকা ঘুরিয়ে। হরিবাবুর বাবাও ছিলেন এই ট্রামেরই চালক। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সে কতবার এই ডিপোতে এসেছে, ট্রামকে দেখেছে এক জীবন্ত সত্তার মতো, যার প্রতিটি যন্ত্রাংশ যেন কথা বলত। বাবার কাছ থেকেই সে শিখেছিল ট্রাম চালানোর সূক্ষ্ম কৌশল, শিখেছিল যাত্রীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, তাদের মুখের ভাষা বুঝতে। বিজলি যেন তার পারিবারিক ঐতিহ্যেরও অংশ ছিল, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে চলা এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। তার বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন ট্রাম চালানো শুধু একটি কাজ নয়, এটি একটি শিল্প, একটি দায়িত্ব, যা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয়, কারণ এই ট্রাম শুধু লোহালক্কড়ের সমষ্টি নয়, এটি শহরের ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিজলির প্রতিটি খটখট শব্দ, প্রতিটি মোড়ের বাঁক, প্রতিটি যাত্রীর হাসি-কান্না তার চেনা। সে জানত কোন যাত্রী প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ নিয়ে ওঠে, কে কোন স্টপেজে নেমে যায়, আর কোন ছাত্রটি শেষ মুহূর্তে দৌড়ে এসে ট্রাম ধরে, তার স্কুলব্যাগ দুলিয়ে। শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে বিজলি যখন এগিয়ে চলত, তখন তার ভেতরের উষ্ণতা যেন যাত্রীদের মনেও ছড়িয়ে পড়ত, কুয়াশার চাদর ভেদ করে আসা ভোরের আলোয় বিজলির প্রতিটি অংশ ঝলমল করত, যেন সে এক রূপকথার জাহাজ। গ্রীষ্মের দুপুরে যখন শহরের রাস্তা তেতে উঠত, বিজলির ধীর গতিতে বয়ে আসা হাওয়াটুকু ছিল এক স্বস্তির নিঃশ্বাস, যা ক্লান্ত পথিকদের মনেও শান্তি এনে দিত, যেন এক শীতল বারিধারা। বিজলির চাকার নিচে কলকাতার কত গল্প তৈরি হয়েছে, কত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কত স্বপ্ন ডানা মেলেছে, তার ইয়ত্তা নেই। হরিবাবু প্রায়ই দেখতেন, ট্রামের জানালার ধারে বসে কেউ কবিতা লিখছে, কেউবা দূরের কোনো অচেনা মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনছে, আবার কেউবা শুধু শহরের চলমান জীবনকে উপভোগ করছে, তাদের চোখে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা। এই ট্রামই ছিল অনেকের প্রথম প্রেম, প্রথম চাকরির স্মৃতি, বা নিছকই এক ক্লান্ত দিনের আশ্রয়, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে পারত, শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে। হরিবাবুর মনে আছে, একবার এক তরুণী যাত্রী তার ট্রামের ভেতরেই একটি ছোট গল্প লেখা শুরু করেছিল, আর প্রতি সপ্তাহে সে গল্পটি তাকে পড়ে শোনাত। বিজলি যেন সেই গল্পেরও এক নীরব সাক্ষী ছিল। আবার, কোনোবার এক বৃদ্ধ দম্পতি ট্রামে উঠে তাদের যৌবনের গল্প বলতেন, কীভাবে তারা প্রথম ট্রামে চড়েছিলেন, কীভাবে এই ট্রামই তাদের ভালোবাসার সাক্ষী ছিল, তাদের চোখে তখন এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটে উঠত।
কিন্তু সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আধুনিকতার দ্রুতগামী রথে পুরনো সব কিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায়। শহরের বুকে উড়ালপুল আর মেট্রোর জাল বুনতে শুরু করল। দ্রুতগামী যানের ভিড়ে ধীরগতির ট্রাম যেন বেমানান হয়ে পড়ছিল, তার গতি যেন আধুনিক কলকাতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না। ট্রামের পুরনো লাইনগুলো জীর্ণ হয়ে আসছিল, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবও প্রকট হচ্ছিল, যেন অবহেলায় তার শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছিল। ট্রাম কোম্পানিগুলো লোকসানের মুখে পড়ছিল, আর ট্রাম শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছিল, তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠছিল এক অজানা ভয়। একদিন খবর এল, হরিবাবুর লাইনটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। শহরের যানজট কমানোর অজুহাতে, পুরনো ট্রামের বদলে আসবে নতুন বাস, মেট্রো। খবরটা শুনে হরিবাবুর বুকটা যেন খাঁ খাঁ করে উঠল, তার বুকের ভেতরটা যেন নিমিষেই শূন্য হয়ে গেল। বিজলিকে ছেড়ে থাকতে হবে? এই ট্রাম, যা তার সত্তার সঙ্গে মিশে গেছে, তাকে ছেড়ে সে কীভাবে বাঁচবে? তার মনে পড়ল, তার বাবাও শেষ জীবনে ট্রাম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় ভুগেছিলেন, যদিও তার জীবদ্দশায় এমনটা ঘটেনি। আজ সেই আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিতে চলেছে, এক নির্মম সত্যের মতো। হরিবাবু রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতেন না, তার কানে শুধু বিজলির চাকার শব্দ নয়, যেন তার নিজের হৃদয়ের ভাঙার শব্দ শুনতে পেতেন।
শেষ কয়েকটা দিন হরিবাবু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তার রাতের ঘুম উড়ে গেল, চোখের নিচে কালি পড়ল, যেন তার শরীরও বিজলির মতোই জীর্ণ হয়ে আসছিল। সকালের চায়ের দোকানে বসেও তার মন থাকত বিজলির কাছে, তার কানে যেন ট্রামের ঘণ্টার শব্দ বাজত, যা তাকে নিরন্তর তাড়া করে ফিরত। বিজলির প্রতিটি যাত্রায় যেন এক বিদায়ের সুর বাজছিল, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি স্টপেজ যেন তাকে বলছিল, “এই শেষবার।” পুরনো যাত্রীরাও মনমরা, তাদের মুখে বিষাদের ছাপ, তাদের চোখেও ছিল এক অব্যক্ত বেদনা। “কী হবে হরিবাবু, এরপর কীসে যাব? এই ট্রামে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।” – এমন প্রশ্ন ভেসে আসত প্রায়ই, তাদের কণ্ঠস্বরে ছিল এক গভীর হতাশা। কেউ কেউ বলত, “ট্রাম ছাড়া কলকাতা ভাবাই যায় না হরিবাবু। এ তো আমাদের প্রাণের স্পন্দন, আমাদের শৈশবের স্মৃতি, আমাদের প্রথম যৌবনের প্রেম, আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।” হরিবাবু শুধু ম্লান হেসে বলতেন, “সময় বদলাচ্ছে গো, সময় বদলাচ্ছে। পুরনোকে ছেড়ে নতুনকে পথ দিতে হয়।” তার এই কথাগুলো যেন শুধু ট্রামের বিদায় নয়, এক জীবনযাত্রার পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তিনি জানতেন, এই পরিবর্তন শুধু ট্রামের নয়, এ পরিবর্তন তাদের জীবনের, তাদের অভ্যাসের, তাদের স্মৃতির। প্রতিটি স্টপেজে নেমে যাওয়া যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতো, যেন তারা তার কাছ থেকে কিছু একটা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা ছিল তাদের সম্পর্ক, যা আজ ছিন্ন হতে চলেছে। ট্রামের ভেতরে বসে তিনি দেখতেন, কিভাবে শহরের পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে নতুন বহুতল তৈরি হচ্ছে, কিভাবে পুরনো দোকানপাটের বদলে ঝাঁ চকচকে শপিং মল গড়ে উঠছে। এই পরিবর্তনগুলো যেন ট্রামের মতোই ধীর গতিতে হলেও, অনিবার্যভাবে এগিয়ে আসছিল, এক অপ্রতিরোধ্য স্রোতের মতো।
অবশেষে সেই দিনটা এল। লাইনের শেষ যাত্রা। তারিখটা ছিল ১০ই জুলাই, ২০২৫। আকাশ সেদিন মেঘলা ছিল, যেন শহরের মনও ভালো নেই, এক গভীর বিষাদ যেন বাতাসে মিশে ছিল, প্রতিটি মেঘ যেন এক একটি অশ্রুবিন্দু। বিজলিকে নতুন করে সাজানো হয়েছিল, ফুল দিয়ে, তার পুরনো ধূসর রঙে যেন এক নতুন ঔজ্জ্বল্য ফিরে এসেছিল, যা শেষবারের মতো ঝলমল করছিল, যেন সে তার শেষ সাজে সেজেছিল। ডিপোর কর্মীরাও যেন বিষণ্ণ ছিল, তাদের চোখেও ছিল এক অব্যক্ত বেদনা, তারা জানত তাদের রুটি-রুজির উৎস আজ শেষ হতে চলেছে, তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। যাত্রীরা এসেছিল উপচে পড়া ভিড় নিয়ে, ট্রামের ভেতরে তিল ধারণের জায়গা ছিল না, এমনকি ছাদেও অনেকে উঠে পড়েছিল, এক শেষবারের মতো এই ঐতিহাসিক যাত্রার অংশীদার হতে, এই মুহূর্তটিকে নিজেদের স্মৃতিতে ধরে রাখতে। শুধু নিত্যযাত্রীরা নয়, এসেছিল কৌতূহলী মানুষ, যারা হয়তো জীবনে কোনোদিন ট্রামে চড়েনি, কিন্তু এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চায়, এক হারিয়ে যাওয়া যুগের শেষ চিহ্ন দেখতে চায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল, তাদের চোখে বিস্ময় আর আনন্দ, তারা হয়তো বুঝছিল না যে একটি যুগের অবসান হচ্ছে, একটি জীবন্ত ইতিহাস তাদের চোখের সামনে শেষ হচ্ছে, যা তাদের পাঠ্যবইয়ের পাতায় স্থান পাবে। হরিবাবু তার চিরাচরিত সাদা শার্ট আর লুঙ্গি পরে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন। তার চোখে জল ছিল না, কিন্তু এক গভীর শূন্যতা ছিল, যা তার মুখমণ্ডলের প্রতিটি রেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল, তার কাঁপা হাতেই যেন পুরো কলকাতার আবেগ জড়ো হয়েছিল, প্রতিটি কম্পনে যেন শহরের হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছিল। তার হাত কাঁপছিল সামান্য, কিন্তু সে কাঁপুনির কারণ ভয় নয়, ছিল এক দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ বেদনা, এক নীরব বিদায়, যা শব্দহীন হলেও ছিল অত্যন্ত গভীর।
ট্রাম চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, প্রতিটি চাকার ঘূর্ণনে যেন এক দীর্ঘশ্বাস মিশে ছিল, এক বিদায়ী সুর বাজছিল। ট্রামের ঘণ্টা বাজতেই পথচারীরা থমকে দাঁড়াল, তাদের চোখেও ছিল এক মিশ্র অনুভূতি – বিস্ময়, শ্রদ্ধা এবং বিষাদ, যেন তারা এক পুরনো বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছিল। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন হাত নাড়ছিল, কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছিল, কেউবা নীরবে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছিল, তাদের চোখেও ছিল এক অদ্ভুত মায়া, যেন তারা একটি চলমান স্মৃতিকে শেষবারের মতো দেখছিল, যা আর ফিরে আসবে না। হরিবাবুর মনে পড়ছিল প্রথম দিনের কথা, যখন সে প্রথম বিজলির স্টিয়ারিং ধরেছিল, তারুণ্যের সেই উত্তেজনা, সেই স্বপ্ন, যা তাকে এই পেশায় টেনে এনেছিল, এক নতুন জীবনের শুরু। মনে পড়ছিল বৃষ্টির দিনে বিজলির ছাদের নিচে আশ্রয় নেওয়া প্রেমিক যুগলদের কথা, যারা ট্রামের ধীর গতিকে ভালোবাসার সময় করে নিয়েছিল, তাদের ফিসফিসানি যেন আজও তার কানে বাজছিল, এক রোমান্টিক স্মৃতির রেশ রেখে। মনে পড়ছিল পুজোর সকালে বিজলি ভর্তি করে মণ্ডপে যাওয়া পরিবারের কথা, তাদের হাসির শব্দ যেন আজও ট্রামের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, এক আনন্দময় স্মৃতির রেশ রেখে, যা তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিল। আর শীতের বিকেলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দিয়ে যেতে যেতে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ, যা বিজলির খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করে তাদের মনকে শীতল করত, এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিত, এক নিস্তব্ধতার বার্তা। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট, প্রতিটি পুরনো বাড়ি, প্রতিটি চায়ের দোকান যেন বিজলিকে বিদায় জানাচ্ছিল, তাদের নীরব চোখে ছিল এক অব্যক্ত বেদনা, এক নীরব প্রার্থনা। পুরনো দিনের গানগুলো যেন ট্রামের ভেতরেই বাজছিল, এক বিষাদের সুর নিয়ে, যা প্রতিটি যাত্রীর মনে এক গভীর দাগ কেটে যাচ্ছিল, যেন প্রতিটি সুরেই বিজলির দীর্ঘশ্বাস মিশে ছিল, এক শেষ বিদায়ের গান। ট্রাম যখন ধর্মতলার মোড় পেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন হরিবাবুর মনে পড়ল, এই মোড়েই তার বাবার সঙ্গে তার প্রথম ট্রাম দেখা হয়েছিল, সেই দিনের স্মৃতি আজও তার মনে টাটকা। প্রতিটি পরিচিত দৃশ্য যেন এক একটি স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল, প্রতিটি স্মৃতিই যেন তাকে আরও বেশি করে বিজলির সঙ্গে বেঁধে রাখছিল।
শেষ স্টপেজে যখন বিজলি থামল, তখন এক নীরবতা নেমে এল, যা ছিল হাজারো শব্দের চেয়েও ভারী, এক গভীর স্তব্ধতা। যাত্রীরা একে একে নেমে গেল, তাদের চোখেও ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন তারা তাদের শৈশব, তাদের তারুণ্যকে বিদায় জানাচ্ছিল, তাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ আজ শেষ হলো। তারা জানত, এই ট্রাম শুধু একটি যান ছিল না, এটি ছিল তাদের জীবনের এক অংশ, এক জীবন্ত ইতিহাস, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। সবাই নেমে গেল, কিন্তু হরিবাবু বসেই রইলেন। তার হাত স্টিয়ারিংয়ে, চোখ বন্ধ। তার কানে যেন বিজলির চাকার সেই পরিচিত খটখট শব্দ বাজছিল, যা এখন শুধু তার স্মৃতিতেই সীমাবদ্ধ, এক মধুর স্মৃতি। মনে হচ্ছিল, বিজলি যেন তাকে বলছে, “বিদায় বন্ধু, এবার আমার বিশ্রাম। তুমিও এবার বিশ্রাম নাও। আমাদের যাত্রা শেষ হলো, কিন্তু আমাদের গল্প বেঁচে থাকবে, চিরকাল।” কিছুক্ষণ পর কয়েকজন কর্মী এসে বিজলিকে ডিপোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। হরিবাবু ধীরে ধীরে নামলেন। তার পা যেন আর চলতে চাইছিল না, প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন এক অদৃশ্য ভার অনুভব করছিলেন, যেন তার চল্লিশ বছরের কর্মজীবনের ভার তার কাঁধে চেপে বসেছিল, এক বিশাল দায়িত্বের বোঝা। একবার শেষবারের মতো বিজলির গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন, তার মসৃণ ধাতব শরীরে যেন উষ্ণতা খুঁজছিলেন, এক শেষ স্পর্শের মাধ্যমে যেন বিজলিকে বিদায় জানাচ্ছিলেন, এক নীরব আলিঙ্গন। তার চোখে তখন জল, কিন্তু সে জল ছিল স্মৃতি আর ভালোবাসার, হারানোর ব্যথা সেখানে চাপা পড়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি জানতেন বিজলি তার মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে, এক অমলিন স্মৃতি হয়ে, এক চিরন্তন বন্ধু হয়ে।
বিজলি চলে গেল। কলকাতার রাজপথ থেকে তার খটখট শব্দ চিরতরে হারিয়ে গেল। হরিবাবু আর ট্রাম চালান না। তিনি এখন তার ছোট চায়ের দোকানে বসেন, যা তার বাড়ির সামনেই। প্রতিদিন সকালে তিনি দোকান খোলেন, আর পুরনো দিনের গল্প বলেন। তার গল্পে বিজলি আজও বেঁচে আছে, কলকাতার প্রতিটি ধুলোমাখা কোণে, প্রতিটি পুরনো বাড়ির জানালায়। তার চায়ের দোকানে এখন ভিড় হয়, শুধু চা খেতে নয়, হরিবাবুর মুখে বিজলির গল্প শুনতে। তিনি জানেন, ট্রামের শেষ যাত্রা হলেও, তার স্মৃতি কোনোদিন শেষ হবে না। সে স্মৃতি প্রতিটা বাঙালির মনে, কলকাতার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে, এক চিরন্তন ভালোবাসার গল্প হয়ে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলবে, আর নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা, যখন কলকাতা ট্রামের ছন্দে জেগে উঠত, যখন জীবন ছিল আরও ধীর, আরও সহজ। হরিবাবু এখন তার চায়ের কাপে চুমুক দেন আর দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে একসময় বিজলি চলত। তার মনে হয়, বিজলি হয়তো আজও কোনো এক অদৃশ্য পথে, সময়ের সীমানা পেরিয়ে, তার পুরনো যাত্রীদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে, এক নতুন গন্তব্যের দিকে, আর সেই পথে তার সঙ্গী হয়েছে হাজারো স্মৃতি আর অগণিত গল্প।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion