Episode 12183 words0 views

কালচক্রের রহস্য

কালচক্রের রহস্য ডক্টর অর্ক রায়, এক নিভৃতচারী বিজ্ঞানী, তাঁর ল্যাবরেটরির নিস্তব্ধতায় ডুবে ছিলেন। বাইরে তখন একুশ শতকের কোলাহল, যানবাহনের অবিরাম শব্দ আর ডিজিটাল স্ক্রিনের নীলচে আলো, কিন্তু অর্কের জগৎ ছিল সময় আর স্থানকে বশ করার এক অদম্য নেশায় ঘেরা। তাঁর ল্যাবরেটরিটি ছিল শহরের এক কোণে, পুরোনো এক বাড়ির চিলেকোঠায়, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া খুব কমই লাগত। এই চিলেকোঠার ছোট জানালা দিয়ে শহরের আকাশ দেখা যেত, কিন্তু অর্কের চোখ ছিল অন্য দিগন্তে – অতীতের গভীরে। এখানেই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি ডুবে থাকতেন জটিল সমীকরণ, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের তত্ত্ব আর যন্ত্রপাতির মাঝে। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটাই – সময়কে অতিক্রম করা, ইতিহাসের পাতায় হেঁটে আসা, সেই সব মুহূর্তগুলোকে নিজের চোখে দেখা যা কেবল বইয়ের পাতায় নিষ্প্রাণ অক্ষরে লেখা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল ‘কালচক্র’ – একটি বিশাল, প্রায় তিন মিটার উঁচু ধাতব গোলক, যার মসৃণ ইস্পাতের গায়ে অজস্র তারের জট, ছোট-বড় লেন্স আর অদ্ভুত নকশার আলোর ঝলকানি। এটি কেবল একটি যন্ত্র ছিল না, ছিল অর্কের জীবনের প্রতিচ্ছবি, তাঁর মেধা আর শ্রমের ফসল। তাঁর গবেষণার ভিত্তি ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্টের এক নতুন ব্যাখ্যা, যা তিনি ‘টেম্পোরাল কোয়ান্টাম লুপ’ নামে অভিহিত করেছিলেন। শৈশব থেকেই ইতিহাসের প্রতি তাঁর এক গভীর টান ছিল, বিশেষ করে পলাশীর যুদ্ধ তাঁকে ভাবাত। কেন বাংলার স্বাধীনতা এভাবে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল? যদি সেই মুহূর্তে কেউ ইতিহাসকে একটু ঘুরিয়ে দিতে পারত, তাহলে কি আজকের ভারত অন্যরকম হতো? এই ভাবনা থেকেই কালচক্রের জন্ম। বছরের পর বছর ধরে অর্ক এর পেছনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সামাজিক জীবন প্রায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজারও তাঁকে ‘পাগল’ বলত, তাঁর গবেষণা নিয়ে উপহাস করত। কিন্তু অর্ক জানতেন, তাঁর এই পাগলামির পেছনে লুকিয়ে আছে এক বৈজ্ঞানিক সত্য। আজ সেই মুহূর্ত, যখন এটি প্রথমবার তার চূড়ান্ত পরীক্ষা দেবে। অর্কের হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, উত্তেজনা আর আশঙ্কায় মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তাঁর সারা শরীরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, যেন প্রতিটি রক্তকণিকা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। অর্কের লক্ষ্য ছিল ১৭৫৭ সালের বাংলা। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক আগের সেই উত্তাল সময়, যখন বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে। ইতিহাস বইয়ের পাতায় যা কেবল কিছু তারিখ আর তথ্য, অর্ক তা নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন, অনুভব করতে চেয়েছিলেন সেই সময়ের বাতাস, মানুষের ভয়, আশা আর বিশ্বাসঘাতকতার চাপা সুর। তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবল প্রত্যক্ষদর্শী হয়েই ইতিহাসের গভীরতা বোঝা সম্ভব, বই পড়ে যা বোঝা যায় না। একটি গভীর শ্বাস নিয়ে তিনি কালচক্রের ভেতরে প্রবেশ করলেন। ধাতব দরজাটি নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল, যা বাইরের পৃথিবীর সকল শব্দকে গ্রাস করে নিল। যন্ত্রের ভেতরে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো, প্রথমে একটি শান্ত ভ্রমরের মতো, তারপর ধীরে ধীরে তা এক তীব্র বজ্রনাদে পরিণত হলো। অর্কের কানে যেন মহাবিশ্বের স্পন্দন বাজছিল, প্রতিটি পরমাণু যেন কাঁপছিল, স্থান-কাল যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। আলোর ঝলকানি বাড়তে লাগল, যেন সহস্র তারার বিস্ফোরণ ঘটছে তাঁর চারপাশে, প্রতিটি আলোকরশ্মি যেন সময় আর স্থানের জাল বুনছিল, তাকে ছিন্ন করে এক নতুন পথ তৈরি করছিল। এক তীব্র কম্পন অর্কের শরীর ভেদ করে গেল, মনে হলো যেন তাঁর প্রতিটি কোষ স্থান-কালের বাঁধন ছিঁড়ে যাচ্ছে, তিনি যেন এক অসীম শূন্যতার মধ্য দিয়ে ভেসে চলেছেন, যেখানে অতীত আর ভবিষ্যৎ মিলেমিশে একাকার, যেখানে সময়ের স্রোত তার চিরচেনা পথ ছেড়ে নতুন এক দিকে মোড় নিচ্ছে। চোখের পলকে চারপাশ বদলে গেল, আলোর ঘূর্ণিপাকে সবকিছু বিলীন হয়ে এক নতুন রূপে আবির্ভূত হলো। কালচক্র যখন স্থির হলো, অর্ক নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন পরিবেশে। যন্ত্রের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে তিনি দেখলেন বাইরে এক নতুন সূর্য, যার আলো এক অন্যরকম সোনালি আভা ছড়াচ্ছে, যেন সময়ের ধুলো মাখা। বাতাস ছিল আর্দ্র, তাতে মাটি আর পুরোনো গাছের গন্ধ মিশে ছিল, আর দূরে ভেসে আসছিল ধূপের মৃদু সুবাস। চারপাশে মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি, আর মানুষের পোশাক-পরিচ্ছেদ সম্পূর্ণ ভিন্ন – পুরুষরা ধুতি-পাঞ্জাবি, মহিলারা শাড়িতে আবৃত, তাদের হাতে শাঁখা-পলা, কপালে সিঁদুরের টিপ। বাতাসে বারুদের গন্ধ আর চাপা উত্তেজনা। দূরে কোথাও ঘোড়ার খুরের শব্দ, গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ, মানুষের কোলাহল, আর পাখির কিচিরমিচির। তিনি ১৭৫৭ সালের মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছেছেন। পলাশীর যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিন বাকি। তারিখটা ছিল ২১শে জুন, ১৭৫৭। অর্ক সাবধানে কালচক্র থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর আধুনিক পোশাক (একটি জিন্স আর টি-শার্ট) এই পরিবেশে সম্পূর্ণ বেমানান। দ্রুত একটি পুরোনো, নোংরা গামছা আর একটি ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলেন, যা তিনি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কালচক্রের ভেতরে রেখেছিলেন। তাঁর কাঁধে ছিল একটি ছোট ঝোলা ব্যাগ, তাতে কিছু শুকনো খাবার, একটি জলের বোতল আর একটি ছোট নোটবুক, যেখানে তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো লিখে রাখবেন বলে ভেবেছিলেন। শহরের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখলেন সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদ – দূর থেকে তার বিশালত্ব আর জৌলুস বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে যেন এক আসন্ন বিপদের ছায়া। প্রাসাদের উঁচু দেয়াল আর বিশাল ফটক যেন এক নীরব কান্না লুকিয়ে রেখেছিল, তার প্রতিটি পাথরে যেন ভবিষ্যতের করুণ ইতিহাস লেখা ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠিগুলোও চোখে পড়ল, যেখানে ইংরেজ বণিকদের ব্যস্ততা আর ঔদ্ধত্য স্পষ্ট। তাদের চোখে ছিল লোভ আর ক্ষমতার ঝলক, মুখে এক চাপা হাসি। পথে ঘাটে সাধারণ মানুষের চোখে ভয় আর অনিশ্চয়তা, মুখে চাপা গুঞ্জন। তারা ফিসফিস করে বলছিল, “নবাবের দিন শেষ, ইংরেজরা সব দখল করে নেবে।” তিনি শুনলেন মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা – তাদের নাম যেন বাতাসে বিষের মতো মিশে ছিল, প্রতিটি উচ্চারণে ছিল ঘৃণা আর হতাশা। ইতিহাসের প্রতিটি পাতা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তাঁর সামনে, প্রতিটি চরিত্র যেন রক্তমাংসের মানুষ হয়ে তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তিনি দেখলেন, কীভাবে সাধারণ মানুষও এই আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস পাচ্ছিল, কিন্তু তাদের করার কিছুই ছিল না, কেবল অসহায়ভাবে ভাগ্যের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া। মুর্শিদাবাদের সরু গলিগুলো ছিল কাদা আর ধুলোয় ভরা। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথীর জলে নৌকার আনাগোনা, ঘাটে মানুষের ভিড়। অর্ক খেয়াল করলেন, শহরের জনজীবন স্বাভাবিক দেখালেও, তার গভীরে এক চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সরাইখানার পাশ দিয়ে যেতে তিনি দেখলেন, কিছু মানুষ জুয়া খেলছে, কেউবা হুঁকো টানছে, আবার কেউবা নিচু স্বরে রাজনৈতিক আলোচনায় মগ্ন। তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট চিন্তার রেখা। অর্ক তাদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। একজন বলছিল, “শুনছি, নবাবের সেনাপতি মীরজাফর ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে।” আরেকজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের কপাল পুড়ল, ভাই। নবাবের হাতে এখন আর কিছুই নেই।” এই কথাগুলো অর্কের কানে বিষের মতো বাজছিল। তিনি জানতেন, এই মানুষগুলোর ভয় সত্যি হতে চলেছে। অর্ক এক সরাইখানায় আশ্রয় নিলেন, যা ছিল মূলত একটি বড় উঠোন আর তার চারপাশে কয়েকটি ছোট কুঠুরি। রাতের বেলায় সেখানে চুল্লির পাশে বসে তিনি শুনলেন এক বৃদ্ধ বণিকের কথা – কীভাবে ইংরেজরা ধীরে ধীরে বাংলার উপর তাদের থাবা বসাচ্ছে, কীভাবে তারা স্থানীয় বণিকদের কোণঠাসা করছে, তাদের ব্যবসা ধ্বংস করছে। বৃদ্ধের চোখে ছিল হতাশা আর ক্ষোভ, তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক গভীর বেদনা। তিনি বলছিলেন, “নবাব একা লড়ছেন, কিন্তু তাঁর চারপাশে সাপেরা ঘুরছে। এই বাংলা আর বেশিদিন শান্ত থাকবে না। আমাদের সর্বনাশ আসন্ন। আমাদের সোনার বাংলা এবার শ্মশান হবে।” অর্কের মনে এক তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হলো। তিনি কি শুধু একজন দর্শক হয়ে থাকবেন? তাঁর কাছে তো ভবিষ্যৎ জ্ঞান আছে! তিনি জানেন, কী হতে চলেছে। তিনি কি ইতিহাসকে বদলে দেবেন? যদি তিনি সিরাজকে সতর্ক করতে পারতেন, যদি মীরজাফরের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে পারতেন? কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ বদলানোর পরিণতি কী হতে পারে? এক ক্ষুদ্র পরিবর্তন হয়তো এক বিশাল বিপর্যয় ডেকে আনবে, যা তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না। হয়তো আরও খারাপ কিছু ঘটবে, হয়তো আরও রক্তক্ষয়ী এক অধ্যায়ের সূচনা হবে। এই প্রশ্ন তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তাঁর বৈজ্ঞানিক মন আর মানবিক অনুভূতি যেন দুই বিপরীত দিকে টানছিল। তিনি জানতেন, সময়-ভ্রমণের মৌলিক নিয়ম হলো ‘নন-ইন্টারফারেন্স’ – কোনোভাবেই অতীতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কিন্তু চোখের সামনে এমন এক ঐতিহাসিক অন্যায় ঘটতে দেখেও চুপ করে থাকা কি সম্ভব? তাঁর বিবেক যেন তাঁকে দংশন করছিল। পরের কয়েকদিন অর্ক মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেন। তিনি নবাবের দরবারের কাছাকাছি গেলেন, যেখানে চাটুকার আর বিশ্বাসঘাতকদের ভিড় ছিল। তিনি দেখলেন, কীভাবে সিরাজউদ্দৌলা একাকীত্বে ভুগছেন, কীভাবে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরদের সংখ্যা কমে আসছে। দরবারের বাতাসে যেন এক বিষণ্ণতা আর আসন্ন পতনের পূর্বাভাস ভাসছিল। অর্ক একবার ভাবলেন, কোনোভাবে যদি নবাবের কাছে পৌঁছানো যেত! কিন্তু তিনি জানতেন, তাঁর এই চেষ্টা কেবল ঝুঁকিই বাড়াবে। তিনি একজন আধুনিক মানুষ, এই সময়ের রীতিনীতি, ভাষা বা পোশাকের সাথে তিনি পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারেননি। সামান্য ভুলও তাঁর পরিচয় ফাঁস করে দিতে পারত, যা তাঁর গবেষণা এবং এমনকি তাঁর জীবনকেও বিপদে ফেলত। তাই তিনি নিজেকে সংযত রাখলেন, কেবল একজন নীরব দর্শক হিসেবেই কাজ করে গেলেন, সবকিছু কেবল নোটবুকে টুকে রাখছিলেন। একদিন, অর্ক যখন শহরের বাইরে একটি নির্জন স্থানে কালচক্রের কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন কিছু ইংরেজ সৈন্য এবং তাদের সাথে মীরজাফরের অনুচরেরা একটি ঘন ঝোপের আড়ালে গোপনে বৈঠক করছে। রাতের আঁধারে তাদের ফিসফিসানি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, কেবল জোনাকিদের মৃদু আলোয় তাদের মুখাবয়ব অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল, তাদের চোখের চতুরতাও যেন সেই আলোয় ধরা পড়ছিল। তারা পলাশীর যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করছিল – কীভাবে সিরাজকে ফাঁদে ফেলা হবে, কীভাবে বাংলার স্বাধীনতাকে বিক্রি করা হবে, কত টাকার বিনিময়ে এই বিশ্বাসঘাতকতা সম্পন্ন হবে। “যুদ্ধ শুরু হবে, কিন্তু আমরা কেবল দাঁড়িয়ে দেখব,” একজন ইংরেজ অফিসার বলল, তার মুখে পৈশাচিক হাসি, “নবাবের পতন অনিবার্য। বাংলা আমাদের হাতের মুঠোয়।” অর্কের রক্ত গরম হয়ে উঠল, তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত কাঁপতে লাগল। তিনি কি এই তথ্য সিরাজউদ্দৌলার কাছে পৌঁছে দেবেন? এই মুহূর্তে তিনি চাইলে ইতিহাসকে অন্য পথে চালিত করতে পারেন, হয়তো বাংলার ইতিহাসই বদলে দিতে পারেন, এক নতুন ভবিষ্যতের জন্ম দিতে পারেন। হঠাৎ, একটি গাছের আড়াল থেকে একজন ইংরেজ সৈনিক অর্ককে দেখে ফেলল। হয়তো তাঁর আধুনিক জুতোর সামান্য শব্দ হয়েছিল, অথবা বাতাসে তাঁর পোশাকের গন্ধ ভেসে গিয়েছিল, কিংবা তার টর্চের আলো অর্কের দিকে পড়েছিল। “কে ওখানে?” বলে সে চিৎকার করে উঠল। তার কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্র সন্দেহ আর চাপা হুমকি। অর্ক দ্রুত নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে অন্য সৈন্যরাও তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। “ওকে ধরো! ও গুপ্তচর!” চিৎকার করতে করতে তারা অর্কের দিকে ছুটে এল। তাদের হাতে ছিল বন্দুক আর তলোয়ার, রাতের অন্ধকারে সেগুলো চকচক করছিল, যেন মৃত্যুর প্রতীক। তাদের হিংস্র চোখগুলো অর্কের দিকে স্থির ছিল, শিকার ধরার নেশায় জ্বলছিল। তাদের ইউনিফর্মের বোতামগুলোও যেন অন্ধকারের মধ্যে চকচক করছিল। অর্ক জানতেন, ধরা পড়লে তাঁর পরিণতি ভয়াবহ হবে। তিনি দ্রুত কালচক্রের দিকে ছুটলেন। তাঁর আধুনিক জুতো আর পোশাকের কারণে তিনি দ্রুত দৌড়াতে পারছিলেন, কিন্তু সৈন্যরাও পিছু ছাড়ছিল না, তাদের বুটের শব্দ যেন মৃত্যুর পদধ্বনি। তাদের গুলির শব্দ আর তলোয়ারের ঝনঝনানি তাঁর কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটি গুলি তাঁর কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল, গাছের গুঁড়িতে লেগে তার ছাল তুলে দিল, কাঠের টুকরো ছিটকে পড়ল। অর্ক অনুভব করলেন, তাঁর গায়ে যেন বাতাসের চাপ লেগেছে, মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ। কালচক্রের কাছে পৌঁছে তিনি দ্রুত তার ভেতরে প্রবেশ করলেন। শেষ মুহূর্তে এক সৈনিক তাঁর হাত প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল, তার তলোয়ারের ডগা কালচক্রের ধাতব গায়ে এক গভীর আঁচড় কেটে দিল, যেন সময়ের গায়ে এক স্থায়ী ক্ষত। যন্ত্রের গায়ে সেই আঁচড় যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত চিহ্ন হয়ে রইল, অর্কের অভিযানের নীরব সাক্ষী। কালচক্রের ভেতরে ঢুকে অর্ক দ্রুত নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে হাত রাখলেন। তিনি দেখলেন, যন্ত্রের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – তলোয়ারের আঁচড় আর গুলির আঘাতে কিছু তার ছিঁড়ে গেছে, কিছু সার্কিট ঝলসে গেছে, প্যানেলের আলো নিভু নিভু করছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিউজ উড়ে গেছে, যার ফলে পাওয়ার সাপ্লাই ব্যাহত হচ্ছিল। দ্রুত মেরামত করতে না পারলে তিনি আর নিজের সময়ে ফিরতে পারবেন না। বাইরে তখন সৈন্যদের কোলাহল বাড়ছে, তারা কালচক্রের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে, তাদের বুটের শব্দ আর অস্ত্রের ঘষাঘষি শোনা যাচ্ছিল, যেন এক উন্মত্ত পশুর দল। অর্ক তাঁর সমস্ত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দ্রুত যন্ত্রটি সারানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল, কিন্তু মন ছিল স্থির, প্রতিটি নড়াচড়া ছিল নিখুঁত। তিনি তাঁর ব্যাগে থাকা ছোট টুলকিট থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বের করলেন। হাতে সময় খুব কম, প্রতি সেকেন্ড মূল্যবান। তিনি ছোট ছোট তারগুলো জোড়া লাগালেন, ক্ষতিগ্রস্ত সার্কিটগুলো বাইপাস করলেন, কিছু তারের সংযোগ বদলে দিলেন, তাঁর আঙুলগুলো যেন যন্ত্রের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। ফিউজটি বদলানোর জন্য তিনি নিজের হাতের ঘড়ি থেকে একটি ছোট ব্যাটারি খুলে নিলেন, যা সাময়িকভাবে ফিউজের কাজ করবে। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, কিন্তু তিনি থামলেন না, কারণ তাঁর জীবন এই যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল। বাইরের সৈন্যদের চিৎকার ক্রমশ বাড়ছিল, মনে হচ্ছিল তারা যেকোনো মুহূর্তে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। শেষ পেরেকটি যখন লাগানো হলো, এবং ব্যাটারিটি সঠিক স্থানে স্থাপন করা হলো, তখন কালচক্রের ভেতরে আবার সেই তীব্র কম্পন শুরু হলো। যন্ত্রের আলো ঝলমল করে উঠল, তার গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে এক গর্জন হয়ে উঠল, যেন সময় নিজেই চিৎকার করে উঠছে। অর্ক চোখ বন্ধ করলেন, প্রার্থনা করলেন যেন সব ঠিক থাকে, যেন তিনি ফিরে যেতে পারেন তাঁর নিজের সময়ে, একুশ শতকের নিরাপদ আশ্রয়ে। যখন চোখ খুললেন, তখন তিনি নিজের ল্যাবরেটরিতে, একুশ শতকের নিস্তব্ধতায়। তাঁর ল্যাবরেটরির পরিচিত গন্ধ, পরিচিত শব্দ, পরিচিত ধুলোর আস্তরণ। তিনি ফিরে এসেছেন। কালচক্রের বাইরে এসে অর্ক হাঁপাতে লাগলেন। তাঁর কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছিল, তাঁর শরীর অবসন্ন লাগছিল, যেন তিনি দীর্ঘ এক ম্যারাথন দৌড়ে এসেছেন। তাঁর হাতে তখনো লেগে ছিল ১৭৫৭ সালের মাটির কণা, আর তাঁর মনে গেঁথে ছিল পলাশীর প্রান্তরের সেই বিশ্বাসঘাতকতার দৃশ্য, ইংরেজ সৈন্যদের হিংস্র চিৎকার, আর বাংলার আসন্ন পতন। তিনি জানতেন, তিনি ইতিহাসকে বদলাতে পারেননি, কিন্তু ইতিহাসকে অনুভব করতে পেরেছিলেন তার সমস্ত ভয়াবহতা আর বাস্তবতার সাথে। তিনি বুঝতে পারলেন, সময়ের নিজস্ব গতিপথ আছে, আর তাতে হস্তক্ষেপ করা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভেবেছিলেন, যদি তিনি সিরাজকে সতর্ক করতেন, কিন্তু সেই ভাবনা দ্রুতই মিলিয়ে গেল। ইতিহাসের চাকা একবার ঘুরতে শুরু করলে তাকে থামানো যায় না, তাকে জোর করে থামানোর চেষ্টা করলে হয়তো আরও ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, হয়তো মানব সভ্যতারই অন্যরকম এক মোড় আসত। ডক্টর অর্ক রায় একজন বিজ্ঞানী হিসেবে সময়ের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করলেন, আর একজন মানুষ হিসেবে ইতিহাসের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বেঁচে রইলেন। কালচক্রের রহস্য তাঁর কাছে আর শুধু একটি যন্ত্র ছিল না, ছিল সময়ের অসীম ক্ষমতার এক নীরব সাক্ষী, যা তাঁকে শিখিয়েছিল ইতিহাসের পাতায় কেবল দর্শক হয়ে থাকাই শ্রেয়, কারণ কিছু গল্প শুধু দেখার জন্যই, বদলানোর জন্য নয়। তিনি জানতেন, এই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। তাঁর ল্যাবরেটরির দেওয়ালে টাঙানো বিশ্ব মানচিত্রে ১৭৫৭ সালের বাংলার মানচিত্রটি এখন তাঁর কাছে কেবল একটি ছবি ছিল না, ছিল এক জীবন্ত স্মৃতি। তিনি আর কখনো সময়-ভ্রমণের কথা ভাবেননি, কারণ তিনি জেনে গিয়েছিলেন, কিছু সত্যকে দূর থেকে দেখাই ভালো, তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে তার মূল্য অনেক বেশি হতে পারে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion