Episode 13523 words2 views

গুপ্তধনের সন্ধানে: সেন রাজবংশের রহস্য

গুপ্তধনের সন্ধানে: সেন রাজবংশের রহস্য গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে, যেখানে প্রাচীন বিক্রমপুরের চিহ্ন আজও মাটির গভীরে ঘুমিয়ে আছে, সেখানেই লুকিয়ে ছিল সেন রাজবংশের এক কিংবদন্তী গুপ্তধন। ইতিহাস বলে, রাজা বল্লাল সেন এবং তাঁর পুত্র লক্ষণ সেনের আমলে বাংলার শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ ছিল। তাঁদের রাজত্বকালে বাংলা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছিল। অসংখ্য মন্দির, প্রাসাদ, এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়, যা দূর-দূরান্ত থেকে পণ্ডিত ও শিল্পীদের আকর্ষণ করত। তাঁদের রাজসভায় কবি জয়দেব, ধোয়ী, শরণ, উমাপতিধর এবং গোবর্ধন আচার্যের মতো দিকপাল পণ্ডিত ও কবিরা অলংকৃত করতেন, যা তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রমাণ। তাঁদের শাসন ছিল সুসংহত, প্রজারা ছিল সুখে শান্তিতে, এবং রাজ্য ছিল সমৃদ্ধির শিখরে। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে সুলতান বখতিয়ার খলজির আকস্মিক ও নৃশংস আক্রমণের সময়, যখন লক্ষণ সেন তাঁর রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন নাকি বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ, যা বহু প্রজন্মের সঞ্চয় ছিল, তা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই গুপ্তধন শুধুমাত্র সোনা-রুপো বা জহরত ছিল না; এর মধ্যে নাকি ছিল অমূল্য প্রাচীন পুঁথি, শিল্পকর্ম, দুর্লভ ভাস্কর্য, এবং এমন কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন যা বাংলার হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে ধারণ করে। এই গুপ্তধন ছিল সেন রাজবংশের শেষ আশা, তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতীক, যা ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল, যেন এক অদৃশ্য সময়-ক্যাপসুল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই গুপ্তধনের গল্প লোকমুখে ফিরলেও, কেউ তার হদিশ পায়নি, তা রয়ে গিয়েছিল এক অধরা কিংবদন্তী হয়ে, যা শুধু কৌতূহলী মনকে আকর্ষণ করত, কিন্তু কোনোদিন তার রহস্য উন্মোচিত হয়নি, যেন প্রকৃতির এক গভীর রহস্যের মতো তা মাটির গভীরে ঘুমিয়ে ছিল, তার উপর জমেছিল সহস্র বছরের ধুলো আর বিস্মৃতির আস্তরণ। কলকাতার এক পুরনো পাড়ার জীর্ণ বাড়িতে থাকতেন ইতিহাস গবেষক ডঃ সুব্রত মিত্র। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই বয়স তাঁর, কিন্তু চোখের তারায় ছিল এক কিশোরের অদম্য কৌতূহল। তাঁর জীবনের একমাত্র নেশা ছিল বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খুঁজে বের করা, বিশেষ করে সেন রাজবংশ নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর ছোটবেলা থেকেই তিনি পুরনো দিনের গল্প, কিংবদন্তী এবং লোককথা শুনতে ভালোবাসতেন। ঠাকুমার মুখে শোনা রূপকথার মতো গল্পগুলো তাঁকে ইতিহাসের প্রতি এক অদম্য কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল, যেন প্রতিটি গল্পের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক একটি অজানা জগৎ, যা তাঁকে হাতছানি দিত। এই ভালোবাসা থেকেই তাঁর মধ্যে ইতিহাস গবেষণার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, যা তাঁকে তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতে শিখিয়েছিল। তিনি দিনের পর দিন পুরনো বইয়ের দোকানে, অ্যান্টিক গ্যালারিতে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ঘুরে বেড়াতেন, যদি কোনো সূত্র খুঁজে পান। তাঁর এই অনুসন্ধান ছিল শুধু পেশাগত নয়, বরং এক গভীর আবেগ ও ভালোবাসার ফসল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইতিহাসের প্রতিটি ধূলিকণার নিচে লুকিয়ে আছে এক একটি গল্প, এক একটি সত্য, যা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান এবং যা ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে। একদিন এমনই এক পুরনো বইয়ের দোকানে ঘাঁটতে ঘাঁটতে, ধুলোমাখা তাকে একটি জীর্ণ পুঁথি খুঁজে পান। পুঁথিটি ছিল তালপাতার, তার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছিল, কিছু অংশ পোকায় কাটা, কিন্তু অক্ষরের বিন্যাস ছিল অসাধারণ, যেন কোনো সুদক্ষ লিপিকারের হাতের ছোঁয়া। ভাষা ছিল প্রাচীন বাংলা, অনেকটা সন্ধ্যাভাষার মতো, যা সাধারণ পাঠকদের কাছে দুর্বোধ্য। পুঁথিটির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি অস্পষ্ট রাজকীয় সীলমোহর দেখে সুব্রতবাবু বুঝতে পারলেন, এটি সাধারণ কোনো লেখা নয়, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে। পুঁথির প্রতিটি পাতায় লেগে ছিল সময়ের ছাপ, এক অদ্ভুত সুবাস, যা অতীতের রহস্যময়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল, যেন প্রতিটি পাতা থেকে প্রাচীন বাংলার গন্ধ ভেসে আসছিল, তাঁকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিল। পুঁথির শেষ পাতায় একটি ছোট, প্রায় অদৃশ্য প্রতীক ছিল – একটি সাপের কুণ্ডলী, যা একটি মুকুটকে ঘিরে আছে। এটি দেখে সুব্রতবাবুর মনে এক অজানা আশঙ্কার ছায়া পড়ল, যেন এই প্রতীকটি কোনো বিপদ বা অভিশাপের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যা গুপ্তধনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুঁথিটি নিয়ে বাড়িতে ফিরে তিনি দিনরাত এক করে তার পাঠোদ্ধারে লেগে পড়লেন। তাঁর পড়ার ঘরে শুধু পুরনো বই আর মানচিত্রের স্তূপ। টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকত ম্যাগনিফাইং গ্লাস, পেন্সিল, আর নোটবুক। রাতের পর রাত তিনি জেগে থাকতেন, কফি কাপের পর কাপ শেষ করতেন, শুধু একটি অক্ষর বা একটি শব্দের অর্থ বোঝার জন্য। তাঁর চোখ জ্বলে উঠত এক অদম্য আগ্রহে, যেন প্রতিটি নতুন আবিষ্কার তাঁর আত্মাকে পুষ্ট করত। প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ যেন এক প্রাচীন রহস্যের চাবিকাঠি। প্রথম কয়েক দিন তিনি কেবল হতাশাই পেলেন, কারণ পুঁথির ভাষা ছিল সাংকেতিক এবং হেঁয়ালি পূর্ণ, যেন ইচ্ছে করেই তথ্য গোপন করার জন্য এমনভাবে লেখা হয়েছিল, যাতে শুধুমাত্র যোগ্য ব্যক্তিরাই এর মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারে। বহু কষ্টে সেই পুঁথি পাঠোদ্ধার করে সুব্রতবাবু জানতে পারলেন, এটি আসলে লক্ষণ সেনের এক বিশ্বস্ত অমাত্যের লেখা দিনলিপি। অমাত্য ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি, যিনি রাজপরিবারের গোপনীয়তা রক্ষা করার দায়িত্বে ছিলেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই দিনলিপি লিখেছিলেন, যেন প্রতিটি শব্দে তাঁর আনুগত্য ও দূরদর্শিতা প্রতিফলিত হচ্ছিল। সেই দিনলিপিতেই গুপ্তধনের অস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, যা ছিল শ্লোক ও ধাঁধার ছলে লেখা। অমাত্য যেন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র সঠিক ব্যক্তিরাই, যারা বুদ্ধি এবং ধৈর্যের অধিকারী, তারাই এই গুপ্তধনের হদিশ পাবে, লোভী বা অযোগ্যদের হাতে যেন এই সম্পদ না পড়ে। এই দিনলিপি ছিল এক ঐতিহাসিক দলিল, যা শুধু গুপ্তধনের পথই নয়, তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির এক ঝলকও তুলে ধরেছিল, যা সুব্রতবাবুকে সেই সময়ের গভীরে ডুব দিতে সাহায্য করল এবং তাঁর গবেষণাকে এক নতুন মাত্রা দিল। পুঁথির একটি শ্লোকে লেখা ছিল: “যেথা সূর্য প্রথম ছোঁয় মাটির বুক, যেথা গঙ্গা পূব পানে ফেরে মুখ, সেথা লুকানো রবে রাজকোষের সুখ।” সুব্রতবাবু বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ স্থান নয়, বরং একটি বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করছে। তিনি তাঁর বিশাল মানচিত্রের সংগ্রহ নিয়ে বসলেন। প্রাচীন বাংলার মানচিত্র, ব্রিটিশ আমলের জরিপ করা মানচিত্র, এমনকি আধুনিক স্যাটেলাইট মানচিত্রও তাঁর সংগ্রহে ছিল। তিনি প্রতিটি মানচিত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি জলধারা যেন এক একটি সূত্র। তাঁর আঙুলগুলো মানচিত্রের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াত, যেন কোনো লুকানো পথ খুঁজছিল। “যেথা সূর্য প্রথম ছোঁয় মাটির বুক” – এর অর্থ হতে পারে বাংলার পূর্ব দিক, কারণ সূর্যোদয় পূর্ব দিকেই হয়। আর “যেথা গঙ্গা পূব পানে ফেরে মুখ” – এই অংশটি তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলল। গঙ্গা সাধারণত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়, কিন্তু কিছু কিছু স্থানে তার গতিপথ পূর্ব দিকে বাঁক নেয়। এই অস্বাভাবিক গতিপথই ছিল মূল সূত্র। দিনের পর দিন তিনি পুরনো ভৌগোলিক মানচিত্র, নদীর গতিপথের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করলেন, ইতিহাসবিদদের লেখা বই পড়লেন, এমনকি লোককথা ও প্রচলিত গান থেকেও সূত্র খোঁজার চেষ্টা করলেন, কারণ অনেক সময় লোককথার মধ্যেও ইতিহাসের সত্য লুকিয়ে থাকে। তাঁর এই নিরলস পরিশ্রমের ফলস্বরূপ, অবশেষে, দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি একটি সম্ভাব্য স্থান খুঁজে পেলেন – বিক্রমপুরের এক নির্জন গ্রাম, যেখানে গঙ্গার একটি শাখা নদী হঠাৎ পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছিল। এই স্থানটি মানচিত্রে চিহ্নিত করার পর সুব্রতবাবুর মনে এক নতুন আশার আলো জ্বলে উঠল। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন হাজার বছরের পুরনো এক রহস্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন, যা তাঁর বহু বছরের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চলেছে। তাঁর হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল, যেন তিনি ইতিহাসের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলেন, এক অজানা উত্তেজনা তাঁকে গ্রাস করল, যা তাঁকে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগাচ্ছিল। তবে এই পর্যায়ে সুব্রতবাবু একটি বড় সমস্যায় পড়লেন। পুঁথির কিছু অংশ এতটাই দুর্বোধ্য ছিল যে তিনি তার অর্থ উদ্ধার করতে পারছিলেন না। বিশেষ করে গুপ্তধনের প্রবেশপথ সম্পর্কিত কিছু শ্লোক ছিল সাংকেতিক এবং দ্ব্যর্থবোধক, যা একাধিক অর্থ বহন করত এবং গবেষককে বিভ্রান্ত করতে পারত। এই শ্লোকগুলো যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করেছিল, যা ভেদ করা কঠিন ছিল। তখন তাঁর মনে পড়ল তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং প্রাচীন লিপি বিশারদ ডঃ নন্দিনী রায়ের কথা। নন্দিনী ছিলেন প্রাচীন বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী। তাঁর বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, তিনি জটিল থেকে জটিলতর প্রাচীন লিপি এবং প্রতীক সহজে বুঝতে পারতেন। তিনি শুধু একজন গবেষক ছিলেন না, বরং একজন শিল্পীও ছিলেন, যিনি প্রাচীন ভাষার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারতেন এবং প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আবেগ অনুভব করতে পারতেন। সুব্রতবাবু পুঁথিটি নিয়ে নন্দিনীর কাছে গেলেন। নন্দিনী পুঁথিটি দেখে মুগ্ধ হলেন এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। তিনি সুব্রতবাবুকে আশ্বস্ত করলেন যে, তিনি এই রহস্যের সমাধান করতে পারবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি তার জটিল অংশগুলির পাঠোদ্ধার করে দিলেন, যা সুব্রতবাবুর জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। নন্দিনীর সহায়তায় সুব্রতবাবু নিশ্চিত হলেন যে গুপ্তধনের স্থানটি বিক্রমপুরের সেই নির্দিষ্ট গ্রামেই, এবং প্রবেশপথের সংকেতগুলোও তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় যেন এক নতুন শক্তি সঞ্চারিত হলো, যেন দুই নদীর ধারা এক হয়ে এক বিশাল সাগরের দিকে ধাবিত হলো, যা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। সুব্রতবাবু তাঁর তরুণ সহকারী, প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র শৌভিক এবং ডঃ নন্দিনী রায়কে নিয়ে সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। যাত্রাটা সহজ ছিল না। প্রথমে ট্রেন, তারপর বাস, এবং শেষমেশ একটি ভাঙাচোরা জিপে করে দুর্গম কাঁচা রাস্তা ধরে তাঁদের এগোতে হলো। প্রতিটি মোড়ে যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছিল, প্রতিটি বাঁকে যেন এক নতুন রহস্য লুকিয়ে ছিল। শৌভিক ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত দক্ষ, ড্রোন চালানো থেকে শুরু করে জিও-রাডার ব্যবহারেও তার জুড়ি ছিল না। সে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাচীন রহস্য উন্মোচনে বিশ্বাসী ছিল, তার কাছে প্রতিটি প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ছিল এক একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা তাকে মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের সন্ধান দিতে পারত। গ্রামটি ছিল জনবিরল, চারপাশে কেবল ধানক্ষেত আর ছোট ছোট টিলা। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া যেন এখানে তেমনভাবে লাগেনি, সময় যেন থমকে গিয়েছিল বহু যুগ আগে, এক শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ। কাঁচা রাস্তা ধরে তাঁদের গাড়ি এগিয়ে চলল, দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত আর দূরে নারকেল গাছের সারি, যা বাংলার চিরন্তন গ্রামীণ দৃশ্যের প্রতীক। পুঁথির সূত্র ধরে তাঁরা একটি প্রাচীন, প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের কাছে পৌঁছালেন। মন্দিরটি সেন আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছিল, তার দেওয়ালে সূক্ষ্ম কারুকাজ থাকলেও, কালের করাল গ্রাসে তা আজ ভগ্নস্তূপ। মন্দিরের দেওয়ালে কিছু অদ্ভুত খোদাই করা চিহ্ন ছিল, যা পুঁথির অন্য একটি অংশে বর্ণিত ধাঁধার সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। নন্দিনী সেই খোদাই করা চিহ্নগুলির অর্থ ব্যাখ্যা করে তাঁদের অনুসন্ধানে আরও সাহায্য করলেন, যা তাঁদের সঠিক পথে চালিত করল। গ্রামবাসীরা যদিও গুপ্তধনের গল্প শুনেছিল, কিন্তু তাদের কাছে তা ছিল নিছকই লোককথা। তাদের চোখে ছিল বিস্ময় আর কিছুটা অবিশ্বাস, যেন তারা এক অসম্ভব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ নিতে দেখছিল। তবে, তাদের চোখে এক অদ্ভুত সতর্কতাও ছিল, যেন তারা কোনো অজানা বিপদ সম্পর্কে অবগত, যা তাদের মুখে এক চাপা ভয় ফুটিয়ে তুলেছিল। তবে, তাঁদের আগমনের খবর যেন বাতাসে ভেসে গিয়েছিল। গ্রামে পৌঁছানোর পর থেকেই সুব্রতবাবু এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাদের অনুসরণ করছে, প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখছে। রাতের বেলায় মন্দিরের আশেপাশে কিছু অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল, যা রহস্য আরও গভীর করে তুলছিল। শৌভিক তার ড্রোন দিয়ে রাতের বেলাতেও নজরদারি চালাচ্ছিল, কিন্তু ঘন জঙ্গলের কারণে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। একদিন সকালে, মন্দিরের প্রবেশপথে একটি পুরনো, মরিচা ধরা তলোয়ারের ভাঙা অংশ পাওয়া গেল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি সম্প্রতি সেখানে রাখা হয়েছে। তলোয়ারের হাতলে একটি অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা পুঁথির শেষ পাতায় থাকা সাপের কুণ্ডলীর প্রতীকের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। নন্দিনী বললেন, “এগুলো কি শুধু কাকতালীয়? নাকি কেউ চাইছে আমরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাই?” সুব্রতবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “হয়তো কেউ আমাদের আগে থেকেই এই গুপ্তধনের পেছনে লেগে আছে, অথবা কেউ চায় না আমরা এটি খুঁজে পাই।” এই অজানা প্রতিপক্ষ তাদের মনে এক নতুন ভয়ের সঞ্চার করল। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, এই গুপ্তধনের কি অন্য কোনো দাবিদার আছে? নাকি এর পেছনে কোনো অভিশাপ লুকিয়ে আছে? রাতের অন্ধকারে তাদের অস্থায়ী শিবিরে কিছু অদ্ভুত শব্দ শোনা যেত, যেন কেউ তাদের তাঁবুর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। শৌভিক তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করল, কিন্তু অজানা শত্রুর উপস্থিতি তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে উদ্বেগময় করে তুলল, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসেই বিপদ লুকিয়ে ছিল। কয়েকদিন ধরে তাঁরা সেই মন্দিরের আশেপাশে অনুসন্ধান চালালেন। দিনের বেলায় প্রখর রোদ, যা মাথার ওপর যেন আগুন ঝরাচ্ছিল, আর রাতে ঘন অন্ধকার, যেখানে জোনাকির আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না, আর শেয়ালের ডাক শোনা যেত। মশার উপদ্রব, সাপের ভয়, আর অজানা পরিবেশের চাপ সত্ত্বেও তাঁদের মনোবল অটুট ছিল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কাজের ভাগ করে নিয়েছিলেন; সুব্রতবাবু পুঁথির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কাজ করছিলেন, নন্দিনী সাংকেতিক লিপির অর্থ উদ্ধার করছিলেন, আর শৌভিক প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছিল। শৌভিক ড্রোন ব্যবহার করে মন্দিরের ওপর থেকে এবং চারপাশের এলাকার ছবি তুলল, যা তাদের ভৌগোলিক বিন্যাস বুঝতে সাহায্য করল এবং মাটির নিচে কোনো অস্বাভাবিক কাঠামো আছে কিনা, তা পরীক্ষা করল। তার জিও-রাডার যন্ত্রটি মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো ফাঁপা স্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যা গুপ্তধনের সম্ভাব্য অবস্থান নির্দেশ করছিল। সুব্রতবাবু ও নন্দিনী পুঁথির প্রতিটি শ্লোক খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন এক একটি ধাঁধা, যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের শান্তি ছিল না। তাঁরা মন্দিরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ভাঙা স্তম্ভ পরীক্ষা করলেন, হাতের স্পর্শে অনুভব করার চেষ্টা করলেন কোনো লুকানো স্থান, কোনো অস্বাভাবিকতা, যেন মন্দিরের প্রতিটি পাথর তাদের সঙ্গে কথা বলছিল। এক সন্ধ্যায়, যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, মন্দিরের একটি বিশেষ স্তম্ভের ওপর সূর্যের শেষ রশ্মি এসে পড়ল। সেই স্তম্ভের উপর যেন এক অলৌকিক আলোকরশ্মি এসে পড়ল, যা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সুব্রতবাবু খেয়াল করলেন, স্তম্ভের গায়ে একটি ছোট ফাটল রয়েছে, যা আগে তাঁদের চোখে পড়েনি। সেই ফাটলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তিনি একটি ছোট পাথরের ফলক টেনে বের করলেন। ফলকটি ছিল মসৃণ, তার উপর কিছু অস্পষ্ট চিহ্ন খোদাই করা ছিল, যা পুঁথির শেষ অংশের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। ফলকটি হাতে নিয়ে সুব্রতবাবুর মনে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল, যেন তিনি হাজার বছরের পুরনো এক ইতিহাসের ছোঁয়া পেলেন, যা তাঁকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ফলকটিতে একটি মানচিত্র খোদাই করা ছিল, যা মন্দিরের ঠিক নিচে একটি গোপন সুরঙ্গের পথ দেখাচ্ছিল। মানচিত্রটি ছিল জটিল, কিন্তু নন্দিনীর প্রাচীন লিপি ও প্রতীক বোঝার ক্ষমতা তাদের সাহায্য করল। মানচিত্রের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি বিন্দু যেন হাজার বছরের পুরনো এক গোপন কথা বলছিল, যা এতদিন মাটির গভীরে ঘুমিয়ে ছিল, যেন সেই পাথরের টুকরোটিই ছিল গুপ্তধনের চূড়ান্ত চাবিকাঠি। উত্তেজনা আর আশঙ্কায় তাঁদের বুক দুরু দুরু করছিল। তাঁরা জানতেন, এই মুহূর্তটি তাঁদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হতে চলেছে, এক ঐতিহাসিক আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, যা শুধু তাদের নয়, সমগ্র বাংলার ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে। গ্রামবাসীদের সাহায্যে তাঁরা মন্দিরের একটি অংশ খুঁড়তে শুরু করলেন। মাটি ছিল শক্ত, কোদালের আঘাতে পাথর ভেঙে যাচ্ছিল, কিন্তু গুপ্তধনের নেশা তাঁদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। শৌভিক তার জিও-রাডার দিয়ে মাটির নিচের কাঠামো চিহ্নিত করল, যা তাদের খনন কাজে সহায়তা করল এবং নিশ্চিত করল যে তারা সঠিক পথেই এগোচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রমের পর মাটির গভীরে একটি পাথরের ঢাকনা উন্মোচিত হলো। ঢাকনা সরাতেই একটি অন্ধকার সুরঙ্গের প্রবেশপথ দেখা গেল। সুরঙ্গের ভেতর থেকে এক স্যাঁতসেঁতে, পুরনো গন্ধ বেরিয়ে এল, যা হাজার বছরের নীরবতার সাক্ষী। বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের ভারে, এক চাপা শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি তাদের গ্রাস করল, যেন তারা এক অন্য জগতে প্রবেশ করছিল, যেখানে সময় থেমে গিয়েছিল। সুরঙ্গের প্রবেশপথে একটি অপ্রত্যাশিত বাধা ছিল। একটি বিশাল পাথরের চাঁই সুরঙ্গের মুখ আংশিকভাবে বন্ধ করে রেখেছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি ইচ্ছে করে বসানো হয়েছে। চাঁইটির গায়ে সেই সাপের কুণ্ডলীর প্রতীকটি খোদাই করা ছিল, যা পুঁথির শেষ পাতায় দেখা গিয়েছিল। শৌভিক তার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল, চাঁইটির পেছনে কোনো ফাঁদ থাকতে পারে। তার যন্ত্র থেকে একটি মৃদু বিপদ সংকেত ভেসে এল। সাবধানে তারা চাঁইটি সরাতেই, সুরঙ্গের ভেতর থেকে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এল, যা তাদের গায়ে কাঁটা দিল। একই সাথে, সুরঙ্গের ছাদ থেকে কিছু ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত বস্তু নিচে পড়তে শুরু করল, যা এক ধরনের প্রাচীন ফাঁদ ছিল, এবং সুরঙ্গের মেঝে থেকে এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হতে শুরু করল। শৌভিক দ্রুত তাদের একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিল এবং মাস্ক পরতে বলল। টর্চের আলোয় তাঁরা সুরঙ্গের গভীরে প্রবেশ করলেন। সুরঙ্গটি ছিল সংকীর্ণ এবং স্যাঁতসেঁতে, মাঝে মাঝে ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছিল, যা পাথরের উপর পড়ে এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছিল, যেন সুরঙ্গটি নিজেই কথা বলছিল। বাতাস ছিল ভারী, মনে হচ্ছিল যেন সময় এখানে থমকে আছে, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন হাজার বছরের পুরনো মাটিতে পড়ছে, প্রতিটি শ্বাস যেন ইতিহাসের গন্ধ বহন করছিল। তাদের পায়ের নিচে মাটির ধুলো আর প্রাচীন পাথরের টুকরো। কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা একটি বড় পাথরের দেওয়ালের সামনে এসে পৌঁছালেন। দেওয়ালে একটি সিংহ মূর্তি খোদাই করা ছিল, যা সেন রাজবংশের প্রতীক। সিংহের চোখগুলো যেন জীবন্ত, তার মুখ ছিল খোলা, যেন সে হাজার বছর ধরে এই গুপ্তধনের প্রহরা দিচ্ছে, তার নীরব উপস্থিতি যেন এক অদৃশ্য শক্তি, যা তাদের পরীক্ষা করছিল। সুব্রতবাবু পুঁথির শেষ শ্লোকটি মনে মনে আওড়ালেন: “সিংহের গর্ভে লুকানো রবে শেষ পথ।” তিনি সিংহের মুখের কাছে হাত দিয়ে একটি লুকানো লিভার খুঁজে পেলেন। লিভারটি ছিল পাথরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে ছিল যে সহজে চোখে পড়ার কথা নয়, যেন প্রকৃতিরই অংশ, যা শুধুমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই খুঁজে পেতে পারে। লিভারটি টানতেই পাথরের দেওয়ালটি ধীরে ধীরে সরে গেল, এক কর্কশ শব্দ করে, যা সুরঙ্গের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল, আর তাঁদের সামনে উন্মোচিত হলো এক বিশাল কক্ষ। কক্ষটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, কিন্তু টর্চের আলোয় যা দেখা গেল, তাতে তাঁদের চোখ ধাঁদিয়ে গেল। সারি সারি স্বর্ণমুদ্রার স্তূপ, রত্নখচিত গহনা, মহামূল্যবান পাথরের অলঙ্কার – সব যেন সময়ের পরিক্রমায় অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে, তাদের ঔজ্জ্বল্য যেন হাজার বছর পরেও অমলিন, যেন তারা সদ্য নির্মিত হয়েছে। কক্ষের এক কোণে ছিল অসংখ্য ব্রোঞ্জের মূর্তি, কিছু প্রাচীন অস্ত্র, এবং সারি সারি মাটির পাত্রে সংরক্ষিত শস্য বীজ। শস্য বীজগুলো হয়তো কোনো দুর্ভিক্ষ বা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত ছিল, বা হয়তো কোনো বিশেষ ধর্মীয় আচার পালনের জন্য রাখা হয়েছিল, যা তৎকালীন কৃষি পদ্ধতির এক অনন্য উদাহরণ। দেয়াল জুড়ে ছিল প্রাচীন চিত্রকর্ম, যা সেন আমলের জীবনযাত্রা, যুদ্ধ এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, তাদের রং কিছুটা ফিকে হলেও, শিল্পীর দক্ষতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, যেন তারা সেই সময়ের গল্প বলছিল। এ শুধু ধনসম্পদ ছিল না, ছিল বাংলার এক হারানো গৌরব, এক প্রাচীন সভ্যতার নীরব সাক্ষী, যা ইতিহাসের প্রতিটি কোণ থেকে কথা বলছিল। কক্ষের বাতাসে এক অদ্ভুত পবিত্রতা ছিল, যেন হাজার বছরের ইতিহাস এখানে জমাট বেঁধে আছে, প্রতিটি বস্তুর মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে এক একটি গল্প, এক একটি জীবন, যা তাদের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠছিল। কিন্তু গুপ্তধনের মধ্যে শুধু সোনা-রুপো ছিল না। কক্ষের এক সুরক্ষিত কাঠের সিন্দুকের মধ্যে পাওয়া গেল কিছু প্রাচীন পুঁথি, হাতে লেখা দলিল এবং একটি তাম্রশাসন। এই দলিলগুলো থেকে সেন রাজবংশের পতন এবং বখতিয়ার খলজির আক্রমণের সময়কার অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এল, যা প্রচলিত ইতিহাসে ছিল না। কিছু পুঁথিতে প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা ছিল, যা তৎকালীন সমাজের জ্ঞানচর্চার গভীরতা প্রমাণ করে। একটি পুঁথিতে লক্ষণ সেনের ব্যক্তিগত ভাবনা এবং তাঁর পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করা হয়েছিল, যা এতদিন বিতর্কিত ছিল এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে আলোচনার বিষয় ছিল। আরেকটি পুঁথিতে সেন রাজবংশের প্রশাসনিক কাঠামো এবং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ ছিল, যা তৎকালীন শাসন ব্যবস্থার এক বিরল চিত্র তুলে ধরে। সুব্রতবাবু ও নন্দিনী বুঝতে পারলেন, এই গুপ্তধন শুধু আর্থিক মূল্য বহন করে না, এর ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম। এটি বাংলার ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে পারে, যা এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, এক নতুন সত্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারে, যা ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখকদের জন্য এক নতুন উপাদান যোগ করবে। গুপ্তধন আবিষ্কারের পর, তাদের সামনে এক নতুন বিপদ ঘনিয়ে এল। সুরঙ্গের মুখ থেকে বেরিয়ে আসার সময়, তারা দেখতে পেল মন্দিরের বাইরে কিছু অপরিচিত লোক ঘোরাঘুরি করছে। তাদের হাতে ছিল কিছু ধারালো অস্ত্র, আর চোখে ছিল হিংস্রতা। সুব্রতবাবু বুঝতে পারলেন, এই লোকগুলোই এতদিন তাদের অনুসরণ করছিল, এবং গুপ্তধনের খবর পেয়ে এখানে এসেছে। এদের নেতা ছিল এক বিশালদেহী, ভয়ংকর চেহারার মানুষ, যার হাতে সেই একই সাপের কুণ্ডলীর প্রতীক খোদাই করা ছিল। তার চোখগুলো ছিল রক্তবর্ণ, যেন সে বহু দিন ধরে এই গুপ্তধনের জন্য অপেক্ষা করছিল। শৌভিক দ্রুত তার ড্রোন উড়িয়ে দিল, যা লোকগুলোর ছবি তুলে রাখল। নন্দিনী দ্রুত গুপ্তধনের সবচেয়ে মূল্যবান পুঁথি এবং তাম্রশাসনগুলো একটি ব্যাগে ভরে নিলেন, কারণ তিনি জানতেন, এই জ্ঞানই আসল সম্পদ। লোকগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, তাদের নেতা হুঙ্কার দিয়ে বলল, “গুপ্তধন আমাদের! তোমরা এখান থেকে জীবিত ফিরতে পারবে না!” সুব্রতবাবু, নন্দিনী এবং শৌভিক দ্রুত মন্দিরের পেছনের দিকে সরে গেলেন, যেখানে একটি ঘন জঙ্গল ছিল। জঙ্গলের পথ ধরে তারা পালাতে শুরু করলেন, পেছনে হিংস্র লোকগুলোর পদধ্বনি। শৌভিক তার প্রযুক্তি ব্যবহার করে লোকগুলোকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল, ড্রোন থেকে উচ্চ শব্দ তৈরি করে তাদের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল, এমনকি কিছু ধোঁয়া বোমাও ব্যবহার করল, যা লোকগুলোকে সাময়িকভাবে অচল করে দিল। এই সুযোগে তারা আরও গভীরে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল, কিন্তু জানত যে বিপদ এখনও কাটেনি। পরের কয়েকদিন তাদের জন্য ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো। জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা পথ চলতে লাগল, খাবার ও জলের অভাবে শরীর দুর্বল হতে লাগল। লোকগুলো তাদের পিছু ছাড়ল না, তারা যেন প্রতিটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ যেন জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। একবার শৌভিক একটি ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল, যা লোকগুলো পেতে রেখেছিল, কিন্তু সুব্রতবাবু এবং নন্দিনীর দ্রুত বুদ্ধিতে সে রক্ষা পেল। নন্দিনী তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শৌভিকের আঘাতপ্রাপ্ত হাতে বেঁধে দিলেন। এক রাতে, যখন তারা একটি নদীর ধারে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন লোকগুলো তাদের প্রায় ধরে ফেলেছিল। সুব্রতবাবু এবং শৌভিক সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ করলেন, কিন্তু তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। নন্দিনী তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ব্যবহার করে লোকগুলোকে কৌশলে বিভ্রান্ত করলেন, তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলেন, তাদের নেতাকে উদ্দেশ্য করে কিছু এমন কথা বললেন যা তাদের নিজেদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করল। ঠিক সেই মুহূর্তে, গ্রামের কিছু সাহসী যুবক, যারা এতদিন তাদের কার্যকলাপ দেখছিল, তারা এগিয়ে এল। তারা সুব্রতবাবুদের সাহায্য করতে রাজি হলো, কারণ তারা বুঝতে পারছিল যে এই গবেষকরা গ্রামের জন্য ভালো কিছু করতে এসেছেন এবং এই গুপ্তধন গ্রামের ঐতিহ্য ও গর্বের অংশ। গ্রামবাসীদের সহায়তায় তারা লোকগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম হলো। এক তুমুল লড়াইয়ের পর, লোকগুলো পিছু হটতে বাধ্য হলো, তাদের নেতা আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল, কিন্তু তাদের চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুন, যা ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অবশেষে, সুব্রতবাবু, নন্দিনী এবং শৌভিক সুরক্ষিতভাবে গ্রামে ফিরে এলেন। গ্রামবাসীরা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল, যেন তারা এক মহান যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরেছে। গুপ্তধনটি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা জানতেন, এই অমূল্য সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করার জন্য নয়, বরং দেশের ইতিহাস গবেষণায় কাজে লাগানোর জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সংরক্ষিত রাখার জন্য। তাঁদের এই আবিষ্কার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক সাড়া ফেলল। সংবাদমাধ্যম, ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই আবিষ্কারকে ‘শতাব্দীর সেরা আবিষ্কার’ বলে আখ্যায়িত করলেন। বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এই গুপ্তধন নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গুপ্তধনটি সুরক্ষিতভাবে উদ্ধার করা হলো এবং একটি বিশেষ জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো, যেখানে সাধারণ মানুষও এই ঐতিহাসিক সম্পদ দেখতে পারবে এবং বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। এই আবিষ্কার শুধু তাঁদের জীবনই নয়, বাংলার ইতিহাসকেও নতুন করে আলোকিত করল। সুব্রতবাবু ও নন্দিনী প্রমাণ করলেন, সত্যিকারের গুপ্তধন শুধু সোনা-রুপো নয়, জ্ঞান এবং ইতিহাসের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যও বটে। তাঁদের এই আবিষ্কার বাংলার প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল, আর সেন রাজবংশের হারানো গৌরব আবার জীবন্ত হয়ে উঠল ইতিহাসের পাতায়, যা আগামী প্রজন্মকে তাদের সমৃদ্ধ অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে এবং তাদের মধ্যে ইতিহাসের প্রতি এক নতুন আগ্রহ তৈরি করবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ পথচলায় সহায়ক হবে। গুপ্তধনের আবিষ্কারের পর, সেই গ্রামের নামও ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য লেখা হয়ে গেল, যা এক নতুন পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হলো, যেখানে মানুষ এসে বাংলার হারানো গৌরবকে অনুভব করতে পারবে। ~সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion