হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি – The Lost Diary
শীতের এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে, পুরনো জিনিসের হাটে রিণা ঘুরছিল। তার শখ পুরনো জিনিস কেনা, বিশেষ করে যেগুলোর পেছনে কোনো গল্প লুকিয়ে থাকে। ভাঙা গ্রামোফোন, জং ধরা ঘড়ি, বিবর্ণ ছবি – প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই সে যেন এক অদৃশ্য ইতিহাসের গন্ধ পায়, এক সুপ্ত অতীতের ফিসফিসানি। সেদিনের সকালটা ছিল অন্যরকম। হাটের কোলাহল, ভেজা মাটির গন্ধ, আর পুরনো জিনিসের স্তূপের ভিড়েও রিণার চোখ আটকে গেল এক কোণে পড়ে থাকা একটি ছোট, চামড়ার বাঁধানো ডায়েরির উপর। মলাটের উপর খোদাই করা ছিল একটি অস্পষ্ট নকশা, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন প্রতীক বা গুপ্ত সংকেত, যেন বহু যুগ ধরে কোনো গোপন বার্তা বহন করে চলেছে। ডায়েরিটা হাতে নিতেই রিণার হাতে একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি হলো, যেন বহু পুরনো কোনো গোপন কথা তার হাতের মুঠোয় ধরা পড়েছে, আর সেই গোপন কথাটি হিমশীতল। তার মন বলছিল, এটা নিছকই একটা পুরনো ডায়েরি নয়, বরং এক নিদ্রিত রহস্যের চাবি, যা তার জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে। দরদাম করে ডায়েরিটা কিনে নিল রিণা, তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর কৌতূহল দানা বাঁধল, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।
বাড়িতে ফিরে, জানালার পাশে আরামকেদারায় বসে, এক কাপ গরম কফি নিয়ে রিণা ডায়েরিটা খুলল। প্রথম পাতায় খুব সুন্দর, কিন্তু কিছুটা ভীতু হস্তাক্ষরে লেখা – “লাবণ্য, ১৯৩২।” লাবণ্য! নামটা শুনেই রিণার মনে এক মিষ্টি সুর বেজে উঠল, কিন্তু তার সাথে মিশে ছিল এক অজানা আশঙ্কা, যেন লাবণ্যের প্রতিটি অক্ষরই কোনো অকথিত ভয়ের গল্প বলছে। ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগল সে। প্রথম দিকের লেখাগুলো ছিল খুব সাধারণ – দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি ঘটনা, প্রকৃতির বর্ণনা, আর কিছু কবিতা। লাবণ্য যেন এক স্বপ্নময়ী তরুণী, যার জীবন ছিল সরল আর সুন্দর, আর তার ডায়েরি ছিল তার একান্ত আশ্রয়। তার লেখাগুলো ছিল এক নির্ভেজাল আনন্দের প্রতিচ্ছবি, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য আর ছোট ছোট স্বপ্নগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত, যেন সে তার প্রতিটি অনুভূতি ডায়েরির পাতায় ঢেলে দিত। সে লিখত বসন্তের আগমন, নতুন ফুলের গন্ধ, প্রিয় পাখির ডাক, আর তার ছোট ছোট সুখের মুহূর্তগুলো।
কিন্তু ধীরে ধীরে ডায়েরির সুর পাল্টাতে লাগল। ১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি থেকে লেখাগুলোয় এক চাপা উদ্বেগ আর অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। লাবণ্য তার ডায়েরিতে এক গোপন ভালোবাসার কথা লিখছে, যার নাম সে দেয়নি, শুধু “তিনি” বলে উল্লেখ করেছে। এই ভালোবাসা ছিল সমাজের চোখে নিষিদ্ধ, এক অচেনা বিপদের পূর্বাভাস। লাবণ্য লিখছে, “আমার মন জানে এ পথ ভুল, তবুও কেন যেন আমি তাকে ছাড়তে পারছি না। তার চোখে আমি এক অদ্ভুত আকর্ষণ দেখি, যা আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক অজানা গন্তব্যে। কিন্তু এই পথের শেষ কোথায়, আমি জানি না। এই সম্পর্ক যেন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আলো নেই। প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি, যেন কেউ আমাকে তাড়া করছে, আর আমি শুধু ছুটছি, ছুটছি… তাদের ছায়া যেন আমার পিছু ছাড়ছে না। ‘তিনি’ আমাকে সতর্ক করেছিলেন, এই পথ বিপদজনক, কিন্তু আমি তার কথা শুনিনি। আমার হৃদয়ের টান আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। আমি জানি, এই ভালোবাসার মূল্য হয়তো আমাকে অনেক বড় আকারে দিতে হবে। আমার প্রতিটি পদক্ষেপ এখন যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।” লাবণ্যের প্রতিটি শব্দে এক গভীর যন্ত্রণা আর দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রিণা অনুভব করল, লাবণ্য যেন তার সামনেই দাঁড়িয়ে তার গল্প বলছে, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস রিণার কানে বাজছে।
কিছুদিন পর থেকে লাবণ্যের লেখায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হতে লাগল। “কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে,” সে লিখল, “আমার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর যেন অদৃশ্য চোখ লেগে আছে। গত রাতে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো, কেউ যেন আমার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার নিঃশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছিলাম। জানালার কাঁচের উপর একটা অস্পষ্ট হাতের ছাপ দেখেছিলাম সকালে, যা আমার মনে আরও ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমি জানি না কী হবে, কিন্তু আমার মন বলছে, বিপদ ঘনিয়ে আসছে, তা আর দূরে নেই।” এরপরের কয়েকটি পাতায় কিছু অস্পষ্ট ইঙ্গিত – “সেই গোপন কথা,” “তাদের ষড়যন্ত্র,” “আমার জীবন বিপন্ন। ওরা আমাকে খুঁজছে, সেই দলিলটার জন্য, যা আমি অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়েছি। রায়চৌধুরীদের পুরনো পাপের দলিল। এই দলিল তাদের সব কুকীর্তির প্রমাণ। আমি লুকিয়ে রেখেছি, কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু কতদিন? আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। তাদের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। ‘তিনি’ চেষ্টা করেছিলেন আমাকে সাহায্য করতে, কিন্তু তার নিজের জীবনও এখন বিপন্ন। আমি জানি, এই দলিল প্রকাশ পেলে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে, কিন্তু তার আগে হয়তো আমার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। আমার কাছে সময় খুব কম।” রিণার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল। কীসের গোপন কথা? কারা ষড়যন্ত্র করছে? কোন দলিল? এই প্রশ্নগুলো তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল, যেন এক জটিল ধাঁধার প্রতিটি টুকরো একে অপরের সাথে মিশে আছে। রিণা অনুভব করল, লাবণ্য কেবল তার ডায়েরিতেই নয়, তার নিজের মনেও এক অস্থিরতা তৈরি করেছে, এক অদৃশ্য সুতোয় সে লাবণ্যের সাথে বাঁধা পড়ে গেছে। তার মনে হলো, লাবণ্যের শেষ দিনগুলো কেমন আতঙ্কের মধ্যে কেটেছিল, তা সে যেন নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে।
ডায়েরির শেষ কয়েকটি পাতা ছিল প্রায় উন্মাদনার মতো। হস্তাক্ষর এলোমেলো, কালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যেন লাবণ্য চরম আতঙ্কের মধ্যে লিখছিল। প্রতিটি শব্দে তার শেষ মুহূর্তের ভয় আর অসহায়তা স্পষ্ট। শেষ এন্ট্রিটা ছিল ১৯৩৪ সালের ২৫শে বৈশাখ, মাত্র কয়েকটি শব্দ – “আমি জানি, ওরা আমাকে ছাড়বে না। সেই অন্ধকার ছায়া আমাকে ঘিরে ধরছে। তাদের চোখ সর্বত্র। আমি পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার পথ বন্ধ। এই সত্য যেন কোনোদিন চাপা না পড়ে… আমার শেষ আশ্রয়… পুকুরের নিচে… বটগাছের গোড়ায়… ওরা আসছে… তাদের পায়ের শব্দ… আমি আর পারছি না… অন্ধকার… শুধু অন্ধকার… আমার আত্মা মুক্তি চায়… আমাকে বাঁচাও…” এরপর আর কিছু নেই। পাতাটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যেন কেউ তাড়াহুড়ো করে কিছু লুকাতে চেয়েছিল, বা লাবণ্য নিজেই শেষ মুহূর্তে কিছু প্রমাণ নষ্ট করতে চেয়েছিল, যা হয়তো তার হত্যাকারীদের হাতে পড়ুক তা চায়নি। রিণার মনে হলো, সে যেন লাবণ্যের শেষ আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে, যা সময়ের পরিক্রমায় ডায়েরির পাতায় আটকে আছে, আর তার প্রতিধ্বনি রিণার কানের কাছে বাজছে।
রিণার হাত কাঁপছিল। লাবণ্য কি খুন হয়েছিল? তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কি কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে? রিণা স্থির করল, সে লাবণ্যের গল্প খুঁজে বের করবে, তার শেষ কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করবে। ডায়েরিতে কিছু নাম আর জায়গার উল্লেখ ছিল, যদিও সেগুলো ছিল খুব অস্পষ্ট। “রায়চৌধুরী এস্টেট,” “পুরনো ঘাট,” “কাকাবাবু” – এই ধরনের কিছু শব্দ, যা একটি ধাঁধার টুকরোর মতো মনে হচ্ছিল, কিন্তু প্রতিটি টুকরোই যেন এক নতুন রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করছিল। রিণা জানত, এই পথ সহজ হবে না, কিন্তু তার কৌতূহল তাকে থামতে দিচ্ছিল না। তার মনে হলো, লাবণ্যের আত্মা যেন তাকে এই রহস্য উন্মোচনের জন্য ডাকছে, তাকে এক অদেখা দায়িত্বের জালে বেঁধে ফেলছে।
রিণা প্রথমে পুরনো খবরের কাগজ খুঁজতে শুরু করল। ১৯৩৪ সালের আশেপাশে কোনো নিখোঁজ বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর। স্থানীয় লাইব্রেরির পুরনো আর্কাইভে সে যখন খবরটি খুঁজতে গেল, তখন লাইব্রেরিয়ান তাকে অদ্ভুত চোখে দেখল, যেন সে এমন কিছু খুঁজছে যা খোঁজা উচিত নয়। লাইব্রেরিয়ান বারবার তাকে অন্য বিষয়ের বই দেখতে অনুরোধ করছিলেন, তার আচরণে এক অস্বাভাবিকতা ছিল। তার চোখ দুটো যেন কিছু লুকাতে চাইছিল, যেন কোনো গোপন নির্দেশ তাকে এমন আচরণ করতে বাধ্য করছিল। রিণা তার এই অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করল, কিন্তু পাত্তা দিল না। সে বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, ধুলোমাখা একটি পুরনো স্থানীয় সংবাদপত্রে সে একটি ছোট খবর খুঁজে পেল: “লাবণ্য সেনগুপ্তা, রায়চৌধুরী এস্টেটের নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা, গত ২৫শে বৈশাখ থেকে নিখোঁজ। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, তিনি হয়তো স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেছেন।” পুলিশ রিপোর্ট ছিল খুব সংক্ষিপ্ত, যেন ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত এই খবরটিকে গুরুত্বহীন প্রমাণ করতে চেয়েছিল। রিণা বুঝতে পারল, এই নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, যা ক্ষমতার বলে চাপা দেওয়া হয়েছে। এই খবরটি পড়ার সময় তার কাঁধের উপর যেন একটি শীতল নিঃশ্বাস অনুভব করল, কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখল কেউ নেই। তার মনে হলো, লাবণ্য যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে পথ দেখাচ্ছে, তাকে সাহস যোগাচ্ছে।
রিণা রায়চৌধুরী এস্টেটের খোঁজ নিল। জানা গেল, সেটি এখন একটি পরিত্যক্ত বাড়ি, যা বহু বছর ধরে বন্ধ। স্থানীয় একজন বৃদ্ধ, যিনি একসময় ওই এস্টেটের কাছাকাছি থাকতেন, তাকে বাড়িটির ঠিকানা বলে দিলেন। কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত ভয়, যেন তিনি রিণাকে সেখানে যেতে বারণ করতে চাইছেন। “ওখানে যাবেন না মা,” বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, তার গলা ভয়ে কাঁপছিল, “ওই বাড়িতে ভালো কিছু নেই। অন্ধকার আর অভিশাপের ছায়া লেগে আছে। যারা ওখানে গেছে, তারা আর ফেরেনি। রায়চৌধুরীরা খুব প্রভাবশালী লোক ছিল, তাদের ক্ষমতা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের অদৃশ্য হাত এখনও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ওই বাড়ির প্রতিটি কোণে যেন মৃত্যুর গন্ধ লেগে আছে। রাতের বেলা নাকি অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়।” তার কথা অগ্রাহ্য করে রিণা সেই বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, এক নির্জন জায়গায় বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, যেন অতীতের সব রহস্য বুকে নিয়ে। তার ভাঙা জানালাগুলো যেন শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে, আর প্রতিটি ইঁট যেন কোনো চাপা আর্তনাদের সাক্ষী। প্রবেশপথের লোহার গেটটা জং ধরে এমনভাবে বেঁকে আছে যেন কোনো অতিকায় প্রাণী তার উপর দিয়ে হেঁটে গেছে। গেটের ওপরে একটি পুরনো ফলকে অস্পষ্টভাবে “রায়চৌধুরী ভিলা” লেখা ছিল, যা একসময় এই পরিবারের প্রতাপের প্রতীক ছিল।
বাড়ির প্রতিটি কোণে যেন লাবণ্যের উপস্থিতি অনুভব করছিল রিণা। বাতাস ভারী, প্রতিটি পদক্ষেপে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ যেন কোনো গোপন বার্তা দিচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নাকে এল, আর মাকড়সার জাল যেন প্রতিটি কোণকে গ্রাস করে রেখেছে। ঘরের আসবাবপত্রগুলো ধুলোর আস্তরণে ঢাকা, যেন বহু বছর ধরে কেউ এখানে আসেনি। প্রতিটি ঘরেই যেন এক চাপা গুমোট ভাব, যা রিণার মনে এক অজানা ভয় তৈরি করছিল। ভাঙা কাঁচের টুকরো, পুরনো কাপড়ের ছেঁড়া অংশ আর ধুলোর আস্তরণ যেন এক বিভীষিকাময় অতীতের কথা বলছিল। দেয়ালের কিছু জায়গায় কালচে দাগ, যা দেখে মনে হচ্ছিল রক্তের শুকিয়ে যাওয়া ছাপ। ডায়েরিতে উল্লিখিত “পুরনো ঘাট” খুঁজতে খুঁজতে সে বাড়ির পেছনের দিকে একটি ছোট পুকুর আর তার পাশে ভাঙা ঘাট দেখতে পেল। ঘাটের পাশে একটি পুরনো বটগাছ, যার ডালপালা পুকুরের জলের উপর ঝুঁকে আছে। ডায়েরিতে লাবণ্য এই বটগাছের নিচে বসে কবিতা লেখার কথা লিখেছিল। পুকুরের জল স্থির, কালো, যেন তার গভীরে কোনো অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে, আর সেই কালো জলে বটগাছের ছায়া যেন এক অশুভ ইঙ্গিত। পুকুরের পাড়ে কিছু শুকনো ফুল আর সিঁদুর লেগেছিল, যেন বহু বছর আগে এখানে কোনো অশুভ কাজ হয়েছিল, যা আজও তার চিহ্ন রেখে গেছে। রিণার মনে হলো, এই পুকুরটিই লাবণ্যের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল, যেখানে তার জীবনের আলো নিভে গিয়েছিল। পুকুরের গভীরে যেন এক অতৃপ্ত আত্মা মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ রিণার চোখ পড়ল ঘাটের এক কোণে, মাটির নিচে কিছুটা বেরিয়ে থাকা একটি ছোট পাথরের উপর। পাথরটি সরাতেই সে দেখতে পেল একটি ছোট কাঠের বাক্স। বাক্সটি খুলতেই তার ভেতরে পাওয়া গেল একটি ছোট চিঠি আর একটি পুরনো সোনার লকেট। চিঠিটি লাবণ্যের হস্তাক্ষরে লেখা:
“যদি কোনোদিন এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছায়, তবে জেনো আমি আর নেই। রায়চৌধুরী পরিবারের অন্ধকার রহস্য আমি জেনে ফেলেছিলাম। তাদের অবৈধ সম্পত্তির খবর, যা তারা বহু বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই দলিল আমি অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম। ‘তিনি’ আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। তাকেও হয়তো ওরা শেষ করে দিয়েছে। এই লকেটের ভেতরেই আছে সেই গুপ্তধনের মানচিত্রের শেষ অংশ, যা ওই দলিলের সাথে যুক্ত। ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে, কিন্তু আমার আত্মা শান্তি পাবে না যতক্ষণ না সত্য প্রকাশিত হয়। এই লকেটটি আমার কাকাবাবুর কাছে পৌঁছে দিও। তিনিই একমাত্র আমাকে বিশ্বাস করতেন এবং আমাকে এই সত্য প্রকাশ করতে বলেছিলেন। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিও। এই লকেটের নকশাটি একটি বিশেষ চিহ্ন, যা শুধু কাকাবাবুই চিনতে পারবেন। এই সত্য যেন সূর্যের আলোর মতো প্রকাশিত হয়, আর আমার আত্মাও যেন মুক্তি পায়।”
রিণার শরীর হিম হয়ে গেল। লাবণ্যকে খুন করা হয়েছিল! আর তার কাকাবাবু? ডায়েরিতে “কাকাবাবু”র কথা কয়েকবার উল্লেখ ছিল, কিন্তু তার পুরো নাম বা ঠিকানা ছিল না। রিণা লকেটটি হাতে নিয়ে দেখল। ভেতরে সত্যিই একটি ছোট ভাঁজ করা কাগজ, তাতে অস্পষ্ট কিছু চিহ্ন। হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ যেন তাকে দেখছে। একটি শীতল বাতাস তার পাশ দিয়ে বয়ে গেল, আর গাছের পাতার মর্মর শব্দ যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে। সে দ্রুত চারপাশে তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। শুধু বাতাসের শব্দ আর গাছের পাতার মর্মর। একটা শীতল ভয় তাকে গ্রাস করল। সে দ্রুত বাক্সটি বন্ধ করে লকেটটি নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল, তার মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে তাড়া করছে। বাড়ির বাইরে এসে সে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, কিন্তু তার মনে এক নতুন জেদ চেপে বসল। লাবণ্যের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে, তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।
রিণা আবার ফিরে এল শহরে। এবার তার লক্ষ্য লাবণ্যের “কাকাবাবু”কে খুঁজে বের করা। ডায়েরিতে লাবণ্য তার কাকাবাবুকে নিয়ে একটি ছোট কবিতা লিখেছিল, যেখানে তার পেশার একটি ইঙ্গিত ছিল – “তিনি শব্দের কারিগর, কলমের জাদুকর, সত্যের সন্ধানে তার জীবন উৎসর্গ।” রিণা বুঝতে পারল, কাকাবাবু হয়তো একজন লেখক বা সাংবাদিক ছিলেন, যিনি সত্যের পেছনে ছুটতে দ্বিধা করতেন না, এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তার মনে হলো, কাকাবাবুও হয়তো লাবণ্যের মতোই সত্যের বলি হয়েছিলেন।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর, রিণা একটি পুরনো সাহিত্য পত্রিকার আর্কাইভে এক লেখকের নাম খুঁজে পেল – “অমল সেনগুপ্ত।” তার লেখার ধরন আর লাবণ্যের ডায়েরিতে উল্লিখিত কাকাবাবুর বর্ণনার মধ্যে অদ্ভুত মিল। অমল সেনগুপ্তের শেষ প্রকাশিত লেখাটি ছিল ১৯৩৪ সালের একটি ছোট প্রবন্ধ, যেখানে তিনি সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রবন্ধটি ছিল অসম্পূর্ণ, যেন লেখককে মাঝপথেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেন তার কলম জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। প্রবন্ধের শেষ বাক্যটি ছিল, “কিছু সত্য এতটাই ভয়ংকর যে তা প্রকাশ করতে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু আমি পিছপা হব না, কারণ সত্যের জয় অনিবার্য।” এই বাক্যটি যেন অমল সেনগুপ্তের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ দিচ্ছিল, যা লাবণ্যের শেষ চিঠির সাথে মিলে যাচ্ছিল।
রিণা অমল সেনগুপ্তের পরিবারের খোঁজ নিল। জানা গেল, তার কোনো সরাসরি বংশধর নেই, কিন্তু তার একজন দূর সম্পর্কের নাতনি এখনও বেঁচে আছেন, যিনি পুরনো পারিবারিক কাগজপত্র নিয়ে কাজ করেন। তার নাম অনুরাধা। তিনি একজন ইতিহাসবিদ, যিনি পুরনো নথি নিয়ে গবেষণা করেন। রিণা তার সঙ্গে যোগাযোগ করল। অনুরাধা রিণার কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও, লাবণ্যের ডায়েরি আর লকেটের কথা শুনে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তিনি জানালেন, লাবণ্য ছিল তার দাদুর খুব প্রিয় ভাগ্নি। লাবণ্যের নিখোঁজ হওয়ার পর তার দাদু খুব ভেঙে পড়েছিলেন এবং এই রহস্যের পেছনে ছুটেছিলেন। তিনি সন্দেহ করতেন, রায়চৌধুরী পরিবারের সঙ্গেই এর যোগসূত্র আছে, কারণ লাবণ্য রায়চৌধুরী পরিবারের এক ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। অমল সেনগুপ্ত নিজেও লাবণ্যের নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন পর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। তার শেষ লেখাটি ছিল সেই গোপন দলিলের প্রথম অংশ নিয়ে, যা তিনি লাবণ্যের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। অনুরাধা রিণাকে তার দাদুর পুরনো একটি সিন্দুকের চাবি দিলেন, যেখানে তার গবেষণার কিছু গোপন নথি থাকতে পারে। সিন্দুকটি ছিল একটি পুরনো কাঠের আলমারির পেছনে লুকানো একটি গোপন কুঠুরিতে, যা বহু বছর ধরে কেউ খোলেনি।
সিন্দুক খুলতেই দেখা গেল, তার ভেতরে অমল সেনগুপ্তের হাতে লেখা কিছু নোটবুক আর একটি অসম্পূর্ণ মানচিত্র। নোটবুকগুলোতে রায়চৌধুরী পরিবারের অবৈধ ব্যবসার বিস্তারিত তথ্য, তাদের প্রভাবশালী যোগসূত্র, এবং কীভাবে তারা সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদ গড়েছিল তার বর্ণনা ছিল। সেখানে কিছু নাম এবং তারিখও উল্লেখ ছিল, যা তাদের অপরাধের গভীরতা প্রমাণ করছিল। কিছু পাতায় অমল সেনগুপ্তের নিজের হাতে লেখা ছিল, “এই দলিল হাতে পাওয়ার পর থেকে আমার জীবন বিপন্ন। ওরা আমাকে ছাড়বে না। লাবণ্যকে ওরা মেরেছে, আমাকেও মারবে। কিন্তু আমি সত্য প্রকাশ করবই, কারণ সত্যের কাছে কোনো শক্তিই চিরকাল টিকে থাকতে পারে না।” এই নোটবুকগুলো যেন লাবণ্যের ডায়েরিরই পরিপূরক ছিল, যা তাদের দুজনের জীবনের শেষ অধ্যায়ের এক মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরছিল। লকেটের ভেতরের মানচিত্রের টুকরো আর অমল সেনগুপ্তের পুরনো কিছু নোটবুক মিলিয়ে রিণা আর অনুরাধা মিলে সেই গুপ্তধনের মানচিত্রের সম্পূর্ণ অংশ উদ্ধার করল। সেটি ছিল রায়চৌধুরী পরিবারের এক বিশাল অবৈধ সম্পত্তির মানচিত্র, যা তারা বহু বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল। এই সম্পত্তির খবর লাবণ্য জেনে গিয়েছিল, আর সেই কারণেই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অমল সেনগুপ্তও সেই সত্য প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাকেও থামিয়ে দেওয়া হয়, তার লেখাকে অসম্পূর্ণ রেখে।
রিণা সমস্ত প্রমাণ নিয়ে পুলিশের কাছে গেল। প্রথমে পুলিশ এই পুরনো মামলা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি, তাদের মনে হয়েছিল এটি একটি মৃতপ্রায় কেস। কিন্তু যখন রিণা ডায়েরি, লকেট, মানচিত্র এবং অমল সেনগুপ্তের নোটবুকগুলো দেখাল, তখন তারা নড়েচড়ে বসল। এই প্রমাণগুলো এতটাই জোরালো ছিল যে, পুলিশ আর তা উপেক্ষা করতে পারল না। একজন সৎ ও সাহসী পুলিশ অফিসার, ইন্সপেক্টর রায়, এই মামলাটি হাতে নিলেন। তিনি রিণার দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। নতুন করে তদন্ত শুরু হলো, যা দেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলল। রায়চৌধুরী পরিবারের ক্ষমতাশালী সদস্যরা প্রথমে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করল, তাদের আইনজীবী দল সবরকম চেষ্টা করল প্রমাণগুলো মিথ্যা প্রমাণ করতে। কিন্তু ইন্সপেক্টর রায়ের অদম্য চেষ্টা এবং রিণার দেওয়া অকাট্য প্রমাণের সামনে তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। প্রমাণের পাহাড় তাদের সামনে দাঁড়াতে পারল না। কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলো, এবং তাদের অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। সংবাদপত্রে এই ঘটনা ফলাও করে ছাপা হলো, যা একসময় চাপা পড়ে গিয়েছিল। লাবণ্য এবং অমল সেনগুপ্তের আত্মারা যেন অবশেষে শান্তি পেল, তাদের মৃত্যুর এত বছর পর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো।
লাবণ্য হয়তো তার জীবন দিয়েছিল, অমল সেনগুপ্তও হারিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের ডায়েরি, লকেট আর রিণার অদম্য জেদ তাদের গল্পকে বাঁচিয়ে রাখল। রিণা ডায়েরিটি যত্ন করে রাখল, কারণ এটি শুধু একটি পুরনো বই ছিল না, এটি ছিল এক তরুণীর হারানো স্বপ্ন, এক চাপা পড়া সত্যের দলিল, যা অবশেষে আলোর মুখ দেখল। এই ডায়েরি রিণার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। কিন্তু রিণা জানে, কিছু অন্ধকার ছায়া সহজে মুছে যায় না। রায়চৌধুরী পরিবারের ক্ষমতার জাল এখনও বিস্তৃত, এবং এই সত্য উন্মোচনের পর তার নিজের জীবনও হয়তো আর আগের মতো নিরাপদ নেই। সে এখন জানে, সত্যের পেছনে ছুটতে গেলে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়, আর কিছু রহস্যের সমাধান নতুন রহস্যের জন্ম দেয়। তার ডায়েরি পড়ার শখ হয়তো তাকে আরও অনেক অজানা পথের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, যেখানে আরও অনেক চাপা পড়া গল্প তার জন্য অপেক্ষা করছে। রিণার নতুন জীবন শুরু হলো, যেখানে সে শুধু একজন পাঠক নয়, বরং ইতিহাসের একজন সক্রিয় অংশীদার, যে সত্যের সন্ধানে নির্ভয়ে এগিয়ে চলে। সে এখন বুঝতে পারে, প্রতিটি পুরনো জিনিসের পেছনেই একটি গল্প লুকিয়ে থাকে, আর কিছু গল্প এতটাই শক্তিশালী যে তা সময়ের বাঁধাকেও অতিক্রম করে যায়। রিণা এখন নিজেকে লাবণ্যের গল্পের উত্তরসূরী মনে করে, যে সত্যকে উন্মোচন করার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিয়েছে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion