হিমাচলের কুল্লু উপত্যকা। মে মাসের শেষ, অথচ হিমালয়ের চূড়াগুলো তখনও বরফের সাদা চাদরে মোড়া। কুল্লুর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিয়াস নদীর খরস্রোত পাথরে আছড়ে পড়ে এক অনবরত গর্জন তৈরি করছিল। পর্যটকদের ভিড় তখনও সেভাবে জমেনি, তাই উপত্যকা জুড়ে এক শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। কিন্তু এই শান্ত প্রকৃতির আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক হিমশীতল আতঙ্ক।
প্রথম ঘটনাটা ঘটেছিল মানালির কাছেই, সোলং ভ্যালির উপরের দিকে, একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে। গ্রামের মানুষজন যাকে ‘ভূত ভ্যালি’ বলে জানে, সেখানেই। পঁচিশ বছর বয়সী নবীন থাপার মৃতদেহ পাওয়া যায় এক পুরনো দেবদারু গাছের নিচে। নবীন ছিল একজন স্থানীয় শিকারি, নির্ভীক এবং অভিজ্ঞ। তার নিখোঁজ হওয়ার খবরটা প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। পাহাড়ে শিকারিরা প্রায়ই গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যায়, অথবা পথ ভুলে অন্য গ্রামে চলে যায়। কিন্তু তিন দিন পর যখন তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল, তখন গ্রামের মুখে কুলুপ আঁটা।
নবীন থাপার দেহটি এমনভাবে পড়ে ছিল যেন তাকে কোনো হিংস্র জন্তু ছিঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু ইনস্পেক্টর বিক্রম সিং, যিনি কুল্লু থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, তিনি প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলেন, এটা কোনো সাধারণ বন্যপ্রাণীর কাজ নয়। নবীন থাপার গলায় একটি অদ্ভুত চিহ্ন ছিল, যেন কোনো ধারালো নখ দিয়ে গভীর আঁচড় কাটা হয়েছে। আর তার বুকের উপর একটি ছোট, কালো পাথর রাখা ছিল, যা স্থানীয়রা অশুভ বলে মনে করে। বিক্রম সিং একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, কিন্তু এই ধরনের খুন তিনি আগে দেখেননি। তার মনে হচ্ছিল, এটা কোনো মানুষ নয়, বরং কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির কাজ। গ্রামের চোখেও সেই ভয় স্পষ্ট। তারা ফিসফিস করে বলছিল, “ভূত ভ্যালির অভিশাপ ফিরে এসেছে।”
বিক্রম সিং কেসটা চাপা দিতে চেয়েছিলেন। পর্যটন মরসুম শুরু হচ্ছে, এমন সময় একটা সিরিয়াল কিলিংয়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে হিমাচলের অর্থনীতিতে বড়সড় ধাক্কা লাগবে। কিন্তু দু’সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল। এবার শিকারি ছিল আরও অভিজ্ঞ, পঞ্চাশোর্ধ্ব রতন সিং। রতন সিংয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেল আরও দুর্গম একটি জায়গায়, একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে। তার মৃতদেহও একইরকমভাবে ক্ষতবিক্ষত ছিল, এবং তার বুকের উপরও সেই একই কালো পাথর। এবার আর চাপা দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। “হিমাচলে রহস্যময় খুন: শিকারিদের টার্গেট করছে কে?” শিরোনামে খবর বেরোতেই সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো।
কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত দার্জিলিংয়ের এক কফি শপে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল অরুণিমা সেন।
কলকাতা পুলিশের একজন অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দা সে। সম্প্রতি একটি কঠিন কেস সমাধান করে সে মানসিক অবসাদ থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও, তার ভেতরের অস্থিরতা তখনও কাটেনি। খবরের কাগজের শিরোনামটা তার চোখে পড়তেই তার কৌতূহল বেড়ে গেল। “হিমাচলে রহস্যময় খুন।” সে খবরটা খুঁটিয়ে পড়ল। নবীন থাপা, রতন সিং, কালো পাথর, ভূত ভ্যালি… প্রতিটি শব্দই তার মনে এক নতুন ধাঁধার জন্ম দিল।
অরুণিমা জানত, এই কেসটা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এটা শুধু একটা খুন নয়, এর পেছনে হয়তো লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো রহস্য। তার মন তাকে টানছিল হিমাচলের দিকে, সেই হিমশীতল উপত্যকার দিকে যেখানে অন্ধকার আর রহস্য হাত ধরাধরি করে চলে। সে সিদ্ধান্ত নিল, এই কেসটার গভীরে তাকে যেতেই হবে। হয়তো এই রহস্যের সমাধানই তাকে তার নিজের ভেতরের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে।
পরের দিন সকালেই অরুণিমা হিমাচলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার মনে এক মিশ্র অনুভূতি – একদিকে অজানা রহস্যের হাতছানি, অন্যদিকে এক চাপা ভয়। সে জানত না, হিমাচলের এই হিমশীতল রহস্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion