কুল্লু বিমানবন্দরে নামতেই অরুণিমা হিমেল বাতাসের এক ঝাপটা অনুভব করল। কলকাতার আর্দ্র গরম ছেড়ে এখানে এসে তার শরীরটা যেন সতেজ হয়ে উঠল। ট্যাক্সি নিয়ে সে সরাসরি কুল্লু থানায় পৌঁছাল। ইনস্পেক্টর বিক্রম সিংয়ের সাথে তার আগে থেকেই ফোনে কথা হয়েছিল, কিন্তু অরুণিমা জানত, একজন বহিরাগত, বিশেষ করে একজন মহিলা গোয়েন্দাকে এখানকার পুলিশ কতটা সহজে গ্রহণ করবে।
থানায় ঢুকে অরুণিমা দেখল, ইনস্পেক্টর বিক্রম সিং তার চেম্বারে বসে কিছু ফাইল দেখছেন। অরুণিমা নিজেকে পরিচয় দিতেই বিক্রম সিং মাথা তুলে তাকালেন। তার চোখে প্রথমে কিছুটা বিস্ময়, তারপর সন্দেহ।
“আপনিই অরুণিমা সেন? কলকাতা থেকে এসেছেন?” বিক্রম সিংয়ের হিন্দিতে একটা পাহাড়ি টান ছিল।
“হ্যাঁ, ইনস্পেক্টর সিং। আমিই অরুণিমা সেন। এখানকার সিরিয়াল কিলিং কেসটা নিয়ে আমি এসেছি।” অরুণিমা শান্তভাবে উত্তর দিল।
বিক্রম সিং একটু হাসলেন, “সিরিয়াল কিলিং? আমরা তো এখনও নিশ্চিত নই যে এটা সিরিয়াল কিলিং। আর কলকাতার পুলিশ কেন এই কেসে এত আগ্রহী, সেটাও বুঝতে পারছি না।”
অরুণিমা তার চোখে চোখ রেখে বলল, “ইনস্পেক্টর, যখন দুটো খুনের ধরন হুবহু এক হয়, এবং শিকার নির্বাচনের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকে, তখন তাকে সিরিয়াল কিলিংই বলে। আর কলকাতা পুলিশ শুধু আগ্রহী নয়, আমরা মনে করি এই কেসটা জাতীয় স্তরে গুরুত্ব পাওয়ার মতো। আমি এখানে আপনার সাথে কাজ করতে এসেছি, আপনাকে সাহায্য করতে।”
বিক্রম সিং কিছুক্ষণ চুপ করে অরুণিমাকে দেখলেন। তার চোখে অরুণিমার আত্মবিশ্বাস ধরা পড়ল। তিনি হয়তো কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েছিলেন।
“ঠিক আছে। বসুন। আমি আপনাকে কেসের ফাইলগুলো দেখাচ্ছি।” বিক্রম সিংয়ের কণ্ঠস্বরে এবার কিছুটা নরম সুর।
অরুণিমা ফাইলগুলো দেখতে শুরু করল। নবীন থাপা এবং রতন সিংয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, ঘটনাস্থলের ছবি, স্থানীয়দের বয়ান – সব খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। ছবিগুলো দেখে তার গা শিউরে উঠল। নিহতদের গলায় সেই অদ্ভুত আঁচড়ের চিহ্ন, যা দেখে মনে হচ্ছে কোনো ধারালো নখ বা পাঞ্জার আঘাত। আর বুকের উপর রাখা সেই কালো পাথর।
“এই পাথরটা কী?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
বিক্রম সিং বললেন, “স্থানীয়রা এটাকে ‘শয়তানের পাথর’ বলে। তাদের বিশ্বাস, এটা মন্দ আত্মাদের প্রতীক। গ্রামের মানুষজন এই পাথরকে ছুঁতেও ভয় পায়।”
“আর এই আঁচড়গুলো? কোনো বন্যপ্রাণীর কাজ হতে পারে?”
“না। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, এটা কোনো জন্তুর কাজ নয়। আঘাতগুলো খুব সুনির্দিষ্ট, যেন কেউ ইচ্ছে করে মেরেছে।” বিক্রম সিংয়ের কথায় বিরক্তি স্পষ্ট। “কিন্তু কে করবে এমন কাজ? আর কেন?”
অরুণিমা গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই আঁচড়গুলো শুধু আঘাত নয়, এর পেছনে কোনো প্রতীকী অর্থ থাকতে পারে। সে ফরেনসিক রিপোর্টটা হাতে নিল। “ডাক্তার প্রীতি শর্মা, ইনিই কি পোস্টমর্টেম করেছেন?”
“হ্যাঁ। আমাদের এখানকার সেরা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। তরুণী হলেও খুব দক্ষ।”
অরুণিমা প্রীতি শর্মার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। তার মনে হচ্ছিল, এই কেসের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে ফরেনসিক রিপোর্টে। বিক্রম সিংয়ের সাথে প্রাথমিক আলাপচারিতার পর অরুণিমা বুঝতে পারল, বিক্রম সিং হয়তো প্রথমদিকে তাকে মেনে নিতে না চাইলেও, তার পেশাদারিত্ব দেখে তিনি ধীরে ধীরে সহযোগিতা করবেন।
পরের দিন সকালে অরুণিমা স্থানীয় হাসপাতালে প্রীতি শর্মার সাথে দেখা করল। প্রীতি শর্মা একজন প্রাণবন্ত এবং বুদ্ধিদীপ্ত তরুণী। অরুণিমাকে দেখে তিনি বেশ খুশি হলেন।
“আমি আপনার কথা শুনেছি, ম্যাম। কলকাতা থেকে এসেছেন। এই কেসটা সত্যিই খুব অদ্ভুত।” প্রীতি শর্মা বললেন।
“হ্যাঁ, ডক্টর। আমি আপনার রিপোর্টগুলো দেখেছি। এই আঁচড়গুলো নিয়ে আপনার কী মনে হয়? এগুলো কি কোনো বিশেষ ধরনের অস্ত্রের আঘাত?”
প্রীতি শর্মা মাইক্রোস্কোপের নিচে কিছু স্লাইড দেখাচ্ছিলেন। “আঁচড়গুলো খুব গভীর এবং সুনির্দিষ্ট। দেখে মনে হয়, কোনো ধারালো, বাঁকানো ধাতব বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তবে, এর আগে আমি এমন আঘাত দেখিনি। মনে হচ্ছে, কোনো বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যা হয়তো স্থানীয় কোনো প্রথা বা আচারের সাথে সম্পর্কিত।”
“আচার?” অরুণিমা কৌতূহলী হলো।
“হ্যাঁ। এই অঞ্চলে কিছু প্রাচীন উপজাতি আছে, যাদের নিজস্ব কিছু প্রথা আছে। তাদের মধ্যে কিছু প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে, যা বাইরের কেউ জানে না।” প্রীতি শর্মা ব্যাখ্যা করলেন। “আর এই কালো পাথর… এর রাসায়নিক গঠনও অদ্ভুত। এটা এখানকার কোনো সাধারণ পাথর নয়।”
অরুণিমা এবং প্রীতি শর্মা দীর্ঘক্ষণ ধরে কেসের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলেন। প্রীতি শর্মা অরুণিমাকে নিহতদের শরীরের আরও কিছু সূক্ষ্ম চিহ্ন দেখালেন, যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। নবীন থাপার শরীরে একটি ছোট ট্যাটু ছিল, যা একটি প্রাচীন পাহাড়ি প্রতীকের মতো দেখতে। রতন সিংয়ের হাতেও একই ধরনের একটি চিহ্ন ছিল, তবে সেটি ট্যাটু নয়, বরং পুড়ে যাওয়ার মতো একটি দাগ।
“এই চিহ্নগুলো কি কোনোভাবে খুনের সাথে সম্পর্কিত?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
“হতে পারে। এই ধরনের প্রতীক এই অঞ্চলের কিছু প্রাচীন উপজাতির মধ্যে প্রচলিত। তারা শিকারি ছিল। হয়তো এই খুনগুলো কোনো পুরনো শত্রুতা বা প্রতিশোধের ফল।” প্রীতি শর্মা অনুমান করলেন।
অরুণিমা বুঝতে পারল, এই কেসটা শুধু খুন নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে হিমাচলের প্রাচীন ইতিহাস, লোককথা এবং কিছু লুপ্তপ্রায় প্রথা। খুনি হয়তো এই প্রথাগুলোকেই ব্যবহার করছে তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। এই কেস সমাধানের জন্য তাকে শুধু অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে না, তাকে হিমাচলের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকেও জানতে হবে।
অরুণিমা প্রীতি শর্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুল্লু থানার দিকে রওনা দিল। তার মনে নতুন করে এক চ্যালেঞ্জের জন্ম হয়েছে। এই কেসটা তার জীবনের অন্যতম কঠিন কেস হতে চলেছে। কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। হিমাচলের হিমশীতল রহস্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য সে বদ্ধপরিকর।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion