অরুণিমা গুহার বাইরে এসে কালীচরণকে খুঁজতে শুরু করল। সে জানত, কালীচরণ কাছাকাছিই আছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই সে একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। সে ছিল কালীচরণ।
কালীচরণ একটি পাথরের উপর বসে ছিল, তার হাতে একটি ত্রিশূল। তার মুখে এক ধরনের শয়তানি হাসি।
“তুমি বেঁচে গেছ, গোয়েন্দা,” কালীচরণ বলল। “কিন্তু তোমার সঙ্গী গুহার ভেতরে আটকা পড়েছে।”
“তুমি কী চাও?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
“আমি চাই প্রকৃতির প্রতিশোধ। যারা প্রকৃতির ক্ষতি করেছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে।” কালীচরণ বলল। “শঙ্কর আমার হাতিয়ার। সে প্রকৃতির রক্ষক।”
“তুমি শঙ্করকে ব্যবহার করছ,” অরুণিমা বলল। “তুমিই আসল খুনি।”
কালীচরণ হাসল। “আমি শুধু পথ দেখিয়েছি। শঙ্কর তার নিজের ইচ্ছায় কাজ করছে।”
অরুণিমা বুঝতে পারল, কালীচরণ একজন উন্মাদ। সে প্রকৃতির প্রতিশোধের নামে খুন করছে, এবং শঙ্করকে ব্যবহার করছে।
অরুণিমা তার রিভলভার বের করল। “তুমি ধরা পড়েছ, কালীচরণ। তোমার খেলা শেষ।”
কালীচরণ হাসল। “আমার খেলা এখনও শেষ হয়নি, গোয়েন্দা। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে।”
হঠাৎই কালীচরণ ত্রিশূলটি অরুণিমার দিকে ছুঁড়ে মারল। অরুণিমা দ্রুত সরে গেল। ত্রিশূলটি তার পাশ দিয়ে চলে গেল এবং একটি গাছে বিঁধে গেল।
কালীচরণ অরুণিমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরুণিমা তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। কুয়াশার মধ্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শুরু হলো। কালীচরণ ছিল শক্তিশালী এবং হিংস্র। অরুণিমা জানত, তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
লড়াইয়ের এক পর্যায়ে অরুণিমা লক্ষ্য করল, কালীচরণের হাতে একটি ছোট তাবিজ বাঁধা আছে। সেই একই তাবিজ, যা শঙ্করের হাতে ছিল। অরুণিমা বুঝতে পারল, কালীচরণই শঙ্করের তাবিজটা নিয়েছিল, এবং সেটা দিয়ে শঙ্করকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিল।
অরুণিমা কালীচরণের হাত থেকে তাবিজটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কালীচরণ তাকে ধাক্কা দিল। অরুণিমা পাথরের উপর পড়ে গেল। কালীচরণ তার দিকে এগিয়ে এল, তার চোখে এক ধরনের উন্মাদনা।
হঠাৎই বিক্রম সিং গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তার হাতে একটি ভাঙা লাঠি। তিনি শঙ্করের সাথে লড়াই করে গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বিক্রম সিং কালীচরণের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
অরুণিমা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সে বিক্রম সিংকে সাহায্য করার জন্য কালীচরণের দিকে এগিয়ে গেল। তারা দুজনে মিলে কালীচরণকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন। কালীচরণ ছিল শক্তিশালী, কিন্তু তারা দুজনেই ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
লড়াইয়ের এক পর্যায়ে কালীচরণ একটি পাথরের উপর হোঁচট খেল। অরুণিমা এই সুযোগটা কাজে লাগাল। সে তার রিভলভার বের করে কালীচরণের দিকে তাক করল।
“থামো, কালীচরণ!” অরুণিমা বলল। “তোমার খেলা শেষ।”
কালীচরণ হাসল। “আমার খেলা শেষ হয়নি, গোয়েন্দা। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে।”
হঠাৎই কালীচরণ একটি ছোট বোতল বের করল, তার ভেতরে এক ধরনের তরল। সে বোতলটি নিজের মুখে ঢেলে দিল।
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং চমকে উঠলেন। কালীচরণ বিষ পান করেছে।
কালীচরণ হাসল, তারপর তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। সে পাথরের উপর পড়ে গেল।
কালীচরণের মৃত্যুতে হিমাচলের হিমশীতল অভিশাপের রহস্যের সমাধান হলো। শঙ্কর বেঁচে ছিল, এবং কালীচরণ তাকে ব্যবহার করে প্রকৃতির প্রতিশোধ নিচ্ছিল। কালীচরণ ছিল একজন উন্মাদ তান্ত্রিক, যে প্রকৃতির প্রতি তার অন্ধ ভক্তি এবং প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিক্রম সিং গুহার ভেতরে প্রবেশ করলেন। শঙ্কর গুহার ভেতরেই ছিল, কিন্তু সে মৃত ছিল। সে বিষাক্ত ভেষজের প্রভাবে মারা গেছে।
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং কুল্লু থানায় ফিরে এলেন। তারা কেসের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করলেন। হিমাচলের মানুষজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সিরিয়াল কিলিংয়ের আতঙ্ক দূর হলো।
অরুণিমা কেসটা সমাধান করতে পেরেছিল, কিন্তু তার মনে এই ঘটনা গভীর ছাপ ফেলে গেল। প্রকৃতির প্রতিশোধ, মানুষের মনের অন্ধকার দিক, এবং প্রাচীন বিশ্বাসের ক্ষমতা – এই সবকিছু তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাল।
অরুণিমা যখন কলকাতা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন বিক্রম সিং তার সাথে দেখা করতে এলেন।
“ম্যাম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,” বিক্রম সিং বললেন। “আপনি না থাকলে এই কেসটা সমাধান করা সম্ভব হতো না।”
অরুণিমা হাসল। “ইনস্পেক্টর, আপনার সাহায্য ছাড়া আমিও কিছু করতে পারতাম না।”
অরুণিমা হিমাচল থেকে বিদায় নিল। তার মনে এক মিশ্র অনুভূতি। এই কেসটা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সে তার নিজের ভেতরের অন্ধকার থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। হিমাচলের হিমেল বাতাস তার মনে এক নতুন আশার জন্ম দিয়েছে।
অরুণিমা জানত, তার জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে। কিন্তু হিমাচলের হিমশীতল অভিশাপের স্মৃতি তার মনে চিরকাল রয়ে যাবে। সে জানত, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে পারে, এবং মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলল, একজন গোয়েন্দা হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে।
গল্পের শেষ দৃশ্যে, অরুণিমা যখন প্লেনে বসে কলকাতার দিকে ফিরছিল, তখন সে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, হিমালয়ের চূড়াগুলো তখনও বরফে মোড়া। সূর্যের আলো তার উপর পড়ছিল, যেন প্রকৃতি তাকে নতুন করে স্বাগত জানাচ্ছে। তার মনে হলো, এই রহস্যময় হিমাচল হয়তো তাকে আবার ডাকবে, নতুন কোনো রহস্য সমাধানের জন্য।
~ সমাপ্ত ~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion