Episode 1801 words4 views

প্রথম পর্ব: ফুলডুবির অভিশাপের গভীরে

কলকাতা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে, ইছামতী নদীর তীরে ঘুমিয়ে আছে ফুলডুবি নামের এক ছোট জনপদ। এই জনপদের নিস্তব্ধতা যেন নিজেই এক চাপা রহস্য। চারপাশের আমবাগান আর পুরোনো পুকুরগুলোর জল স্থির, যেন বহু শতাব্দী ধরে কোনো পরিবর্তনকে তারা ধারণ করেনি। আর সেই জনপদের এক প্রান্তে, শ্যাওলা পড়া পাথরের স্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে ফুলডুবি রেল স্টেশন। দিনে দু’টো লোকাল ট্রেন এখানে এসে করুণ শিস্ দিয়ে চলে যায়, তারপর প্ল্যাটফর্মের ধূসর কংক্রিট জুড়ে শুধু মাকড়সার জাল আর দুপুরের রোদ। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে এই স্টেশনের আসল পরিচিতি দিনের আলোয় নয়, গভীর রাতে। অয়ন আর প্রসেনজিৎ, দুই বন্ধু, ফুলডুবির ছেলে। তারা একই স্কুল, একই কলেজ পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের মনোজগৎ সম্পূর্ণ বিপরীত। অয়ন যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান তার কাছে জীবনের একমাত্র সত্যের পথ। সে বিশ্বাস করে, যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তা হয় কল্পনা, নয়তো ভ্রান্তি। তার জীবন গণিতশাস্ত্রের মতো সুশৃঙ্খল। আর প্রসেনজিৎ? সে হলো রহস্যের পূজারি। সাধারণ জীবন তাকে টানে না, যা কিছু যুক্তিকে অস্বীকার করে, যা কিছু অন্ধকারের আড়ালে লুকানো, প্রসেনজিৎ সেখানেই বাঁচার রসদ খুঁজে পায়। তার চোখে সবসময়েই এক অনুসন্ধানী জিজ্ঞাসা। তাদের আলোচনা, স্বপ্ন এবং ভয়—সবকিছুর কেন্দ্রে থাকত একটিই বিষয়—শেষ রাতের ট্রেন। প্রসেনজিৎ বলত, "জানিস অয়ন, লোকে বলে এই ট্রেনটা অন্য কোনো সময় থেকে আসে। এর কোনো চালক নেই, ইঞ্জিন নেই। ওটা আসলে আমাদের না-মেটা ইচ্ছেগুলোর ভার বহন করে। ওটা এক ধরণের 'বাসনা-জাহাজ'—যা শুধু অপূর্ণ আত্মাদের ঠিকানা খুঁজে দেয়।" অয়ন হাসত, কপালের ভাঁজ গভীর করে, "পুরোনো রেললাইনের উপর দিয়ে পুরোনো বগি গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। বাতাসে জলীয় বাষ্পের কারণে সৃষ্ট অপটিক্যাল বিভ্রম। তুই অতিরিক্ত ভাবিস। ওটা নিশ্চিত কোনো হলদিয়া বা দুর্গাপুরগামী মালগাড়ির ভুল রুট। হরিশঙ্কর কাকা নিশ্চয়ই জানেন।" "ভুল রুট? রাত ১টা ১৭-তে ট্রেনটা আসে। একটা মিনিটও এদিক-ওদিক হয় না। যেন কোনো অদৃশ্য ঘড়ি ধরে চলছে। আর তুই কখনো যাত্রী দেখেছিস? দেখিসনি। শুধু ছায়ামূর্তি, যারা নিঃশব্দে উঠে যায়, আর ফিরে আসে না। তারা কারা, অয়ন? কেন তারা ফেরে না? এই না ফেরাটাই তো আসল রহস্য!" প্রসেনজিৎ-এর চোখে নেশা। ফুলডুবি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে একটা ভাঙা বেঞ্চ ছিল। ওটাই ছিল তাদের গবেষণার জায়গা। বেঞ্চের কাঠগুলো ক্ষয় হয়ে গেছে, যেন বহু শতাব্দী ধরে এই রহস্যের ভার বইছে। প্রতি রাতে ঘড়িতে ১টা ১৫ বাজলে তারা সেখানে গিয়ে বসত। নির্দিষ্ট দিন, ১টা ১৬ মিনিটে দূর থেকে একটি অদ্ভুত, করুণ শব্দ ভেসে আসে—যেন কেউ বহু দূর থেকে কান্নাকে টেনে আনছে। বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে এক ঝাপসা, পুরোনো ধোঁয়ার গন্ধে—যেন বাষ্প নয়, জমাট দীর্ঘশ্বাস। কোনো ইঞ্জিনের শব্দ নেই, শুধু ধাতব চাকার একটা চাপা, নিয়মিত ঘর্ষণ, যার ছন্দ মানুষের হৃদস্পন্দনের মতো ধীর এবং ভয়ংকর। ট্রেনটা নিজেই যেন এক জীবিত দীর্ঘশ্বাস। ১টা ১৭ মিনিটে ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। ট্রেনটি খুবই পুরোনো, ব্রিটিশ আমলের মতো ভারী লোহা আর কাঠের তৈরি। বগিগুলোতে সবুজ শ্যাওলা জমেছে, কাঁচগুলো ঘোলাটে, যেন ভেতরের জগৎটিকে বাইরে থেকে আড়াল করতে চায়। বগির ভেতরে কোনো আলো নেই, শুধু মৃদু নীলচে একটা আভা, যা কোনো বৈদ্যুতিক উৎস থেকে নয়, বরং পুরোনো বিষাদ থেকে উদ্গত বলে মনে হয়। বগির গায়ে কোনো নাম লেখা নেই, শুধু আবছা ভাবে আঁকা একটি প্রতীক—একটি উল্টোমুখী ঘড়ি। যেন সময় এখানে পিছনের দিকে চলে। দুটো দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। ভেতরে কোনো কন্ডাক্টর নেই, কোনো টিকিট চেকার নেই। শুধু অন্ধকার আর নীলচে আভার নীরব আমন্ত্রণ, যা জীবিতদের আকর্ষণ করে। অয়ন দেখল, ছায়া ছায়া কিছু মানুষ, নাকি মানুষের প্রতিরূপ—তারা স্টেশনের বেঞ্চগুলো থেকে, প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার কোণ থেকে উঠে এসে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাঁটার মধ্যে কোনো তাড়া নেই, কোনো আবেগ নেই। তারা যেন বাধ্যগত পুতুল, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির নির্দেশ পালন করছে। তাদের গতি যেন সময়ের সাথে বেমানান, অনেকটা Slow Motion-এর মতো। সেই রাতে, প্রসেনজিৎ অয়নের হাত ধরে বলল, "আর নয়, অয়ন। আজ আর চুপ করে বসে থাকব না। আমি নিশ্চিত, এই ট্রেন অন্য জগতের দরজা। আমি যাব। আমার জীবনটা ছোট শহর আর বাবার মুদির দোকানে আটকা পড়ে আছে। আমার বড় কিছু করার আকাঙ্ক্ষা... সেটা আমায় ডাকছে। আমি সেই ডাকে সাড়া দেব।" অয়ন আতঙ্কিত হয়ে উঠল, যুক্তির সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল, "না প্রসেনজিৎ! তুই কী বলছিস! এটা একটা ফাঁদ, একটা অলৌকিক বিভ্রম! প্লিজ ফিরে আয়! তোর স্বপ্ন... সেটা এখানেই পূরণ করা যায়! এখানে থেকেই সাহস দেখা।" "আমার জন্য চিন্তা করিস না, বন্ধু," প্রসেনজিৎ-এর মুখে এক অদ্ভুত, প্রায় অমানবিক হাসি। "রহস্যের লোক আমাকে ডাকছে। আমি একটা টিকিট পেয়েছি। এর বাইরে আমার আর কিছু চাই না।" অয়ন দেখল, প্রসেনজিৎ-এর হাতে সত্যি সত্যি একটা পুরোনো হলদেটে কাগজের টুকরো, যার ওপর কালি দিয়ে অস্পষ্টভাবে কিছু লেখা—ঠিক যেন কোনো পুরোনো রেলওয়ের ছাপ। টিকিটটি যেন প্রসেনজিৎ-এর হাতের তালুতে হঠাৎ ফুটে উঠেছে। প্রসেনজিৎ দ্রুত হেঁটে ট্রেনের দরজায় পৌঁছাল। এক মুহূর্তের জন্য সে ফিরে তাকাল অয়নের দিকে। সেই চোখে ছিল ভয়, উত্তেজনা এবং এক গভীর বিস্মৃতির আকাঙ্ক্ষা—যেন সে তার বর্তমান জীবনকে ভুলে নতুন কিছু শুরু করতে চেয়েছিল। তারপর সে ট্রেনের ভেতরে অদৃশ্য নীলচে আলোর জগতে প্রবেশ করল। দরজাটি নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। ১টা ১৮ মিনিটে ট্রেনটি চলতে শুরু করল। কোনো শিস্ নেই, কোনো ঝাঁকুনি নেই। শুধু চাপা ঘর্ষণের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল গভীর অন্ধকারের মধ্যে। অয়ন একা বসে রইল ভাঙা বেঞ্চে। সে জানে, প্রসেনজিৎ কোনো সাধারণ ট্রেনে ওঠেনি। সে এমন এক যাত্রাপথে চলে গেল, যেখান থেকে কেউ কখনও ফেরে না। তার যুক্তিবাদী জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল এক অভিশাপের সামনে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion