Episode 2608 words2 views

দ্বিতীয় পর্ব: অনুসন্ধান ও সঙ্কেত

প্রসেনজিৎ-এর নিখোঁজ হওয়ার পর দু'সপ্তাহ কেটে গেছে। অয়ন প্রথম দিকে পুলিশকে সেই রাতের ট্রেনের কথা বললেও, কেউ তাকে বিশ্বাস করেনি। তার যুক্তিবাদী মন এখন সেই অলৌকিক রহস্যের সামনে হার মেনে শুধু বন্ধুর জন্য কাতর। সে ঘুমোতে পারে না। প্রতি রাতে ১টা ১৭ মিনিটের শব্দ তার কানের পর্দায় আঘাত করে, যদিও বাস্তবে ট্রেন আসে না। সে গেল স্টেশন মাস্টার হরিশঙ্কর বাবুর কাছে। হরিশঙ্কর বাবু বৃদ্ধ, সাদা কাঁচাপাকা চুল, চোখ দুটি শুকনো পাতার মতো—বহু রহস্যের নীরব সাক্ষী। অয়ন বলল, "হরিশঙ্কর কাকু, আপনি বলুন। এই ট্রেন... এর উদ্দেশ্য কী? কেন এমন হয়?" হরিশঙ্কর বাবু চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। তাঁর চোখে ভয় আর অপরাধবোধের মিশ্রণ। তারপর ফিসফিস করে বললেন, "বাবা, কিছু জিনিস ঈশ্বরকে প্রশ্ন করতে নেই। এই ট্রেন... এটা ফুলডুবির অভিশাপ। 'দুর্ঘটনাহীন' অভিশাপ।" তিনি বললেন, "বহু বছর আগে, ১৯৫০-এর দশকে, এই লাইনেই একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বহু যাত্রী জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল, তাদের দেহ শনাক্ত করাও যায়নি। তারা তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ না করেই মরেছিল। কেউ পরিবারকে শেষ কথা বলতে পারেনি, কেউ ভালোবাসার কথা জানাতে পারেনি, কেউ তার স্বপ্নের পথে পৌঁছাতে পারেনি। তাদের আত্মা মুক্তি চায়নি, শুধু আর একটি সুযোগ চেয়েছিল—যা সময় দিতে অস্বীকার করেছিল।" "আর এই ট্রেন?" অয়ন উৎসুক, তার সমস্ত মনোযোগ হরিশঙ্কর বাবুর দিকে। "এই ট্রেন তাদেরই ছায়া নিয়ে আসে। যারা ফুলডুবির অভিশাপের শিকার হয়। যারা জীবনে বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা অথবা অনুতাপ জিইয়ে রেখেছিল। ট্রেনটা তাদের সেই অনুতাপের ভার বহন করে নিয়ে যায়। গন্তব্য? আমি জানি না। তবে যে যায়, সে মুক্তি পায় না, শুধু স্থবির হয়ে যায়। তার আত্মা তার অনুতাপের দৃশ্যে চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে যায়। এটা হলো আকাঙ্ক্ষার পুনর্জন্ম।" হরিশঙ্কর বাবু আরো জানালেন, "এই ট্রেনের টিকিট কেউ বিক্রি করে না। টিকিট তার হাতেই আসে, যার মন অনুতাপ বা অপূর্ণ বাসনার ভারে ভারাক্রান্ত। টিকিটটা হলো সেই বাসনা-বন্ধন ছিন্ন করার শেষ চেষ্টা। প্রসেনজিৎ-এর মন হয়তো সেই ডাক শুনেছিল।" অয়ন সেদিন রাতে প্রসেনজিৎ-এর ঘর তছনছ করে খুঁজতে লাগল। সে জানত, প্রসেনজিৎ কোনো না কোনো সঙ্কেত রেখে গেছে। একটি পুরোনো ট্রাঙ্কের নিচে সে খুঁজে পেল একটা ছোট্ট ক্যাসেট রেকর্ডার এবং তার একটি নোটবুক। নোটবুকে প্রসেনজিৎ-এর শেষ চিন্তাগুলো লেখা, হাতের লেখা দ্রুত এবং অস্থির: "১/১১/২০২৫, রাত ১১টা। ট্রেন আসছে। আমি জানি ভেতরে কী আছে। এটা সময়ের ধারক নয়, এটা অনুভূতির ধারক। যারা ভেতরে যায়, তারা তাদের জীবনের সেই মুহূর্তে ফিরে যায়, যখন তারা সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিল বা সবচেয়ে বড় সুযোগটা হাতছাড়া করেছিল। তারা সেই মুহূর্তটাকে বারবার বাঁচে, যতক্ষণ না তাদের বাসনা-বন্ধন ছিন্ন হয়। আমি যাচ্ছি... আমার ভেতরের সেই পুরোনো ভয়টাকে জয় করতে, যে আমাকে এতদিন আটকে রেখেছিল। আমার টিকিট প্রস্তুত। বিদায়, বন্ধু।" ক্যাসেট রেকর্ডারে প্রসেনজিৎ-এর গলা—আবেগপ্রবণ কিন্তু দৃঢ়, যেন সে কোনো প্রতিজ্ঞা করছে: "...অয়ন, তুই জানিস আমি কেন যাচ্ছি? আমি সবসময় ভয় পেতাম, হেরে যাওয়ার ভয়। নিজের ব্যবসা শুরু করার স্বপ্নটা দেখতাম, কিন্তু ভয় পেতাম যদি ফেইল করি। এই ভয় আমাকে তোর মতো যুক্তি দিয়ে জীবনকে ভালোবাসতে দেয়নি। এই ট্রেনে আমার সেই হার স্বীকার করা দরকার। যদি আমি না ফিরি, তুই ভয় পাস না। আর প্লিজ, তুই কখনো আসিস না। তোর জীবনটা যুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যা। তবে যদি আসতে চাস, মনে রাখিস—তোকে মুক্তি পেতে হলে ভেতরের জগৎটাকে গ্রহণ করতে হবে, লড়াই করতে নয়। কারণ ট্রেনের গভীরে আছে প্রহরী। সে তোমাকে তোমার অপূর্ণতা দিয়ে বিচার করবে।" অয়ন বুঝতে পারল, প্রসেনজিৎ আসলে নিজেকে খুঁজতে সেই ট্রেনে উঠেছিল। তার কাছে নিজের স্বপ্ন পূরণ না করার অনুতাপ ছিল জীবনের চেয়েও ভারী। সেই রাতেই, অয়ন আবার গেল ফুলডুবি স্টেশনে। ১টা ১৫-তে সে ভাঙা বেঞ্চে বসল। সে তার চোখ বন্ধ করল, বন্ধুর স্মৃতি, হাসি, তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক—সবকিছু মনে করল। হঠাৎ তার হাতের তালুতে কী যেন একটা কঠিন বস্তু অনুভব হলো। চোখ খুলে দেখল—তার হাতেও সেই পুরোনো, হলদেটে কাগজের টিকিট! সেই ট্রেনের আমন্ত্রণ, যা আর যুক্তি দিয়ে ঠেকানো যায় না। অয়ন আর দেরি করল না। সে এবার যুক্তি নয়, হৃদয়ের ডাক শুনল। বন্ধুকে ফেরাতে, বা অন্তত তার শেষ পরিণাম জানতে, এই যাত্রায় তাকে যেতেই হবে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion