This entry is part 1 of 10 in the series অভিশপ্ত পিয়ানো
কুয়াশার আবরণে কালিম্পং ও উইন্ডসর হাউস
কালিম্পং-এর শান্ত, কুয়াশাচ্ছন্ন উপত্যকায় পা রাখতেই অর্ক এক অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত শান্তি অনুভব করেছিল, যেন তার বহুদিনের ক্লান্ত আত্মা এক শীতল প্রশান্তির স্পর্শ পেয়েছিল। শহরের কোলাহল, দূষিত বাতাস আর যন্ত্রসভ্যতার নির্মম, অস্থির তাড়া থেকে বহু দূরে, প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ, সবুজ কোলে সে যেন নতুন করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, তার ফুসফুস ভরে গিয়েছিল বিশুদ্ধ পাইন-গন্ধী বাতাসে, যা তার অস্তিত্বের গভীরে এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করছিল। প্রতিটি ভোর ছিল এক নতুন সূচনার প্রতীক, যেখানে সোনালী সূর্যালোক উঁচু পাইন গাছের শীর্ষ ছুঁয়ে আসত, কুয়াশার পাতলা চাদর ভেদ করে মায়াবী আলো-ছায়ার খেলা তৈরি করত, যেন প্রকৃতি নিজেই এক লুকানো রহস্য উন্মোচন করছিল। প্রতিটি দিন যেন এক নতুন করে বাঁচার সুযোগ, যেখানে পুরনো কষ্টগুলো ধূসর হয়ে যেত স্মৃতির পাতা থেকে, তাদের তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলত, আর এক অনাবিল মুক্তি যেন তার সত্তাকে সতেজ করে তুলছিল, তার আত্মায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করছিল, তাকে ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, এক নতুন আশার দিকে। তার মনে হয়েছিল, সে অবশেষে তার বহু বছরের আকাঙ্ক্ষিত শান্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য প্রস্তুত, যেখানে সে তার অতীতকে পেছনে ফেলে আসতে পারবে।
শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটানোর উদ্দেশ্যেই অর্কের এই ভ্রমণ ছিল, একটি নিছকই সরল ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা, যা তার জীবনে এক নতুন মোড় নেবে তা সে কল্পনাও করেনি। অনলাইনে সে একটি পুরনো ব্রিটিশ ভিলা ভাড়া করেছিল, নাম ‘উইন্ডসর হাউস’। ছবিগুলির গ্যালারিতে ভিলাটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন দেখাচ্ছিল; তার গথিক ধাঁচের স্থাপত্য, প্রাচীন ইটের দেয়াল, কারুকার্যময় লোহার রেলিং এবং প্রশস্ত বারান্দা যেন এক পুরনো আভিজাত্যের গল্প বলছিল, এক সুপ্ত ইতিহাসের কথা ফিসফিস করছিল। প্রতিটি ইটে যেন ব্রিটিশ রাজত্বের গভীর ছাপ স্পষ্ট, প্রতিটি কাঠামোগত অংশে যেন শতবর্ষের ঐতিহ্য মিশে আছে, যা অতীতের এক নিস্তব্ধ সাক্ষী, এক নীরব প্রহরী। তার প্রাচীন গাম্ভীর্য ছিল চোখে পড়ার মতো, যেন প্রতিটি দেয়াল শতবর্ষের অজানা গল্প ধরে রেখেছে, তার ভেতরের নীরবতাও যেন কথা বলছিল, এক অস্পষ্ট ফিসফিসানিতে, যা ভয়ের এক নতুন মাত্রা যোগ করছিল, যেন প্রাচীন আত্মাগুলি শ্বাস নিচ্ছে তার পাশেই, তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তে।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ভিলাটিতে পা রাখার পরই অর্কের মনে কেমন যেন একটা অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। প্রথম পদক্ষেপেই মাটি থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত ঠান্ডা তার পায়ে লেগেছিল, যা ভেতরের গভীরে এক অজানা শিহরণ জাগিয়েছিল, যেন মাটি নিজেই তাকে কিছু বলতে চাইছিল, এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ভিলাটি শহরের এক নির্জন প্রান্তে অবস্থিত, মূল সড়ক থেকে অনেক দূরে, একটি উঁচু ঢালের ওপর একা, প্রায় বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে, যেন বহুকাল ধরে পরিত্যক্ত। চারদিক ঘন উঁচু পাইন গাছে ঘেরা, তাদের দীর্ঘ, সরু, সূঁচালো ডালপালা যেন আকাশ ঢেকে রেখেছিল, সূর্যালোককে প্রবেশ করতে দিত না, যেন সূর্যের আলোকেও ভিলাটি ঘৃণা করত, তার উপস্থিতি সহ্য করত না, আর তার ওপর সূর্যালোক পৌঁছতে পারত না। দিনের বেলাতেও সেখানে এক ধরনের আবছা অন্ধকার লেগেই থাকত, যেন ভিলাটি নিজেই আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, একটি জীবন্ত সত্তার মতো, যা কেবল অন্ধকারকেই ধারণ করে এবং বিস্তার করে, তার চারপাশের সবকিছুকেই গ্রাস করে নেয়, এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধায়, যা কখনো মেটে না, যা চিরন্তন এবং অনির্বাণ, যা সবকিছুকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়, নিঃশব্দে, তাদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। ভিলার সামনে একটি পুরনো লোহার গেট ছিল, তার উপর মরচে ধরেছিল, যা শতাব্দী প্রাচীন দুঃখের প্রতীক, যেন তার প্রতিটি শিকল এক অতীত যন্ত্রণার নীরব সাক্ষী। গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই কাঁচ-ভাঙা জানালাগুলো যেন শূন্য চোখে, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তারা কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর লুপ্ত, কেবল এক নীরব আর্তনাদ তাদের চোখে। বাতাস ছিল অস্বাভাবিকভাবে ভারী, যেন হাজারো দীর্ঘশ্বাস তার মধ্যে মিশে আছে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন এক পুরনো, চাপা, পচা গন্ধ মিশে ছিল, যা অর্কের মনকে জানান দিচ্ছিল যে, এই স্থানটি কেবল একটি পুরনো ভিলা নয়, এর ভেতরে আরও কিছু লুকিয়ে আছে, এক অশুভ, অদৃশ্য উপস্থিতি, যা শ্বাস নিচ্ছে তার পাশেই, তার অস্তিত্বকে ঘিরে রাখছিল। এই অস্বস্তিই ক্রমশ এক হিমশীতল ভয়ে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল, যা তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাচ্ছিল, তার প্রতিটি পেশী যেন কঠিন পাথরের মতো জমে যাচ্ছিল, তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ শিহরিত হচ্ছিল এক অদৃশ্য স্পর্শে, যেন মৃতদের শীতল শ্বাস তার ঘাড়ের ওপর পড়ছে, তার ভেতরের আত্মাকে ঠান্ডা করে দিচ্ছে, তাকে এক জীবন্ত ফ্রিজে পরিণত করেছে, যেখানে তার হৃদপিণ্ডও জমে যেতে বসেছে, তার রক্তপ্রবাহ যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি শিরায় শিরায় যেন বরফ জমাট বাঁধছে, তার জীবনশক্তি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, সে যেন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মৃত্যু অনুভব করছিল, তার অস্তিত্বই যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, একটি ভঙ্গুর কাঁচের মতো, যা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে, আর সে ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় ছিল, তার শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায়।
চলবে……..
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion