Episode 102306 words1 views

অভিশপ্ত পিয়ানো : দশম অধ্যায়

চূড়ান্ত আত্মার সংগ্রাম এবং অভিশাপের রেশ হঠাৎ করেই পিয়ানো বেজে উঠল। এইবার সুরটা আরও জোরালো, আরও করুণ, কিন্তু তার মধ্যে মিশে ছিল তীব্র যন্ত্রণা, আর আর্তনাদ। এই সুরের মধ্যে যেন এক হতাশা, এক মুক্তি পাওয়ার আকুতি ছিল, কিন্তু তার সাথে মিশে ছিল অশুভ শক্তির বিকৃত হাসি, যেন সেই শক্তিই এলিজাবেথের সুরকে বিকৃত করে দিয়েছে, তাকে এক ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে, এক নরকীয় শব্দ, যা তার আত্মাকে গ্রাস করছিল, তাকে চিরতরে বন্দি করতে চাইছিল। অর্কের গা ছমছম করে উঠল। সুকান্তের চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে গেছে, তার যুক্তিবাদী বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছিল, সে একটি নতুন, ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা চোখ বন্ধ করতে চাইল, কিন্তু পারল না। হলঘরের প্রতিটি জিনিস যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, তাদের থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, “যাও… ফিরে যাও… তোমরা মরবে… এখানে… মরবে… আমাদের সাথে থাকবে… চিরকাল!” তাদের কণ্ঠস্বর যেন তাদের মাথার ভেতরেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তাদের মনকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছিল, তাদের চিরতরে বন্দি করতে চাইছিল, তাদের তার দাসে পরিণত করতে চাইছিল। সিলিং থেকে পুরনো প্লাস্টারের টুকরো ভেঙে পড়তে লাগল, আর তাদের পায়ের নিচে মেঝে কেঁপে উঠল, যেন পুরো ভিলাটাই তাদের ওপর ভেঙে পড়তে চাইছে, তাদের এই স্থান থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে, তাদের ধ্বংস করতে চাইছে, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে চাইছে। গুরুজি তার মন্ত্রের গতি বাড়ালেন, তার কণ্ঠস্বর এক নতুন তীব্রতা লাভ করল। তার মুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে, তার কণ্ঠস্বর যেন বজ্রপাতের মতো, যা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করছিল, তাকে ছিন্নভিন্ন করছিল। তিনি পিতলের পাত্র থেকে পবিত্র জল নিয়ে পিয়ানোর দিকে ছিটিয়ে দিলেন, আর এলিজাবেথের ছায়া মূর্তির দিকেও। জলের ফোঁটাগুলি যখন ছায়া মূর্তির ওপর পড়ল, তখন সে তীব্র যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল, যেন অদৃশ্য আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, তার শরীর থেকে এক ঝলক কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এলো, যা হলঘরের বাতাসকে আরও ভারী করে তুলল, এক অশুভ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, এক পৈশাচিক উপস্থিতি, যা তাদের শ্বাসরোধ করতে চাইছিল। পিয়ানোর সুর আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন এলিজাবেথ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, কিন্তু তার সেই চিৎকার ছিল এক ভয়াবহ আর্তনাদ, যা তার হৃদপিণ্ডকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল, আর অর্কের মনে হলো তার নিজের হৃদপিণ্ডও ফেটে যাবে, সুকান্তের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, তাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত আসন্ন, তারা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, তাদের আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গুরুজি তার মন্ত্রের মধ্য দিয়ে সেই অশুভ শক্তিকে আঘাত হানছিলেন, তাকে এলিজাবেথের শরীর থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করছিলেন, তার আত্মাকে মুক্তি দিতে চাইছিলেন, তাকে শান্তি দিতে চাইছিলেন, তাকে অনন্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চাইছিলেন, তাকে তার চিরন্তন ঘুম ফিরিয়ে দিতে চাইছিলেন। “বেরিয়ে যাও! এই স্থান তোমার নয়! তুমি এই পবিত্র আত্মাকে আটকে রাখতে পারবে না! তোমার কোনো অধিকার নেই এখানে! এই আত্মা মুক্ত!” গুরুজি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, তার চোখ তখনও বন্ধ, কিন্তু তার মুখ রক্তবর্ণ, তার কপালে ঘাম জমেছে, তার শরীর কাঁপছে, প্রতিটি পেশী যেন কঠিন, তার শিরায় শিরায় রক্ত যেন দ্রুতগতিতে বইছে। তার কণ্ঠস্বরে এমন শক্তি ছিল যা অর্ক বা সুকান্ত আগে কখনো শোনেনি, যেন দেবতা নিজেই তার কণ্ঠে কথা বলছেন, তার শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো হলঘরে আছড়ে পড়ল, তার প্রতিটি শব্দ যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করছিল, যা অশুভ শক্তিকে আটকে রাখছিল, তাকে বিতাড়িত করছিল। ভিলার প্রতিটি কোণা থেকে যেন এক অন্ধকার শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের দিকে, অদৃশ্য হাতগুলো তাদের শ্বাসরোধ করতে চাইল, তাদের শরীরকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছিল, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে চাইছিল, তাদের চিরতরে অন্ধকার করে দিতে চাইছিল। আসবাবপত্রগুলো বাতাসে উড়তে শুরু করল, আর বইগুলো তাক থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ল, তাদের পাতাগুলো ছিঁড়ে গেল, যেন তারা কোনো দানবের আক্রমণে বিধ্বস্ত। অর্ক আর সুকান্ত দুজনেই তার চোখ বন্ধ করে ফেলল, ভয়ে তাদের শরীর কাঁপছিল। তাদের মনে হলো, এলিজাবেথের বিকৃত মুখ তাদের ঠিক সামনে, তার কালো চোখ দুটি তাদের গ্রাস করতে চাইছে, তাদের আত্মাকে টেনে নিতে চাইছে বাতা-ফোলার গভীরে, যেখানে অনন্ত অন্ধকার, যেখানে কোনো মুক্তি নেই, কেবল অনন্ত নরক, এক চিরন্তন বন্দিত্ব। তাদের শরীর শীতল ঘামে ভিজে গেল, কিন্তু তাদের ভেতরের ভয় যেন সব ঠান্ডাকে ছাপিয়ে গেল, তাদের এক অকল্পনীয় যন্ত্রণায় ডুবিয়ে দিল, তাদের চেতনা লুপ্ত হতে চাইছিল, তারা যেন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি, তাদের আত্মা যেন শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ করেই, এলিজাবেথের ছায়া মূর্তির মুখ থেকে একটি তীব্র, শেষ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, যা হলঘরের বাতাসে মিশে গেল, যেন অনন্তকালের জন্য একটি দীর্ঘশ্বাস। তার দেহ থেকে কালো, ধোঁয়াটে একটি শক্তিপিণ্ড দ্রুতবেগে বেরিয়ে এসে পিয়ানোটিকে ঘিরে ফেলল, পিয়ানোর কি-গুলি যেন যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল, প্রতিটি কাঠামোগত অংশ থেকে এক বীভৎস শব্দ বেরিয়ে এলো, যেন পিয়ানো নিজেই শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেই শক্তিপিণ্ডটি পিয়ানোর কাঠের গভীরে বিলীন হয়ে গেল, যেন তাকে গ্রাস করে নিল। এলিজাবেথের ছায়া মূর্তিটি ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে শুরু করল। তার রূপ ম্লান হয়ে আসছে, যেন আলোর দিকে চলে যাচ্ছে, এক নতুন পৃথিবীর দিকে, যেখানে শান্তি আর মুক্তি রয়েছে, এক উজ্জ্বল আলো তার দিকে টানছিল, তাকে এক নতুন জীবনের আশা দেখাচ্ছিল। পিয়ানোর সুরও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে, যেন এলিজাবেথের শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর সেই অশুভ শক্তিও পিছু হটছে, তার কবল থেকে এলিজাবেথ মুক্ত হচ্ছে, সে যেন আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার শতবর্ষের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে। অর্ক অনুভব করল, তার চারপাশের ঠান্ডা কমতে শুরু করেছে, বাতাস আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, আর হলঘরে এক অন্যরকম শান্তি নেমে এলো, এক গভীর নিস্তব্ধতা, যা আগে কখনো অনুভব করেনি, এক নতুন আশার আলো। ধূপের সুগন্ধ আরও তীব্র হলো, যেন বাতাস থেকে সব নেতিবাচক শক্তি দূর হয়ে যাচ্ছে, আর হলঘরে এক পবিত্র আভা ছড়িয়ে পড়ল, এক নতুন সকালের ইঙ্গিত, এক নতুন জীবনের সূচনা, যা অন্ধকারকে মুছে দিচ্ছে, আশার আলো দেখাচ্ছে, এক পবিত্র পরিবেশ তৈরি করছিল। একসময় পিয়ানোর সুর সম্পূর্ণ থেমে গেল। এলিজাবেথের ছায়া মূর্তিটিও সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন সে আলোর দিকে চলে গেছে, অনন্ত শান্তির খোঁজে, তার শতবর্ষের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। হলঘরটা আবার শান্ত হয়ে গেল, যেন কিছুই হয়নি, কিন্তু তার দেয়ালে এখনও সেই ভয়াবহতার ছাপ স্পষ্ট, ভাঙা কাঁচ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্র সেই সংগ্রামের সাক্ষী, যা চিরকাল মনে রাখবে সেই রাতের ভয়াবহতা, সেই ভয়াবহ যুদ্ধ, সেই কঠিন সংগ্রাম, সেই রক্তাক্ত স্মৃতি। গুরুজি তার মন্ত্র পাঠ শেষ করলেন এবং ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তার মুখে এক ক্লান্তির ছাপ, তার শরীর থেকে যেন সব শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু চোখে এক তৃপ্তির আভা, এক গভীর সন্তুষ্টি। তার পোশাকের কিছু অংশ ছেঁড়া, আর তার হাত থেকে সামান্য রক্তপাত হচ্ছিল, যা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে তাদের এই সংগ্রাম কতটা ভয়াবহ ছিল। “সে মুক্ত,” গুরুজি মৃদু কণ্ঠে বললেন, তার কন্ঠে গভীর প্রশান্তি। “এলিজাবেথ এখন শান্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ সহজে পিছু হটবে না। সে শুধু দুর্বল হয়েছে, কিন্তু তার ক্ষিদে রয়ে গেছে।” তার কণ্ঠস্বরে এক চাপা উদ্বেগ ছিল, যা অর্ক এবং সুকান্তের মনে এক নতুন ভয়ের জন্ম দিল, এক নতুন আশঙ্কার, এক অনাগত বিপদের ইঙ্গিত, যা তখনও তাদের চারপাশে lurking করছিল। অর্ক অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল। ঘরটা আর ঠান্ডা নেই। ভয়ের পরিবেশটা যেন কেটে গেছে, কিন্তু বাতাসে এক সূক্ষ্ম উত্তেজনা রয়ে গেছে। সুকান্তও তার নোটবুকটি আবার খুলল, দ্রুত কিছু লিখছিল, তার মুখে এক মিশ্র অনুভূতি, বিস্ময় আর ভয়ের এক মিশ্রণ। অর্ক উঠে গিয়ে পিয়ানোর কাছে গেল। পিয়ানোটা আগের মতোই নীরব দাঁড়িয়ে আছে, যেন বহু বছর ধরে কেউ তাকে স্পর্শ করেনি, কিন্তু তার কি-বোর্ডে এখনও যেন এলিজাবেথের হাতের ছাপ রয়ে গেছে। “তবে,” গুরুজি বললেন, “এখানে শুধু এলিজাবেথের আত্মা ছিল না। আরও কিছু আত্মা ছিল, যারা এই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’র দ্বারা আটকে ছিল। তাদেরও মুক্তি হয়েছে। কিন্তু পোর্টালটি খোলা।” তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “এই ভিলাটি একটি ‘পোর্টাল’ বা প্রবেশদ্বার ছিল, যা বাতা-ফোলা’র সঙ্গে যুক্ত। লেপচা উপজাতিরা এই পোর্টালের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানত। তারা জানত কিভাবে সেই শক্তিকে শান্ত রাখতে হয়, কিভাবে মৃতদের সাথে জীবিতদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, কিভাবে এই দুই জগতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, যাতে কোনো অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু যখন ব্রিটিশরা আসে, তারা সেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ফলে সেই শক্তি uncontrolled হয়ে যায় এবং যারা এই ভিলাতে মারা যায়, তাদের আত্মাকে গ্রাস করত, তাদের চিরকালের জন্য বন্দি করে রাখত, তাদের উপর নিজের অন্ধকার প্রভাব বিস্তার করত, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত, তাদের আত্মা পরিণত হত সেই শক্তির দাসে, এক জীবন্ত মৃতদেহে।” “এখন কি সব শেষ?” অর্ক জানতে চাইল, তার কণ্ঠে এখনও এক অনিশ্চয়তা, এক অজানা ভয়। সুকান্তও গুরুজির দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখে একই প্রশ্ন। গুরুজি মাথা নাড়লেন, “না, পোর্টালটি এখনো খোলা আছে। আমরা শুধু বন্দি আত্মাদের মুক্তি দিয়েছি। পোর্টালটি বন্ধ করার জন্য আরও শক্তিশালী আচার-অনুষ্ঠান প্রয়োজন, যা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। এর জন্য লেপচা উপজাতির প্রাচীন জ্ঞান এবং সময়ের প্রয়োজন, এমন কাউকে প্রয়োজন যে এই জ্ঞানকে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারে, যে বাতা-ফোলা’র রহস্যকে বুঝতে পারে, যে সেই শক্তিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এখনকার জন্য এলিজাবেথ শান্তি পেয়েছে। সেই শক্তিও সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, তার ক্রোধ সাময়িক ভাবে প্রশমিত হয়েছে।” গুরুজি আরও বললেন, “এই স্থানটিকে আবার পবিত্র করতে হবে। লেপচা উপজাতির আচার-অনুষ্ঠান আবার পালন করতে হবে, তবেই এই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ শান্ত হবে, আর এই পোর্টাল চিরতরে বন্ধ হবে, যাতে কোনোদিনও আর কোনো আত্মা এখানে বন্দি না হয়, আর কোনো মানুষ এই অভিশাপের শিকার না হয়, আর এই স্থানটি চিরতরে পবিত্র হয়।” তিনি অর্ক ও সুকান্তকে পরামর্শ দিলেন যে, এই ভিলাটিকে আর কখনো ভাড়া না দেওয়া হয়, বরং এটিকে লেপচা উপজাতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক, যাতে তারা তাদের পুরনো আচার-অনুষ্ঠান আবার শুরু করতে পারে এবং এই স্থানটিকে আবার পবিত্র করতে পারে, চিরতরে এর অন্ধকার প্রভাব দূর করতে পারে, এবং এই স্থানটিকে আবার শান্তির প্রতীক করে তুলতে পারে, যেখানে কোনো অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারবে না। পরদিন সকালে, অর্ক আর সুকান্ত গুরুজিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে চলল শিলিগুড়ির দিকে। তাদের মনে আর সেই তীব্র ভয় নেই, শুধু এক গভীর প্রশান্তি। উইন্ডসর হাউসের অভিশাপ হয়তো পুরোপুরি শেষ হয়নি, কারণ সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ তখনও দুর্বল হয়ে সেখানে lurking করছিল, তার নিঃশ্বাস যেন কালিম্পং-এর বাতাসে মিশে আছে, তার উপস্থিতি এখনও অনুভব করা যায়, এক সূক্ষ্ম ভয়ের রেশ, যা চিরকাল তাদের সাথে থাকবে, তাদের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু তারা অন্তত এলিজাবেথকে শান্তি দিতে পেরেছিল, যা তাদের এক গভীর মানসিক শান্তি এনে দিয়েছিল, তাদের জীবনকে নতুন অর্থ দিয়েছিল, এক নতুন উদ্দেশ্য, তাদের এক নতুন মানুষে পরিণত করেছিল, এক সাহসী মানুষে। আর এই অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছিল যে, প্রকৃতির কিছু রহস্য মানবজাতির জ্ঞানের বাইরে, আর কিছু শক্তিকে সম্মান না করলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে, যা তাদের জীবনকে নরকে পরিণত করতে পারে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে পারে, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে পারে, তাদের চিরন্তন দাসে পরিণত করতে পারে। উইন্ডসর হাউস এখন তাদের কাছে শুধু একটি ভিলা ছিল না, ছিল এক প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী, এক রহস্যের প্রতীক, এক নীরব স্মৃতিসৌধ যেখানে বহু আত্মা শান্তি খুঁজেছিল, এবং অনেক আত্মা এখনও মুক্তির অপেক্ষায় আছে, এক অনন্ত বন্দিত্বে, এক চিরন্তন যন্ত্রণায়। শিলিগুড়ি ফিরে আসার পর অর্ক এবং সুকান্তের জীবন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। রাতের ঘুম ফিরে আসে, আর অফিসের কাজেও তারা মনোযোগ দিতে পারে। তাদের চেহারাতেও কিছুটা সতেজতা ফিরে আসে। কিন্তু উইন্ডসর হাউসের অভিজ্ঞতা তাদের মনে এক গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছিল, যা কোনোদিনও মুছে যাওয়ার নয়। তারা আর আগের মতো সাধারণ জীবনযাপন করতে পারছিল না। তাদের চোখে মাঝে মাঝেই সেই অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি ভেসে উঠত, কানে বাজত এলিজাবেথের পিয়ানোর সুর, কিন্তু এখন সেই সুর করুণ নয়, বরং শান্ত, এক মুক্তির গান, যা তাদের এক অন্যরকম শান্তি দিত, এক গভীর প্রশান্তি। তারা বুঝতে পারছিল, এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা এক নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছে, এক এমন জগৎ যা সাধারণ মানুষের কাছে অদৃশ্য, যা কেবল কিছু বিশেষ মানুষই অনুভব করতে পারে, যারা এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করার সাহস রাখে, যারা আলোর পথে চলে, যারা সত্যকে জানতে চায়। কয়েক মাস পর, অর্ক জানতে পারল উইন্ডসর হাউসকে আর ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না। সুকান্তর মাধ্যমে সে নিয়মিত খোঁজ রাখত। লেপচা উপজাতির একটি দল ভিলাটির দখল নিয়েছে এবং সেখানে তাদের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান শুরু করেছে। তারা সেখানে পবিত্র মন্ত্র পাঠ করছে, এবং ভিলাটিকে আবার পবিত্র করার চেষ্টা করছে, তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, তাকে আবার শান্তির স্থান করে তোলার চেষ্টা করছে, যেখানে কোনো অশুভ প্রভাব থাকবে না। অর্ক মনে মনে খুশি হলো। সে জানত, এটাই ছিল একমাত্র উপায় এই স্থানটিকে পুরোপুরি পবিত্র করার, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মানুষ এই অভিশাপের শিকার না হয়, আর কোনো আত্মা এই অন্ধকারে বন্দি না হয়, আর এই স্থানটি চিরতরে পবিত্র হয়, তার অশুভ প্রভাব চিরতরে বিলীন হয়, এবং এই স্থানটি আবার প্রকৃতির অংশে পরিণত হয়। সুকান্ত, তার সাংবাদিকতার দায়িত্বের খাতিরে, উইন্ডসর হাউসের ঘটনা নিয়ে একটি গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে শুরু করলেন। সরাসরি ভৌতিক ঘটনার উল্লেখ না করে, তিনি কালিম্পং-এর প্রাচীন লেপচা লোককথা, ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভাব এবং স্থানীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখলেন। তার প্রতিবেদনগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলল। অনেকেই বিস্মিত হলো যে, কালিম্পং-এর মতো একটি পর্যটন কেন্দ্রে এমন গভীর ইতিহাস এবং রহস্য লুকিয়ে আছে। সুকান্তের এই কাজ পরোক্ষভাবে উইন্ডসর হাউসের পুনর্গঠন এবং লেপচা উপজাতির সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করল। অর্ক তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, এবং তারা দুজনেই জানত যে, কিছু রহস্য হয়তো কখনোই পুরোপুরি উন্মোচিত হওয়া উচিত নয়, কিছু সত্যকে হয়তো নীরবতার আড়ালেই থাকতে দেওয়া উচিত। কিন্তু তবুও, উইন্ডসর হাউসের গল্প কালিম্পং-এর বাতাসে ভেসে বেড়াবে, এক অজানা রহস্যের রেশ রেখে, এক অশুভ শক্তির উপস্থিতি জানান দিয়ে। এই গল্প অর্ক এবং সুকান্তের স্মৃতিতে চিরকাল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো থেকে যাবে, যা তাদের মনে করিয়ে দেবে পৃথিবীর গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য জগতের অস্তিত্বের কথা, যা মানবজাতির ধারণার বাইরে, এক এমন জগৎ যা অনন্ত রহস্যে ঘেরা। মাঝে মাঝে, যখন তারা কোনো পুরনো পিয়ানোর সুর শুনত, তখন তাদের কানে আবার ভেসে আসত উইন্ডসর হাউসের সেই করুণ সুর, আর তাদের মনে হতো, হয়তো বাতা-ফোলা’র প্রবেশপথ এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, হয়তো সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ এখনও সেখানেই অপেক্ষা করছে, তার পরবর্তী শিকারের জন্য, তার ক্ষমতার অপেক্ষায়, তার ক্রোধকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। আর এই চিন্তা তাদের শিহরিত করে তুলত, মনে করিয়ে দিত যে, এই পৃথিবী যত বড়, তার চেয়েও বড় অজানা রহস্যের জগৎ, যেখানে অন্ধকার শক্তিগুলি মানুষের অজান্তেই রাজত্ব করে, তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তাদের ভাগ্যের উপর প্রভাব ফেলে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করে। অর্ক এবং সুকান্ত এখন জানত, কিছু স্থান আছে যেখানে মানবজাতিকে পা রাখা উচিত নয়, কারণ সেখানে এমন কিছু শক্তি লুকিয়ে আছে যা তাদের কল্পনাতেও আসে না, যা তাদের ধ্বংস করতে পারে, তাদের আত্মাকে চিরতরে গ্রাস করতে পারে, তাদের চিরন্তন দাসে পরিণত করতে পারে। সেই রাতের পর থেকে অর্ক আর সুকান্ত কখনো কালিম্পং-এর দিকে ফিরে তাকায়নি, কেবল দূর থেকে সেই পবিত্র স্থানের শান্তি কামনা করত। উইন্ডসর হাউস তাদের কাছে ছিল এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি, যা তাদের শিখিয়েছিল অস্তিত্বের গভীরতম সত্য, এবং তাদের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল জীবন সম্পর্কে, তাদের এক নতুন মানুষে পরিণত করেছিল। তাদের জীবনে সেই রাতের অভিজ্ঞতা এক চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল, যা তাদের সবসময় মনে করিয়ে দিত যে, পৃথিবীর গভীরে আরও কত রহস্য লুকিয়ে আছে, এবং কিছু রহস্যকে উন্মোচন করা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। তারা এখন প্রকৃতির প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল, এবং অজানা শক্তির প্রতি আরও সতর্ক, তাদের জীবন এখন এক নতুন পথে চলছে, কিন্তু সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাদের চিরকাল তাড়া করে বেড়াবে। ~ সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion