Episode 91131 words0 views

অভিশপ্ত পিয়ানো : নবম অধ্যায়

অভিশপ্ত ভিলায় প্রত্যাবর্তন পরের দিন সন্ধ্যা। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। ঠান্ডা বাতাস বইছে আর ঘন কুয়াশা চারদিক ঢেকে ফেলছে, যেন পুরো কালিম্পং শহরকে এক রহস্যময় চাদরে ঢেকে দিয়েছে, তার ভয়ঙ্কর রূপ লুকিয়ে রাখছে, আর তার প্রতিটি কোণে মৃত্যু যেন লুকিয়ে আছে, তার নিঃশ্বাস যেন বাতাসে মিশে আছে, তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়, এক শীতল, অশুভ উপস্থিতি, যা মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। কালিম্পং-এর প্রকৃতি যেন নিজেই এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে, এক আসন্ন বিপদের বার্তা বহন করে আনছে, প্রতিটি গাছের পাতা যেন ভয়ে কাঁপছে, প্রতিটি নীরবতা যেন চিৎকার করে কিছু বলছে, এক নীরব আর্তনাদ, এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি, যা তাদের স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের ধ্বংসের জন্য। অর্ক, সুকান্ত এবং গুরুজি উইন্ডসর হাউসের দিকে হেঁটে চলল, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে দৃঢ়তা, কিন্তু ভেতরে এক চাপা উদ্বেগ। সুকলাল দারোয়ানকে কিছু বলা হয়নি, কারণ গুরুজি বলেছিলেন যে এসব বিষয় সবার বোঝার বাইরে, এবং এই কাজ অত্যন্ত গোপনীয় রাখা প্রয়োজন, কারণ সেই শক্তি বাইরের কাউকে তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না, তার উপস্থিতি কেউ টের পেলে বিপদ হতে পারে, এমনকি তাদের মৃত্যুও, তাদের আত্মাও বন্দি হতে পারে, এক অনন্ত নরকে, যেখানে কোনো মুক্তি নেই। ভিলার পুরনো লোহার গেটটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল, যেন স্বাগত জানাচ্ছে না, বরং ভীতি দেখাচ্ছে, এক অশুভ হাসি হাসছে, তার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ যেন তাদের কানের পর্দা ছিঁড়ে দিচ্ছিল, তাদের মস্তিষ্কে আঘাত হানছিল। গেটের লোহার শিকগুলো যেন দীর্ঘ, কালো হাত বাড়িয়ে তাদের ভেতরে টেনে নিতে চাইছে, তাদের গ্রাস করতে চাইছে, চিরতরে তাদের আটকে রাখতে চাইছে, তাদের আত্মাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে, তাদের চিরন্তন দাসে পরিণত করতে চাইছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা অদ্ভুত শীতলতা অর্ক এবং সুকান্তের শরীর ভেদ করে গেল, যেন হাজারো সূঁচ তাদের ত্বকে বিঁধছে, তাদের শিরায় শিরায় বরফ জমে যাচ্ছে, প্রতিটি রক্তকণিকা যেন জমাট বেঁধেছে, তাদের হৃদপিণ্ড যেন থেমে যাবে, তাদের শরীরের সব অনুভূতি যেন লুপ্ত হয়ে গেছে, তারা যেন এক জীবন্ত মৃতদেহ। দিনের বেলাতেও ভিলাটা কেমন অন্ধকার আর গুমোট হয়ে আছে, যেন তার ভেতরে কোনো আলো প্রবেশ করতে পারে না, প্রতিটি কোণায় যেন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে, সেই অন্ধকার যেন তাদের গ্রাস করতে চাইছে, তাদের শ্বাসরোধ করতে চাইছে, তাদের আত্মাকে শুষে নিতে চাইছে, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে চাইছে। হলঘরে প্রবেশ করতেই পিয়ানোটা নজরে পড়ল। দিনের আলোয় পিয়ানোটা আর ততটা ভীতিজনক লাগছিল না, কিন্তু অর্ক জানত রাতের বেলা এর রূপ কতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে, যখন অন্ধকার তার সত্যিকারের চেহারা প্রকাশ করে, আর তার থেকে ভেসে আসে অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদ। ভিলার ভেতরে বাতাস ভারি হয়ে উঠল, শ্বাস নেওয়া যেন কঠিন হয়ে গেল, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে মৃত্যু মিশে আছে, বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, প্রতিটি কণা যেন প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। গুরুজি তার সাথে কিছু পূজার সামগ্রী এনেছিলেন: চন্দনকাঠ, ধূপ, কিছু শুকনো ফুল এবং একটি পিতলের পাত্রে পবিত্র জল। তিনি হলঘরের মাঝখানে একটি ছোট আসন পাতলেন এবং সেই স্থানে পূজার সামগ্রী সাজালেন। পূজার স্থানে এক অদ্ভুত কালো শক্তি ঘুরপাক খাচ্ছিল, যা অর্ক এবং সুকান্ত স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল, যেন অদৃশ্য কোনো সত্তা তাদের ঘিরে আছে, তাদের প্রতিটি নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছে, আক্রমণের অপেক্ষায়, তাদের আত্মাকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায়, এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধা নিয়ে, এক অদম্য ক্রোধ নিয়ে। অর্ক গুরুজির পাশে বসল, তার হৃদপিণ্ড তখনও দ্রুতগতিতে ধুকপুক করছে, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সুকান্ত, যদিও যুক্তিবাদী, তার মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, তার সাংবাদিকসুলভ দৃঢ়তা যেন এই অশুভ পরিবেশে কিছুটা ফিকে হয়ে যাচ্ছিল, তবুও সে তার নোটবুকটি শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যেন কোনো এক অজানা উপায়ে এই সবকিছুকে ধারণ করতে চাইছে, বাস্তবতাকে বিশ্বাস করতে চাইছে। গুরুজি চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত ও গম্ভীর, যা সেই ভীতিকর পরিবেশে এক ধরনের সাহস যোগাচ্ছিল, কিন্তু তার কপালের শিরাগুলো টানটান হয়ে গিয়েছিল, তার শরীর থেকে যেন প্রচণ্ড শক্তি নির্গত হচ্ছে, তার মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করছিল। তিনি লেপচা ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন, যা অর্ক এবং সুকান্ত বুঝতে পারছিল না, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দে এক গভীর শক্তি অনুভব করছিল, যেন প্রতিটি শব্দেই অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি হচ্ছে, যা তাদের রক্ষা করছে, এবং সেই অশুভ শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখছে, তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তাকে দুর্বল করে তুলছে, তার ক্ষমতা হ্রাস করছিল। মন্ত্র পাঠের সাথে সাথে গুরুজি ধূপ জ্বালালেন। ধূপের সুগন্ধ ধীরে ধীরে হলঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, যা সেই গুমোট পরিবেশকে কিছুটা হালকা করছিল, কিন্তু তার সাথে মিশে যাচ্ছিল এক তীব্র পচাগন্ধ, যেন সেই গন্ধই অশুভ শক্তির উপস্থিতি, যা তাদের শ্বাসরোধ করতে চাইছে, তাদের চেতনা কেড়ে নিতে চাইছে, তাদের মনকে বিকৃত করতে চাইছে, তাদের উন্মাদ করে তুলতে চাইছে। মন্ত্র পাঠ চলতেই থাকল। প্রায় পনেরো মিনিট পর, অর্ক অনুভব করল ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করেছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস জমে যাওয়ার উপক্রম, যেন তার ফুসফুসে বরফ জমে যাচ্ছে, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন কষ্টকর। সুকান্তও শীতে কাঁপতে শুরু করল, তার হাত থেকে নোটবুকটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, তার দাঁত কিড়মিড় করছিল ভয়ে। ফায়ারপ্লেসে আগুন না থাকলেও ঘরটা যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি কণায় যেন মৃত্যু মিশে আছে, বাতাস যেন হিমশীতল ছুরি হয়ে তাদের ত্বকে আঘাত হানছে। হঠাৎ করেই, ভিলার প্রতিটি দরজা-জানালা সশব্দে খুলতে ও বন্ধ হতে লাগল, যেন অদৃশ্য কোনো ক্রোধ ভিলার প্রতিটি কোণে আছড়ে পড়ছে, তার তীব্র শব্দে তাদের কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছিল, তাদের মস্তিষ্কে আঘাত হানছিল, তাদের পাগল করে দিচ্ছিল। কাঁচের জিনিসপত্র আপনা-আপনি কাঁপতে লাগল, আর দেয়ালের ছবিগুলো কাত হয়ে গেল। তাদের ফ্রেমে থাকা মুখগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তাদের চোখ থেকে এক তীব্র যন্ত্রণা ঝরে পড়ছে, তাদের ঠোঁট যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে, এক নীরব আর্তনাদ, এক অদৃশ্য অভিশাপ, যা তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছে। এরপরই, পিয়ানোর ঢাকনাটা আপনা-আপনি খুলে গেল, এক তীব্র ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে, যেন এক মৃত জন্তু তার মুখ খুলছে, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারকে উন্মুক্ত করছে, এক ভয়ংকর দৃশ্য যা তাদের চোখকে বিদ্ধ করছিল, তাদের মনকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল। অর্ক ভয়ে শিউরে উঠল, তার শরীর কেঁপে উঠল, সুকান্তের মুখ থেকে একটি অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, কিন্তু গুরুজি চোখ খুললেন না, তার মন্ত্র পাঠ অব্যাহত থাকল, আরও জোরালো এবং দ্রুতগতিতে, যেন তিনি এক অদৃশ্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, প্রতিটি মন্ত্র তার অস্ত্র, প্রতিটি শব্দ এক তীব্র আঘাত, যা অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করছিল, তাকে পিছু হটিয়ে দিচ্ছিল। তারপর, পিয়ানোর সাদা কালো কি-গুলির ওপর একটি অস্পষ্ট ছায়া নড়াচড়া করতে লাগল। অর্ক এবং সুকান্ত দুজনেই দেখল, এটা এলিজাবেথের আত্মা, কিন্তু এবার সে শুধু একটি অস্পষ্ট ছায়া ছিল না, বরং তার চারপাশে এক কালো শক্তি ঘুরপাক খাচ্ছিল, যেন সেই শক্তিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার শরীরকে ব্যবহার করছে, তাকে এক পুতুলের মতো নাচিয়ে চলেছে, তার নিজের ইচ্ছাকে অস্বীকার করে, তার জীবনকে এক ভয়াবহ যন্ত্রণায় পরিণত করেছে। এবার ছায়াটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটি পুরনো ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরিহিত নারী মূর্তি, যার মুখ বিকৃত, চোখ দুটি অন্ধকার গহ্বরের মতো, যেন তার ভেতরের সব আলো নিভে গেছে, আর তার চোয়াল অস্বাভাবিকভাবে ঝুলে আছে, যেন একটি মৃতদেহ তার সামনে দাঁড়িয়ে, তার দিকে তাকিয়ে আছে, এক বীভৎস দৃষ্টিতে, তার চোখে কেবল ঘৃণা, এক নরকীয় ক্রোধ। তার হাতগুলো ছিল অস্বাভাবিক লম্বা, এবং তার আঙুলগুলো পিয়ানোর কিতে স্পর্শ করতেই এক বিকট শব্দ করে উঠল, যেন হাড় ভেঙে যাচ্ছে, এক বীভৎস আওয়াজ, যা তাদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছিল, তাদের মস্তিষ্কে আঘাত হানছিল। সে পিয়ানোর সামনে বসল, তার ছায়া হাতগুলি কি-গুলোর ওপর রাখল, কিন্তু তার নড়াচড়ায় কোনো ছন্দ ছিল না, কেবল এক যান্ত্রিকতা, যেন সে কোনো অদৃশ্য শক্তির পুতুল, যার নিজের কোনো ইচ্ছা নেই, কেবল তার প্রভুর নির্দেশ পালন করছে, তার নিজের ইচ্ছাকে বিলীন করে দিয়েছে। চলবে….

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion