Episode 1944 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : প্রথম অধ্যায়

বস্তির জীবন ও স্বপ্নের অঙ্কুর শহরের কোলাহলপূর্ণ জনজীবনের এক নিভৃত কোণে, যেখানে সূর্যালোক পৌঁছাতো কদাচিৎ, যেন কোনো অভিশাপ লেগেছিল সেই অঞ্চলের ওপর, সেখানে ছিল এক ঘিঞ্জি গলি। গলির মুখ থেকে এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে আসতো – পচা নর্দমার জল, আবর্জনা আর মানুষের ঘামের মিশে যাওয়া এক তীব্র দুর্গন্ধ। ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়তো অসংখ্য টিনের ছাউনি দেওয়া, বাঁশের মাচায় তৈরি ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরের সারি, যেখানে মানুষের চেয়ে ইঁদুর আর পোকামাকড়ই বেশি আরামদায়ক জীবন কাটাতো। সেই স্যাঁতসেঁতে বস্তির মাঝে, আকাশ নামের এক ছেলে তার ভাঙাচোরা, প্রায় জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে বসে স্বপ্ন বুনতো। তার কুঁড়েঘরের দেয়ালগুলো ছিল শেওলা ধরা, বর্ষার দিনে ছাদ থেকে টুপটাপ জল পড়তো প্লাস্টিকের বালতি ও ভাঙা হাঁড়িতে, যা গভীর রাতে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিতো, তার স্বপ্নেও বৃষ্টির শব্দ মিশে যেতো। মেঝেতে ছিল ধুলো, কাদা ও অপরিষ্কার আবর্জনার মিশ্রণ – এক অসহনীয়, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ, যেখানে এক মুহূর্ত শ্বাস নেওয়াও কঠিন ছিল। চারপাশে পচা জলের দুর্গন্ধ, নোংরা নর্দমার উপচে পড়া ঢেউ, যেখানে মশার অবাধ বিচরণ; আর সারাক্ষণ বস্তির কোলাহল, ঝগড়া-বিবাদ, শিশুদের চিৎকার – এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তার চোখ সবসময় উঁচুতে, দিগন্তের ওপরে এক অন্য জগতের দিকে তাকিয়ে থাকতো। সে স্বপ্ন দেখতো আলোর, জ্ঞানের আর সম্মানের – এমন এক জীবনের, যেখানে তার জন্মগত দারিদ্র্য কোনো বাধা হবে না, যেখানে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, তার মেধা হবে তার একমাত্র পরিচয়, তার সম্মান হবে তার অর্জিত সম্পত্তি, যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তার চোখে ছিল এক অদম্য জেদ, এক জ্বলন্ত শিখা, যা দারিদ্র্যের অন্ধকারকে ভেদ করে আলোর পথে ছুটতে চাইতো, যেন কোনো শক্তিশালী টর্চের আলো অমানিশার বুকে পথ দেখাচ্ছিল, তাকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আকাশের বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর, তার নাম রঞ্জিত। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় তিনি বিছানা ছেড়ে বের হতেন, সূর্য ওঠার অনেক আগে, যখন শহর কেবল জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিতো, যখন রাতের শেষ প্রহর। খালি পায়ে, জীর্ণ লুঙ্গি আর শার্ট পরে তিনি কাজের সন্ধানে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যেতেন। কখনো রিকশা চালাতেন, কখনো নির্মাণাধীন বাড়ির ইট বয়ে নিয়ে যেতেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তার পিঠের মাংসপেশী ফুলে উঠতো, ক্লান্তিতে তার সর্বশরীর অসাড় হয়ে যেতো। আবার কখনো বাজারে মাছ-সবজি টানার কাজ করতেন, বা লোড-আনলোডের কাজে অংশ নিতেন, যেখানে তাকে ভারী বস্তা মাথায় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতে হতো। তার শরীর ছিল ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া, কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য তিনি কোনোদিন হার মানেননি, তার মুখের প্রতিটি রেখায় ছিল এক দৃঢ় সংকল্প আর এক অফুরন্ত ভালোবাসা, এক নীরব আশীর্বাদ। আকাশের মা ছিলেন সারদা দেবী, যিনি পরের বাড়িতে বাসন মাজতেন, কাপড় কাচতেন, সকালে বেরিয়ে দুপুর ফিরতেন, আবার বিকেলে যেতেন, সারাদিন তিনি অন্যের বাড়ির কাজ করতেন। আর সামান্য যে পয়সা পেতেন, তার সবটাই যত্ন করে তুলে দিতেন আকাশের হাতে, যাতে সে বই কিনতে পারে বা স্কুলের ফি দিতে পারে। মায়ের হাতের রুটিতে প্রায়শই নুন ছাড়া আর কিছু থাকতো না, কখনো কখনো সেটিও জুটতো না। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটানো যেখানে এক কঠিন সংগ্রাম, প্রায়শই তাদের রাতের খাবার জুটতো না, ক্ষুধা নিয়েই তাদের ঘুমিয়ে পড়তে হতো, আকাশের মনে সেই কষ্ট চিরদিন ছিল। এই চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও, এক অদৃশ্য ঋণের বোঝা তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। বস্তির স্থানীয় এক প্রভাবশালী মহাজন, নকুড় দাস, তার বাবা রঞ্জিতকে সামান্য কিছু টাকা ধার দিয়েছিল, যা সুদের চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে পাহাড়সমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নকুড় দাস প্রায়শই তাদের ঘরে এসে হুমকি দিতো, মায়ের গহনা, এমনকি আকাশের বইখাতা বিক্রি করে দেওয়ার ভয় দেখাতো। এই ভয় আকাশের মনে এক স্থায়ী উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল। সেখানে বই আর বিদ্যার বিলাসিতা ছিল এক অলীক কল্পনা, এক দুঃসাহসিক স্বপ্ন, যা শুধু সাহসীরাই দেখতে পারে, যাদের মনে অদম্য আকাঙ্ক্ষা থাকে, যাদের চোখ থাকে সুদূরের পানে। তবুও আকাশ হার মানেনি, তার মনোবল ছিল ইস্পাতের মতো শক্ত, তার আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশছোঁয়া। তার কাছে পড়াশোনা কেবল অক্ষর জ্ঞান ছিল না, ছিল পরাধীনতা থেকে মুক্তির এক সুদৃঢ় পথ, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র হাতিয়ার, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়। সে বিশ্বাস করতো, শিক্ষা একাই পারে তার জীবনকে নতুন দিশা দেখাতে, তাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দিতে, সম্মানজনক একটি জীবন দিতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায়, যখন বস্তির বাকি ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াতো, মার্বেল খেলতো বা রেডিওতে তারস্বরে বাজানো সস্তা হিন্দি গান শুনতো, আকাশ তখন তার একমাত্র সঙ্গী, একটা পুরোনো খাতা আর ছেঁড়া পেনসিল নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। তার প্যান্টের পকেটে সেই পুরোনো খাতা আর ছেঁড়া পেনসিল ছিল যেন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তার কাছে যেকোনো রত্নের চেয়েও বেশি দামি। রাত যত বাড়তো, বস্তি ততই শান্ত হয়ে আসতো, শুধু কুকুরের ডাক আর দূর থেকে আসা গাড়ির শব্দ শোনা যেত, কিন্তু আকাশের মন আরও সজাগ হয়ে উঠতো, যেন জ্ঞানের পিপাসা তাকে ঘুমোতে দিত না, তার মস্তিষ্ক যেন নতুন জ্ঞান অর্জনের জন্য অস্থির ছিল। রাস্তার ধারে নিয়ন আলোর নীচে, কখনো বা কোনো দোকানের আবছা বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে, সে গভীর মনোযোগে অঙ্ক কষতো, ইতিহাসের পাতায় ডুব দিতো আর বিজ্ঞানের জটিল সূত্রগুলো বোঝার চেষ্টা করতো। চারপাশে হইচই, গাড়ির শব্দ, মানুষের চিৎকার – কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারতো না, সে যেন এক গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতো, নিজের জগতে বিলীন হয়ে যেত, বাইরের জগতের কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করতো না। তার টিফিন মানে ছিল শুধুই শুকনো রুটি, কখনো নুন দিয়ে, কখনো বা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। এই শুকনো রুটিই ছিল তার কাছে অমৃত, তার পুষ্টির একমাত্র উৎস, তার জীবনের শক্তি। আর তার স্কুলের ইউনিফর্মের কলার ছিল তেল চিটচিটে, প্রায়ই ছেঁড়া, যেখানে সুতো বেরিয়ে থাকতো। তার জুতোয় বড় বড় ফুটো ছিল, যা দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকে তার পা ভেজাতো, শীতের দিনে তার পা ঠান্ডায় নীল হয়ে যেতো, কিন্তু সে কোনো অভিযোগ করতো না, তার মুখে কোনো কষ্ট দেখা যেত না, সে জানতো এটাই তার নিয়তি। সহপাঠীরা তার পোশাক দেখে হাসাহাসি করতো, টিটকারি দিতো, কখনো বা তাকে দেখে নাক সিঁটকাতো, যেন সে কোনো ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে এসেছে, তার উপস্থিতি তাদের কাছে ছিল বিরক্তিকর, এক আপদ। এমনকি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশও তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন, তার মেধাকে নয়, তার দারিদ্র্যকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু এসব কিছুই তার স্বপ্ন দেখতে বাধা দিতে পারেনি। তার চোখে সর্বদা এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ঝলমল করতো, যেন সেই আলো তার সব দুঃখকে গ্রাস করে নিতো, তাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতো, তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখাতো, তাকে বেঁচে থাকার কারণ দিতো। চলবে…….  

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion