Episode 2818 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : দ্বিতীয় অধ্যায়

অভিজাত স্কুলে নতুন জগৎ ও দিশার আগমন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় এক কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে মেধার জোরে শহরের সবচেয়ে অভিজাত স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। সেদিনের আনন্দ আকাশ তার জীবনে কোনোদিন ভুলবে না। সেদিনের সকালটা তার জীবনের এক নতুন সূর্যোদয় ছিল, এক অসম্ভবকে সম্ভব করার দিন, এক অলৌকিক ঘটনা। তার বাবা-মায়ের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু, তাদের বহুদিনের পরিশ্রম যেন সেদিন সার্থক মনে হয়েছিল, তাদের সব স্বপ্ন যেন ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল, এক নতুন জীবন যেন শুরু হয়েছিল। বস্তির প্রতিবেশীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল – কেউ মন খুলে অভিনন্দন জানালো, তার সাফল্যের জন্য মিষ্টি বিতরণ করলো, কেউ আবার ঈর্ষার কালো দৃষ্টিতে তাকে দেখলো, তাদের চোখে ছিল এক অব্যক্ত বিদ্বেষ, এক চাপা রাগ, যেন আকাশের সাফল্যে তারা নিজেদের ব্যর্থতা দেখছিল, তাদের মনে ছিল এক চাপা যন্ত্রণা। আকাশের কাছে এই স্কুল ছিল এক নতুন জগৎ, এক স্বপ্নপুরী যেখানে আলো ঝলমল করে, যেখানে জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার অপেক্ষা করছে তার জন্য। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো জাদুর জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে তার সব স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে, যেখানে সে তার পরিচয় তৈরি করতে পারবে, সমাজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে আকাশ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের বিশাল গেট, যা লোহার কারুকাজে ভরা ছিল, যেন শিল্পীর হাতের নিখুঁত কাজ, এটি দেখে তার চোখ ঝলসে গেল। মসৃণ মার্বেলের করিডোর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণীকক্ষ, ঝাঁ-চকচকে ল্যাবরেটরি যেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সারি, সুসজ্জিত খেলার মাঠ যেখানে সবুজ ঘাস বিছানো ছিল – সবকিছুই তার কাছে অচেনা, এক স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল, যেন সে অন্য কোনো গ্রহে চলে এসেছে। ক্লাসের প্রতিটি শিশু যেন এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা। তাদের দামি স্কুলব্যাগ, চকচকে ব্র্যান্ডেড জুতো, বিদেশি ঘড়ি আর টিফিনের সুগন্ধে ভরা বাক্স – পিৎজা, স্যান্ডউইচ, চকলেট, বিদেশি ফল – সব দেখে আকাশের মন কুঁকড়ে যাচ্ছিল। নিজের পুরোনো, শতছিন্ন স্কুলব্যাগটা যেন তার দারিদ্র্যের এক নীরব বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, যা দেখে সে নিজেকে আরও ছোট মনে করছিল। সে নিজেকে বড্ড ছোট, বড্ড নগণ্য মনে করছিল সেই বিরাট প্রতিষ্ঠানের সামনে। তার মনে হচ্ছিল, সে কি সত্যিই এই জায়গার যোগ্য? সে কি এই অভিজাত পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? এই চিন্তাগুলো তাকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তার আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল, তাকে এক অসহায়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। স্কুলের প্রথম ক’দিন আকাশের কাছে ছিল এক নিরন্তর যুদ্ধ। ক্লাসে শিক্ষকরা যখন ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতেন, তার বুঝতে অসুবিধা হতো। সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতেই গল্প করতো, নামীদামি ব্র‍্যান্ডের পোশাক, গ্যাজেট আর গ্রীষ্মকালীন ছুটির বিদেশি ভ্রমণের গল্পে মেতে উঠতো। আকাশ এক কোণে চুপচাপ বসে থাকতো, নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন মনে হতো। তাদের হাসি-ঠাট্টা, তাদের সহজ জীবনযাত্রা – সবকিছুই তার কাছে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করতো। টিফিনের সময় সে সবার থেকে দূরে, হয় লাইব্রেরির এক কোণে, নয়তো খেলার মাঠের শেষ প্রান্তে বসে তার শুকনো রুটি খেতো। ক্লাসের রনি আর তার বন্ধুরা তাকে ‘বস্তির পোকা’ বলে ডাকতো, কখনো তার ছেঁড়া ইউনিফর্ম নিয়ে হাসাহাসি করতো। একবার রনি তার পুরোনো জুতোয় কাদা মেখে দিয়েছিল, যা দেখে সবাই হেসে উঠেছিল। আকাশের চোখে তখন জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি, শুধু মাথা নিচু করে নিজের অপমান হজম করেছিল। এই পরিস্থিতিতে সে নিজেকে বড্ড একা মনে করতো, তার মনে হতো, এই দামী স্কুলের উজ্জ্বল আলোয় সে যেন আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন, আরও বেশি নগণ্য। তবুও সে হার মানেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শুধু মেধার আলো দিয়েই সে এই অন্ধকার ভেদ করে নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে। সে জানতো, তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন, তার নিজের স্বপ্ন – সবকিছুর জন্য তাকে এই লড়াই লড়তেই হবে। ঠিক তখনই, ক্লাসে প্রবেশ করলো দিশা। যেন এক ঝলক বসন্তের হাওয়া প্রবেশ করলো শ্রেণীকক্ষে, তার আগমনে পুরো কক্ষ যেন আলোকময় হয়ে উঠলো, ফুলের সুগন্ধে ভরে উঠলো। লম্বা, ফর্সা, কালো চুলের বিনুনি যা তার পিঠ ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছিল, আর ঝলমলে চোখ – তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক স্নিগ্ধ আভিজাত্য, এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য। তার পরনে ছিল নিখুঁত ইস্ত্রি করা স্কুল ইউনিফর্ম, যা তার ব্যক্তিত্বকে আরও ফুটিয়ে তুলছিল। দিশা যেন স্কুলের চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা এক জীবন্ত ছবি, যেখানে প্রতিটি রং ছিল নিখুঁত, প্রতিটি রেখা ছিল সুস্পষ্ট, এক অনবদ্য সৃষ্টি। সে ছিল ক্লাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়ে। পড়াশোনায় সেরা, প্রতিটি বিষয়ে তার দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো, খেলাধুলায় অসাধারণ এবং সকলের সাথে তার মিষ্টি হাসি আর সহজ ব্যবহার সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। তার চারপাশে সবসময় বন্ধুদের ভিড় লেগে থাকতো, যেন সে তাদের মধ্যমণি, এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলোতে সবাই আলোকিত হতে চাইতো। প্রথমদিকে আকাশ নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। সে জানতো, তার জগৎ আর দিশার জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অবস্থান – সবকিছুতেই ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সে নিজেকে দিশার কাছে ছোট মনে করতো, নিজেকে তার যোগ্য ভাবতো না। তার মনের মধ্যে এক হীনমন্যতার বোধ কাজ করতো, যা তাকে দিশার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিতো, তাকে একাকী করে দিতো। দিশার বন্ধুদের বৃত্ত ছিল অনেক বড়। তারা বড় বড় গাড়ি করে স্কুলে আসতো, নামীদামি রেস্টুরেন্টে খেতো, আর ছুটির দিনে তাদের বাগানবাড়ি বা বিদেশ ভ্রমণের গল্প নিয়ে আলোচনা করতো। তাদের কথা যেন আকাশের মাথার উপর দিয়ে যেতো, সে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন মনে করতো, যেন সে এক ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। আকাশের কাছে এগুলি ছিল শুধুই গল্পের বইয়ের বা টেলিভিশনের বর্ণনা। সে কখনো কল্পনাই করতে পারতো না যে এমন একটা জীবনও বাস্তব হতে পারে, যেখানে এত প্রাচুর্য থাকতে পারে, এত বিলাসিতা থাকতে পারে, যেখানে মানুষ শুধু আনন্দের জন্য বাঁচতে পারে। চলবে……  

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion