Episode 9866 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : নবম অধ্যায়

দিশার ত্যাগ ও সত্যের উন্মোচন পরের কয়েকদিনে আকাশ আর দিশার মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখা হলো। তারা দুজনেই কফি শপে বা নিরিবিলি জায়গায় দেখা করতো, পুরোনো দিনের কথা বলতো, হারানো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতো। তারা একে অপরের কাছে তাদের ফেলে আসা জীবনের গল্প বলতো, তাদের দুঃখ, তাদের স্বপ্ন, তাদের হতাশা, তাদের সংগ্রাম। দিশা বললো, তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তার বাবা-মা তাকে জোর করে অনির্বাণের সাথে বাগদান করিয়ে দিয়েছিলেন, যা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। নিউ ইয়র্কের অভিজাত কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তার জীবন আপাতদৃষ্টিতে মসৃণ দেখালেও, ভেতরে ভেতরে সে ছিল এক ভাঙা পুতুল। প্রতি রাতে সে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতো, আকাশের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। বন্ধুদের সাথে পার্টিতে গিয়েও সে হাসি মুখে থাকতো, কিন্তু তার ভেতরের শূন্যতা তাকে কুরে কুরে খেত। তার বাবা-মা তাকে অনির্বাণের সাথে জোর করে সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন, যেখানে তাকে হাসিমুখে ছবি তুলতে হতো, মিথ্যে হাসিতে ঢেকে রাখতে হতো তার ভেতরের সব যন্ত্রণা। অনির্বাণ তাকে উপহার দিতো দামি গহনা, দামী পোশাক, কিন্তু তার প্রতিটি স্পর্শ দিশার কাছে ছিল বিষের মতো। অনির্বাণ ছিল কর্তৃত্বপরায়ণ, দিশার প্রতিটি সিদ্ধান্ত সে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো। দিশা যেন এক সোনার খাঁচায় বন্দিনী ছিল, যেখানে প্রাচুর্য ছিল, কিন্তু স্বাধীনতা ছিল না, ভালোবাসা ছিল না। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে সাহায্য করার নামে অনির্বাণের সাথে তার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল, যা তাকে আরও বেশি করে সেই চক্রের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। সে সব দেখেও চুপ করে থাকতো, কারণ প্রতিবাদ করার মতো শক্তি তার ছিল না, তার কণ্ঠস্বর ছিল চাপা, তার স্বপ্ন ছিল বিলীন। সে প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো, যেন এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়, যেন কোনো অলৌকিক উপায়ে আকাশ তার জীবনে ফিরে আসে। দিশা জানালো, অনির্বাণ একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ধূর্ত ব্যবসায়ী। তার হাতে অনেক কালো টাকা আছে, যা সে অবৈধ পথে রোজগার করতো – ভূমি দখল, মাদক পাচার, মানব পাচার – সবরকম জঘন্য কাজ। সে তার বাবাকেও বিভিন্ন অবৈধ কাজে জড়িয়েছে, যার মধ্যে এই ভূমি কেলেঙ্কারি অন্যতম। অনির্বাণ তাকে একটি পুতুলের মতো ব্যবহার করতো, তার কোনো মতামত ছিল না, তার কোনো অধিকার ছিল না। দিশা এই সম্পর্কের মধ্যে থেকেও খুব সুখি ছিল না। সে অনির্বাণের অন্ধকার দিকটা জানতো এবং নীরবে অনেক কষ্ট ভোগ করছিল। সে যেন এক জালের মধ্যে আটকে পড়েছিল, যেখান থেকে সে মুক্তি চাইছিল, কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না, তার চারপাশ অন্ধকার ছিল। তার প্রতিটি দিন কাটছিল এক দমবন্ধ করা পরিবেশে, যেখানে সে শ্বাস নিতে পারছিল না, তার জীবন যেন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার আত্মা যেন প্রতি মুহূর্তে কাঁদছিল। সে মনে মনে মুক্তি চাইছিল, কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। “আকাশ, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম,” দিশা বললো, তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, যা সে কোনোমতে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, তার সারা শরীর কাঁপছিল। “আমি জানতাম, তুমি একদিন বড় হবে। আমি চেয়েছিলাম, তুমি এসে আমাকে এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে মুক্ত করো। তুমিই আমার একমাত্র আশা, তুমিই আমার আলোর দিশা, তুমিই আমার জীবনের একমাত্র কারণ।” তার গলায় ছিল আকুতি, আর চোখে ছিল এক অদম্য বিশ্বাস, যা আকাশকে মুগ্ধ করলো, তার মনে নতুন শক্তি যোগালো।আকাশের বুকটা ব্যথা করে উঠলো। দিশার কষ্ট সে বুঝতে পারছিল। তার মনের মধ্যে একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে তার কর্তব্যবোধ – এক কঠিন দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সে দিশাকে অনির্বাণের জাল থেকে মুক্ত করতে চাইছিল, কিন্তু তার কর্তব্য তাকে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করছিল, যা হয়তো দিশাকে আরও কষ্ট দেবে, তার বাবাকে হয়তো সমস্যার মুখে ফেলবে, যা তার জন্য ছিল কঠিনতম পরীক্ষা। একদিন, আকাশ দিশার সাথে তার ভূমি কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে আলোচনা করলো। সে অনির্বাণের নামও উল্লেখ করলো, তার কাছে থাকা প্রমাণ সম্পর্কেও জানালো। দিশা চুপ করে সব শুনলো। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, তার শরীরের রক্ত যেন জমে গিয়েছিল, তার শরীর কাঁপছিল, তার চোখে ছিল এক গভীর ভয়।“অনির্বাণ এই কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত,” আকাশ বললো। “আমার কাছে এর জোরালো প্রমাণ আছে। আমি তাকে ছাড়বো না। তাকে আমি আইনের হাতে তুলে দেব, যত বড়ই সে হোক না কেন, সে কোনোভাবেই বাঁচতে পারবে না।”দিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আমি জানি আকাশ। আমি অনেকদিন ধরেই এটা সন্দেহ করছিলাম। আমার বাবাও হয়তো জড়িত। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। আমাকে ওরা বন্দী করে রেখেছিল। আমি ওদের ভয়ে কিছু বলতে পারিনি, আমার কোনো শক্তি ছিল না, আমার কোনো উপায় ছিল না।” তার চোখে ছিল অসহায়তা, এক গভীর যন্ত্রণা, এক দীর্ঘদিনের চাপ।আকাশ দিশার হাত ধরলো। তার চোখে ছিল এক গভীর সহানুভূতি, এক দৃঢ় সংকল্প। “দিশা, আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই। এই সম্পর্কের জাল থেকে মুক্ত করতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? তোমার সাহায্য ছাড়া এই কাজটা কঠিন হবে, অনেক প্রমাণই অধরা থেকে যাবে, অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে.”দিশা আকাশের চোখের দিকে তাকালো, তার চোখে ছিল এক নতুন সংকল্প, এক নতুন আশা, এক নতুন দিগন্ত। তার মুখে ছিল এক অদম্য সাহস। “আমি তোমার পাশে আছি, আকাশ। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো। আমি এই মিথ্যা জীবন থেকে মুক্তি চাই। আমি আর এই অন্যায়ের অংশ হতে চাই না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই, সত্যের পাশে দাঁড়াতে চাই, আমার জীবন দিয়ে হলেও।” এই ছিল সেই মোচড়। দিশা কেবল অনির্বাণের স্ত্রী (বা বাগদত্তা) ছিল না, সে ছিল তার অবৈধ কাজের নীরব সাক্ষী এবং একরকম শিকার। তার ভালোবাসার মানুষটি এখন তার সবচেয়ে বড় মামলার প্রধান অভিযুক্তের সাথে জড়িত। আকাশের জন্য এটা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। তার ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং তার পেশাগত সততার মধ্যে এক তীব্র সংঘাত। তাকে তার ভালোবাসা এবং কর্তব্য, এই দুটোর মধ্যে এক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সে জানতো, এটা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু সে তা নিতে প্রস্তুত ছিল, দিশার জন্য, এবং ন্যায়ের জন্য, সমাজের জন্য। চলবে……

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion