Episode 81405 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : অষ্টম অধ্যায়

অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন ও রহস্যের আভাস আকাশ তার কর্মজীবনে অত্যন্ত সফল ছিলেন। সততা, দক্ষতা এবং দৃঢ়তার জন্য তিনি সারা রাজ্যে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার আপসহীন মনোভাব এবং বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার কঠোর পদক্ষেপগুলি তাকে জনগণের প্রিয় করে তুলেছিল, কিন্তু একই সাথে কিছু প্রভাবশালী মহলের বিরাগভাজনও করে তুলেছিল। অনেকেই তাকে ভয় পেতো, কারণ সে অন্যায়ের সাথে কোনো আপস করতো না, তার চোখে ছিল এক নির্ভেজাল সততা, যা দেখে প্রভাবশালীরা কেঁপে উঠতো, তাদের অন্যায় কাজ বন্ধ হয়ে যেতো। তিনি যেন ছিলেন এক জ্বলন্ত শিখা, যা দুর্নীতির অন্ধকারকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে প্রস্তুত, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। তার সাহস আর নিষ্ঠা ছিল কিংবদন্তী, তার নাম শুনলে অসৎ মানুষেরা শিউরে উঠতো, তারা তাদের কাজ বন্ধ করে দিতো। কয়েক বছর পর, আকাশকে রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-সমৃদ্ধ জেলায় বদলি করা হলো। এই জেলায় কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী সক্রিয় ছিল এবং অবৈধ খনিজ উত্তোলনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখানে পরিবেশ দূষণ ছিল চরম পর্যায়ে, অসংখ্য গাছ কাটা হচ্ছিল, নদী দূষিত হচ্ছিল বিষাক্ত বর্জ্যে, আর সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করা হচ্ছিল প্রতিনিয়ত, তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। এখানকার মানুষজন ছিল নিপীড়িত, তাদের কোনো কথা শোনার মতো কেউ ছিল না, তারা যেন অদৃশ্য এক জালে আটকা পড়েছিল, তাদের কণ্ঠস্বর ছিল চাপা। আকাশ এই নতুন দায়িত্বকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন, কারণ তিনি জানতেন, এই জেলায় কাজ করা সহজ হবে না, এখানে ক্ষমতা এবং অর্থের একটি শক্তিশালী যোগসাজশ ছিল। মাফিয়া চক্র এবং কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মদতে এই অবৈধ কাজগুলো চলছিল, যা আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছিল, প্রশাসনকেও নিয়ন্ত্রণ করছিল, এমনকি বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করছিল। তিনি শপথ নিলেন, এই জেলার চেহারা তিনি বদলাবেনই, অন্যায়কে তিনি কিছুতেই প্রশ্রয় দেবেন না, যত বাধাই আসুক না কেন, যত বিপদই আসুক না কেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আকাশ একটি বড় ভূমি কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করলেন। এই কেলেঙ্কারিতে শত শত দরিদ্র কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে, তাদের জোর করে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তাদের স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের জীবন ধ্বংস করা হয়েছিল। আর একটি প্রভাবশালী রিয়েল এস্টেট কোম্পানি জড়িত ছিল, যারা এই অবৈধ কাজগুলোর মূল হোতা ছিল। এই কোম্পানিটি শহরের উপকণ্ঠে একটি বিশাল স্মার্ট সিটি প্রকল্প তৈরি করার জন্য এই জমিগুলি দখল করছিল, যেখানে বড় বড় বিল্ডিং, শপিং মল, এবং অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছিল, যা সমাজের দরিদ্র মানুষদের আরও প্রান্তিক করে তুলছিল। তদন্ত যত গভীরে যাচ্ছিল, আকাশ তত বেশি করে ক্ষমতাশালী মানুষের মুখোশ উন্মোচন করতে পারছিলেন। সে জানতে পারলো, এই কেলেঙ্কারির পেছনে রাজ্যের কিছু অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত, যাদের হাত অনেক লম্বা, এবং যারা নিজেদের আইনকেও নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করতে পারতো, তাদের কাছে আইন ছিল কেবল একটি খেলনা, যা দিয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতো। একদিন রাতে, আকাশ তার সরকারি বাংলোতে বসে ভূমি কেলেঙ্কারির নথি পরীক্ষা করছিলেন। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল, গাছের পাতা আর ডালপালার ঘষায় এক অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল, যেন কেউ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার দরজায় মৃদু টোকা পড়লো। এত রাতে কে আসতে পারে, ভেবে আকাশ একটু অবাক হলেন। দরজা খুলে দেখলেন, কেউ নেই। শুধু দরজার সামনে একটি কালো ভেলভেটের ছোট বাক্স পড়ে আছে। বাক্সটি দেখে তার সন্দেহ হলো। তিনি সাবধানে বাক্সটি হাতে তুলে নিলেন। ভেতরে একটি ছোট, বাঁধানো ডায়েরি এবং একটি পুরোনো ঘড়ি। ডায়েরিটি খুলে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। এটি ছিল দিশার মায়ের হাতের লেখা পুরোনো ডায়েরি। তাতে কিছু অদ্ভুত কোড এবং তারিখ লেখা ছিল, যা কোনো সাধারণ হিসেব মনে হচ্ছিল না। ঘড়িটি ছিল একটি পুরোনো পকেট ঘড়ি, যা আকাশের বাবার মতোই দেখতে, কিন্তু এটি ছিল অনেক বেশি দামি এবং সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। ঘড়ির ভেতরে একটি ছোট খোদাই করা অক্ষর ছিল, ‘A.M.’। Akash Mukherjee? Akash Mondol? একটি চাপা শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। এগুলো তার কাছে কে পাঠাতে পারে? কেনই বা দিশার মায়ের পুরোনো ডায়েরি? আর এই ঘড়িই বা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? ডায়েরির পাতায় একটি শুকনো গোলাপের পাপড়ি রাখা ছিল, যা দেখে আকাশের মনে হলো এই ডায়েরি দিশার মায়ের জীবনের কোনো গোপন রহস্য বহন করছে। এই ঘটনাটি আকাশের মনে এক গভীর রহস্যের জন্ম দিল। সে বুঝতে পারছিল, এই কেলেঙ্কারি শুধুমাত্র অনির্বাণের সাথে জড়িত নয়, এর পেছনে আরও গভীর কোনো খেলা চলছে, যার জাল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কে তাকে এই ইঙ্গিত দিচ্ছে? এর উদ্দেশ্যই বা কী? তার মনে এক নতুন ধাঁধা তৈরি হলো, যা তাকে আরও বেশি করে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য করলো। একদিন, একটি সরকারি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আকাশকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। এই অনুষ্ঠানটি ছিল জেলার নতুন একটি স্মার্ট সিটি প্রকল্পের উদ্বোধন। সেই অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রী এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ, আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠেছিল পুরো এলাকা, যেন কোনো স্বপ্নপুরী মাটির বুকে নেমে এসেছে, এক বিশাল আয়োজন। আকাশ যখন মঞ্চে তার বক্তব্য রাখছিলেন, তার চোখ দর্শকদের ভিড়ের উপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল। সে তার দায়িত্বের কথা বলছিল, তার স্বপ্নের কথা বলছিল, কিভাবে তিনি এই জেলাকে বদলে দিতে চান তার কথা বলছিল, তার চোখে ছিল এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, এক দৃঢ় সংকল্প। হঠাৎ এক পরিচিত মুখ তার চোখে পড়লো, যা দেখে সে মুহূর্তের জন্য তার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, তার হৃদপিণ্ড যেন দ্রুত তালে বাজতে শুরু করলো, তার সারা শরীর কাঁপছিল। দিশা! হ্যাঁ, সে দিশাই ছিল। আগের চেয়েও আরও সুন্দরী, আরও পরিপক্ক, যেন সময় তাকে আরও সুন্দর করেছে, আরও অভিজ্ঞ করেছে, তার সৌন্দর্য যেন সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। সে একটি অভিজাত শাড়িতে ঝলমল করছিল, তার প্রতিটি গয়না যেন তার আভিজাত্যের পরিচয় দিচ্ছিল, তার হাতে ছিল একটি দামি ঘড়ি, তার চুল ছিল সুন্দর করে বাঁধা। তার চোখে সেই পুরোনো দীপ্তি, সেই সারল্য, কিন্তু তার চোখে ছিল এক গভীর বিষাদ, যা আকাশ আগে কখনো দেখেনি, এক চাপা কষ্ট তার চোখে স্পষ্ট ছিল। তার হাসি ছিল নিষ্প্রাণ, তার মুখে ছিল এক চাপা কষ্ট, যেন সে কোনো অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়েছিল। সে একজন শক্তিশালী ব্যবসায়ী, মিস্টার অনির্বাণ মুখার্জির পাশে বসেছিল, যিনি এই স্মার্ট সিটি প্রকল্পের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী ছিলেন। মিস্টার মুখার্জি ছিলেন সেই ভূমি কেলেঙ্কারির প্রধান অভিযুক্ত, যার বিরুদ্ধে আকাশ তদন্ত করছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য আকাশের মনে এক গভীর ঝড় তুলে দিল, তার হৃদপিণ্ড যেন দ্রুত তালে বাজছিল, তার মন জুড়ে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, তার সব স্বপ্ন যেন এক মুহূর্তে ভেঙে যাচ্ছিল। আকাশের মনে এক মিশ্র অনুভূতি হলো – আনন্দ, বিস্ময়, এবং কিছুটা আঘাত। দিশা কি তাকে চিনতে পেরেছে? সে কি তার পুরোনো প্রেমিককে চিনতে পেরেছে, যে আজ তার স্বামীর (বা সম্ভাব্য স্বামীর) বিরুদ্ধে তদন্ত করছে? তার মনে হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে এলো, যা তার মনকে অস্থির করে তুললো। সে কি তার স্বপ্ন নিয়ে এতোদিন বেঁচে ছিল, আর আজ এই দৃশ্য দেখছে? তাদের পথ কি সত্যিই আবার এক হতে চলেছে? নাকি তাদের মধ্যে এক নতুন দেয়াল তৈরি হয়েছে? অনুষ্ঠান শেষে, দিশা এগিয়ে এলো। তার চোখেও বিস্ময় এবং এক অদ্ভুত অনুভূতি। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আকাশকে তার সামনে দেখে। তার শরীর কাঁপছিল, তার মুখে ছিল এক চাপা আবেগ, তার চোখ ছলছল করছিল।“আকাশ?” দিশার কণ্ঠস্বর মৃদু এবং কাঁপা কাঁপা শোনালো, যেন সে তার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার চোখে ছিল এক অদম্য আবেগ, এক অব্যক্ত ভালোবাসা, যা এত বছর ধরে তার মনে চাপা ছিল।“দিশা!” আকাশও একইরকম বিহ্বল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন এক স্বপ্ন দেখছে, যা সত্যি হওয়ার নয়, যা এত বছর ধরে সে দেখে এসেছে, তার স্বপ্ন যেন আজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।তাদের চারপাশের কোলাহল যেন মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল। শুধু তাদের দুজনের চোখেই ছিল পুরোনো স্মৃতির আনাগোনা, এক অব্যক্ত ভালোবাসা, যা এত বছর পরেও অমলিন ছিল, যা সময়ের সাথে সাথে আরও দৃঢ় হয়েছে, এক গভীর সংযোগ।“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এখানে,” দিশা বললো, তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, যা সে কোনোমতে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল, যাতে অনির্বাণ তাকে দেখতে না পায়, তার দুর্বলতা প্রকাশ না পায়।“আমিও,” আকাশ উত্তর দিল। তার মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে যেন পৃথিবীর সবকিছু থমকে গেছে, শুধু তারা দুজন ছাড়া, যেন তারা এক অন্য জগতে চলে গেছে, যেখানে শুধু তাদের ভালোবাসা আছে। তাদের কথা বলার সুযোগ খুব বেশি ছিল না, কারণ মিস্টার মুখার্জি এগিয়ে এলেন। তার মুখ ছিল গম্ভীর, চোখে ছিল এক কৃত্রিম হাসি, কিন্তু তার গলায় ছিল কর্তৃত্বের সুর, যা শুনে দিশা যেন কেঁপে উঠলো, তার শরীর শক্ত হয়ে গেল।“দিশা, তুমি একে চেনো?” অনির্বাণ মুখার্জির গলায় কিছুটা কর্তৃত্বের সুর, যেন সে দিশার উপর তার অধিকার জাহির করতে চাইছিল, আকাশকে একরকম ছোট করতে চাইছিল, তার চোখে ছিল এক চূড়ান্ত উপহাস।দিশা ইতস্তত করে বললো, “হ্যাঁ অনির্বাণ। ও আমার স্কুলের বন্ধু, আকাশ। আমাদের নতুন জেলা শাসক।” তার গলায় কিছুটা জড়তা ছিল, সে অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক চাপা সাহস।অনির্বাণ হাসলেন। “ওহ, আমাদের নতুন জেলা শাসক। আপনার সাথে দেখা করে ভালো লাগলো, মিস্টার চ্যাটার্জি। আপনার সততা আর কর্মদক্ষতার কথা আমরা অনেক শুনেছি।” তার হাসিটা ছিল যেন এক মুখোশ, যা তার ভেতরের ধূর্ততাকে আড়াল করে রাখছিল, তার চোখে ছিল এক অন্যরকম কুটিলতা, যা আকাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।আকাশের মনে হলো, এই হাসিটা কেবলই লোক দেখানো, এর পেছনে এক গভীর চক্রান্ত লুকিয়ে আছে। সে অনির্বাণের চোখে এক ধূর্ততা দেখতে পেল, যা তার ভেতরের অন্ধকারকে প্রকাশ করছিল। সে বুঝতে পারছিল, অনির্বাণ কোনো সাধারণ মানুষ নয়, সে একজন শক্তিশালী এবং ভয়ংকর শত্রু। চলবে……

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion