Episode 1719 words0 views

প্রথম অধ্যায় : শহরের ক্যানভাস

কলকাতার বসন্ত মানে হঠাৎ আসা কালবৈশাখী আর পলাশের আগুন। তবে দিয়া চক্রবর্তীর জীবনে বসন্ত আসত তার Wacom ট্যাবলেটের শীতল, মসৃণ স্ক্রিনে। বাইপাসের ধারের বহুতল ফ্ল্যাটের প্রশস্ত কাঁচের জানলার বাইরে আছড়ে পড়া বৃষ্টির দিকে তার হুঁশ ছিল না। কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আঁকিবুকি কেটে যে ক্ষণস্থায়ী শিল্প তৈরি করছিল, তা তার চোখ এড়িয়ে গেল। তার সমস্ত মনোযোগ ছিল স্ক্রিনের ওপর, যেখানে একটা ডিজিটাল তুলির সূক্ষ্ম টানে ফুটে উঠছিল এক পরাবাস্তব শহরের ছবি। উঁচু উঁচু বাড়ির জঙ্গল সেখানে ইস্পাত আর কাঁচের তৈরি, তাদের চূড়া মেঘ ফুঁড়ে আকাশে মিশেছে। সেই বাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পান্না সবুজ ধাতব ড্রাগন, যাদের ডানার নিচে ফসফরাসের মতো আলো জ্বলে-নেভে। আর রাস্তায় নিয়ন আলোয় মানুষের বদলে হেঁটে বেড়াচ্ছে রোবটের ছায়া—তাদের যান্ত্রিক পদক্ষেপে কোনো আবেগ নেই, আছে শুধু উদ্দেশ্য। তার নতুন সিরিজের থিম—’টেকনো-মিথ’। পুরনো কল্পনারা—পক্ষীরাজ ঘোড়া, বেঙ্গমা-বেঙ্গমি, মামদো ভূত—যদি আজকের প্রযুক্তির যুগে জন্মাত, তবে কেমন হতো তাদের রূপ—এই ছিল তার ভাবনা। “দিয়া! কফিটা তো হিম হয়ে গেল,” মায়ের গলা শুনে ঘোর কাটল তার। একটা চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই অন্যমনস্কভাবে বলল, “আসছি মা।” কফির মগটা তার ট্যাবলেটের পাশেই রাখা, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার মা, অনিন্দিতা দেবী, মেয়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঘরের চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো আর্ট বই, স্কেচপ্যাড আর দামী সব সরঞ্জাম। কিন্তু মেয়ের জগৎটা যেন ওই কালো কাঁচের স্ক্রিনেই বাঁধা। অনিন্দিতা দেবীর নিজেরও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি টান ছিল এককালে, কিন্তু সংসার আর আধুনিক জীবনের চাপে সে সব এখন অতীত। দিয়ার বাবা, অরিজিৎ সেন, নামকরা আর্কিটেক্ট। তাদের পরিবারে শিল্পের কদর ছিল, তবে সেটা আধুনিকতার মোড়কে। পুরনো দিনের কাঁথা স্টিচ বা পটচিত্র তাদের কাছে শুধুমাত্র বৈঠকখানা সাজানোর সৌখিন বস্তু, এর বেশি কিছু নয়। “তোর দিদিমার কথা মনে পড়ে?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন অনিন্দিতা দেবী। তার গলার স্বরে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা। প্রশ্নটা দিয়ার কাছে বেমানান এবং কিছুটা বিরক্তিকর লাগল। দিদিমা। হুগলির এক প্রায়-ভুলে-যাওয়া গ্রামের ছবি। মাটির স্যাঁতসেঁতে দাওয়ায় বসে একরাশ সাদা চুলের এক বয়স্ক মহিলা নিবিষ্ট মনে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা আঁকছেন। দিয়ার শৈশবের আবছা কিছু স্মৃতি। শেষবার সে গ্রামে গিয়েছিল ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। তারপর পড়াশোনার চাপ, কলেজের প্রোজেক্ট, নিজের জগৎ—সব মিলিয়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দিদিমা যেন তার জীবনে একটা পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠির মতো, যার কথা মনে পড়লে শুধু ধুলোর গন্ধ নাকে আসে। “হঠাৎ দিদিমার কথা?” দিয়া স্ক্রিনে জুম করে একটা রোবটের চোখে প্রতিফলিত শহরের আলো বসাচ্ছিল। তার কাছে এটাই বাস্তব, এটাই শিল্প। “এমনিই। আজ কোজাগরী পূর্ণিমা তো… তোর দিদিমা এই দিনে সারা বাড়ি আলপনা দিয়ে ভরিয়ে দিতেন। বলতেন, আজ রাতে মা লক্ষ্মী তাঁর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে ঘরে আসেন। যার ঘরের আলপনা যত সুন্দর, যত যত্ন করে আঁকা, তার ঘরে মা লক্ষ্মীর আসন তত পাকা হয়।” দিয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, যা সে লুকোনোর চেষ্টাও করল না। “মা, প্লিজ। ওসব আলপনা-ফালপনা এখন কে করে? ওটা আর্ট নয়, ওটা রিচুয়াল, কুসংস্কার। আমার কাছে আর্ট হলো এক্সপ্রেশন, ফিউচারিস্টিক ভিশন। যা নেই, তাকে কল্পনা করা। যা আছে, তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়।” “সব পুরনো জিনিস ফেলনা নয়, দিয়া,” অনিন্দিতা দেবীর গলায় এবার স্পষ্ট অভিমানের সুর। “তোর দিদিমার হাতে জাদু ছিল। উনি যখন আঁকতেন, মনে হতো ওই সাদা সরল রেখার মধ্যে উনি যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। প্রতিটা বৃত্ত, প্রতিটা রেখা যেন কথা বলত।” দিয়া আর তর্ক করল না। মায়ের এই অহেতুক আবেগ তার কাজের মনোযোগ নষ্ট করছিল। তার ফাইনাল ইয়ারের এগজিবিশন আসছে। তার ‘টেকনো-মিথ’ সিরিজের ছবিগুলো নিয়ে সে স্বপ্ন দেখছে। কলকাতার সবচেয়ে বড় আর্ট গ্যালারিতে তার একক প্রদর্শনী হবে। খবরের কাগজে তার নাম বেরোবে। এই সময় গ্রামের পুরনো বাড়ির আলপনার মতো সামান্য বিষয় নিয়ে ভাবার তার সময় কোথায়? ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই। একটা অচেনা নম্বর। মা ফোনটা ধরলেন। ফোনের ওপারে কী কথা হলো দিয়া শুনতে পেল না, কিন্তু সে দেখল তার মায়ের মুখের ভূগোলটা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। অনিন্দিতা দেবীর হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কোনোমতে সেটাকে কানে চেপে ধরলেন তিনি। তার চোখ দুটো স্থির, বিস্ফারিত। “কী হয়েছে মা?” দিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার বুকে একটা অজানা ভয় দানা বাঁধছিল। অনিন্দিতা দেবী ফ্যাকাশে মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার ঠোঁট কাঁপছিল। তিনি কিছু বলতে গিয়েও পারছিলেন না। অবশেষে ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলেন, “তোর… তোর দিদিমা আর নেই।” একটা মুহূর্ত। ঘরের ভেতর শুধু এসির একটানা শব্দ, বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ আর দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির টিকটিক শব্দ। দিয়ার কানে যেন কিছুই ঢুকছিল না। দিদিমা নেই। কথাটা একটা অর্থহীন শব্দের মতো তার মাথায় ভাসতে লাগল। যে মানুষটা তার জীবনে একটা আবছা স্মৃতির মতো ছিলেন, তার অনুপস্থিতিটা হঠাৎ করে একটা বিরাট, ঠান্ডা শূন্যতার মতো তার বুকের ভেতরটা চেপে বসল। তার ডিজিটাল ক্যানভাসের উজ্জ্বল, পরাবাস্তব শহরটা এক নিমেষে অর্থহীন, প্রাণহীন আর বিবর্ণ মনে হলো। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion