হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়া ভোরবেলার লোকাল ট্রেনটা দিয়াকে তার অপছন্দের এক জগতে নিয়ে যাচ্ছিল। কামরার জানলার ধারে বসে তার মনে হচ্ছিল সে যেন সময়ের স্রোতের বিপরীতে যাত্রা করছে। জানলার বাইরে সবুজ ধানক্ষেত হাওয়ায় দুলছে, মাঝে মাঝে রুপোলি জলের পুকুর সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠছে, আর ছোট ছোট মাটির বাড়িগুলো ছবির মতো সরে সরে যাচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো দিয়ার কাছে অচেনা, প্রায় ভিনগ্রহের দৃশ্যের মতো। তার পৃথিবী হলো কংক্রিটের জঙ্গল, ফ্লাইওভারের তীব্র বাঁক আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফের নিওন আলো।
বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকায় মা আর দিয়াকেই যেতে হচ্ছিল। অনিন্দিতা দেবী সারা রাস্তা পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখে জল ছিল কি না, দিয়া বুঝতে পারছিল না। হয়তো তিনি তার শৈশবের রাস্তায়, হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। দিয়ার একবার ইচ্ছে হলো মায়ের কাঁধে হাত রাখে, কিন্তু কী বলবে সে? যে দিদিমাকে সে প্রায় চেনেই না, তার জন্য কী সান্ত্বনা দেবে?
গ্রামের নাম ‘আমলকী’। স্টেশন থেকে টোটো করে আরও প্রায় আধ ঘণ্টা। কাঁচা রাস্তার দু’পাশে ঘন গাছের সারি। বাতাসে একটা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, যা দিয়ার অচেনা কিন্তু strangely familiar। বাড়িটা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। একটা পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি, জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে ইটের পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। লোনা ধরা দেওয়ালে শেওলার ছোপ। বাড়ির সামনে একটা বড় উঠোন, আর তার এক কোণে একটা শিউলি গাছ। ফুল ঝরে তার তলায় একটা সাদা-কমলা চাদর বিছিয়ে রেখেছে।
বাড়িতে ঢুকে দিয়ার দমবন্ধ লাগছিল। সব কিছু যেন সময়কে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো, কালো হয়ে যাওয়া কাঠের আসবাব, দেওয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পারিবারিক ছবি, আর সবকিছুর ওপর একটা হালকা ধুলোর আস্তরণ। দিদিমার শরীরটা তখন আর ছিল না, সৎকার হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা, দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা এসে সমবেদনা জানিয়ে যাচ্ছিল। দিয়া এই অচেনা মুখের ভিড়ে নিজেকে বড্ড একা, বড্ড বেমানান অনুভব করছিল। তার জিন্স আর টপ-পরা শরীরটার দিকে সবার কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে আরও সংকুচিত করে তুলছিল।
কয়েকটা দিন কেটে গেল শ্রাদ্ধশান্তির নানা আচারে। দিয়ার শহুরে মন এই ধীরগতির, অর্থহীন নিয়মকানুনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না। তার বারবার মনে হচ্ছিল, কলকাতায় তার প্রোজেক্টটা কী অবস্থায় আছে, তার বন্ধুরা কী করছে। এখানে যেন সময় থমকে গেছে।
একদিন বিকেলে, সব কাজ শেষ হওয়ার পর, যখন বাড়িটা একটু শান্ত, দিয়া একা একা দোতলায় দিদিমার ঘরে এসে ঢুকল। ঘরটা ছোট, কিন্তু আশ্চর্যরকম গোছানো। একটা পুরনো সেগুন কাঠের খাট, একটা ছোট লেখার টেবিল, আর একটা বড় জানলা, যেখান দিয়ে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত দেখা যায়। ঘরের বাতাসে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ— শুকনো ফুল, কর্পূর আর পুরনো কাগজের সম্মিলিত সৌরভ।
জানলার পাশে রাখা একটা পুরনো কাঠের সিন্দুকের ওপর দিয়ার চোখ পড়ল। সিন্দুকটা মাঝারি আকারের, তার গায়ে জটিল নকশা খোদাই করা—ফুল, লতা, আর দুটো ময়ূর। কৌতূহলবশত সে সিন্দুকের ভারী ডালাটা খুলল। একটা মৃদু ক্যাঁচ শব্দ হলো। ভেতরে ভাঁজ করে রাখা কিছু পুরনো কাঁtha আর সিল্কের শাড়ি, ন্যাপথলিনের তীব্র গন্ধ বেরিয়ে এল। সেগুলোকে সরাতেই তার হাতে ঠেকল শক্ত মতো কিছু একটা। একটা চামড়ায় বাঁধানো, বেশ ভারী খাতা।
দিয়া খাতাটা বের করে আনল। পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে, ধারে ধারে ভঙ্গুর। কিন্তু যা তাকে অবাক করল, তা হলো খাতার ভেতরের বিষয়বস্তু। প্রতিটি পাতায় হাতে আঁকা বিভিন্ন আলপনার নকশা। শুধু সাধারণ বৃত্ত বা ফুল-লতাপাতা নয়, কিছু নকশা ছিল অবিশ্বাস্যরকমের জটিল। জ্যামিতিক প্যাটার্ন, সাংকেতিক চিহ্ন, আর এমন কিছু প্রতীক যা দিয়ার চেনা শিল্পের জগতের সম্পূর্ণ বাইরে। একটা নকশায় সে দেখল, মাছের শরীরের ভেতর স্বস্তিক চিহ্ন, আরেকটায় দেখল পেঁচাকে ঘিরে থাকা তারামণ্ডলী।
প্রতিটি আলপনার পাশে ছোট ছোট অক্ষরে পুরনো বাংলায় কিছু লেখা। দিয়া ভালো করে পড়তে পারছিল না, কিন্তু কয়েকটা শব্দ উদ্ধার করতে পারল—’অমাবস্যার রাত’, ‘পূর্বমুখী দ্বার’, ‘সপ্তর্ষির দৃষ্টি’, ‘মনসার ঝাঁপি’।
দিয়ার শিল্পীমন প্রথমবার সচকিত হয়ে উঠল। এগুলো শুধু আলপনা নয়, এর মধ্যে একটা গভীরতর শৃঙ্খলা আছে, একটা ডিজাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে, যা সে কোনোদিন দেখেনি। তার মনে হলো, এই নকশাগুলোর মধ্যে কোনো গোপন অর্থ, কোনো হারানো জ্ঞান লুকিয়ে আছে। সে খাতাটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল, যেন কোনো গুপ্তধন পেয়েছে। তার মনে হলো, সে যেন তার দিদিমাকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছে। যে মানুষটাকে সে শুধু একজন সাধারণ গ্রাম্য বৃদ্ধা বলে ভেবে এসেছিল, তার ভেতরে যে এত বড় একজন শিল্পী, একজন গণিতবিদ লুকিয়ে ছিলেন, তা সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion