Episode 131359 words0 views

ত্রয়োদশ অধ্যায় : গল্পকারের প্রত্যাবর্তন

অনুশোচনার গোলকধাঁধা পেছনে ফেলে কিংশুক-রূপী জোনাকির সবুজ আলো তাদের এক বিশাল, গোলাকার সভাগৃহে নিয়ে এল। এটা ছিল দুর্গের কেন্দ্র, ছায়াপতির হৃৎপিণ্ড। এখানকার নিস্তব্ধতা ছিল অসংবেদী। বাতাস এত ভারী ছিল যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। সভাগৃহের ঠিক মাঝখানে ছিল একটা সিংহাসন। সিংহাসনটা কোনো ধাতু বা পাথর দিয়ে তৈরি নয়, বরং জমাট বাঁধা লক্ষ কোটি দীর্ঘশ্বাস আর না-ফেলা চোখের জল দিয়ে গড়া। তার আকার ক্রমাগত পরিবর্তনশীল —কখনো সেটা কাঁটাওয়ালা, তো কখনো অজগরের মতো প্যাঁচানো। সিংহাসনটা ঘরের সমস্ত আলো, সমস্ত আশা শুষে নিচ্ছিল। আর সেই সিংহাসনে বসেছিল ছায়াপতি। সে আর শুধু একটা অবয়বহীন ছায়ামূর্তি ছিল না। অন্ধকারের ভেতরে ফুটে উঠেছিল এক তরুণের চেহারা—মনন। কিন্তু এ সেই সৃষ্টির আনন্দে ভরপুর মনন নয়। তার মুখ ছিল যন্ত্রণায় বিকৃত, চোখ দুটো ছিল দুটো গভীর, আলোহীন কুয়োর মতো, আর তার কাঁধ দুটো ছিল হতাশার ভারে ঝুঁকে পড়া। সে ছিল একটা জীবন্ত ক্ষত। সিংহাসনের ঠিক পাশেই ছিল একটা খাঁচা। খাঁচাটা তৈরি হয়েছিল কালো, কাঁটাওয়ালা লতা দিয়ে, যা দেখে মনে হচ্ছিল জমাট বাঁধা ঘৃণা দিয়ে তৈরি। আর সেই খাঁচার ভেতরে, একটা দুর্বল, মিটমিটে আলো জ্বলছিল-নিভছিল। দিয়া বুঝতে পারল, ওটাই ‘আলোর পাখি’। সে এতটাই দুর্বল যে তার আসল রূপ আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা আলোর স্পন্দন ছাড়া। “এসেছিস,” ছায়াপতির কণ্ঠস্বর এবার আর মনের ভেতর নয়, ঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। তার স্বরে ছিল শীতল, ব্যঙ্গাত্মক সুর। “শেষ পর্যন্ত আমার হতাশার কেন্দ্রে এসে পৌঁছালি। কী ভেবেছিলি? এখানে এসে আমাকে যুদ্ধ করে হারাবি?” ছায়াপতি তার হাতটা তুলল। সঙ্গে সঙ্গে দিয়ার চোখের সামনে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য ভেসে উঠল—তার নিজের শহর কলকাতা। সেই ধূসর কুয়াশা এখন আরও ঘন হয়ে কলেজ স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড চত্বর গ্রাস করে ফেলেছে। মানুষজন একে অপরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। তাদের মুখে কোনো অনুভূতি নেই। দিয়া দেখল, তার নিজের মা-ও সেই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তার মুখটাও ভাবলেশহীন। “দেখ,” ছায়াপতি বলল। “এটাই ভবিষ্যৎ। অনুভূতিহীন, গল্পহীন এক জগৎ। কোনো কষ্ট নেই, কোনো আনন্দও নেই। শুধু শান্তি। আমি তোদের মুক্তি দিচ্ছি। আর তুই ভাবছিস, একটা পুরনো আলপনা এঁকে এই শান্তিকে তুই নষ্ট করে দিবি?” দিয়ার আত্মবিশ্বাস টলে গেল। তার মায়ের মুখটা দেখে তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। সে কি সত্যি পারবে? সে কি ঠিক কাজ করছে? দিয়া ছায়াপতির ফাঁদে প্রায় পা দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ঠিক তখনই জোনাকি-রূপী কিংশুক উড়ে এসে তার হাতে বসল। তার ছোট্ট, সবুজ আলোটা ছিল দুর্বল, কিন্তু স্থির। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে দিয়ার মনে পড়ল, সে এখানে যুদ্ধ করতে আসেনি। সে এসেছে একটা গল্প শেষ করতে। সে ছায়াপতির চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। “তুমি মুক্তি দিচ্ছ না, তুমি কেড়ে নিচ্ছ। গল্প ছাড়া, কল্পনা ছাড়া আমরা মানুষ নই, আমরা শুধু যন্ত্র।” সে আর তর্ক করল না। সে তার ঝোলা থেকে শেষ সম্বল—এক টুকরো সাদা খড়িমাটি বের করল। হতাশার সিংহাসনের চারপাশে, কালো, প্রাণহীন মেঝেতে সে আঁকতে শুরু করল। এটা দিদিমার খাতার কোনো আলপনা ছিল না। এটা ছিল দিয়ার নিজের সৃষ্টি। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম। সে কোনো সুরক্ষার চিহ্ন আঁকল না, কোনো শক্তির প্রতীকও আঁকল না। সে আঁকল মননের ভুলে যাওয়া গল্পগুলোকে। তার খড়িমাটির টানে ফুটে উঠল সেই ‘ঘুম-পাখি’, যার গান শুনলে শিশুরা হাসিমুখে ঘুমিয়ে পড়ত। ফুটে উঠল সেই ‘সাহসী জোনাকি’, যে তার ছোট্ট আলো দিয়ে অমাবস্যার অন্ধকার দূর করত। সে আঁকল সেইসব চরিত্রদের, যারা ‘বিস্মৃত স্বপ্নের প্রান্তর’-এ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল—এবার তাদের মুখে ছিল হাসি, তাদের অপূর্ণতাগুলো সম্পূর্ণ। দিয়া তার শিল্পীমনের সমস্ত সহানুভূতি, সমস্ত মমতা ঢেলে দিয়ে সেইসব ভুলে যাওয়া গল্পগুলোকে আবার প্রাণ দিচ্ছিল। সে তাদের মনে করছিল, আর তাই তারা আবার জীবন্ত হয়ে উঠছিল। “বন্ধ কর!” ছায়াপতি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। এই ছবিগুলো ছিল তার সবচেয়ে গভীর ক্ষত, তার সবচেয়ে বড় অনুশোচনা। সে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াল। তার শরীর থেকে বেরিয়ে এল অন্ধকারের তীব্র ঢেউ, যা দিয়াকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে কিংশুক তার জোনাকি রূপ ত্যাগ করে নিজের রূপে ফিরে এল। সে তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে দিয়ার সামনে একটা সবুজ আলোর দেওয়াল তৈরি করল। অন্ধকারের ঢেউটা সেই দেওয়ালে আছড়ে পড়ে প্রতিহত হলো। “আঁকতে থাকো, দিয়া!” কিংশুক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। তার শরীরটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছিল। “গল্পটাকে শেষ করো!” দিয়া আঁকতে লাগল। তার আঁকা আলপনা থেকে একটা নরম, সোনালী আলো বেরিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই আলো ছিল স্মৃতির আলো, ভালোবাসার আলো। সেই আলো ধীরে ধীরে কাঁটাওয়ালা খাঁচাটার দিকে এগিয়ে গেল। আলোর স্পর্শে খাঁচার কাঁটালতাগুলো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল। সেগুলো আর ঘৃণা দিয়ে তৈরি ছিল না, সেগুলো ছিল স্রষ্টার যন্ত্রণা দিয়ে গড়া। আর ভালোবাসার স্পর্শে সেই যন্ত্রণা গলে যেতে লাগল। খাঁচাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ‘আলোর পাখি’ এবার মুক্ত। সে তখনও দুর্বল, কিন্তু সে তার হীরের মতো পালকগুলো ঝাড়া দিয়ে উঠল। ডানা মেলে সে উড়ে গিয়ে সিংহাসনের উপরে বসল। সে ছায়াপতি/মননের দিকে তাকাল। তার নীলকান্ত মণির মতো চোখে কোনো ঘৃণা ছিল না, ছিল শুধু গভীর করুণা। পাখিটা গান ধরল। কিন্তু সে কোনো শক্তির গান গাইলো না, কোনো বিজয়ের সঙ্গীত নয়। সে গাইতে শুরু করল একটা নরম, শান্ত ঘুমপাড়ানি গান। সেই গান, যা মনন তাকে প্রথম সৃষ্টি করার পর শুনিয়েছিল। আরোগ্যের গান, ক্ষমার গান। সেই গান দুর্গের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ল। হতাশার দেওয়াল কাঁপতে শুরু করল। অনুশোচনার কাঁচের দেওয়ালে ফাটল ধরল। দিয়ার দেখা সেই কলকাতার দৃশ্য থেকে ধূসর কুয়াশা সরে যেতে লাগল, তার মায়ের মুখে আবার চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। “থামাও… এই গান…” ছায়াপতি তার দুই কানে হাত চাপা দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। তার শরীরটা কাঁপছিল। তার ছায়ারূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল মননের যন্ত্রণাকাতর মুখ। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ছায়া আর আলোর অশ্রু। দিয়া তার আলপনার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিল। সে ধীরে ধীরে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। সে ছায়াপতির মধ্যে আর কোনো ভয়ঙ্কর শত্রুকে দেখল না। সে দেখল একজন প্রতিভাবান, কিন্তু পথ হারানো শিল্পীকে। “তোমার গল্প এখনও শেষ হয়নি, মনন,” দিয়া নরম গলায় বলল। “একটা গল্প তখনই শেষ হয়, যখন সেটা বলার মতো আর কেউ থাকে না। আর আমি তোমার গল্প বলব। আমরা সবাই বলব।” সে তার আলপনার শেষ, ফাঁকা জায়গাটার কাছে এসে দাঁড়াল। গল্পটাকে শেষ করতে হবে। একটা নতুন সমাপ্তি দিতে হবে। সে মনন আর আলোর পাখির দিকে তাকাল। তারপর খড়িমাটি দিয়ে শেষ ছবিটা আঁকল। সে কোনো সমাপ্তি আঁকল না, সে আঁকল এক নতুন শুরু। সে আঁকল, মনন তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর আলোর পাখি উড়ে এসে বসছে তার হাতে। পুনর্মিলন আর ক্ষমার এক সহজ, সুন্দর ছবি। যে মুহূর্তে ছবিটা আঁকা সম্পূর্ণ হলো, আলোর পাখির গান তার সর্বোচ্চ সুরে পৌঁছাল। পাখিটার শরীর থেকে বেরিয়ে এল সোনালী আলোর এক তীব্র, কিন্তু স্নিগ্ধ বিস্ফোরণ। সেই আলোয় সারা দুর্গ ভেসে গেল। কিন্তু সেই আলো অন্ধকারকে ধ্বংস করল না। সেই আলো অন্ধকারকে আরোগ্য করল। ছায়ারা আর ছায়া রইল না, তারা আবার রঙ, সুর আর অসমাপ্ত গল্পে পরিণত হয়ে দুর্গের ভাঙা দেওয়াল দিয়ে আকাশের দিকে উড়ে গেল। সিংহাসনের উপর বসা মূর্তিটা আর ছায়াপতি ছিল না। সে ছিল মনন, সেই তরুণ গল্পকার। ক্লান্ত, বিষণ্ণ, কিন্তু আবার সম্পূর্ণ। তার চোখের গভীর অন্ধকার কেটে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছিল ভোরের আকাশের মতো এক নরম আলো। কল্পলোক ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল। আকাশে আবার পটচিত্রের রঙ ফিরে আসছিল। টেরাকোটা গ্রামের বাসিন্দাদের মুখে হাসি ফুটেছিল। ‘রূপকথা’ নদীর জল আবার স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিল। মনন এখন ‘বিস্মৃত স্বপ্নের প্রান্তর’-এর রক্ষক। সে সেইসব অসমাপ্ত গল্পদের সাহায্য করে তাদের নিজেদের সমাপ্তি খুঁজে পেতে। বেঙ্গমা-ঠাকুরের আশ্রমে দিয়া আর কিংশুক ফিরে এল। কিংশুক আবার তার আগের রূপে, আগের উচ্ছলতায় ফিরে গেছে। বেঙ্গমা-ঠাকুরের মুখে ছিল শান্ত হাসি। “তুমি শুধু কল্পলোককে বাঁচাওনি, দিয়া,” তিনি বললেন। “তুমি দুই জগৎকেই শিখিয়েছ যে, পুরনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকে পাওয়া যায় না। পুরনো আর নতুনকে একসাথে হাত মিলিয়ে চলতে হয়।” দিয়ার সামনে ফুটে উঠল তার চেনা সেই আলোর দরজা। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। সে কিংশুক আর বেঙ্গমা-ঠাকুরের থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে কিংশুক তার হাতে একটা ছোট্ট কাঠের বাঁশি তুলে দিয়ে বলল, “যখন নিজেকে একা মনে হবে, এটা বাজিও। কল্পলোকের হাওয়া তোমার কাছে ঠিক পৌঁছে যাবে।” দিয়া দরজার ওপারে পা রাখতেই নিজেকে আবিষ্কার করল দিদিমার সেই পুরনো ঘরে। ভোরের আলো ফুটেছে। মেঝের আলপনাটা এখন শুধু চালের গুঁড়োর দাগ। সব কিছু কি স্বপ্ন ছিল? কিন্তু তার হাতের মুঠোর মধ্যে সে অনুভব করল একটা ছোট্ট, মসৃণ কাঠের বাঁশি। আর তার ঝোলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা মৃদু নীল আভা—’আনন্দ মঞ্জরী’ ফুলটা তখনও ফুরোয়নি। কলকাতায় ফিরে আসার পর সবাই তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করল। সে আর অধৈর্য, আত্মকেন্দ্রিক মেয়েটা নেই। সে মন দিয়ে মায়ের কথা শোনে, বাবার সাথে তার ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করে। সে তার দিদিমার রেখে যাওয়া জিনিসগুলো নতুন শ্রদ্ধার সাথে দেখে। তার ফাইনাল এগজিবিশনের দিন এল। গ্যালারির একদিকে ছিল তার সেই চোখ ধাঁধানো ‘টেকনো-মিথ’ সিরিজের ডিজিটাল প্রিন্ট। কিন্তু গ্যালারির অন্য দিকটা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। সেখানে ছিল ক্যানভাসের উপর হাতে আঁকা ছবি। পটচিত্রের আকাশ, টেরাকোটার গাছ, সাহসী জোনাকি আর এক বহুরূপী বন্ধুর ছবি। আর ঠিক মাঝখানে ছিল সবচেয়ে বড় ক্যানভাসটা—এক তরুণ গল্পকার, যার হাতে বসে আছে এক আলোর পাখি। গল্পটি এখানেই শেষ।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion