পুঁথি-পাঠাগারের অক্ষর-তোরণ পেছনে মিলিয়ে যেতেই দিয়া আর কিংশুক এক নতুন, ভয়ঙ্কর জগতে পা রাখল। এখানকার আকাশটা ছিল বিবর্ণ ধূসর, যেন কেউ একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে সব রঙ মুছে দিয়েছে। বাতাসটা ছিল স্থির ও ভারী, তাতে কোনো গন্ধ ছিল না, কোনো শব্দও ছিল না। এটা ছিল ছায়াপতির রাজ্য।
তাদের পায়ের তলার মাটি ছিল নরম, ধূসর ছাইয়ের মতো। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অদ্ভুত সব অসমাপ্ত জিনিস। তারা দেখল, একটা সিঁড়ি অর্ধেক তৈরি হয়ে আকাশে উঠে গেছে এবং তারপর হঠাৎ শেষ। তারা শুনল, একটা গানের সুর বারবার শুরু হচ্ছে, কিন্তু দুটো লাইনের পরই থেমে যাচ্ছে। তারা দেখল, গল্পের চরিত্ররা—যাদের কাহিনী কোনোদিন লেখা হয়নি—এখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা ডানাওয়ালা বাঘ, যার শুধু একটা ডানা গজিয়েছে; একজন রাজপুত্র, যে তার রাজকন্যার নামটাই ভুলে গেছে; একটা একপেয়ে ভূত, যে লাফাতে লাফাতে কাঁদছে।
“এটা ‘বিস্মৃত স্বপ্নের প্রান্তর’,” কিংশুক ফিসফিস করে বলল। তার গলার স্বরেও যেন জোর নেই। “মানুষলোকে যত কল্পনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তারা সবাই এখানে এসে জমা হয়।”
এই পরিবেশটা দিয়ার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছিল। তার নিজের মনের ভেতরকার সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত আত্মসংশয় যেন এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল, তার ‘টেকনো-মিথ’ সিরিজটাও একদিন এই প্রান্তরে একটা অসমাপ্ত ছবির মতো ভেসে বেড়াবে। তার শিল্পীসত্তার সবচেয়ে বড় ভয়—তার শিল্পকর্মের কোনো অর্থ খুঁজে না পাওয়া—তাকে ঘিরে ধরছিল।
কিংশুকের অবস্থাও ভালো ছিল না। সে তার রূপ বদলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এই প্রাণহীন, গল্পহীন জগতে সে অনুপ্রেরণা খুঁজে পাচ্ছিল না। সে অসহায়ভাবে বলল, “আমি… আমি কিছু অনুভব করতে পারছি না, দিয়া। এখানে কোনো গল্প নেই, তাই কোনো রূপও নেই।”
তারা সাবধানে এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ দিয়ার পা নরম মাটিতে ডুবে গেল। সে চিৎকার করে উঠল। কিংশুক তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। “সাবধান! এগুলো ‘স্মৃতির চোরাবালি’!” সে বলল। “এখানে পা দিলে অন্যাদের ভুলে যাওয়া দুঃখে তুমি চিরকালের জন্য আটকে পড়বে।”
দিয়া দেখল, বালির নিচে থেকে হাজার হাজার ব্যথিত মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার সমস্ত মানসিক শক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাল—এটা তার দুঃখ নয়। সে একজন রক্ষক, তাকে অন্যের দুঃখে ডুবে গেলে চলবে না, তাকে দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। এই ভেবে সে জোরে এক झটকা দিয়ে নিজের পা-টা বের করে আনল।
বহুক্ষণ হাঁটার পর, দিগন্তে তারা দেখতে পেল ছায়াপতির দুর্গ। দুর্গটা কোনো পাথর বা ইট দিয়ে তৈরি নয়। ওটা তৈরি হয়েছে জমাট বাঁধা হতাশা আর যন্ত্রণা দিয়ে। তার কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। এক মুহূর্ত সেটাকে একটা কাঁটাওয়ালা সিংহাসনের মতো দেখাচ্ছে, তো পরমুহূর্তেই সেটা একটা আর্তনাদ করা মুখের মতো হয়ে যাচ্ছে। দুর্গের চূড়া থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে ধূসর বরফকণা—যা আসলে ভুলে যাওয়া চোখের জল।
দুর্গের কোনো দরজা বা প্রবেশপথ ছিল না। পুরোটাই একটা মসৃণ, দুর্ভেদ্য দেওয়ালের মতো।
“এর ভেতরে আমরা ঢুকব কী করে?” দিয়া হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“জানি না,” কিংশুক উত্তর দিল। “এর কোনো দরজা নেই কারণ হতাশার জগতে কেউ প্রবেশ করতে চায় না, শুধু আটকে পড়ে।”
তারা যখন উপায় খুঁজছে, তখন দুর্গের দেওয়ালটা কেঁপে উঠল। দেওয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর মূর্তি। সেটার কোনো শরীর নেই, আছে শুধু একটা বিশাল হাঁ করা মুখ, যা থেকে বেরিয়ে আসছে হাজার হাজার শিল্পীর ব্যর্থতার আর্তনাদ।
“ও হলো ‘গর্জন’!” কিংশুক ভয়ে পিছিয়ে গেল। “ওর শক্তি হলো আমাদের আত্মসংশয়। আমরা যত ভয় পাব, ও তত শক্তিশালী হবে।”
‘গর্জন’ তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তার চিৎকারে দিয়ার মনে হচ্ছিল, তার মাথাটা ফেটে যাবে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার জীবনের সব ব্যর্থতা—যে ছবিটা সে শেষ করতে পারেনি, যে পুরস্কারটা সে পায়নি, যে প্রশংসাটা সে আশা করেছিল কিন্তু পায়নি।
সে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই তার মনে পড়ল পুঁথি-পাঠাগারের কথা। ধ্বংস দিয়ে নয়, সৃষ্টি দিয়ে জয় করতে হবে। সে তার ঝোলা থেকে এক টুকরো সাদা খড়িমাটি বের করল, যা সে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল।
সে ‘গর্জন’-এর দিকে পিঠ ফিরে দুর্গের দুর্ভেদ্য দেওয়ালে আঁকতে শুরু করল। সে কোনো অস্ত্র আঁকল না, কোনো বর্মও আঁকল না। কাঁপা কাঁপা হাতে সে আঁকল একটা খুব সাধারণ দৃশ্য—তার দিদিমা উঠোনে বসে মন দিয়ে একটা ছোট্ট কলমিলতার আলপনা আঁকছেন। সেই ছবিতে কোনো বিশালতা ছিল না, ছিল শুধু পবিত্র ভালোবাসা আর সৃষ্টি করার আনন্দ।
যে মুহূর্তে ছবিটা আঁকা শেষ হলো, এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সেই ছোট্ট আলপনার ছবিটা থেকে একটা নরম, সাদা আলো বেরিয়ে এসে দেওয়ালের উপর ছড়িয়ে পড়ল। ‘গর্জন’ সেই আলোর দিকে তাকিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। আত্মসংশয় আর হতাশা, পবিত্র সৃষ্টির আলোর সামনে এক মুহূর্তও টিকতে পারল না। সে আবার দেওয়ালের ভেতরে মিলিয়ে গেল। আর দিয়ার আঁকা ছবিটার জায়গায়, দেওয়ালে একটা ছোট, আলোর দরজা খুলে গেল।
তারা আলোর দরজা দিয়ে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে আরও অন্ধকার, আরও ঠান্ডা। তারা নিজেদেরকে একটা গোলকধাঁধার মধ্যে খুঁজে পেল। এর দেওয়ালগুলো পাথর বা ইটের নয়, বরং কাঁচের মতো স্বচ্ছ। আর সেই কাঁচের ভেতরে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার চলমান দৃশ্য—মননের জীবনের সমস্ত অনুশোচনা।
তারা দেখল, একটা বাচ্চা ছেলে তার আঁকার খাতাটা তার বাবাকে দেখাচ্ছে, কিন্তু তার বাবা ব্যবসার কাগজপত্রে এতই ব্যস্ত যে মুখ তুলে তাকাচ্ছেও না। তারা শুনল, একজন তরুণ লেখক তার প্রথম পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে প্রকাশকের কাছে গেছে, আর প্রকাশক পাণ্ডুলিপিটা না পড়েই ফিরিয়ে দিচ্ছে। তারা অনুভব করল, একজন বৃদ্ধ গল্পকারের যন্ত্রণা, যার নাতি-নাতনিরা তার গল্প শোনার বদলে মোবাইলে খেলা করতে ব্যস্ত।
“এইসব… এইসবই মননের স্মৃতি,” কিংশুক ফিসফিস করে বলল।
এই দৃশ্যগুলো দিয়ার মনকেও প্রভাবিত করছিল। তার নিজের জীবনের অনুশোচনাগুলোও তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল—কেন সে দিদিমার সাথে আর একটু বেশি সময় কাটায়নি, কেন সে মায়ের আবেগকে কোনোদিন গুরুত্ব দেয়নি, কেন সে নিজের শিল্পকে এত অহঙ্কারের সাথে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে এসেছে। এই অনুশোচনার ভারে তার পা দুটো ভারী হয়ে আসছিল। সে আর এগোতে পারছিল না।
“দিয়া, ওদের দিকে তাকিয়ো না!” কিংশুক চিৎকার করল। “ওগুলো তোমাকে আটকে ফেলবে!”
কিন্তু দিয়া ততক্ষণে অনুশোচনার জালে জড়িয়ে পড়েছে। সে দেওয়ালের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।
কিংশুক মরিয়া হয়ে উঠল। সে কী করবে? তার তো রূপ বদলানোর শক্তিও কাজ করছে না। হঠাৎ তার মনে পড়ল পুঁথি-পাঠাগারে দেখা একটা অসমাপ্ত গল্পের কথা—’সাহসী জোনাকি’র গল্প। যে তার ছোট্ট আলো দিয়ে অন্ধকার দূর করত।
কিংশুক তার সমস্ত শক্তি এক জায়গায় জড়ো করল। সে একটা বিশাল বাঘ বা ভালুক হওয়ার চেষ্টা করল না। বদলে, সে নিজেকে একটা ছোট্ট, মিটমিটে আলো ছড়ানো জোনাকি পোকায় পরিণত করল। তার শরীরটা ছিল প্রায় স্বচ্ছ, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা নরম, সবুজ আভা।
সেই জোনাকিটা উড়ে গিয়ে দিয়ার সামনে বসল। তার ছোট্ট, মৃদু আলোটা দিয়ার চোখের জলকে উজ্জ্বল করে তুলল। সেই আলোয় কোনো তেজ ছিল না, ছিল শুধু আশ্বাস। দিয়ার ঘোরটা কেটে গেল। সে দেখল, এই ছোট্ট আলোটা মননেরই একটা ভুলে যাওয়া সৃষ্টি। একটা ছোট্ট আশা, যা এখনও তার মনের গভীরে কোথাও টিকে আছে।
“কিংশুক?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
জোনাকিটা একবার জ্বলে-নিভে যেন উত্তর দিল।
“আমাদের পথ দেখাও, সাহসী জোনাকি,” দিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
কিংশুক-রূপী জোনাকিটা এবার গোলকধাঁধার অন্ধকার পথের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলল। তার ছোট্ট সবুজ আলোটা অনুশোচনার অন্ধকারকে পুরোপুরি দূর করতে পারছিল না, কিন্তু তা পথ দেখানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। দিয়া সেই ছোট্ট আশার আলোকে অনুসরণ করে গোলকধাঁধার আরও গভীরে এগিয়ে চলল—দুর্গের একেবারে কেন্দ্রের দিকে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion