রাতুল বোস একা থাকতো। বেহালার এক পুরনো পাড়ার, একচিলতে একটা ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট না বলে স্টুডিও বলাই ভালো। একটা ঘরেই তার থাকা, খাওয়া, ঘুম আর কাজ। ঘরটার দুটো দেয়াল জুড়ে শুধু ছবি। সাদা-কালোয় ধরা কলকাতা। রাতুলের কলকাতা।
রাতুল একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। তবে দিনের বেলার ভিড়, ধুলো, ব্যস্ততা তার ভালো লাগে না। সে নিশাচর। তার ক্যামেরা জেগে ওঠে যখন শহর ঘুমিয়ে পড়ে। তার প্যাশন হলো— "Kolkata Nocturne" — রাতের কলকাতার আলো-আঁধারি, তার নির্জন রাস্তা, তার প্রাচীন স্থাপত্য। রাতুল বিশ্বাস করে, দিনের আলোয় শহরটা একটা মুখোশ পরে থাকে; তার আসল রূপ দেখা যায় শুধু চাঁদের আলোয় বা সোডিয়াম ল্যাম্পের হলদেটে আভায়।
তার সঙ্গী বলতে তার মিররলেস ক্যামেরা (একটি সনি আলফা সেভেন আর ফোর), একটা দামী ম্যানফ্রেটো ট্রাইপড, আর একটা পুরনো রয়্যাল এনফিল্ড। রাত এগারোটা বাজলেই সে বেরিয়ে পড়তো। গঙ্গার ঘাট, কুমোরটুলি, সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি, উত্তর কলকাতার গলি-ঘুঁজি— কিছুই তার লেন্সের নজর এড়ায়নি।
সেদিন ছিল অগ্রহায়ণের শেষ দিক। একটা পাতলা কুয়াশার চাদর শহরটাকে ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে। শীতের এই সময়টা রাতুলের সবচেয়ে প্রিয়। কুয়াশা আলোকে নরম করে দেয়, সবকিছুর চারপাশে একটা রহস্যময় আভা তৈরি করে।
রাতুল ঠিক করলো, আজ সে এসপ্ল্যানেড চত্বরটা ধরবে। ভিক্টোরিয়া, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল হয়ে সে বাইক রাখলো নিউ মার্কেটের কাছে। ট্রাইপড আর ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলো।
চৌরঙ্গীর নিওন সাইনগুলো কুয়াশায় কেমন যেন অமானுষিক দেখাচ্ছিল। ফাঁকা রাস্তায় মাঝে মাঝে এক-আধটা ট্যাক্সি বা পুলিশের জিপ ছুটে যাচ্ছে। রাতুল বেশ কিছু লং এক্সপোজার শট নিলো। গাড়ির হেডলাইটের লাল-সাদা রেখাগুলো ছবির ক্যানভাসে ফুটে উঠছিল। মেট্রো সিনেমার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে একটা ছবি তুলল। নিয়ন আলো ভেজা পিচঢালা রাস্তায় প্রতিফলিত হয়ে একটা অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট তৈরি করেছে।
রাত তখন প্রায় দুটো। সে টিপু সুলতান মসজিদের দিক থেকে এগিয়ে একটা অচেনা গলিতে ঢুকে পড়লো। সরু গলি, স্যাঁতস্যাঁতে। দুপাশের পুরনো বাড়িগুলো যেন একে অপরের গায়ে হেলে পড়েছে। একটা অদ্ভুত ভ্যাপসা গন্ধ। কর্পোরেশনের আবর্জনা পরিষ্কার হয়না বললেই চলে। গলির শেষে একটা ভাঙা খিলান (archway) দেখা যাচ্ছে, তার ওপাশে হয়তো বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো গুদাম।
রাতুল উত্তেজনা বোধ করলো। এইরকম ফ্রেমই তো সে খোঁজে। এই গলিগুলোতেই কলকাতার আসল আত্মা লুকিয়ে থাকে।
সে ট্রাইপড সেট করলো। ক্যামেরার সেটিংস ঠিক করলো—শাটার স্পিড ১০ সেকেন্ড, অ্যাপারচার f/8, আইএসও (ISO) ১০০। ম্যানুয়াল ফোকাস ঠিক করে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলো। তার ক্যামেরাটা হাই-এন্ড মডেল; ইলেকট্রনিক ভিউফাইন্ডার (EVF) রাতের অন্ধকারকেও দিনের মতো স্পষ্ট করে তোলে।
খিলানটাকে ফ্রেমে এনে সে শাটার বাটনটা অর্ধেক চাপলো ফোকাস লক করার জন্য। আর ঠিক তখনই সে দেখলো।
খিলানটার ঠিক মাঝখানে, অন্ধকারের মধ্যে, একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
ছায়াটা ঠিক মানুষের মতোই লম্বা, কিন্তু কেমন যেন চ্যাপ্টা আর স্থবির। রাতুল চোখ সরালো ভিউফাইন্ডার থেকে।
খালি চোখে কিচ্ছু নেই।
শুধু স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, খসে পড়া পলেস্তারা। হাওয়াটাও বন্ধ। রাতুল ভুরু কোঁচকালো। "কোনো মূর্তিও তো নেই," সে বিড়বিড় করলো। আবার ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলো।
আছে। ছায়ামূর্তিটা ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। একচুল নড়ছে না।
রাতুল লেন্সটা খুলে फूঁ দিয়ে পরিষ্কার করলো। আবার লাগালো। না, ওটা দাগ নয়। সে ক্যামেরার সেটিংস চেক করলো। আইএসও বাড়িয়ে ৬৪০০ করলো। ভিউফাইন্ডারের ছবিটা আরও উজ্জ্বল হলো, কিন্তু ছায়াটা একইরকম কালো রয়ে গেলো। এটা লেন্স ফ্লেয়ারও নয়, কারণ উল্টো দিক থেকে কোনো জোরালো আলো আসছে না।
"সেন্সর গ্লিচ," রাতুল বিড়বিড় করলো। "অতিরিক্ত লো-লাইটে কাজ করতে করতে হট পিক্সেল বা সেন্সর গরম হয়ে গেছে।" এটা মাঝে মাঝে হয়।
সে ঠিক করলো, গ্লিচ সমেতই ছবিটা তুলবে। পরে পোস্ট-প্রসেসিং-এ ক্লোন স্ট্যাম্প টুল দিয়ে ওটা মুছে দেবে। সে শাটার টিপলো। ক্লিক। দশ সেকেন্ডের লং এক্সপোজার।
ছবিটা প্রসেস হওয়ার পর সে ক্যামেরার এলসিডি স্ক্রিনে দেখলো। হ্যাঁ, ছবিটা এসেছে। খিলানের ভেতরের অন্ধকার détails দারুণভাবে ধরা পড়েছে। আর... তাতে ওই ছায়ামূর্তিটাও স্পষ্ট। ভীষণভাবে স্পষ্ট।
বুকটা হঠাৎ করে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। একটা হিমেল স্রোত যেন শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেলো। একটা ছবি তোলার পর 'গ্লিচ' এত স্পষ্ট থাকার কথা নয়। রাতুল ঠিক বুঝতে পারলো না কেন, কিন্তু তার মনে হলো এই গলিতে আর এক মুহূর্তও থাকা উচিত নয়।
সে চটপট ট্রাইপড গুটিয়ে প্রায় দৌড়েই গলি থেকে বেরিয়ে এলো। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার সময় সে আড়চোখে গলিটার দিকে তাকালো। অন্ধকার। নির্জন। কিচ্ছু নেই।
"মনের ভুল," নিজেকে বোঝালো রাতুল। "বেশি রাত জাগলে এরকমই হয়। বাড়ি গিয়ে কফি খেতে হবে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion