Episode 2483 words3 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: ফ্রেমের মধ্যে

ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে। রাতুলের রুটিন বাঁধা। ফিরেই আগে কার্ড রিডার দিয়ে সব ছবি কম্পিউটারে ট্রান্সফার করা। তারপর এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি নিয়ে সে বসলো ছাব্বিশ ইঞ্চির মনিটরে ছবিগুলো বাছতে। ভিক্টোরিয়ার ছবিগুলো দারুণ এসেছে। কুয়াশার মধ্যে গম্বুজটা যেন ভেসে আছে। ক্যাথিড্রালের ছবিগুলোও ভালো। তারপর এলো সেই গলির ছবিগুলো। প্রথম ছবিটা সে অ্যাডোবি লাইটরুমে (Adobe Lightroom) খুললো। জুম করলো। হ্যাঁ, ওই তো। খিলানের নিচে ছায়ামূর্তিটা। রাতুল ছবিটার এক্সপোজার (Exposure) আর শ্যাডো (Shadow) স্লাইডারগুলো বাড়িয়ে দিলো। ছায়াটা স্পষ্ট হলো। এটা কোনো সাধারণ ছায়া নয়। এর একটা আকার আছে। একটা লম্বাটে মুখ, কাঁধ, কিন্তু কোনো হাত-পা বা পোশাকের ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে না। যেন কেউ একটা কালো আলখাল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, ছায়াটার কোনো মুখ নেই। শুধু একটা মসৃণ, অন্ধকার শূন্যতা। রাতুল পরের ছবিতে গেলো। এটা সে গলি থেকে বেরোনোর সময় ট্রাইপড হাতে নিয়েই তুলেছিল (handheld shot)। ফ্রেমটা একটু কেঁপে গেছে। খিলানটা ফ্রেমের একপাশে। কিন্তু ছায়ামূর্তিটা... সেটা আর খিলানের নিচে নেই। সেটা গলির মুখে, কয়েক কদম এগিয়ে এসেছে। রাতুলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। "এটা কী করে সম্ভব? আমি তো সরে এসেছিলাম।" সে মাউসের হুইল ঘোরালো। পরের ছবি। এটা সে তুলেছিল গলির ঠিক বাইরে, মেইন রোডের ল্যাম্পপোস্টটার। ছায়ামূর্তিটা এখন গলির বাইরে, ল্যাম্পপোস্টের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে সে ছবিটা তুলেছিল, তার থেকে মাত্র দশ ফুট দূরে। রাতুলের হাত কাঁপতে শুরু করেছে। সে বুঝতে পারছিল, এটা গ্লিচ নয়। সে ফোল্ডারে ফিরে গেলো। সেই রাতের সমস্ত ছবি সে টাইমস্ট্যাম্প (Timestamp) অনুযায়ী সাজালো। মোট বিয়াল্লিশটা ছবি। এক... দুই... তিন... সে অবিশ্বাসের সাথে একটার পর একটা ছবি ক্লিক করে যেতে লাগলো। খিলানের ছবিটা ছিল রাত ১:৫২ মিনিটে। ল্যাম্পপোস্টের ছবিটা রাত ১:৫৩ মিনিটে। পরের ছবিটা সে তুলেছিল দশ মিনিট পর, চৌরঙ্গী রোডের ওপর। একটা ডবল ডেকার বাসের। বাসের ছবিটা সে জুম করলো। বাসের জানলার কাচে, রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িগুলোর আবছা প্রতিবিম্বের মধ্যে, ওটা দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামূর্তিটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে রাতুলের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে এক এক করে বাকি সব ছবি দেখলো। পার্ক স্ট্রিটের ছবি। ভিক্টোরিয়ার গেটের ছবি। প্রত্যেকটা ছবিতে, কোথাও না কোথাও—কখনও গাছের আড়ালে, কখনও গাড়ির কাচে, কখনও বা কুয়াশার মধ্যে একটা আবছা সিলুয়েট (silhouette) হয়ে—ওটা আছে। এবং প্রত্যেকটা ছবিতে, টাইমস্ট্যাম্প অনুযায়ী, ওটা একটু একটু করে... এগিয়ে আসছে। ফোল্ডারের শেষ ছবিটা ছিল তার ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায় তোলা, রাত ২:৪৭ মিনিটে। একটা প্রায়-অন্ধকার ফ্রেম, শুধু তার নিজের ফ্ল্যাটের জানলার আলোটা দেখা যাচ্ছে। রাতুল ছবিটা জুম করলো। তার নিজের জানলার ঠিক নিচেই, রাস্তার ওপারে, ছায়ামূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। সোজা তার জানলার দিকে তাকিয়ে। রাতুল একটা চিৎকার করে চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লো। সে পাগলের মতো ছবিগুলো সিলেক্ট করলো। শিফট + ডিলিট (Shift + Delete)। "তুমি সত্যি নও। তুমি সত্যি নও!" সে প্রলাপ বকতে লাগলো। কম্পিউটারের রিসাইকেল বিন (Recycle Bin) খালি করলো। তারপর ক্যামেরা থেকে এসডি কার্ড (SD Card) বের করে সেটাকে ভেঙে দু-টুকরো করে ফেললো। সে ছুটে গিয়ে ঘরের সব আলো জ্বেলে দিলো। জানলার পর্দাগুলো টেনে দিলো। কিন্তু তার মনে হতে লাগলো, পর্দাটা যে কোনো মুহূর্তে সরে যেতে পারে। এবং কাচের ওপারে, অন্ধকার থেকে, দুটো শূন্য চোখের গহ্বর তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সেদিন রাতে রাতুল আর ঘুমালো না।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion