Episode 1709 words4 views

প্রথম অধ্যায়: দেবীতীর্থ

অর্ক মিত্র ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিন থেকে চোখ সরালো। সতেরো তলা কন্ডোমিনিয়ামের ত্রিমাত্রিক নকশাটা তার দিকে তাকিয়ে যেন ব্যঙ্গ করছিল। নিখুঁত, জ্যামিতিক, কিন্তু প্রাণহীন। জানলার বাইরে কলকাতার একঘেয়ে বিকেল। হর্নের কর্কশ সিম্ফনি, ফ্লাইওভারের ধুলো আর হাজারো মানুষের ব্যস্ততার ঘাম। অর্কর দমবন্ধ লাগছিল। আর্কিটেকচার তার প্যাশন ছিল, কিন্তু এখন সেটা স্রেফ ক্লায়েন্টের ইচ্ছেমতো কংক্রিটের বাক্স বানানোর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গ। দেবীতীর্থ। নামটা শুনলেই একটা হিমেল, ভেজা মাটির গন্ধ, ধূপের ধোঁয়ার সাথে মেশা শিউলি ফুলের সুবাস যেন নাকে এসে লাগে। মাসখানেক আগে, বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর, এই প্রথম সে তার পৈতৃক ভিটের নামটা শোনে। বাবা, প্রদীপ মিত্র, অদ্ভুতভাবে এই প্রসঙ্গটা সারাজীবন এড়িয়ে গেছেন। শুধু জানতো, তাঁদের আদি বাড়ি ওখানে, জ্যাঠামশাই—অলোকেশ রায়চৌধুরী—যিনি চিরকুমার ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বাড়িটা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে প্রায় পঁচিশ বছর। বাবার এক পুরোনো সেগুন কাঠের সিন্দুকে পাওয়া একটা মরচে ধরা, ভারী চাবির গোছার সাথে একটা হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিও ছিল। জ্যাঠামশাইয়ের চিঠি। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা, "প্রদীপ, তুই তো শিকড় ছিঁড়ে পালালি। কিন্তু পারবি না। এই মাটির টান বড় সাংঘাতিক। অর্ক বড় হলে এই বাড়ির ভার তাকেই দিস। শিকড়কে ভুলে থাকতে নেই। এই বাড়ি তার অপেক্ষা করবে।" শিকড়। অর্কর কাছে শব্দটার কোনো মানে ছিল না। সে মডার্ন আর্কিটেক্ট। তার জীবন কাঁচ, স্টিল আর পরিমাপের অঙ্কে বাঁধা। কিন্তু বাবার শেষ ইচ্ছে সে ফেলতে পারেনি। তাছাড়া, একটা আস্ত প্রাসাদোপম 'হেরিটেজ' বাড়ি সংস্কার করার প্রজেক্টটাও পেশাগত দিক থেকে বেশ লোভনীয়। কলকাতার এই যান্ত্রিক জীবন থেকে একটা লম্বা বিরতিও দরকার ছিল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন ট্রেনটা পৌঁছালো, তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে। সমতলের গরম হাওয়াটা উধাও। একটা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব। একটা জিপ ভাড়া করে যখন সে দেবীতীর্থ পৌঁছালো, তখন সন্ধে নামছে। শহর বলতে যা বোঝায়, তা নয়। তিস্তার একটা মরা খাতের পাশে, চা বাগানের গা ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো একটা ঘুমন্ত জনপদ। বাজার এলাকায় কিছু দোকানপাট, একটা পুরনো ক্লক টাওয়ার। কিন্তু বড় বেশি নিস্তব্ধ। জিপটা শহর ছাড়িয়ে, চা বাগানের ভেতর দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় এসে থামলো। একটা প্রকাণ্ড, শ্যাওলা ধরা লোহার গেটের সামনে। গেটের মাথায় একটা ভাঙা পাথরের ফলক— "রায়চৌধুরী নিবাস"। "এসে গেছি, বাবু," ড্রাইভার বিড়বিড় করে বললো। তার গলায় কেমন একটা অস্বস্তি। "এই হলো পোড়োবাড়ি।" অর্ক জিপ থেকে নামলো। নভেম্বর মাসের সন্ধে। এখনই বেশ ঠান্ডা। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ। গেটের ওপারে যা দেখা যাচ্ছে, তাকে বাড়ি না বলে একটা ধ্বংসস্তূপের কঙ্কাল বলাই ভালো। বট-অশ্বত্থের ঝুরি নেমেছে কার্নিশ বেয়ে, জানলার কাঁচ ভেঙে ঝুলে আছে। আগাছার জঙ্গল উঠোন ছাপিয়ে বারান্দায় উঠে এসেছে। "বাবু, রাতটা বরং আপনি সার্কিট হাউসেই থাকুন। এ বাড়িতে... লোকে বলে, ভালো না," ড্রাইভার প্রায় ফিসফিস করে বললো। "জ্যাঠামশাইয়ের পর থেকে এ বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না।" "না, আমি এখানেই থাকবো। সব ব্যবস্থা করা আছে," অর্ক বললো। সে আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তার কলকাতার অফিস থেকে দুজন লোক এসে বাড়ির একটা দিক—বাইরেমহলের দুটো ঘর—কোনোমতে সাফ করে জেনারেটরের ব্যবস্থা করে গেছে। গেটটা খুলতে একটা বিকট, অমানুষিক ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হলো। যেন বহু বছরের ঘুমন্ত কোনো দৈত্য জেগে উঠলো। অর্ক ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। জিপটা যেন পালানোর সুযোগ পেয়েই স্টার্ট দিয়ে মিলিয়ে গেলো। "অর্ক বাবু?" অন্ধকার থেকে একটা গলার স্বর শুনে অর্ক চমকে উঠলো। একটা লণ্ঠন হাতে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন। রোগা, লম্বাটে চেহারা। চামড়া কুঁচকে গেছে। পরনে ধুতি আর ফতুয়া। "আমি শম্ভু। এই বাড়ির পুরনো কেয়ারটেকার। মানে, আমার বাবা ছিলেন—হরিশঙ্কর। আমি শুধু দূর থেকে দেখাশোনা করি।" "ওহ, নমস্কার। আপনিই শম্ভু জ্যাঠা? বাবা আপনার কথা বলে গেছিলেন," অর্ক স্বস্তি পেলো। "বলেছিলেন, আপনি না থাকলে এ বাড়ি কবেই ধুলোয় মিশে যেতো।" "কর্তার দয়া," শম্ভু জ্যাঠার গলার স্বর বড্ড নিচু, যেন মাটির ভেতর থেকে আসছে। "আসুন। আপনার ঘর গুছিয়ে দিয়েছি।" লণ্ঠনের কাঁপা আলোয় বাড়ির ভেতরের বারান্দাটা দেখা গেলো। প্রকাণ্ড গ্রিক থাম, ইতালিয়ান মার্বেলের মেঝে ধুলোয় ঢাকা। দেওয়ালে টাঙানো অস্পষ্ট পোট্রেট থেকে কারা যেন তাদের দেখছে। একটা ভ্যাপসা, পুরনো গন্ধ। যেন বহু বছরের চেপে রাখা নিঃশ্বাস, পচা পাতা আর কর্পূরের মেশানো একটা গন্ধ এইমাত্র মুক্তি পেলো। বাইরেমহলের একটা ঘরে তাকে নিয়ে এলেন শম্ভু জ্যাঠা। ঘরটা পরিষ্কার করা হলেও দেওয়ালের ড্যাম্প ধরা দাগগুলো স্পষ্ট। একটা পুরনো খাট আর টেবিল। "এ বাড়িতে একলা থাকবেন, বাবু? সাহস আছে আপনার," শম্ভু জ্যাঠা বললেন। "ভয়ের কী আছে? পুরনো বাড়ি," অর্ক ক্লান্তভাবে হাসার চেষ্টা করলো। শম্ভু জ্যাঠা দরজার কাছে থামলেন। লণ্ঠনের আলো তার মুখে এসে পড়েছে। চোখের কোটরে গভীর অন্ধকার। "ভয় পুরনো বাড়িকে নয়, বাবু। ভয় পুরনো স্মৃতিকে। এ বাড়ির দেওয়ালে অনেক স্মৃতি লেখা আছে। সব স্মৃতি সুখের নয়। রাত-বিরেতে অন্দরমহলের দিকে যাবেন না। ওদিকটা ভালো নয়।" বৃদ্ধ আর দাঁড়ালেন না। তার ছায়াটা বারান্দার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। অর্ক দরজা বন্ধ করলো। জেনারেটরের একটানা শব্দটাও যেন এই প্রকাণ্ড বাড়ির নীরবতাকে ভাঙতে পারছিল না।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion