পরের দিন সকালটা ছিল অদ্ভুত। কুয়াশার চাদর ভেদ করে যখন রোদ উঠলো, অর্ক বাড়ির আসল চেহারাটা দেখলো। এটা শুধু বাড়ি নয়, একটা ইতিহাস। দুটো প্রকাণ্ড মহল— অন্দরমহল আর বাইরেমহল। মাঝে মস্ত উঠোন, সেখানে একটা ভাঙা ফোয়ারা। বারান্দার খিলানগুলো অসাধারণ। ইউরোপীয় আর ভারতীয় স্থাপত্যের অদ্ভুত মিশ্রণ।
অর্ক তার কাজ শুরু করলো। লেজার মেজারিং টেপ, নোটপ্যাড, ক্যামেরা। সে বাড়ির প্রতিটি কোণের মাপজোক, কাঠামোর ক্ষতি—সবকিছুর meticulous নোট নিতে শুরু করলো। কিন্তু কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, ততটা ছিল না। বাড়িটা যেন তাকে বাধা দিচ্ছিল। কখনো মনে হচ্ছে, দোতলার বারান্দা থেকে কেউ তাকে দেখছে। কখনো অন্দরমহলের কোনো বন্ধ ঘর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট পায়রার ডাক বা ঘুঙুরের শব্দের মতো আওয়াজ।
শম্ভু জ্যাঠা তাকে দুপুরের খাবার দিয়ে গেলেন। রুটি, সবজি আর এক বাটি ঘন ডাল। "বাবু, একটা কথা," যাওয়ার আগে ইতস্তত করে বললেন। "সব ঘরে যাবেন, মাপজোক করবেন, কিন্তু অন্দরমহলের উত্তর-পূর্ব কোণের ওই ঠাকুরঘরটা... ওটা বন্ধই থাক। ওটা ভালো জায়গা নয়।"
"ঠাকুরঘর ভালো জায়গা নয়? কেন?" অর্ক অবাক হলো। "যেকোনো সংস্কারের কাজ শুরু করার আগে তো ওখানেই পুজো দেওয়া উচিত।"
"পুজো?" শম্ভু জ্যাঠা এমনভাবে চমকে উঠলেন, যেন অর্ক কোনো অকথ্য কথা বলেছে। "না, বাবু! ওই ঘরে পুজো হয় না। পঁচিশ বছর আগে আপনার জ্যাঠামশাই অলোকেশবাবু ওই ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর থেকেই ওটা বন্ধ। রায়চৌধুরী বংশের পতন ওখান থেকেই শুরু। ওটা অভিশপ্ত।"
অর্ক হেসে ফেললো। "অভিশপ্ত? একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এসব বলছেন, জ্যাঠা?"
শম্ভু জ্যাঠা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন। "যা ভালো বুঝবেন, করুন। আমি আমার বাপের কাছে শোনা কথা বললাম।"
অভিশাপ। এই কথাটা অর্কর মাথায় গেঁথে গেলো। আর্কিটেক্টের কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে গেলো সেই ঠাকুরঘরের দিকে।
অন্দরমহলের একেবারে শেষ প্রান্তে ঘরটা। প্রকাণ্ড একটা সেগুন কাঠের দরজা, তাতে পিতলের জটিল পদ্মফুলের কাজ। কিন্তু সব সবুজ ছোপ ধরা। একটা বিশাল, পুরনো আমলের কাঁসার তালা ঝুলছে।
অর্ক তার বাবার দেওয়া চাবির গোছাটা বের করলো। আশ্চর্য! প্রথম চাবিটাই তালায় লেগে গেলো। মরচে ধরা তালাটা খুলতে বেশ বেগ পেতে হলো।
ক্যাঁ...চ...
দরজাটা খুলতেই একটা ঠান্ডা হাওয়া, কর্পূর, শুকনো ফুল আর পচা ফলের মেশানো একটা তীব্র গন্ধ বেরিয়ে এসে অর্ককে ধাক্কা দিলো।
ভেতরটা অন্ধকার। অর্ক মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলো। বিশাল ঘর। এককালে খুব জাঁকজমক ছিল। দেওয়ালে রাধা-কৃষ্ণের ফ্রেস্কো পেইন্টিং, সব খসে পড়ছে। মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের বেদি। সেখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটা কালো পাথরের বেদি, তাতে গভীর করে কাটা একটা চক্রচিহ্ন।
ঘরের মেঝেতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। কিন্তু একটা জায়গায় অর্কর চোখ আটকে গেলো। বেদির ঠিক সামনে, মেঝেতে একটা চৌকো পাথরের স্ল্যাব। অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। ওটার চারপাশে ধুলো জমলেও, স্ল্যাবটার মাঝখানটা কে যেন পরিষ্কার করে মুছে রেখেছে। যেন এই সকালেই কেউ মুছে গেছে।
অর্ক স্ল্যাবটার কাছে এগিয়ে গেলো। ওটার গায়ে একটা অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা। একটা চক্র, তার মধ্যে দুটো মাছ। মিনচক্র।
সে হাঁটু গেড়ে বসে স্ল্যাবটা পরীক্ষা করলো। কোনো হাতল নেই। কিন্তু একটা সূক্ষ্ম ফাটল বোঝা যাচ্ছে। সে পকেট থেকে তার সুইস নাইফটা বের করে ফাটলের মধ্যে ঢুকিয়ে আলতো করে চাপ দিলো।
খটাস করে একটা শব্দ হলো। স্ল্যাবটা কয়েক ইঞ্চি বসে গেলো।
অর্ক অবাক হয়ে দেখলো, স্ল্যাবটা আসলে একটা ঢাকনা। সে সর্বশক্তি দিয়ে ওটা একপাশে সরালো।
নিচে একটা অন্ধকার গর্ত। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। ভ্যাপসা, স্যাঁতস্যাঁতে একটা গন্ধ উঠে আসছে।
অর্ক এক মুহূর্ত ভাবলো। শম্ভু জ্যাঠার কথাগুলো তার মনে পড়লো। কিন্তু কৌতূহল সব ভয়কে ছাপিয়ে গেলো। সে টর্চ জ্বেলে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion