অর্ণব যখন শোনাপুর গ্রামে তার পৈতৃক ভিটেয় পৌঁছাল, তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে এসেছে। হেমন্তের হিমেল হাওয়া বইছে, তবে তাতে ঠান্ডার চেয়ে কেমন যেন এক চাপা গুমোট ভাব বেশি। গাছের পাতা নড়ছে না, আকাশে মেঘের গুরুগম্ভীর ছায়া। আজ ভূতের চতুর্দশী। কালীপূজার ঠিক আগের রাত। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে মর্ত্যে নেমে আসে কোটি কোটি প্রেতাত্মা। প্রকৃতি যেন সেই আগমনের অপেক্ষায় থমকে আছে। গ্রামে এক ধরণের অস্থির নিস্তব্ধতা বিরাজ করে এই দিনে, যা শোঁ-শোঁ শব্দের চেয়েও ভয়ংকর।
শোনাপুরের এই রায়চৌধুরী বাড়ি, যা স্থানীয়দের কাছে 'বড়বাড়ি' নামে পরিচিত, তার দেওয়ালগুলিতেও যেন শতাব্দীর পুরোনো ভয় আর বিষণ্ণতা লেপ্টে আছে। এটি প্রায় দুশো বছরের পুরোনো দালান, যার রঙ বহুকাল আগে চুন-সুরকি ভেদ করে বিবর্ণ হয়ে গেছে। এর ইট পাথরের প্রতিটি খাঁজে যেন দীর্ঘশ্বাস জমা। উঠোনে এককালের বিলাসবহুল ফরাস এখন স্যাঁতসেঁতে শৈবালে ঢাকা। শহরে বড় হওয়া অর্ণব এই প্রথাগুলোয় বিশ্বাস করে না। সে পেশায় সফটওয়্যার ডেভেলপার, যুক্তিবাদী এবং প্রায়শই ঠাকুমা'র অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে হাসাহাসি করে। এই পরিবেশে তার দম বন্ধ হয়ে আসে, যেন ইতিহাস আর প্রাচীন ভয়ের ভারে বাতাস ভারী হয়ে আছে। সে ফিরেছে অসুস্থ ঠাকুমা’র অনুরোধে। ঠাকুমা গত দুই বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে দুর্বল, কিন্তু এই একটা দিনের আচার-অনুষ্ঠানে তার কোনো ত্রুটি হতো না—এটিই যেন তার জীবনের শেষ কর্তব্য।
বাড়ির উঠোন পার হতেই ঠাকুমা'র তীব্র, প্রায় পাগলের মতো কণ্ঠস্বর কানে এল। তিনি বারান্দার কাঠের চৌকিতে বসে আছেন, তার শরীর frail, কিন্তু চোখ দুটো তীক্ষ্ণ, স্থির। তিনি চাকর পরেশকে প্রায় চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছেন। পরেশ এই বাড়ির প্রাচীন কর্মচারী, তার বয়সও প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই, তার মুখশ্রীতে গ্রাম্য ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। "পরেশ, চোদ্দোটি নতুন সলতে আর চোদ্দোটি প্রদীপে যেন খাঁটি সর্ষের তেল থাকে। আর মনে রাখিস, তেল যেন কোনোভাবেই কালো না হয়ে যায়! সলতেগুলো যেন কোনোভাবে ভিজে বা সামান্যও বাঁকা না থাকে! আজ একটাও ভুল হলে কিন্তু সর্বনাশ! জানিস তো, চোদ্দো প্রদীপ শুধু প্রথা নয়, এটা বাঁধন, প্রেতাত্মার বাঁধন! ভুল হলে সেই প্রেতগুলো মুক্তি পাবে, তারা তো শুধু মুক্তি চায় না, তারা চায় আমাদের রক্ত!"
অর্ণব ঘরে ঢুকতেই ঠাকুমা'র চাপা উত্তেজনা কিছুটা কমল। "এসেছিস বাবা? ভালো করেছিস," তিনি বললেন। কিন্তু তার চোখে অর্ণবের জন্য স্নেহের চেয়েও বেশি ছিল এক ধরণের সতর্ক, উদ্বেগের দৃষ্টি, যা অর্ণবকে অস্বস্তিতে ফেলল। অর্ণব দেখল, ঠাকুমার কপালে একটি গভীর ভাঁজ, যা শুধু বয়সের কারণে নয়, এক দীর্ঘস্থায়ী ভয়ের চিহ্ন।
ঠাকুমা অর্ণবকে কাছে টেনে ফিসফিস করে বললেন, "শুনে রাখ, আজকের রাতটা অন্যরকম। আজ চোদ্দো প্রেতাত্মা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের এই বাড়িটা তাদের বাঁধন। রায়চৌধুরী বংশের এক পূর্বপুরুষ এক ডাইনিকে বন্দি করেছিলেন এই বাড়িতে। তার অভিশাপ, প্রতি বছর চোদ্দো প্রেতাত্মা মুক্তির জন্য চেষ্টা করে। এই চোদ্দো প্রদীপ সেই চোদ্দোটি কক্ষ, সেই চোদ্দোটি অতৃপ্ত আত্মাকে বেঁধে রাখে। একটিও প্রদীপ যদি না জ্বলে বা ভুল জায়গায় জ্বলে, তবে সেই আত্মা মুক্ত হবে। আর যে আত্মা মুক্ত হবে, সে আমাদের বংশের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা কেড়ে নেবে। আর এবার, ১৪ নম্বরটাই মুক্তির চেষ্টা করবে।"
অর্ণব হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। "ঠাকুমা, এসব পুরনো দিনের গল্প। এখন তো বিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞান... এসব ডাইনি-টানিনি, ওঝা-তান্ত্রিকের গল্পে আমি বিশ্বাস করি না।" অর্ণবের কণ্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য।
ঠাকুমা কঠিন দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালেন। "বিজ্ঞানকে দূরে রাখ। আজকের রাতে বিজ্ঞান কাজ করে না, কাজ করে কেবল প্রথা আর বিশ্বাস। মিষ্টিকে দেখছিস? তোর দাদার মেয়ে, আমার নাতনি। পাঁচ বছরের নিষ্পাপ প্রাণ। তার হাসি দেখলে মনে হয় যেন সূর্যোদয়। ওই নিষ্পাপ প্রাণটাই এখন আমাদের বংশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আজ রাতে তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়, তার দায়িত্ব তোরও।"
পাঁচ বছরের মিষ্টি, অর্ণবের ভাইঝি, তখন তার মা সোমা'র পাশে বসে বারান্দায় খেলছিল। তার খেলনার ঝুড়িতে একটি ভাঙা পুতুল রাখা। নিষ্পাপ হাসিতে গোটা বাড়িটা উজ্জ্বল করে রেখেছে সে। অর্ণবের মনে হল, এই মিষ্টি হাসিটাই হয়তো এই অন্ধকার বাড়ির একমাত্র আলো। এই হাসিকে সে কোনোভাবেই ম্লান হতে দেবে না। তার যুক্তিবাদী মন এই প্রথা না মানলেও, মিষ্টির জন্য হলেও সে প্রদীপগুলো জ্বালাবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion