সন্ধ্যা নামতেই ঠাকুমা অর্ণবকে টেনে নিলেন ঠাকুরঘরের পাশের ছোট একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে। ঘরটি দুর্লভ পুরোনো নথিপত্র, পুঁথি আর কুলজি-পঞ্জিতে ভর্তি। সেখানে এক ধরণের পুরোনো, তেতো গন্ধ—শুকনো তুলসী পাতা, ইঁদুরের বিষ্ঠা আর পুরনো কাগজের মিশ্রণ। তিনি একটি জীর্ণ, চামড়ার বাঁধাই করা পুথি বের করলেন। এটি ছিল প্রায় তিনশো বছর আগেকার রূপেন রায়চৌধুরী'র হাতে লেখা ডায়েরি। এর পাতাগুলো হলদেটে ও ভঙ্গুর, হাতে নিলেই মনে হয় যেন শত শত বছরের চাপা ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা গেল।
"রূপেন ছিল আমাদের বংশের আদিপুরুষ। সে ছিল তান্ত্রিক। কিন্তু সে ছিল সাদা তান্ত্রিক—অর্থাৎ মানুষের ভালোর জন্য শক্তি ব্যবহার করত। আর এই অভিশাপের জন্ম তার হাতেই," ঠাকুমা ফিসফিস করলেন।
ঠাকুমা ডায়েরির একটি পাতা খুলে দেখালেন, সেখানে কাঁপানো হাতে লেখা একটি ভয়ংকর ঘটনা। সপ্তদশ শতকের সেই সময়ে শোনাপুর অঞ্চলে এক বিধবা ডাইনি থাকত, নাম চন্দ্রিমা, যার কালো জাদু আর নৃশংসতার গল্প পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ছিল ১৩ জন কট্টর শিষ্য। চন্দ্রিমা গ্রামের শিশুদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের আত্মা দিয়ে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করত। গ্রামবাসীরা তাকে ঈশ্বরের অভিশাপ বলে মনে করত। রূপেন তখন নিজের তন্ত্রজ্ঞান ব্যবহার করে, বহু বছর ধরে সাধনা করে, চন্দ্রিমাকে ধরেন এবং তার ১৩ জন শিষ্যকে এই বড়বাড়ির বিভিন্ন গোপন কক্ষ—দেওয়ালের কুলুঙ্গি, চিলেকোঠার মেঝে, সিঁড়ির ধাপের নিচে—আটকে রাখেন।
"কিন্তু রূপেন চন্দ্রিমাকে হত্যা করতে পারেননি। ডাইনি সে সময় অভিশাপ দেয়—সে নিজে মুক্তি পেলে রায়চৌধুরী বংশের সব আলো, সব নিষ্পাপ জীবন কেড়ে নেবে। রূপেন তখন এই বিশেষ মন্ত্র, এই প্রদীপের বাঁধন তৈরি করেন। তিনি বাড়ির কাঠামোয় এক ধরণের শক্তিচক্র তৈরি করেন। ১৩টি প্রদীপ ১৩ জন শিষ্যের জন্য, আর ১৪তম প্রদীপটি স্বয়ং চন্দ্রিমা ডাইনির কক্ষ! সেই ১৪তম কক্ষটি হলো পশ্চিমের দহলি ঘরের জানলার কুলুঙ্গি, যেখানে চন্দ্রিমাকে প্রথম বন্দি করে তার আত্মা সিল করা হয়েছিল।"
অর্ণব ডায়েরির পাতাগুলোর দিকে তাকাল। সেখানে শুধু লেখা: "ভস্ম না হলে মুক্তি নেই। আলো দিয়ে বাঁধন। প্রতিটি চতুর্দশীতে বিশুদ্ধ আলো, নতুবা বাঁধন আলগা হবে। ১৪তমের মুক্তি হলে বংশের আলো নিভে যাবে।" তার যুক্তিবাদী মনে এই গল্প কোনো ছাপ ফেলল না, কিন্তু ঠাকুমার মুখের স্থির ভয় তাকে চুপ করিয়ে দিল। সে অনুভব করল, তার হাতে যা তুলে দেওয়া হয়েছে, তা শুধু প্রদীপ আর তেল নয়, শত শত বছরের এক গোপন চুক্তি।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion