রাত ঠিক ১১:৫৫। গোটা বাড়ি অন্ধকার। শুধু ১৩টি প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছে। কিন্তু তাদের আলো আজ স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল। বাইরে বাতাস এমন জোরে বইছে, মনে হচ্ছে যেন কেউ বড়বাড়ির দেওয়াল ধরে নাড়া দিচ্ছে।
অর্ণব, সোমা, ঠাকুমা ও পরেশ দহলি ঘরে। মিষ্টি ঘুমিয়ে আছে তার মায়ের ঘরে।
রাত ১২টা বাজতেই, ১৩টি প্রদীপ একসাথে কেঁপে উঠল। প্রতিটি প্রদীপের আলোয় ফুটে উঠল এক একটি বিকৃত মুখ—১৩ জন শিষ্যের প্রেতাত্মা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে। ১৪ নম্বর কুলুঙ্গির ভাঙা ফাটল থেকে তীব্র কালো ধোঁয়া বের হতে শুরু করল।
ঠাকুমা চিৎকার করলেন, "চন্দ্রিমা আসছে! প্রদীপ জ্বালা অর্ণব!"
অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে সর্ষের তেল ঢেলে শেষবারের মতো প্রদীপটি জ্বালাতে গেল। কিন্তু প্রদীপের কাছে যেতেই এক শীতল বাতাস অর্ণবকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।
পশ্চিমের জানলা দিয়ে চন্দ্রিমা ডাইনির পূর্ণ অবয়ব ঘরে প্রবেশ করল। এটি আগের রাতের ছায়া-প্রেত নয়, এটি একটি বিকৃত, ভয়ংকর নারী মূর্তি। তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে, তার শরীর থেকে স্যাঁতসেঁতে কয়লার গন্ধ বের হচ্ছে। সে তার কালো, লম্বা নখ দিয়ে দহলি ঘরের ছাদ আঁচড়ে ধরল।
"রায়চৌধুরীর বংশ! তোমরা আমাকে বাঁধতে চেয়েছিলে! আজ আমি তোমাদের সব আলো কেড়ে নেব! আগে এই শুদ্ধ আত্মাকে গ্রাস করব!" চন্দ্রিমা তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করল। সে সরাসরি সোমার দিকে এগিয়ে গেল।
অর্ণব মরিয়া হয়ে প্রদীপটা নিয়ে ছুটে গেল। কিন্তু চন্দ্রিমা তার সামনে দাঁড়াল। "তুমি পারবে না, দুর্বল মানব! তোমার বিশ্বাস অপূর্ণ!"
চন্দ্রিমা তার কালো হাত অর্ণবের দিকে বাড়াল। অর্ণবের শরীর থেকে যেন জীবন শক্তি শুষে নিতে লাগল। সে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো।
তখন সোমা এগিয়ে এল। তার চোখে ভয় ছিল, কিন্তু মাতৃত্বের তীব্র ক্রোধ সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেল। সে মিষ্টির কথা মনে করল।
সোমা কুলুঙ্গির ভাঙা ফাটলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল।
"অর্ণব! প্রদীপ জ্বালাও! আমি প্রস্তুত!"
অর্ণব তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে প্রদীপটি জ্বালাল। ক্র্যাক! ১৪ নম্বর প্রদীপটি তীব্র আলোয় জ্বলে উঠল!
এই আলো চন্দ্রিমার দিকে তীর্যকভাবে আঘাত করল। চন্দ্রিমা চিৎকার করে পিছিয়ে গেল।
সোমা চোখ বন্ধ করল, তার কণ্ঠে পবিত্রতা ও ভালোবাসা: "জ্যোতির্লোকে শুদ্ধাত্মনঃ, অন্ধকারের নিবৃত্তি করো।"
প্রথম অংশ উচ্চারিত হতেই কুলুঙ্গির ফাটল থেকে একটি সাদা, পবিত্র জ্যোতি বের হলো। এটা কমলার আত্মার আলো।
চন্দ্রিমা তখন দুর্বল। সে সোমার দিকে তাকিয়ে হাসল। "আর বাকিটা? তোমার ভালোবাসা! আমি তোমার ভালোবাসাকেই গ্রাস করব!"
সোমা তখন তার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা, রাগ, আর জেদ একত্রিত করে চিৎকার করল: "তুমি আমার সন্তানের আলো নিতে পারবে না! আমি তোমাকে আমার রক্ত দিয়ে, আমার জীবন দিয়ে, আমার মাতৃত্বের শক্তি দিয়ে চিরতরে বাঁধলাম! ফিরে যা!"
সোমার শেষ কথাগুলো মন্ত্রের রূপ নিল। সেই কণ্ঠস্বর যেন লক্ষ বছরের পুরনো কোনো মহাশক্তির মতো। কুলুঙ্গির ফাটল থেকে বের হওয়া সাদা আলোয় সোমার শরীর উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই আলো দ্রুত চন্দ্রিমার দিকে ধাবিত হলো।
চন্দ্রিমা একটি অসহ্য, আর্তনাদ করে উঠল। তার বিকৃত মূর্তিটি দ্রুত সংকুচিত হতে শুরু করল। সাদা আলো চন্দ্রিমা ডাইনিকে পুড়িয়ে ভস্ম করতে শুরু করল। তীব্র ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেল।
ধীরে ধীরে আলো নিভে গেল। ধোঁয়া মিলিয়ে গেল।
চন্দ্রিমা নেই। তার জায়গায়, ১৪ নম্বর কুলুঙ্গির ভাঙা ফাটলটি অলৌকিকভাবে বুজে গেল। কুলুঙ্গিতে এখন এক টুকরো শ্বেত পাথর জ্বলজ্বল করছে, যার ওপর একটি স্থির প্রদীপ জ্বলছে।
সোমা অজ্ঞান হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে, যখন অর্ণব সোমাকে কোলে নিয়ে বাইরে এল, ঠাকুমা কুলুঙ্গির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। "বাঁধন আজ পূর্ণ হলো, অর্ণব। এইবার চিরতরে।"
রায়চৌধুরী বংশের অভিশাপ শেষ হলো। তবে অর্ণব জানে, আধুনিক জীবনের বাইরেও এমন শক্তি আছে, যা বিশ্বাস আর ভালোবাসার বাঁধন ছাড়া কোনো বিজ্ঞান দিয়ে বাঁধা যায় না। অর্ণব তার ল্যাপটপ আর যুক্তির জগৎ ছেড়ে নতুন জীবনে পা রাখল, যেখানে প্রথা আর বিশ্বাসের মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion