রাত তখন ঠিক দুটো সতেরো।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বেহালার এই পুরোনো পাড়াটার লাইটপোস্টগুলো বেশিরভাগই নিভে গেছে। রাতুলের একতলার ফ্ল্যাটের জানলার কাঁচ ভেদ করে শুধু বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গুরুগুরু আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই আসছিল না।
রাতুল সেনগুপ্ত। বয়স বত্রিশ। একটা মাঝারি মাপের প্রাইভেট ফার্মে অ্যাকাউন্টের কাজ করে। জীবন বলতে সকালে লোকাল ট্রেন, তারপর সারাদিনের ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব, আর রাতে ফিরে এই এক কামরার ফ্ল্যাট। বাবা-মা বর্ধমানের বাড়িতে থাকেন। কলকাতায় সে একাই।
গভীর রাতে এই বৃষ্টিতে ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়ে এসেছিল। হঠাৎই টেবিলের ওপর রাখা সস্তার স্মার্টফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠল।
রাতুল বিরক্ত হয়ে চোখ খুলল। এত রাতে কে? অফিসের কেউ? নাকি মা? মায়ের শরীরটা কি আবার...
ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল।
"UNKNOWN NUMBER".
ফোনটা সে ধরল। হ্যালো বলার আগেই ওপার থেকে একটা চাপা, আতঙ্কিত মহিলার স্বর ভেসে এল।
"বাঁচান... প্লিজ... আমাকে বাঁচান..."
গলার স্বরটা অদ্ভুতভাবে কাঁপছিল। যেন কেউ দৌড়ে এসে ফিসফিস করে কথা বলছে।
রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। "কে? কে বলছেন? কাকে চাই?"
"ওরা... ওরা আমাকে মেরে ফেলবে... প্লিজ... আমি..." মহিলার স্বরটা কান্নায় প্রায় বুজে আসছিল।
"আপনি কে বলছেন? ভুল নম্বর?" রাতুলের ঘুম জড়ানো গলায় বিস্ময় আর বিরক্তি।
"না! না! ভুল নম্বর নয়! আমি... আমার নাম অনন্যা... ওরা আমাকে..."
হঠাৎ ফোনের ওপারে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ এল। একটা কর্কশ পুরুষ কণ্ঠের চিৎকার, "ফোনটা দে!"
"না!" মহিলাটি আর্তনাদ করে উঠল। "৮/বি... সোনাগাছি... ৮/বি... আআআ..."
একটা যন্ত্রণাকাতর চিৎকারের সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।
রাতুল কয়েক সেকেন্ড ফোনটা কানে ধরে রইল। স্ক্রিনে "CALL ENDED" লেখা।
সারা ঘরে শুধু বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ।
"সোনাগাছি?" রাতুল বিড়বিড় করল। "ধ্যাত্তেরি!"
সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবল, নির্ঘাত কোনো স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বা কোনো মাতালের প্র্যাঙ্ক কল। সোনাগাছির নাম শুনে তার সন্দেহটা আরও গভীর হলো। হয়তো কোনো দালালচক্রের ব্যাপার।
বিরক্ত হয়ে সে নম্বরটায় কল ব্যাক করার চেষ্টা করল। "The number you are trying to reach is currently switched off."
রাতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা আবার টেবিলে রেখে দিল। আলো নিভিয়ে কম্বলটা টেনে নিল। কিন্তু কেন যেন আর ঘুম আসছিল না। কানের মধ্যে শুধু ওই আর্তনাদটা বাজছিল— "৮/বি... সোনাগাছি..."
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion