Episode 2870 words2 views

প্রথম অধ্যায়: কাগজের খবর

পরদিন সকালটা ছিল চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল। রাতের বৃষ্টির জেরে রাস্তায় জল জমে একাকার। বাস পেতে পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেট। অফিসে ঢুকে বসের ঝাড় খেয়ে যখন রাতুল নিজের ডেস্কে বসল, তখন সকাল দশটা। রাতের ওই ফোনটার কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। ওসব প্র্যাঙ্ক কল হামেশাই আসে। দুপুরের লাঞ্চ ব্রেকে সে অফিসের ক্যান্টিনে বসেছিল। সবেমাত্র ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চিকেন স্টু-তে এক টুকরো পাউরুটি ডোবাতে যাবে, এমন সময় পাশের টেবিলের কলিগ, সুজয়, তার ফোনটা প্রায় রাতুলের চোখের সামনে মেলে ধরল। "দেখেছিস কান্ড! একেবারে ফিল্মি ব্যাপার!" সুজয় একটা নিউজ পোর্টালের লিঙ্কে ট্যাপ করল। রাতুল বিরক্ত হয়ে বলল, "কী?" "আরে দেখ না। এই মেয়েটা। অনন্যা সেন। নামকরা মডেল। কাল রাত থেকে নিখোঁজ।" রাতুল নিউজের হেডলাইনটা পড়ল: "শহরের বুক থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ মডেল অনন্যা সেন। অপহরণের আশঙ্কা।" খবরের সাথে একটা ঝকঝকে ছবি। মেয়েটি হাসছে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। রাতুল ছবিটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। ঠিক চিনতে পারল না, কিন্তু "অনন্যা" নামটা... "কী হয়েছে রে? এভাবে দেখছিস কেন?" সুজয় জিজ্ঞেস করল। রাতুল শুকনো গলায় বলল, "না, কিছু না।" সে নিজের ফোনে গুগলে সার্চ করল। "মডেল অনন্যা সেন নিখোঁজ"। খবরটা সত্যি। বিভিন্ন পোর্টালে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, কাল সন্ধ্যায় সে তার এক বন্ধুর সাথে কফি শপে দেখা করতে গিয়েছিল। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। তার ফোন সুইচড অফ। পরিবার অপহরণের অভিযোগ করেছে। রাতুল আবার নিজের কল লগে গেল। রাত ২:১৭। "UNKNOWN NUMBER"। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। একটা অসম্ভব, অবাস্তব চিন্তা তার মাথায় খেলে গেল। "আমার নাম অনন্যা..." "৮/বি... সোনাগাছি..." রাতুল খবরটা আবার মন দিয়ে পড়ল। পুলিশ জানিয়েছে, অনন্যার শেষ টাওয়ার লোকেশন পাওয়া গেছে শ্যামবাজারের কাছে। সেখান থেকে সোনাগাছি খুব বেশি দূরে নয়। বুকটা ধড়াস করে উঠল। এটা কি হতে পারে? যে মেয়েটা তাকে ফোন করেছিল, সে-ই এই অনন্যা সেন? "কী রে? শরীর খারাপ? জল খাবি?" সুজয়ের ডাকে রাতুল বাস্তবে ফিরল। "না, না। ঠিক আছি।" রাতুল উঠে দাঁড়াল। সোজা চলে গেল বসের কেবিনে। "স্যার, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমি আজকের দিনটা হাফ-ডে নিতে চাই।" অফিস থেকে বেরিয়ে সে সোজা বাসে উঠল। গন্তব্য— লালবাজার। লালবাজারের সেন্ট্রাল রিপোর্টিং সেকশনে তখন ভরদুপুর। লোকজনের ভিড়, টাইপরাইটারের খটখট আওয়াজ, আর ভাজাভুজি-চায়ের গন্ধ। রাতুলকে দেখে একজন প্রৌঢ় কনস্টেবল হাই তুলে জিজ্ঞেস করলেন, "কী চাই?" "আমি একটা সিরিয়াস ম্যাটার জানাতে এসেছিলাম..." "সিরিয়াস ম্যাটার তো সবাই জানাতে আসে। কী হয়েছে? মানিব্যাগ পকেটমার?" "না। একটা নিখোঁজ কেসের ব্যাপারে।" কনস্টেবলটি তাকে একটা ডেস্কের দিকে এগিয়ে দিলেন। সেখানে একজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসার বসেছিলেন। তার নেমপ্লেটে লেখা— "এ. সান্যাল"। ইন্সপেক্টর অরূপ সান্যাল লোকটা মাঝবয়সী। চুল পাতলা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রাতুলের কথাগুলো তিনি খুব মন দিয়ে শুনলেন। রাতুল কোনো কথা বাদ দিল না। রাতের ফোন কল, মহিলার আতঙ্কিত স্বর, ধস্তাধস্তির আওয়াজ, "অনন্যা" নামটা, আর সবশেষে "৮/বি, সোনাগাছি" ঠিকানাটা— সব বলল। সব শুনে ইন্সপেক্টর সান্যাল তার চশমাটা খুললেন। টেবিলের ওপর রাখা একটা লাল পেপারওয়েট দিয়ে খাতা চাপতে চাপতে বললেন, "হুঁ।" "স্যার," রাতুল উত্তেজিত হয়ে বলল, "আজ সকালেই আমি খবর দেখলাম, মডেল অনন্যা সেন নিখোঁজ। আমার মনে হচ্ছে, ওই মহিলা..." সান্যাল তাকে থামিয়ে দিলেন। "আপনার নাম রাতুল সেনগুপ্ত। আপনি অমুক জায়গায় অ্যাকাউন্টেন্ট। ঠিক?" "আজ্ঞে হ্যাঁ।" "দেখুন মিস্টার সেনগুপ্ত," সান্যাল এবার একটু ঝুঁকে বসলেন। "অনন্যা সেনের কেসটা আমরাই দেখছি। এটা একটা হাই-প্রোফাইল কেস। কিন্তু আপনি যেটা বলছেন, সেটার কোনো মানে হয়?" "মানে?" "মানে, একজন হাই-প্রোফাইল মডেলকে কেউ কিডন্যাপ করলে তাকে সোনাগাছিতে রাখবে কেন? আর সে যদি ফোন করার সুযোগ পায়, তাহলে সে পুলিশ বা তার পরিবারকে ফোন না করে, গোটা কলকাতার মধ্যে র্যান্ডমলি আপনার নম্বরটা ডায়াল করবে কেন?" রাতুল থতমত খেয়ে গেল। "আমি জানি না স্যার। কিন্তু..." "কিন্তু আপনি ভাবছেন, আপনিই একমাত্র হিরো যে তাকে বাঁচাতে পারে?" সান্যালের গলায় হালকা ব্যঙ্গের সুর। "দেখুন, প্রতিদিন এরকম হাজারটা 'সোর্স ইনফরমেশন' আসে। ৯৯% হলো ধাপ্পা। আর সোনাগাছি থেকে 'বাঁচাও বাঁচাও' ফোন কল তো আমাদের কাছে রুটিন ব্যাপার। বেশিরভাগই দালালদের নিজেদের মারপিট।" "কিন্তু ও তো নিজের নাম বলল!" রাতুল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। "নামটা আপনি আজ সকালে খবরের কাগজে দেখেছেন, মিস্টার সেনগুপ্ত।" সান্যাল সোজা রাতুলের চোখের দিকে তাকালেন। "আপনার হয়তো কোনো কারণে মনে হচ্ছে আপনি একটা কানেকশন খুঁজে পেয়েছেন। এটাকে সাইকোলজিতে অ্যাপোফেনিয়া বলে। সম্পর্কহীন দুটো জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজা।" "স্যার, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?" "বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়। প্রমাণের কথা।" সান্যাল উঠে দাঁড়ালেন। "আপনার কাছে ওই 'আননোন নাম্বার' ছাড়া আর কোনো প্রমাণ আছে? কোনো রেকর্ডিং? কিছু?" "না। কিন্তু..." "তাহলে আপনি এখন আসতে পারেন। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।" ইন্সপেক্টর সান্যাল অন্য একটা ফাইলে মন দিলেন। রাতুল অপমানিত বোধ করল। সে বুঝতে পারছিল, পুলিশ তার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করেনি। তারা ভাবছে, সে স্রেফ খবরের কাগজের খবর পড়ে উত্তেজনা খুঁজতে এসেছে। থানা থেকে বেরিয়ে সে ফুটপাতে এসে দাঁড়াল। বিকেলের ভিড় শুরু হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ঠিকই বলেছে। সে কে? তার কথা কে বিশ্বাস করবে? হয়তো সত্যিই সে ভুল ভাবছে। হয়তো রাতের ফোনটা একটা বাজে জোক ছিল, আর অনন্যা সেনের নিখোঁজ হওয়াটা একটা আলাদা ঘটনা। দুটোকে সে অকারণে জুড়ে দিচ্ছে। "ভুল নম্বর..." সে বিড়বিড় করল। সে ঠিক করল, বাড়ি ফিরে যাবে। এসব ঝামেলার মধ্যে সে নেই। বাসে বসে সে আবার ফোনটা বের করল। কল লগে ওই "UNKNOWN NUMBER" টা জ্বলজ্বল করছে। সে নম্বরটার দিকে তাকিয়ে রইল। যদি... শুধু যদি... ইন্সপেক্টর সান্যাল ভুল হন? যদি ওই মহিলা সত্যিই অনন্যা সেন হন? যদি সে সত্যিই বিপদে পড়ে, আর রাতুলই একমাত্র মানুষ যে তার শেষ লোকেশনটা জানে? রাতুল বাস থেকে নেমে পড়ল। উল্টো দিকের বাসে উঠল। গন্তব্য— শ্যামবাজার। সে ঠিক করল, পুলিশ বিশ্বাস না করুক, সে একবার ওই "৮/বি, সোনাগাছি" ঠিকানাটায় গিয়ে দেখবে। শুধু একবার। নিজের কৌতুহল মেটানোর জন্য। সে তখনো জানত না, এই একটা সিদ্ধান্ত তার সাধারণ, পানসে জীবনটাকে কোন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চলেছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion