Episode 1999 words0 views

ছায়াবাজির পুতুল : প্রথম পর্ব

কলকাতার আকাশে সেদিন শরতের মেঘ আর আশ্বিনের রোদের এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলছিল। পুরনো মেটেবুরুজের এক সরু, এঁদো গলির শেষ প্রান্তে ভবতোষ ভট্টাচার্যের বাড়ির বিবর্ণ খড়খড়িতে সেই আলো-ছায়ার খেলা এক মায়াবী আলপনা এঁকে দিচ্ছিল। বাইরে থেকে দেখলে বাড়িটিকে আর পাঁচটা পুরনো বাড়ির থেকে আলাদা করার উপায় নেই। দেওয়ালে শ্যাওলার গাঢ় সবুজ আস্তরণ, কার্নিশে পায়রার অবিরাম বকবকম আর সদর দরজার কপালে একটা ক্ষয়ে যাওয়া মাটির লক্ষ্মীর পট—সবই বড় সাধারণ। কিন্তু এই সাধারণত্বের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক অসাধারণ জগৎ, যার অধিপতি ছিলেন ভবতোষ নিজে। লোকে তাঁকে জানত একজন সামান্য জ্যোতিষী হিসেবে। হাত দেখা, ঠিকুজি-কুষ্ঠি বিচার করা, আর যজ্ঞ-শান্তির জন্য কিছু মাদুলি-কবচ দেওয়া—এই ছিল তাঁর পরিচিতি। তাঁর বৈঠকখানাটিও ছিল সাদামাটা, কয়েকটি বেতের চেয়ার আর একটি জলচৌকি ছাড়া বিশেষ আসবাব ছিল না। কিন্তু সেই ঘরের লাগোয়া একটি ছোট দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যেত তাঁর আসল জগতে—তাঁর পূজার ঘরে, যা আদতে ছিল তন্ত্র সাধনার এক গুপ্ত ক্ষেত্র। সেই ঘরের বাতাসে ধূপ, কর্পূর, শুকনো শেকড়বাকড় আর পুরনো পুঁথির এক ভারী, গাঢ় গন্ধ। দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটি পট—মহাকালী, বগলা আর ছিন্নমস্তার। একটি দেরাজে রাখা ছিল শাঁখ, ঘণ্টার মতো পূজার সামগ্রীর পাশে নরকরোটি, পঞ্চমুণ্ডীর আসনের মাটি আর নানা অদ্ভুত আকৃতির শিলাখণ্ড। এই দুই জগৎকে ভবতোষ বড় নিপুণভাবে আলাদা করে রেখেছিলেন। যৌবনে হিমালয়ের দুর্গম প্রান্তে, কামাখ্যার শ্মশানে, আর বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তা পুঁথির পাতার বাইরে বড় একটা প্রকাশ পেত না। বয়স এখন ষাটের কোঠায়, জরা আর অভিজ্ঞতার বলিরেখা তাঁর চোখেমুখে এক গভীর প্রশান্তি এনে দিয়েছে। তন্ত্রের সেই আগুন এখন ছাইচাপা, শুধু প্রয়োজন পড়লে তার স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়। সেদিন বিকেলে তাঁর বৈঠকখানায় বসে তিনি একমনে একটি তালপাতার পুঁথি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন। ঘরের বাতাসে ধূপ আর পুরনো কাগজের এক মিশ্র গন্ধ। এমন সময় বাইরে থেকে তাঁর বহুদিনের বন্ধু, সাংবাদিক শরৎ চাটুজ্জের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “ভবতোষ আছ নাকি? এক কাপ চা না খাওয়ালে কিন্তু আজ তোমার পুঁথির একটা পাতাও আস্ত রাখব না।” শরৎ হলো ভবতোষের বাইরের জগতের সঙ্গে একমাত্র জীবন্ত সংযোগ। যুক্তিবাদী, অট্টহাসিতে ভরপুর এবং সব বিষয়ে সন্দিহান হলেও, ভবতোষের জ্ঞানকে সে মনে মনে শ্রদ্ধা করত। তার খবরের কাগজের জন্য মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত, অলৌকিক ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে এসে সে ভবতোষের বৈঠকখানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত। ভবতোষ পুঁথি থেকে চোখ না তুলেই বললেন, “বোসো হে। চা আসছে। কিন্তু তোমার কাগজের আপিসের বাইরেও যে জগৎ আছে, সে খবর রাখো?” শরৎ একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, “জগতের খবর রাখতে রাখতেই তো তোমার কাছে ছুটে এলাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে শহরে, ভবতোষ। একেবারে যাকে বলে ভূতুড়ে কাণ্ড!” তার গলার স্বরে উত্তেজনার চেয়ে বেশি ছিল এক ধরনের চাপা উদ্বেগ। ভবতোষ মৃদু হেসে বললেন, “ভূত তো তোমার মাথায়। খুলে বলো দেখি, কী হয়েছে।” শরৎ গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল, “সিমলেপাড়ার মিত্রবাড়ির ভাঙা নাটমন্দিরটা চেনো তো? সেই যে, যেখানে একসময় যাত্রাপালা হতো। এখন তো প্রায় পোড়োবাড়ি। সেখানেই মাসখানেক হলো এক পুতুলনাচের দল এসে আস্তানা গেড়েছে। নাম ‘মায়াপুতুলের খেল’। তাদের খেলা দেখতেই ভিড় জমছে রোজ।” “এতে ভূতুড়ে কাণ্ডের কী হলো?” ভবতোষের গলায় কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সুর। “পুতুলনাচ তো আমাদের দেশের পুরনো শিল্প।” “আরে, সেই কথাই তো বলছি,” শরৎ উত্তেজিত হয়ে বলল। “এ সে রকম পুতুলনাচ নয়। যারা একবার এর খেলা দেখতে যাচ্ছে, তারা যেন কেমন বদলে যাচ্ছে। আমার অফিসের একজন সহকর্মী, অনাদিবাবু, ঘোর সংসারী মানুষ, তিনি সেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর থেকে কেমন যেন উদাস, আনমনা। সারাদিন শূন্যে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর স্ত্রী বলছিলেন, আজকাল নাকি উনি আয়নার সামনে দাঁড়াতেও ভয় পান। বলেন, আয়নায় নাকি নিজের মুখটা কেমন ঝাপসা, অস্পষ্ট দেখেন। চোখের মণিটা দেখেছ, ভবতোষ? মনে হয় যেন স্থির, নিষ্প্রভ। যেন কেউ ভিতর থেকে জীবনের সব আলো শুষে নিয়েছে।” ভবতোষ এবার পুঁথিটা বন্ধ করে শরতের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। শরৎ বলে চলল, “শুধু অনাদিবাবু নন, পাড়ার আরও বেশ কয়েকজন… তাদের সকলেরই এক অবস্থা। তারা রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে সেই পুতুলনাচ দেখতে যায়, যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়েছে। তাদের বাড়ির লোক চিন্তায় অস্থির। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েও কিছু হয়নি। সবাই বলছে, এ নিশ্চয়ই কোনো গুণতুক, কোনো মারণ ক্রিয়া ।” “পুতুলগুলো কেমন?” ভবতোষের প্রশ্নটা ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ। “অসাধারণ!” শরতের চোখেও এক অদ্ভুত ঘোর। “কাঠের পুতুল যে এত জীবন্ত হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মানুষের মতোই তাদের অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি। আর তাদের নাচ… সে এক আশ্চর্য মায়া। মনে হয় যেন পুতুলগুলো নয়, তাদের পিছনে থাকা অদৃশ্য কোনো শক্তি নাচছে। দলের প্রধান যে লোকটা, সেই-ই নাকি সব। নাম তার মনোহর ওস্তাদ। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, চোখে এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি। সে নাকি কথা প্রায় বলেই না, শুধু তার হাতের ইশারায় পুতুলেরা নাচে।” ভবতোষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর অভিজ্ঞ মন বলছিল, এটা সাধারণ কোনো গুণতুকের ঘটনা নয়। এর পিছনে আরও গভীর, আরও জটিল কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি বললেন, “শরৎ, কাল সন্ধ্যায় আমাকে একবার ওই মায়াপুতুলের খেল দেখতে নিয়ে যেতে পারবে?” শরৎ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে জানত, ভবতোষ যদি একবার কোনো বিষয়ে আগ্রহী হন, তবে তার মূল পর্যন্ত না গিয়ে ছাড়বেন না। সে বলল, “নিশ্চয়ই! আমি কাল ঠিক সময়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। আমার মন বলছে, এর পিছনে এমন কোনো রহস্য আছে, যা তোমার মতো মানুষ ছাড়া আর কেউ ভেদ করতে পারবে না।” শরৎ চলে যাওয়ার পর ভবতোষ আবার সেই পুঁথিটি খুললেন, কিন্তু তাঁর মন আর অক্ষরের জগতে স্থির থাকতে পারল না। তাঁর মন চলে গিয়েছিল সিমলেপাড়ার সেই ভাঙা নাটমন্দিরে, যেখানে কাঠের পুতুলেরা এক অদ্ভুত মায়ার জাল বুনছে। তাঁর মনে পড়ছিল তন্ত্রের এক বিস্মৃত অধ্যায়ের কথা—’ছায়াতন্ত্র’। এ এক অতি গুহ্য এবং ভয়ঙ্কর সাধনা, যেখানে মানুষের ছায়াকে ব্যবহার করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ছায়া হলো প্রাণের প্রতিবিম্ব। যদি ছায়াকেই বশ করা যায়, তবে কায়াকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাঁর গুরুজি তাঁকে সাবধান করে বলেছিলেন, “ভবতোষ, ছায়া হলো মায়া। এই মায়ার সাধনা বড় পিচ্ছিল পথ। যে ছায়া নিয়ে খেলে, একদিন সে নিজেই ছায়ায় পরিণত হয়।” কিন্তু এই সাধনা অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক। সামান্য ভুল হলে সাধকের নিজের অস্তিত্বই ছায়ায় বিলীন হয়ে যেতে পারে। তবে কি এই মনোহর ওস্তাদ সেই ছায়াতন্ত্রের সাধক? একজন ‘ছায়াবাজিকর’? যদি তাই হয়, তবে তার উদ্দেশ্য কী? শুধু মানুষকে সম্মোহিত করে রাখা? নাকি এর পিছনে আরও কোনো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে? ভবতোষের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘام জমল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এক দীর্ঘ, অন্ধকার রাতের মুখোমুখি হতে চলেছেন তিনি। যে রাতের রহস্য ভেদ করতে হলে তাঁকে তাঁর সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে। কাঠের পুতুলের আড়ালে যে খেলা চলছে, তা কোনো সাধারণ বিনোদন নয়, তা হলো আলো আর অন্ধকারের এক আদিম লড়াই। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion