Episode 21012 words0 views

ছায়াবাজির পুতুল : দ্বিতীয় পর্ব

পরদিন সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শরৎ এসে হাজির হলো। ভবতোষ তৈরিই ছিলেন। গায়ে একটা মোটা খদ্দরের চাদর জড়িয়ে, হাতে তাঁর বহু পুরনো সঙ্গী—এক অশ্বত্থ গাছের ডালের লাঠি—নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সিমলেপাড়ার গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে যখন তাঁরা মিত্রবাড়ির সামনে পৌঁছলেন, তখন চারপাশ প্রায় অন্ধকার। ভাঙা নাটমন্দিরের সামনে টিমটিম করে কয়েকটি তেলের প্রদীপ জ্বলছে। নাটমন্দিরের বিশাল থামগুলো যেন অতীতের কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে একটা স্যাঁতসেঁতে, পুরনো গন্ধের সাথে ভেসে আসছে শ্যাওলা আর বাদুড়ের মলের তীব্র গন্ধ। কিছু লোক ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে। তাদের চোখেমুখে এক অদ্ভুত ঘোরলাগা ভাব। তারা একে অপরের সঙ্গে বিশেষ কথা বলছে না, শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। মঞ্চ বলতে নাটমন্দিরের উঁচু চাতালটা। সেখানে একটা কালো পর্দা টাঙানো। পর্দার সামনে মনোহর ওস্তাদ বসে আছে একটা মাদুরের উপর। পরনে তার কালো পোশাক, মাথায় একটা ফেট্টি বাঁধা। চেহারাটা সত্যিই আকর্ষণীয়, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি বড় শীতল, যেন কোনো পাথরের মূর্তি। তার পাশে রাখা আছে কয়েকটি অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র। ভবতোষ আর শরৎ এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভবতোষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মঞ্চের প্রতিটি কোণ, উপস্থিত দর্শকদের মুখ এবং সর্বোপরি মনোহর ওস্তাদকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তিনি লক্ষ্য করলেন, দর্শকদের মধ্যে অনেকেই গত কয়েকদিন ধরে এখানে আসছেন, তাদের মুখ দেখেই বোঝা যায়। তাদের চোখের মণি স্থির, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন তারা কোনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর। কিছুক্ষণ পর মনোহর ওস্তাদ তার হাতের একটি ছোট ডমরু বাজাতেই চারপাশের কোলাহল থেমে গেল। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপর সে একটি সারেঙ্গির মতো দেখতে যন্ত্র তুলে নিল এবং তাতে ছড়ি টানতেই এক করুণ, বিষণ্ণ সুর ভেসে এল। সেই সুর যেন উপস্থিত দর্শকদের মনের গভীরে প্রবেশ করে তাদের সমস্ত চেতনাকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে ফেলল। এরপরই মঞ্চের কালো পর্দা ধীরে ধীরে সরে গেল। মঞ্চে আলো বলতে কয়েকটি মাত্র প্রদীপ। সেই আলো-আঁধারিতে দেখা গেল, কয়েকটি পুতুল ঝুলছে। দুটি প্রধান পুতুল—একটি রাজা, অন্যটি রানি। তাদের পোশাক জমকালো, মুখে আশ্চর্য কারুকার্য। ভবতোষের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। পুতুলগুলোর মুখশ্রী জীবন্ত মানুষের মতো, কিন্তু তাদের চোখে কোনো প্রাণ নেই—শুধু শূন্যতা। মনোহর ওস্তাদের সারেঙ্গির সুরের তালে তালে পুতুলগুলো ধীরে ধীরে নাচতে শুরু করল। তাদের নড়াচড়া এত মসৃণ, এত স্বাভাবিক যে, মনেই হচ্ছে না কেউ সুতো দিয়ে তাদের নাচাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন তাদের নিজস্ব প্রাণ আছে। রাজা আর রানির এক প্রেমের কাহিনী ফুটে উঠতে লাগল তাদের নাচের মাধ্যমে—বিরহ, মিলন, আনন্দ, বিষাদ। গল্পটা ছিল এক রানির, যাকে এক মায়াবী রাক্ষস তার ছায়া চুরি করে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করে দিয়েছিল। রাজা তখন কঠিন তপস্যা করে সেই ছায়া ফিরিয়ে আনার উপায় জানতে পারে। দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই নাচ দেখছে। তাদের শরীর স্থির, কিন্তু ভবতোষ লক্ষ্য করলেন, প্রদীপের আলোয় তাদের যে ছায়া মাটিতে পড়েছে, তা যেন সামান্য কাঁপছে। শুধু তাই নয়, পুতুলগুলোর নাচের ছন্দের সাথে সাথে সেই ছায়াগুলোও যেন একটু একটু করে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ এক অতি সূক্ষ্ম পরিবর্তন, যা সাধারণ চোখে ধরা পড়া প্রায় অসম্ভব। ভবতোষ তাঁর তান্ত্রিক দৃষ্টি দিয়ে যা দেখলেন, তাতে তাঁর শরীর হিম হয়ে গেল। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, প্রতিটি দর্শকের শরীর থেকে এক ক্ষীণ, ধোঁয়ার মতো ছায়াসূত্র বেরিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মনোহর ওস্তাদের পায়ের কাছে রাখা একটি কালো পাথরের উপর গিয়ে মিশে যাচ্ছে। আর সেই পাথর থেকেই শক্তি সঞ্চয় করে পুতুলগুলো নাচছে। মনোহর ওস্তাদ শুধু বাজাচ্ছে না, সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে দর্শকদের প্রাণশক্তি, তাদের ‘ছায়া’কে শোষণ করছে। পুতুলগুলো আসলে ফাঁকা খোলস, যা দর্শকদেরই জীবনীশক্তি দিয়ে চলছে। নাচের ক্লাইম্যাক্সে রাজা যখন রাক্ষসকে বধ করে রানির ছায়া ফিরিয়ে আনল, ঠিক সেই মুহূর্তে রাজা আর রানি পুতুল একে অপরকে আলিঙ্গন করল। ঠিক সেই মুহূর্তে দর্শকদের মধ্যে থেকে একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ বেরিয়ে এল। যেন তাদের ভিতর থেকে কিছু একটা ছিনিয়ে নেওয়া হলো। তারপরই নাচ থেমে গেল। পর্দা পড়ে গেল। মনোহর ওস্তাদ বাজনা থামিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নোয়াল। দর্শকরা যেন ঘোর থেকে জেগে উঠল। কিন্তু তাদের চোখে ক্লান্তি, শরীরে অবসাদ। তারা ধীর পায়ে একে একে বেরিয়ে যেতে লাগল। শরৎও কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে ভবতোষকে বলল, “কী আশ্চর্য নাচ, তাই না? আমারও কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে।” ভবতোষ শরতের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “ঘুম নয়, শরৎ। এ হলো চেতনার অবশ অবস্থা। তোমার ছায়ার সামান্য অংশও সে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। চলো, এখুনি এখান থেকে বেরোতে হবে।” বাইরে বেরিয়ে এসে ভবতোষ গভীর শ্বাস নিলেন। তিনি শরৎকে বললেন, “যা ভেবেছিলাম, তাই। লোকটা একজন ভয়ঙ্কর ছায়াবাজিকর। সে পুতুলনাচের আড়ালে মানুষের জীবনীশক্তি চুরি করছে।” শরৎ অবাক হয়ে বলল, “ছায়া চুরি? সে আবার কী?” “ছায়া হলো আমাদের আত্মার প্রতিবিম্ব,” ভবতোষ ব্যাখ্যা করলেন। “তাকে যদি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে সে ধীরে ধীরে আমাদের কায়াকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই লোকটা তাই করছে। দিনের পর দিন সামান্য অংশ শোষণ করে সে ওই মানুষগুলোকে জীবন্মৃত করে ফেলছে। তাদের আত্মা এখন ওই পুতুলগুলোর মধ্যে বন্দি।” “কিন্তু কেন? তার উদ্দেশ্য কী?” শরতের গলায় আতঙ্ক। “সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,” ভবতোষ গম্ভীরভাবে বললেন। “এতগুলো মানুষের প্রাণশক্তি দিয়ে সে কী করতে চায়? এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় এবং ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য আছে। হয়তো কোনো বড় ধরনের তন্ত্র সাধনা, যার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন।” সেদিন রাতে ভবতোষ নিজের আসনে বসলেন। সামনে একটি পঞ্চপ্রদীপ, ধূপের ধোঁয়া আর কিছু তান্ত্রিক উপকরণ। তিনি চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, মনোহর ওস্তাদের শক্তির উৎস এবং তার মানসিক জগতের একটি আভাস পাওয়া। অনেকক্ষণ সাধনার পর, মধ্যরাতে, তিনি এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, মনোহর ওস্তাদ তার পুতুলশালায় বসে আছে। তার সামনে একটি অল্পবয়সী মেয়ের ছবি। মেয়েটি দেখতে ভারি মিষ্টি, কিন্তু তার চোখদুটি বিষাদে ভরা। মনোহর কাঁদছে আর বলছে, “আর বেশিদিন নয়, মা। আমি তোকে ফিরিয়ে আনবই। এই নিষপ্রাণ পুতুলের জগতে তুই হবি একমাত্র জীবন্ত পুতুল। তোর আত্মা আবার ফিরে আসবে, তোর শরীর আবার প্রাণ পাবে।” আর সেই ছবির পাশেই রাখা আছে একটি মানব-আকৃতির পুতুল, যা এখনো অসম্পূর্ণ। ভবতোষ বুঝতে পারলেন, মনোহর ওস্তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পিছনে আছে তার মৃত কন্যাকে পুনরুজ্জীবিত করার এক মরিয়া চেষ্টা। সে ‘পঞ্চকায়া’ নামক এক ভয়ঙ্কর আচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেখানে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর শক্তি এবং বহু মানুষের জীবনীশক্তি দিয়ে একটি মৃতদেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এই আচারে যদি সামান্য ভুল হয়, তবে যে আত্মা ফিরে আসবে, তা আর মানুষের থাকবে না, হয়ে উঠবে এক অতृপ্ত, ভয়ঙ্কর ‘প্রেতকায়া’। ভবতোষের ধ্যান ভেঙে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, সময় খুব কম। আগামী অমাবস্যাতেই মনোহর তার চূড়ান্ত আচার সম্পন্ন করার চেষ্টা করবে। তার আগে যদি তাকে না আটকানো যায়, তবে শুধু কিছু নিরীহ মানুষই নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তি মুক্তি পাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভবতোষ ঠিক করলেন, এই ছায়াবাজিকরের মায়ার খেলা তাঁকে শেষ করতেই হবে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion