ভবতোষ দ্রুত হাতে রেশমি কাপড়টা সরাতেই ‘ছায়া-দর্পণ’ থেকে এক তীব্র নীল আলোকরশ্মি বেরিয়ে এসে মনোহরের কালো পাথরটিকে আঘাত করল। পাথরটি তীব্র উত্তাপে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। নাটমন্দিরের বাতাস যেন সেই আলোয় জমে গেল। মনোহর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। তার সারেঙ্গির সুর থেমে গেল।
যে ছায়াগুলো মায়ার দেহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তারা দিক পরিবর্তন করে তীব্র গতিতে মনোহরের দিকেই ফিরে আসতে লাগল। কিন্তু এবার তারা আর নিরীহ ছায়া নয়, তারা যেন ক্ষুধার্ত রাক্ষস। মনোহর চিৎকার করে বলল, “না! এ হতে পারে না! আমার শক্তি আমার বিরুদ্ধেই!”
ভবতোষ কঠোর স্বরে বললেন, “এটাই ছায়াতন্ত্রের নিয়ম, মনোহর। যে ছায়া নিয়ে খেলে, ছায়াই একদিন তাকে গ্রাস করে।”
মনোহরের নিজের ছায়া তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। তার শরীরটা বেঁকেচুরে যেতে লাগল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। সে তার মেয়ের দেহের দিকে তাকিয়ে আকুলভাবে চিৎকার করে উঠল, “মায়া! মা আমার! আমাকে বাঁচা!”
ঠিক সেই মুহূর্তে, সাদা চাদরে ঢাকা দেহটি সামান্য নড়ে উঠল। চাদরটা ধীরে ধীরে সরে যেতেই দেখা গেল, একটি কিশোরী মেয়ে উঠে বসেছে। কিন্তু তার মুখ মায়ার ছবির মতো মিষ্টি নয়। তার চামড়া ফ্যাকাশে, ঠোঁট নীল, আর চোখদুটি গনগনে আগুনের মতো জ্বলছে। মুখে এক ভয়ঙ্কর, অতৃপ্তির হাসি। সে মনোহরের দিকে তাকিয়ে এক শীতল, অপার্থিব গলায় বলল, “বাবা, আমার খুব খিদে পেয়েছে। অনেক… অনেক খিদে…”
মনোহর ভয়ে, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, ভবতোষের কথাই সত্যি। এ তার মেয়ে নয়, এ এক ভয়ঙ্কর প্রেতকায়া।
সেই প্রেতকায়া তখন নীচে বসে থাকা অনাদিবাবুদের দিকে তার লম্বা, শীর্ণ হাত বাড়াল। কিন্তু ভবতোষ তার আগেই দর্পণটি সেদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দর্পণের নীল আলোয় প্রেতকায়াটি যন্ত্রণায় এমন এক তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল যে, নাটমন্দিরের পুরনো কাঁচগুলো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। তার শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে আবার সেই নিষ্প্রাণ দেহে মিলিয়ে গেল।
এদিকে মনোহরের অবস্থা তখন সঙ্গীন। সে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভবতোষের পায়ের কাছে এসে পড়ল। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমাকে বাঁচান… আমি ভুল করেছি… আমার মায়াকে মুক্তি দিন…”
ভবতোষের মনে করুণার উদ্রেক হলো। তিনি দর্পণটি মনোহরের দিকে ধরে একটি বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। দর্পণের আলোয় ছায়াগুলো ধীরে ধীরে শান্ত হলো এবং ফিরে গিয়ে তাদের নিজ নিজ দেহে প্রবেশ করল। অনাদিবাবুরাও যেন দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠে একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলেন।
কিন্তু মনোহরের ছায়া আর তার দেহে ফিরল না। ছায়াতন্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলে সে তার নিজের ছায়াকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। সে এখন এক ছায়াহীন মানুষ, এক জীবন্মৃত সত্তা।
ভোরের প্রথম আলো যখন নাটমন্দিরের ভাঙা থামের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করল, তখন সব শান্ত। মনোহর ওস্তাদ এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। ভবতোষ মায়ার দেহের কাছে গিয়ে কিছু মন্ত্র পড়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। আগুনের লেলিহান শিখা এক পিতার অন্ধ মোহ আর এক কন্যার অতৃপ্তিকে গ্রাস করে তাকে মুক্তি দিল।
বাড়ি ফেরার পথে শরৎ জিজ্ঞেস করল, “মনোহরের কী হবে?”
ভবতোষ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তার সবচেয়ে বড় শাস্তি সে পেয়ে গেছে। সে এখন এক ছায়াহীন মানুষ। নিজের অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব ছাড়াই তাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। এর চেয়ে বড় নরক আর কিছু নেই।”
কলকাতার জনবহুল রাস্তায় তখন দিনের কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ভবতোষের মনে তখন বাজছিল এক গভীর নিস্তব্ধতার সুর। তিনি জানতেন, আলো আর ছায়ার এই খেলা কোনোদিন শেষ হবে না। তিনি শুধু তার একজন সামান্য প্রহরী মাত্র।
~সমাপ্ত ~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion